কাতার পারস্য উপসাগরের একটি দেশ। এ দেশটি আরব উপদ্বীপের পূর্ব উপকূল থেকে উত্তর দিকে প্রসারিত কাতার উপদ্বীপে অবস্থিত। কাতারের দক্ষিণে সৌদি আরব আর এর পশ্চিমে দ্বীপরাষ্ট্র বাহরাইন অবস্থিত। আরব উপদ্বীপের মত কাতারও একটি উত্তপ্ত এবং শুষ্ক মরু এলাকা। এখানে ভূ পৃষ্ঠস্থ কোন জলাশয় নেই । প্রাণী ও উদ্ভিদের সংখ্যাও যৎসামান্য। বেশির ভাগ লোক শহরে বিশেষত রাজধানী দোহা শহরে বাস করেন। দেশটিতে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের বড় মজুদ আছে। সেই প্রাকৃতিক সম্পদের কারণেই দেশটির অর্থনীতি অত্যন্ত সমৃদ্ধ। ১৯শ শতকের শেষভাগ থেকে আল থানি গোত্রের লোকেরা কাতার অঞ্চলটিকে একটি আমিরাত হিসেবে শাসন করে আসছেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে দেশটি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে আসে। ১৯৭১ সালে এটি পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্তও এটি একটি তুলনামূলকভাবে দরিদ্র দেশ ছিল। সে সময় দেশটিতে পেট্রোলিয়ামের মজুদ আবিষ্কৃত হয় এবং সেগুলি উত্তোলন শুরু হয়। বর্তমানে মাথাপিছু আয়ের হিসেবে কাতার বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশগুলির একটি।
প্রাগৌতিহাসিক কাতারে স্থায়ী জনবসতির কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায় না। তবে প্রাগৌতিহাসিক কালথেকে কাতারে প্রাণের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। প্রত্নতত্তবিদ ডে কার্ডির মত অনুযায়ী কাতারে প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো। সেখানের আবহাওয়া ছিলো বৃষ্টিবহুল জলপ্রপাত, উচু ঘাস এবং স্বচ্ছ পানির নালা ছিলো বলে প্রমাণও পাওয়া যায়। আধুনিক ইতিহাসের জনক হেরাডোটাসের মত অনুযায়ী কাতারে কান্নানিয়ান নামক জেলে সম্প্রদায়ের বসবাস ছিলো। তারা মাছ ধরার মৌসুমে অস্থায়ী ক্যাম্পেইন করে মাছ শিকার করতেন।প্রাচীনকালে কাতারের বিভিন্ন প্রত্নতত্ত যেমনঃ মাটির বাসন, চকমকি পাথর, পাথর কাটার যন্ত্র বিশ্লেষণ করে পাওয়া যায়।
কাতারের পূর্ব উপকূল রাস আব্রুখের সাথে মেসোপটেমিয়ান আল উবায়েদ গোত্রের ব্যবসা ছিলো। পরবর্তিতে টলেমির মানচিত্রে কাতারের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যেখানে একে কাথারা ও এর একটি শহর কাদারা নামে দেখানো হয়।ইসলাম পূর্ব যুগে কাতার আরব উপ দ্বীপের অন্যান্য দেশের মতোই পারস্যের শাসানী রাজবংশের অধীনস্থ ছিলো। পরবর্তিতে সপ্তম শতকে সমগ্র আরব উপ দ্বীপে ইসলাম প্রসার লাভ করলে সে অঞ্চলও ইসলামের ছায়ায় চলে আসে। সে সময় বনু আমের বিন আবদ উল কায়েস বনু সাদ বিন যায়েদ মিনাহ বিন তামি্ম নামক বিভিন্ন গোত্রের বসবাস ছিলো। বর্তমান শাসক গোষ্ঠী আল সানি, আ্ল তামিমিরই একটি শাখা। মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসলাম দক্ষিণ আরবীয় অঞ্চলে ইসলাম প্রসারে আলা আল হাদরামি কে প্রেরণ করেন ৬২৮ সালে। তখন কাতার অঞ্চলে শাসন করছিলো স্থানীয় বনু তামিম গোত্র। বনু তামিমের গোত্র প্রধান মুনযির বিন সাওয়া আল তামিমি ইসলাম গ্রহণে সম্মত হন এবং পরবর্তীতে অন্যান্য গোত্রে ইসলাম প্রসারে ভূমিকা রাখেন।
ইসলামের প্রথম যুগে কাতারে স্থায়ী বসবাস ছিলো। তাছাড়াও মুরওয়াব নামক স্থানে একটি দুর্গ এবং একশটির মতো পাথুরে বাড়ীর সন্ধান মিলে। সে সময় কাতারের মূল ব্যবসা মাছ এর পাশাপাশি উট ও ঘোড়া পালন এবং বিক্রয় জনপ্রিয়তা লাভ করে। হাদীস থেকে জানা যায় কাতারে এক ধরনের কাপড় তৈরি হতো উটের পশম থেকে। সেটিও কাতারের অন্যতম ব্যবসায়িক আকর্ষণ ছিলো। উমাইয়া (৬৬১-৭৫০ খ্রি) এবং আব্বাসীয় (৭৫০-১২৫৮ খ্রি) আমলে দামেস্ক ও বাগদাদ কেন্দ্রিক ব্যবসা গড়ে ওঠে। উমাইয়া আমলে এ অঞ্চল বিখ্যাত উট ও ঘোড়া ব্যবসার কেন্দ্রে পরিণত হয়। আব্বাসীয় আমলে মুক্তা ব্যবসার উন্নতি পরিলক্ষিত হয়। কাতারি মুক্তার চাহিদা প্রাচ্যের দেশগুলোয় বেড়ে চলে চীনেও কাতারি মুক্তার চাহিদা ছিলো। পরবর্তীতে ব্যবসায়র রুট হয় দুইটি উপসাগর এবং লোহিত সাগর। ষোড়শ শতকে কাতার আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতার মুখে পরে। সে শতকের প্রথমার্ধ ছিলো মামলুকের অধিকারে। পরবর্তীতে মামলুকের প্রভাব কমে যাওয়ায় আরব অঞ্চলে অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয় উসমানীয় সালতানাত। তাছাড়া স্থানীয় শক্তি ছিলো হরমুজ। উসমানীয় সালতানাত মামলুককে সরিয়ে আরব অঞ্চলে অধিকার প্রতিষ্ঠা করে। ইরানের সাফাভি রাজবংশ উসমানীয় থেকে বাগদাদ দখল করে। একই সময় স্প্যানিশ পর্তুগীজদের হাতে মুসলিম ইউরোপীয় শক্তি আল আন্দালুসের পতন হয়। পর্তুগীজ নৌ শক্তি বিভিন্ন স্থানে প্রভাব বিস্তারে ছড়িয়ে পরে। তারা খুব অল্প সময়ে দূর্ধর্ষতার জন্য খ্যাতি অর্জন করেন। ১৫০৯ সালে উসমানিয়া ও মামলুক এবং ভারতীয় মুসলিম রাজশক্তি মিলিত হয়ে পর্তুগীজদের দমনে শক্তি প্রয়োগ করেন। ইতিহাসে সেটি তিন রাজার যুদ্ধ নামে পরিচিত। সে যুদ্ধে পর্তুগীজ দের নৌবহরের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।