কল্পতরু (দেবনাগরী: कल्पवृक्ष), অথবা কল্পবৃক্ষ, কল্পদ্রুম বা কল্পপাদপ হল হিন্দু পুরাণ, জৈন ধর্ম এবং বৌদ্ধ ধর্মের একটি ইচ্ছা পূরণকারী ঐশ্বরিক গাছ। আদি সংস্কৃত সাহিত্যে এর উল্লেখ রয়েছে। এছাড়াও, এটি জৈন বিশ্বতত্ত্ব এবং বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম জনপ্রিয় বিষয়।
সমুদ্র মন্ত্রন বা "দুধের সমুদ্র" মন্থনকালে কামধেনুর সাথে কল্পতরুর উৎপত্তি হয়েছিল। কামধেনু হল ঐশ্বরিক গাভী, যে সমস্ত প্রয়োজন মেটায়। দেবতাদের রাজা, ইন্দ্র এই গাছটি নিয়ে তার স্বর্গে ফিরে এসেছিলেন। কল্পতরুকে অনেক গাছের সাথে চিহ্নিতও করা হয়, যেমন পারিজাত (এরিথ্রিনা ভারিগাটা), ফিকাস বেঙ্গালেনসিস, অ্যাকেসিয়া, মধুকা লঙ্গিফোলিয়া, প্রোসোপিস সিনেরারিয়া, বাসিয়া বুটিরাসিয়া এবং তুঁত গাছ (মরাস নিগ্রা গাছ)। মূর্তিশিল্প এবং সাহিত্যেও গাছটি প্রশংসিত।
কল্পতরু হিন্দু ভাগবত, জৈন ও বৌদ্ধদের মধ্যে সাধারণ একটি শৈল্পিক এবং সাহিত্যের বিষয়।[১]
বৈদিক ধর্মগ্রন্থে, জীবনের বৃক্ষ কল্পতরু, অথবা "বিশ্ব তরু"র উল্লেখ পাওয়া যায়। সমুদ্র মন্থন বা দুধের সমুদ্র মন্থনের প্রথমদিকের বিবরণে মহাসাগর মন্থন প্রক্রিয়া চলাকালীন প্রথম দিকেই জল থেকে কল্পতরুর উত্থান হয়েছিল। এর সঙ্গে পাওয়া গিয়েছিল কামধেনুকে, যে হল ঐশ্বরিক গাভী, জীবনের সমস্ত প্রয়োজন মেটায়। গাছটিকে আকাশগঙ্গা ছায়াপথ বা লুব্ধক তারার জন্মস্থান হিসাবেও বলা হয়। দেবরাজ ইন্দ্র এই কল্পতরুকে নিয়ে স্বর্গে তার বাসভবনে ফিরে এসে সেখানে রোপন করেছিলেন। শিল্প শাস্ত্রের সংস্কৃত পাঠ মনসারাতে গাছটির উল্লেখ রয়েছে।[২][৩] অপর একটি কল্পকথায় বলা আছে যে কল্পতরু পৃথিবীতেই ছিল কিন্তু পৃথিবীর মানুষ এর কাছে মন্দ কামনা করে অপব্যবহার শুরু করায় একে ইন্দ্রের আবাসে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।[৪] কথিত আছে, ইন্দ্রের ‘দেবলোকে’ পাঁচটি কল্পতরু রয়েছে। সেগুলি হল - মন্দনা, পারিজাত, সন্তান, কল্পতরু ও হরিচন্দন। এর সবগুলিই বিভিন্ন ইচ্ছা পূরণ করে।[৪] বলা হয়, কল্পতরুটি ইন্দ্রের পাঁচটি স্বর্গীয় উদ্যানের মাঝখানে মেরু পর্বতের শীর্ষে রোপন করা হয়েছিল। এই ইচ্ছাপূরণ গাছগুলির কারণে অসুররা দেবতাদের সাথে চিরকালীন যুদ্ধ চালিয়ে গেছে, কারণ দেবতারা কল্পতরুর "ঐশ্বরিক ফুল এবং ফল" থেকে অবাধে উপকৃত হয়েছে, যেখানে অসুরদের গাছের নিচের "ডাল এবং শিকড়" নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। পারিজাত প্রায়শই তার পার্থিব প্রতিরূপ, ভারতীয় প্রবাল গাছ (এরিথ্রিনা ইন্ডিকা)র সাথে চিহ্নিত হয়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিত্রিত হয় ম্যাগনোলিয়া বা কাঠগোলাপ এর মতো, (সংস্কৃত): চম্পক) গাছ। বলা হয় এটির শিকড় সোনা দিয়ে তৈরি, রৌপ্যময় মধ্যভাগ, নীলকান্তমণি বৃক্ষশাখা, প্রবাল পত্র, মুক্তা ফুল, রত্ন পাথর কুঁড়ি, এবং হীরক ফল।[৩] আরও বলা হয় যে পার্বতীর একাকিত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য অশোকসুন্দরীকে একটি কল্পতরু থেকে তৈরি করা হয়েছিল।[৫]
হিন্দু পুরাণ অনুসারে, অনেক বেদনাদায়ক আলোচনার পরে, শিব এবং পার্বতী, তাদের কন্যা অরণ্যানির সাথে বিচ্ছেদের সময়, তাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য ঐশ্বরিক কল্পতরুকে দিয়েছিলেন যখন রাক্ষস অন্ধকাসুর তার সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল। পার্বতী কল্পতরুকে তার কন্যার “সুরক্ষা, প্রজ্ঞা, স্বাস্থ্য এবং সুখ,” দিতে এবং তাকে বনের সুরক্ষাকারী বনদেবী করে তুলতে অনুরোধ করেছিলেন।[৬]
জৈন বিশ্বতত্ত্বতে কল্পতরুগুলি ইচ্ছাপূরণ গাছ যা একটি বিশ্বচক্রের প্রাথমিক পর্যায়ে মানুষের ইচ্ছা পূরণ করে। প্রাথমিক যুগে বাচ্চারা জোড়ায় জন্ম নেয় (ছেলে এবং মেয়ে) এবং কোনও কর্ম করে না।[৭] ১০টি কল্পব্রক্ষ রয়েছে যা ১০ রকম স্বতন্ত্র ইচ্ছা পূরণ করে, সেগুলি হল বসবাসের জন্য আবাস, পোশাক, পাত্র, ফল এবং মিষ্টিসহ পুষ্টি, মনোরম সংগীত, অলংকার, সুগন্ধযুক্ত ফুল, জ্বলন্ত প্রদীপ এবং রাতে উজ্জ্বল আলো।[৭]
জৈন বিশ্বতত্ত্ব অনুযায়ী, অধোগামী ধনু (অবসরপিনি) তিন আরা (অসম সময়কাল)তে, যা প্রয়োজন তা সবই কল্পতরু সরবরাহ করে, তবে তৃতীয় আরা-র শেষে, তাদের থেকে উৎপাদন হ্রাস পায়। কয়েকটি গ্রন্থে এই রকম আট প্রকারের গাছের বর্ণনা করা হয়েছে, যার প্রত্যেকটি বিভিন্ন বস্তু সরবরাহ করে। সুতরাং ‘মধ্যাঙ্গ গাছ’ থেকে সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর পানীয়; "ভোজনাঙ্গ" থেকে,সুস্বাদু খাবার; "জ্যোতিরাঙ্গ" থেকে সূর্য ও চাঁদের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল আলো; "দোপাঙ্গ" থেকে অন্দরের আলো পাওয়া যেত। অন্যান্য গাছগুলি ঘর, বাদ্যযন্ত্র, খাবার থালাবাসন, সূক্ষ্ম পোশাক, পুষ্পস্তবক এবং সুবাস সরবরাহ করে।[৪]
তিলোয়া পানাত্তি এই তালিকাটি পাওয়া যায়: পানাঙ্গ, তুরিয়াঙ্গ, ভূষণাঙ্গ, ভট্টাঙ্গ, ভোজাঙ্গ, আলয়াঙ্গ, দিব্যাঙ্গ, ভয়নাঙ্গ, মালাঙ্গ, তেজাঙ্গ যথাক্রমে চমৎকার পানীয়, সংগীত, অলংকার, পোশাক, ভোজ্য এবং তৈরি খাবার, বাস করার জন্য বাসস্থান, প্রদীপ, বাসনপত্র, ফুলের মালা এবং শেষেরটি, তেজাঙ্গ, নিজেকে আলোকিত করে, যা স্বর্গীয় আলোকসজ্জার কাজ করে।[৮]
বৌদ্ধ ধর্মে, অমিতায়ুস এবং উষ্ণিষবিজয় এর মতো "দীর্ঘায়ু দেবতাদের" হাতে ধরা "দীর্ঘজীবী ফুলদানি"র উপরের অংশে সাজানো একটি ছোট ইচ্ছাপূরণকারী গাছ দেখানো হয়েছে। শ্রমন দেবী তার বাম হাতে কল্পতরুর রত্নযুক্ত শাখা ধরে রাখেন।[৩]
মানব উপাসনার এক রূপ হিসাবে ফিকাস বেঙ্গালেনসিস (নিয়গ্রোধ)র উপাসনা বিদিশার বৌদ্ধ ভাস্কর্যে চিত্রিত হয়েছে।[৯] বিদিশার এই ভাস্কর্যটি, খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতাব্দীর সময়ের এবং কলকাতা যাদুঘরে প্রদর্শিত।[১০]
মিয়ানমারে, যেখানে থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম চর্চা হয়, কল্পতরুর তাৎপর্য বার্ষিক অনুষ্ঠানের আকারে পালন করা হয়। এর নাম কাঠিনা (পোশাক উপহার দেওয়া), যেখানে অপেশাদারী লোকজন সন্ন্যাসীদের কাছে অর্থ গাছের আকারে উপহার দেয়।[১১]
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে কিছু গাছকে বিশেষ কল্পতরু হিসাবে উল্লেখ করা হয়। এগুলি নিচে বর্ণিত হয়েছে:
বটগাছ (ফিকাস বেঙ্গালেনসিস), যাকে নিয়গ্রোধ গাছও বলা হয়, যেটি সারা দেশে পাওয়া যায়, এবং সেটি মানব প্রয়োজনে যথেষ্ট পরিমাণে সরবরাহ করার দক্ষতার কারণে কল্পতরু বা কল্পবৃক্ষ হিসাবে পরিচিত।[১২][৯]
দেশের বেশিরভাগ অঞ্চলে পাওয়া নারকেল গাছকে ('কোকোস নুসিফেরা') কল্পতরু বলা হয়, কারণ, এর প্রতিটি অংশই কোনো না কোনো কাজে লাগে। ফলের ভিতরে নারকেল জল একটি সুস্বাদু পানীয়। শুকনো আকারে একে কোপরা বলা হয় এবং তেল উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। নারকেলের ছোবড়া, যা কয়ার নামে পরিচিত, তা দড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। পাতাগুলি কুঁড়েঘর, পাখা, মাদুর তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। পাম সুগার কুঁড়ি থেকে তৈরি হয়। শুকনো মধ্যশিরা নৌকা তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।[১৩]
অশ্বত্থ গাছ (পবিত্র ডুমুর গাছ) কল্পতরু নামেও পরিচিত, যেখানে দেব-দেবতা ও ব্রহ্মার বাস, আর এখানেই মহর্ষি নারদ গাছের পূজা করার পদ্ধতি এবং এর উপযোগিতা সম্পর্কে ঋষিদের শিখিয়েছিলেন।[১৪]
মহুয়া গাছ (মধুকা লঙ্গিফোলিয়া) উপজাতির লোকদের প্রতিদিনের জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অর্জন করে আছে। এটি মধু (মধুকা ইন্ডিকা) নামক ইচ্ছাপূরণ গাছের মত কল্পতরু।[১৫]
দেশের মরুভূমি অঞ্চলে শামি গাছ (প্রোসোপিস সিনেরারিয়া) পাওয়া যায়, স্থানীয় উপভাষায় এটি আজমির বা জান্ত নামে পরিচিত, এটি একটি কল্পতরু। রাজস্থান মরুভূমিতে এর শিকড় ১৭–২৫ মিটার (৫৬–৮২ ফু) গভীরতায় যায়। এটি মরুভূমির বালুকাময় মাটির ক্ষয় রোধ করে। এই কারণে গাছটি খরার পরিস্থিতিতেও সবুজ থাকে। রাজস্থানের লোকেরা তাই এই গাছটিকে কল্পতরু হিসাবে বিবেচনা করে, কারণ খরার সময় যখন কোনও ঘাস বা চারণ কোথাও পাওয়া যায় না তখন গবাদিপশু এর সবুজ পাতা খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে।[১৬]
হিমালয়ের ৫০০ থেকে ১০০০ মিটারের মধ্যে উচ্চতায় বৃদ্ধি পাওয়া চিউর গাছ, যা ভারতীয় মাখন গাছ হিসাবে পরিচিত (ডিপ্লোনেমা বুটিরাসিয়া), পার্বত্য অঞ্চলের লোকেদের কাছে কল্পতরু বা স্বর্গের গাছ নামে পরিচিত, কারণ এটি মধু, গুড় এবং ঘি দান করে। এটি একটি ছাতার আকারে বেড়ে ওঠে।[১৭]
উত্তরাখণ্ডের যোশীমঠে একটি তুঁত গাছ, যা ২৪০০ বছর বয়সী বলে মনে করা হয়, একটি কল্পতরু হিসাবে বিখ্যাত এবং সম্মানিত। অষ্টম শতাব্দীতে, আদি শঙ্করাচার্য এই গাছের নিচে "প্রায়শ্চিত্ত" করেছিলেন। তিনি এটিকে প্রভু শিবের অবতার বলে মনে করেছিলেন।[১৮] এটাও বিশ্বাস করা হয় যে ঋষি দুর্বাসা উর্গামে এই গাছের নিচে ধ্যান করেছিলেন।[৫] [১৯] কৈলাস পর্বতের ঢালে কল্পতরুর প্রাচুর্য রয়েছে বলে মনে করা হয়।[১৯]
রাজস্থানের আজমিরের নিকটে মঙ্গলিয়াবাসে দুটি পূজিত গাছ রয়েছে (পুরুষ এবং স্ত্রী) যা ৮০০ বছরেরও বেশি পুরানো। এগুলি কল্পতরু নামে পরিচিত। হিন্দু শ্রাবণ মাসের অমাবস্যার দিনে এদের পূজা করা হয়।[৫]
ঝাড়খণ্ডের রাঁচিতে, তিনটি কল্পতরু রয়েছে। তারা হিনু নামে লোকালয়ে আছে। তামিলনাড়ুর সংস্কৃতিতে, তাল (বোরাসাস ফ্লাবিলিফার) খেজুরের একটি ধরন (বোরাসাস), এর সমস্ত অংশের ব্যবহার রয়েছে বলে এটি কল্পতরু হিসাবে পরিচিত। এই গাছটিও এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াতে পাওয়া যায়, সাধারণভাবে এগুলি ১০০ বছর বাঁচে, এদের উচ্চতা ২০ মিটার (৬৬ ফু) পর্যন্ত হয়; এর পাতার আকার পাখার মত এবং রুক্ষ হয়। পাতাগুলি প্রাচীনকালে লেখার জন্য ব্যবহৃত হত।[২০]
হরিবংশ পুরাণে, পারিজাত, বাওবাব গাছকে কল্পতরু বা ইচ্ছাপূরণ গাছ বলা হয়, এটি উত্তরপ্রদেশের বারাবাঁকির কাছে কিন্তুর গ্রাম ছাড়া কেবল স্বর্গে পাওয়া যায়। পাণ্ডব গোত্রের রাজপুত্র অর্জুনের সাথে গাছটির পৌরাণিক যোগসূত্র রয়েছে, বলা হয় তিনি এটি স্বর্গ থেকে এনেছিলেন। তার মা কুন্তী যাঁর নামে গ্রামের কিন্তুর নামকরণ করা হয়েছে শিবের উপাসনা করতে এই গাছ থেকে ফুল দিতেন। আরও বলা হয় যে প্রভু কৃষ্ণ তার স্ত্রী সত্যভামাকে সন্তুষ্ট করার জন্য এই গাছ স্বর্গ থেকে এনেছিলেন।[২১]
কল্পলতা হল একটি আকাঙ্ক্ষা পূরণ লতা, যা আর্য যুগের শেষ অংশে উপাসিত হত। বলা হয় যে এই গাছের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কোনও ব্যক্তি সুন্দর অলঙ্কার, পোশাক এবং এমনকি অবিবাহিত মেয়ে লাভ করবে।[২২]