কাগজ তৈরি বলতে সামগ্রিক ভাবে কাগজ তৈরির কলা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দ্বারা কাগজ ও পিচবোর্ড তৈরির প্রক্রিয়া, উপকরণ এবং উপাদানকে নির্দেশ করা হয়। এগুলো বড় পরিসরে মুদ্রণ, লিখন ও মোড়ক সহ আরো অনেক কাজে এবং প্রয়োজনীয় পণ্যে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে, প্রায় সব কাগজই শিল্পকারখানায় উংপাদিত হয় এবং হস্তনির্মিত কাগজ তৈরী করা হয় বিশেষ শিল্প এবং সুকৌশলী অভিব্যক্তি হিসেবে।
কাগজ তৈরিতে এক ধরনের মিশ্র সাসপেনশন (যা পানিতে ডোবানো সেলুলোস তন্তু দ্বারা গঠিত)ছাকনির মতো পর্দা দ্বারা আপীত হয় যেন এলোমেলোভাবে খচিত তন্তু মাদুরের ন্যায় নিঃসৃত হয়। শিটটি থেকে পানি পরবর্তীতে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে অপসারণ করা হয় আবার কখনও শোষন যন্ত্র ব্যবহার করে বা উত্তপ্ত করার মাধ্যমে শিটটিকে শুকানো হয়। একবার শুকিয়ে গেলে সাধারণত একটি সমতল, অভিন্ন ও শক্ত কাগজের শিট পাওয়া যায়।
বর্তমানকালে ব্যাপক স্বয়ংক্রিয় যস্ত্রপাতির গ্রহণযোগ্যতা ও তা আবিষ্কারের আগে, সব কাগজ হাতে তৈরি করা হতো। বিশেষায়িত পরীক্ষাগারে শ্রমিকরা একবারে একটি শিট তৈরী করতেন। এমনকি এখনো যারা যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে হাত দিয়ে কাগজ তৈরি করেন, তাদের কৌশল শত বছর পূর্বের কৌশলের সাথে প্রায় সাদৃশ্যপূর্ণ। প্রকৃতভাবে এটি চায়না ও এশিয়াতে বিকশিত হয় এবং পরবর্তীতে ইউরোপে আরো উন্নত হয়। হস্তনির্মিত কাগজকে এখনও এর প্রতিটি শিট এ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য এবং দক্ষ নৈপুণ্যতার জন্য কদর করা হয়।
কাগজ তৈরীর যে কর্মযজ্ঞ তা দেখে সচেতন নাগরিকরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন। কারণ কাগজ তৈরীতে অনেক রাসায়নিক ব্যবহার হয়; এছাড়াও সেলুলোজের জন্য প্রাথমিক উৎস হচ্ছে গাছের কাঠ, যার ফলে প্রচুর গাছ কাটা হয়। কাগজের কারখানায়, প্রচুর পানি ব্যবহার করার কারণে, সেই দূষিত পানি, পার্শ্ববর্তী নদী, নালায় ফেলা হয়, যা পরিবেশকে দূষন করে। তুলা থেকে প্রস্তুত কাগজের দাম গাছের কাঠ থেকে প্রস্তুত কাগজের দামের চেয়ে বেশি হওয়ায়; সেই কাগজের চাহিদা কম।
হেম্প কাগজ চীনে ৮ম খ্রিষ্ঠপূর্বে মোড়ানো ও প্যাড হিসেবে ব্যবহার হত।[১] ৮ শতক পূর্বেই এই কাগজের উপর চাইনীজরা লিখত।[২] হ্যান রাজত্বকালে (২০২ খ্রিষ্টপূর্ব-২২০ খ্রিষ্ঠাব্দ) ঐতিহ্যবাহী আবিষ্কারক কার্ল লুনকে এই কাগজের প্রস্তুকারক বলা হয়। তিনি তন্তুগাছ এবং অন্যান্য বাস্ট তন্ত মাছের আশ, পুরাতন ন্যাকড়া ও হেম্প বর্জ্য সহযোগে এটি প্রস্তুত করতেন।[৩] ৩য় শতকে কাগজ লেখার অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ছড়িয়ে পরে।[৪] এবং ৬ষ্ঠ শতকে তা টয়লেট পেপার হিসেবে চীনে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।[৫] ট্যাং রাজত্বকালে (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্ঠাব্দ) কাগজ ভাজ কর ও সেলাইয়ের মাধ্যমে চতুষ্কোনীয় চা-ব্যাগ হিসেবে তৈরী করা হয়।[১] পরবর্তীতে সং রাজত্বে (৯৬০-১২৭৯ খ্রিষ্ঠাব্দে) কাগজের মুদ্রার প্রথম প্রচলন হয়।
৮ম শতকে কাগজ প্রস্তুতি ছড়িয়ে পরেছিল মুসলিম বিশ্বে, যেখানে এই প্রক্রিয়া পরিশোধিত হয়েছে এবং তা ব্যাপকভাবে উৎপাদন করা হতে থাকে। উৎপাদন শুরু হয়সমরকন্দে, বাগদাদে, দামেস্কাসে, কায়রোতে, মরোক্কতে এবং এরপর মুসলিম স্পেইনে।[৬] মুসলিমরা এমন পদ্ধতি আবিষ্কার করে; যার ফলে কাগজের পাতলা শিট তৈরী করা যায়। এই নতুনত্ব কাগজকে শিল্পকলা থেকে কাগজ কারখানার সূচনা করে।[৭][৮] ৮ম শতকে সমরকন্দ থেকেই কাগজের মণ্ড থেকেই কাগজ তৈরী করা হত।[৯] পূর্বের তথ্যসূত্র থেকে দেখা যায়; ইসলামিক স্বর্ণযুগ থেকেই কাগজের কারখানা এসেছে। ৯ম শতকে দামেস্কাসে আরবীয় ভূতাত্ত্বিক দ্বারা এটি উদ্ধৃত হয়।[১০]
ঐতিহ্যবাহী এশিয়ার কাগজশিল্পে উদ্ভিদের অভ্যন্তরের ছাল থেকে কাগজ প্রস্তুত করা হয়। লম্বা তন্তু থেকে শক্ত, স্বচ্ছ কাগজের শিট তৈরী করা হয়। পূর্ব এশিয়াতে, তিনটি ঐতিহ্যবাহী তন্তু হচ্ছে এবাকা, কজো এবং গাম্পি। হিমালয়ে, লোক্টা উদ্ভিদ থেকে কাগজ তৈরী করা হয়।[১১] বর্তমানে এই কাগজ লিপিবিদ্যা, পুস্তক হিসাবে, বই শিল্প হিসাবে এবং ত্রিমাত্রিক কাগজ যেমনঃ অরিগ্যামী হিসাবে ব্যবহৃত হয়।
ইউরোপে, কাগজের ছাচ তৈরীতে ধাতুর তার ব্যবহার করা হত। যেখানে জলছাপ ১৩০০ খ্রিষ্ঠাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয়। যখন হেম্প ও লাইনেন ন্যাকড়া মণ্ড তৈরীর প্রধান উৎস হিসেবে ব্যবহৃত হত। এরপর উৎস হিসেবে তুলা ব্যবহৃত হতে থাকে।[১১] ১৫ শতকের পূর্ব পর্যন্ত বহনযোগ্য প্রিন্টিং মেশিন তৈরীর আগ পর্যন্ত কাগজ উৎপাদন ইউরোপে ততটা জনপ্রিয় ছিল না।[১২][১৩]
আধুনিক কাগজ প্রস্তুত শিল্প শুরু হয় ইউরোপে ১৯ শতকের পূর্ব ভাগে। এর অন্যতম কারণ ছিল ফোর্ড্রিনিয়ার যন্ত্রের ক্রমবিকাশ। এই যন্ত্র একক শিটের পরিবর্তে ক্রমাগত কাগজের রোল তৈরী করতে পারত। এই যন্ত্র আকারে বড় ছিল। কিছু কিছু ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১০ মিটার প্রস্থ ছিল। ১৮৮৪ সালে কানাডীয় চার্লস ফেনেরটি ও জার্মান এফ.জি.কেলার এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যেখানে মণ্ড তৈরীতে কাঠ ব্যবহার করা যাবে।[১৪] এই নতুনত্ব ২০০০ বছর ধরে চলে আসা শুধুমাত্র ন্যাকড়া দিয়ে মণ্ড থেকে কাগজ তৈরীর যুগের অবসান ঘটিয়ে খবরের কাগজ তৈরীর সূচনা করল এবং তার ফলে বর্তমানে প্রায় সব কাগজই কাঠের মণ্ড থেকে তৈরী হয়।
পানিতে তন্তু ভিজিয়ে তাকে মিশ্রিত করা হয়। একে বলা হয় ফার্নিশ। এরপর মাদুরের মত করে চ্যাপটা করা হয় মণ্ডকে। তারপর স্ক্রিন বা একধরনের পর্দা দিয়ে অভ্যন্তরীণ তন্তুর সাহায্যে মাদুর প্রস্তুত করা হয়। তারপর মাদুর থেকে পানি অপসারণ করা হয়।[১৫]
দীর্ঘ সময় জুড়ে হাতে তৈরী কাগজ শিল্পের কৌশল যন্ত্রপাতির উন্নয়ন সত্ত্বেও খুব কমই পরিবর্তিত হয়েছে। কৌশল গুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ
কাঠের তৈরী অথবা এলুমিনিয়ামের ছাচ দ্বারা সঠিক মাপে কাগজটিকে কাটা হয়। অতিরিক্ত পানি শুষে নেওয়া হয়। যে অংশে সিক্ত পানি থাকে; তা হাইড্রোলিক চাপের দ্বারা ধীরে ধীরে চাপ দিয়ে শুষ্ক করা হয়। এই পদ্ধতি বারবার পুনরাবৃত্তি করা হলে, একই মাপের অনেকগুলো কাগজ পাওয়া যায়। এভাবে করে এ ফোর আকার সহ নানা মাপের কাগজ প্রস্তুত করা হয়[১৬]
কাঠের ফ্রেমকে বলা হয় "ডেকেল"। এর ফলে কাগজের প্রান্ত একটু ঢেউ খেলানো হয়; যা দেখে বুঝা যায়; কাগজটি হাতে তৈরী। ডেকেল কাগজ উৎসব উপলক্ষে তৈরী করা হয় এটি দামী হয়। এই ঢেউয়ের মধ্যে জলছাপ রাখা হয়। ঢেউগুলো উপর থেকে নিচের দিকে করা হয়।
হস্তচালিত কাগজ পরীক্ষাগারে এখনো প্রস্তুত করা হয়; যাতে করে কাগজ প্রস্তুতিরর কৌশল আর তার গুণাগুন পরীক্ষা করা যায়। টাপ্পির হিসাবে পরীক্ষার জন্য ব্যবহৃত হস্তচালিত কাগজের আদর্শিক মান হলো টি ২০৫[১৭] যা ১৫.৯ সে.মি. (৬.২৫ ইঞ্চি) এটি দিয়ে কাগজের উজ্জ্বলতা, কতটুকু মজবুত এবং আকার নির্ধারণ করা যায়।[১৮]
আধুনিক কাগজ কারখানা বিভিন্ন অংশে বিভক্ত এবং প্রত্যেকটা অংশই একে অপরের সাথে সংযুক্ত। মণ্ডকে এখানে পানির সাথে মিশ্রিতও নানা উপাদান সংযুক্ত করে পরিশোধিত করা হয়। ফোর্ড্রিনার মেশিনের হেড বক্স কাগজের কাইকে একটি চলমান যন্ত্রে ঢেলে দেয়, সেখান থেকে অভিকষর্জ টানে অথবা নিচে ভ্যাকুয়াম যন্ত্রের দরুণ পানি নিষ্কাশিত হয়ে যায়। এরপর সিক্ত কাগজের শিট চাপ দিয়ে শুষ্ক করা হয়। এরপর একে লম্বা রোল করে পাকানো হয়। এই রোলের ওজন কয়েক টন হতে পারে।
কাগজ শিল্পের অন্য আরেকটা পদ্ধতি হলো; সিলিন্ডার ছাচঁ তৈরী করা; যা আংশিকভাবে মিশ্রিত কোমল মণ্ডে ডুবানো হয়। এরপর এই মণ্ডটিকে তোলার পর; একটি কোচ রোলার এই মণ্ডটিকে পিষে ফেলে, পাতলা কাগজের শিট তৈরী করে [তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
যদিও কাগজ তৈরীকে অনেকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন, কিন্তু "স্মরণীয় কাগজনির্মাতা" এই শব্দটি যারা কাগজ তৈরী করেন; তাদের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয় না। এই পরিভাষা ব্যবহার হয়েছে, তাদের উদ্দেশ্যে যারা কাগজ দিয়ে শৈল্পিক কাজ করেছেন, বিশেষ করে যারা এটা নিয়ে গবেষণা করেছেন, বইপত্র লিখেছেন। যারা এই কাগজ শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল-ব্যবস্থাপনার জনক ছিলেন; যেমনঃ মন্ড যিনি প্রথম তৈরী করেছেন, তাদের ক্ষেত্রে এই পরিভাষা ব্যবহার হয়।
কিছু বিখ্যাত কাগজ নির্মাতা, অন্য ক্ষেত্রে প্রখ্যাত হয়ে যাওয়ায়, এই পরিভাষা সাম্প্রতিক সময়ে এখন আর ব্যবহৃত হয় না। এরকম উল্লেখযোগ্য মানুষের নাম হলো মনটগোলফির ভ্রার্তৃদ্বয়, যারা প্রথম উড্ডয়ন করেছিলেন। বেলুনে উড্ডয়নের সময় কাগজ ব্যবহার করেছিলেন, যা তাদের সফলতায় ভূমিকা রেখেছে। তাদের পরিবারের বেশ কিছু কাগজের কারখানাও ছিল।
এরকম কিছু উল্লেখযোগ্য মানুষ হচ্ছেন হেনরী ফোর্ড্রিনার, হেনরিচ ভলতেয়ার এবং কার্ল ড্যানিয়েল একম্যান।