কাত্যায়নী | |
---|---|
বিজয় | |
দেবনাগরী | कात्यायिनी |
অন্তর্ভুক্তি | মহাশক্তি, নবদুর্গা, পার্বতী, আদি পরাশক্তি |
আবাস | ঋষি কাত্যায়নের আশ্রম / শিবের পাদমূল |
অস্ত্র | খড়্গ, খেটক, বজ্র, ত্রিশূল, বাণ, ধনুক, পাশ, শঙ্খ, ঘণ্টা ও পদ্ম |
উৎসব | |
সঙ্গী | শিব |
কাত্যায়নী হিন্দু দেবী দুর্গার একটি বিশেষ রূপ এবং মহাশক্তির অংশবিশেষ। তিনি নবদুর্গা নামে পরিচিত দুর্গার নয়টি বিশিষ্ট রূপের মধ্যে ষষ্ঠ। নবরাত্রি উৎসবের সময় তার পূজা প্রচলিত।[১]
শাক্তধর্ম মতে, তিনি মহাশক্তির একটি ভীষণা রূপ এবং ভদ্রকালী বা চণ্ডীর মতো যুদ্ধদেবী রূপে পূজিতা।[২] লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, তার গাত্রবর্ণ দুর্গার মতোই লাল। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দীতে রচিত পতঞ্জলির মহাভাষ্য গ্রন্থে তাকে মহাশক্তির আদিরূপ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।[৩]
কৃষ্ণ যজুর্বেদের অন্তর্গত তৈত্তিরীয় আরণ্যকে দেবী কাত্যায়নীর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। স্কন্দ, বামন ও কালিকা পুরাণ অনুযায়ী, মহিষাসুর বধের নিমিত্ত দেবগণের অনুরোধে দেবী পার্বতী নিজের তেজ শক্তি তাদের দান করেন ও তাকে কায়া মূর্তি দিতে বলেন মহিষাসুর বর প্রাপ্ত ছিলো যে তাকে একমাত্র নারী মারতে পারবে যে মাতৃ গর্ভে জন্মাই নি তাই দেবী পার্বতী দেবগণের সহায়তাতে তামসি দেবী কে সৃষ্টি করেন সেই দেবী মহিষ অসুর বধ করেন। ভারতের অধিকাংশ অঞ্চলে এই পৌরাণিক ঘটনাটির প্রেক্ষাপটেই বাৎসরিক দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।[৪]
খ্রিষ্টীয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতাব্দী নাগাদ রচিত মার্কণ্ডেয় পুরাণের অন্তর্গত দেবীমাহাত্ম্যম্ ও একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত দেবীভাগবত পুরাণ গ্রন্থে কাত্যায়নীর দিব্যলীলা বর্ণিত হয়েছে। একাধিক বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থ এবং তন্ত্রগ্রন্থেও কাত্যায়নীর উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিষ্টীয় দশম শতাব্দীতে রচিত কালিকা পুরাণে বলা হয়েছে, উড্ডীয়ন বা ওড্রদেশ (ওড়িশা) দেবী কাত্যায়নী ও জগন্নাথের ক্ষেত্র।[৫][৬] কাত্যায়নী পূজা অতি প্রাচীন কাল থেকেই প্রচলিত। আর. জি. ভাণ্ডারকরের মতে, কাত্য জাতির পূজিতা ছিলেন বলে দেবী কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হন।[৭]
যোগশাস্ত্র ও তন্ত্র মতে, কাত্যায়নী আজ্ঞা চক্রের অধিষ্ঠাত্রী দেবী এবং এই বিন্দুতে মনোনিবেশ করতে পারলে তার আশীর্বাদ পাওয়া যায়।[১]
হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য তার হিন্দুদের দেবদেবী: উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বইয়ে বলেছেন, তন্ত্রসারে বর্ণিত ধ্যানমন্ত্রে কাত্যায়নীকে দশভূজা মহিষাসুরমর্দিনীর রূপেই বর্ণনা করা হয়েছে:[৮]
সব্যপাদসরোজেনালঙ্কৃতোরুমৃগাধিপাম্। বামপাদাগ্রদলিতমহিষাসুরনির্ভরাম্।।
সুপ্রসন্নাং সুবদনাং চারুনেত্রত্রয়ান্বিতাম্। হারনূপুরকেয়ূরজটামুকুটমণ্ডিতাম্। বিচিত্রপট্টবাসামর্ধচন্দ্রবিভূষিতাম্।।
খড়্গখেটকবজ্রাণি ত্রিশূলং বিশিখং তথা। ধারয়ন্তীং ধনুঃ পাশং শঙ্খং ঘণ্টাং সরোরুহাম্। বাহুভির্ললিতৈর্দেবীং কোটিচন্দ্রসমপ্রভাম্।।[৯]
—যিনি দক্ষিণ পাদপদ্ম দ্বারা বিরাট মৃগাধিপতিকে (সিংহ) অলঙ্কৃত করে বাম পদের অগ্রভাগ দ্বারা মহিষাসুরকে বিদলিত করছেন; যিনি সুপ্রসন্না ও সুন্দর বদনযুক্তা; যাঁর তিনটি নেত্রই মনোহর; যিনি হার, নূপুর, কেয়ূর ও জটামুকুটাদিতে শোভিতা; যাঁর পরিধানে বিচিত্র পট্টবস্ত্র এবং কপালে অর্ধচন্দ্র; যিনি সুকোমল দশ বাহুতে খড়্গ, খেটক, বজ্র, ত্রিশূল, বাণ, ধনুক, পাশ, শঙ্খ, ঘণ্টা ও পদ্ম ধারণ করে থাকেন; যাঁর দেহপ্রভা কোটি চন্দ্রের ন্যায়... [সেই দেবীকে ধ্যান করিবে]।
হরিবংশ গ্রন্থে দেবী অষ্টাদশভূজা। এই গ্রন্থে বর্ণিত মূর্তিটি নিম্নরূপ:[১০]
অষ্টাদশভূজা দেবী দিব্যাবরণভূষিতা। হারশোভিতাসর্বাঙ্গী মুকুটোজ্জ্বলভূষণা।। কাত্যায়নী স্তূয়সে ত্বং বরমগ্রে প্রযচ্ছসি।
—অষ্টাদশভূজা, দিব্যাবরণভূষিতা, সর্বাঙ্গে হারশোভিতা, উজ্জ্বল মুকুট ভূষণা দেবী কাত্যায়নী আপনার স্তব করি, আমাকে বর প্রদান করুন।
প্রাচীন কিংবদন্তি অনুযায়ী, দেবী পার্বতী কাত্যবংশীয় ঋষি কাত্যায়নের কন্যারূপে জন্মগ্রহণ করে কাত্যায়নী নামে পরিচিতা হন। মতান্তরে, কালিকা পুরাণে বলা হয়েছে, ঋষি কাত্যায়ন প্রথম দেবী পার্বতী পূজা করেন; তাই তিনি কাত্যায়নী নামে অভিহিতা হন। আবার, তিনি শিবের পত্নী পার্বতীররূপ বিশেষ রূপান্তর। নবরাত্রি উৎসবে তার পূজা প্রচলিত।[১][১১]
বামন পুরাণ গ্রন্থে দেবী কাত্যায়নীর উদ্ভবের কাহিনি বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে: "দেবগণ চরম দুরবস্থায় বিষ্ণুর নিকট সহায়তা প্রার্থনা করলে, বিষ্ণু ও তাঁর আদেশে শিব, ব্রহ্মা ও অন্যান্য দেবগন দেবী পার্বতীর অংশ নিয়ে তাকে কায়া রূপ দেন সকলের দেহ হতে দিব্য তেজ বিনির্গত হয়ে এক জ্যোতিপর্বতের সৃষ্টি করল। এই জ্যোতিপর্বত ধারণ করল অষ্টাদশভূজা, কৃষ্ণকেশী, ত্রিনয়না ও সহস্র সূর্যের প্রভাযুক্তা দেবী কাত্যায়নীর রূপ। শিব তাঁকে ত্রিশূল প্রদান করলেন। বিষ্ণু দিলেন সুদর্শন চক্র, বরুণ দিলেন শঙ্খ, অগ্নি দিলেন শক্তি, বায়ু দিলেন ধনুক, সূর্য দিলেন তীরভরা তূণীর, ইন্দ্র দিলেন বজ্র, কুবের দিলেন গদা, ব্রহ্মা দিলেন অক্ষমালা ও কমণ্ডলু, কাল দিলেন খড়্গ ও ঢাল এবং বিশ্বকর্মা দিলেন কুঠার ও অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্র। এইভাবে অস্ত্রসজ্জিতা হয়ে দেবী গেলেন বিন্ধ্যাচলে। সেখানে করার বিবকরার অসুরদ্বয় তাঁকে দেখে তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাদের রাজা মহিষাসুরের নিকট দেবীর রূপ বর্ণনা করেন। মহিষাসুর দেবীকে লাভ করবার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সে দেবীর পাণিপ্রার্থনা করে। দেবী জানান, তাঁকে লাভ করতে হলে তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে হবে। মহিষাসুর যুদ্ধ করতে এলে দেবী সিংহপৃষ্ঠে আরোহণ করে যুদ্ধ করেন। মহিষাসুর মহিষের রূপ ধরে দেবীকে আক্রমণ করলে, দেবী তাঁকে তীব্র পদাঘাত করেন। দেবীর পদাঘাতে মহিষাসুর অচৈতন্য হয়ে মাটিতে পড়ে গেলে দেবী তার মস্তক ছিন্ন করেন। এইভাবে দেবী কাত্যায়নী মহিষাসুরমর্দিনী নামে অভিহিতা হন।"[৪] বরাহ পুরাণ ও দেবীভাগবত পুরাণ গ্রন্থেও এই কাহিনির উল্লেখ রয়েছে।[১২]
তন্ত্র অনুসারে, শিবের ছয় মুখের মধ্যে উত্তর মুখ থেকে দেবী কাত্যায়নীর উদ্ভব। এই মুখ নীলবর্ণ এবং ত্রিনয়ন। দক্ষিণাকালী, মহাকালী, গুহ্যকালী, শ্মশানকালী, ভদ্রকালী, একজটা, উগ্রতারা, তারিণী, ছিন্নমস্তা, নীল সরস্বতী, দুর্গা, জয়দুর্গা, নবদুর্গা, বাশুলী, ধূমাবতী, বিশালাক্ষী, গৌরী, বগলামুখী, প্রত্যাঙ্গীরা, মাতঙ্গী ও মহিষাসুরমর্দিনী দেবী এবং তাদের মন্ত্র ও পূজাপদ্ধতির উদ্ভবও হয় এই মুখ থেকেই।উদ্ধৃতি ত্রুটি: <ref>
ট্যাগের ক্ষেত্রে </ref>
ট্যাগ যোগ করা হয়নি
ভাগবত পুরাণ গ্রন্থের দশম স্কন্দের দ্বাবিংশ অধ্যায়ে কাত্যায়নী ব্রতের উল্লেখ আছে। এই কাহিনি অনুযায়ী, ব্রজের গোপীগণ কৃষ্ণকে পতিরূপে কামনা করে সমগ্র মাঘ মাস জুড়ে এই ব্রত করেন। এই একমাস তারা কেবলমাত্র মশলাবিহীন খিচুড়ি খেতেন এবং সকাল বেলা যমুনায় স্নান করে যমুনাতীরে মাটির কাত্যায়নী মূর্তি গড়ে চন্দন, দীপ, ফল, পান, নবপত্র, মালা ও ধূপ দিয়ে দেবীর পূজা করতেন। এরপরই যমুনায় স্নানকালে কৃষ্ণকর্তৃক গোপীদের বস্ত্রহরণের উল্লেখ রয়েছে।[১৩][১৪]
মনোমতো স্বামী প্রার্থনায় এক মাস ব্যাপী উপবাস করে কাত্যায়নী ব্রত পালন করা হয়। এই একমাস তাকে চন্দন, ধূপ, দীপ ইত্যাদি দিয়ে পূজা করা হয়।
মকর সংক্রান্তির দিন উদ্যাপিত শস্য উৎসব পোঙ্গল (তাই পোঙ্গল) উপলক্ষে তামিলনাড়ুর মেয়েরা সারা মাস ধরে বৃষ্টি ও সমৃদ্ধির জন্য প্রার্থনা করেন। এই সময় তারা দুগ্ধ বা দুগ্ধজাত খাদ্য গ্রহণ করেন না। সকালে স্নান করে ভিজে বালিতে খোদিত কাত্যায়নীর মূর্তি পূজা করেন তারা। তামিল পঞ্জিকা অনুযায়ী পয়লা তাই (জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি) তাদের ব্রতের পারণ হয়।[১৫]
নবদ্বীপ রাসযাত্রায় কাত্যায়নী মাতার পুজো হয়। এখানকার এই পুজো অনেকদিনের পুরোনো। প্রতিবছর রাসে আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে এই পুজো হয়ে থাকে।