কাদম্বিনী গাঙ্গুলী | |
---|---|
![]() | |
জন্ম | ১৮ জুলাই, ১৮৬১ |
মৃত্যু | ৩ অক্টোবর, ১৯২৩ (বয়স ৬২) |
জাতীয়তা | ভারতীয় |
পরিচিতির কারণ | নারী চিকিৎসক |
দাম্পত্য সঙ্গী | দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় |
পিতা-মাতা |
|
কাদম্বিনী গাঙ্গুলী (১৮ জুলাই, ১৮৬১ - ৩ অক্টোবর, ১৯২৩) ব্রিটিশ ভারতের প্রথম দুই জন নারী স্নাতকের একজন এবং ইউরোপীয় চিকিৎসাশাস্ত্রে শিক্ষিত দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম নারী চিকিৎসক। উনিশ শতকের শেষভাগে তিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসায় ডিগ্রি অর্জন করেন এবং আনন্দীবাঈ জোশীর সাথে তিনিও হয়ে ওঠেন ভারতের প্রথমদিককার একজন নারী চিকিৎসক।
ব্রাহ্ম সংস্কারক ব্রজকিশোর বসুর কন্যা কাদম্বিনীর জন্ম হয় ১৮ই জুলাই ১৮৬১ তে বিহারের ভাগলপুরে। তার মূল বাড়ি ছিলো বর্তমান বাংলাদেশের বরিশালের চাঁদশীতে। তার বাবা ভাগলপুর স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। ব্রজকিশোর বসু অভয়চরণ মল্লিকের সাথে ভাগলপুরে মহিলাদের অধিকারের আন্দোলন করেছিলেন। তারা মহিলাদের সংগঠন ভাগলপুর মহিলা সমিতি স্থাপন করেছিলেন ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে। এই ঘটনা ছিল ভারতে প্রথম। দ্বারকানাথ ও তার বন্ধু কাদম্বিনীর পিসতুতো দাদা মনমোহনের হাত ধরে কাদম্বিনী তার পড়াশোনা আরম্ভ করেন হিন্দু মহিলা বিদ্যালয়ে। এক কালে দ্বারকানাথের পোলিও আক্রান্ত ছেলে সতীশের জ্বরের সময়ে তার মাথা ধুইয়ে তার প্রাণরক্ষা করেছিলেন কাদম্বিনী। এর জন্য তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসাও করেছিলেন তৎকালীন বিখ্যাত ডাক্তার মহেন্দ্র লাল সরকার। স্কুলজীবনে পড়াশুনা ছাড়াও অন্যান্য বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল কাদম্বিনীর। স্কুলে পড়ার সময়ে তিনি ১৮৭৮ সালে প্রথম মহিলা হিসাবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাস করেন। তার দ্বারাই প্রভাবিত হয়ে বেথুন কলেজ প্রথম এফ.এ (ফার্স্ট আর্টস) এবং তারপর অন্যান্য স্নাতক শ্রেণি আরম্ভ করে। কাদম্বিনী এবং চন্দ্রমুখী বসু বেথুন কলেজের প্রথম গ্র্যাজুয়েট হয়েছিলেন ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে। তারা বি.এ পাস করেছিলেন।[১] তারা ছিলেন ভারতে এবং সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের প্রথম মহিলা গ্র্যাজুয়েট।[২]
গ্র্যাজুয়েট হবার পর কাদম্বিনী দেবী সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি ডাক্তারি পড়বেন। ১৮৮৩ সালে মেডিকেল কলেজে ঢোকার পরেই তিনি তার শিক্ষক দ্বারকানাথ গাঙ্গুলীকে বিয়ে করেন। দ্বারকানাথ বিখ্যাত সমাজসংস্কারক ও মানবদরদী সাংবাদিক হিসেবে খ্যাত ছিলেন। যখন তিনি বিয়ে করে তখন ৩৯ বছর বয়েসের বিপত্নীক, কাদম্বিনীর বয়স তখন ছিল একুশ। কাদম্বিনী ফাইন্যাল পরীক্ষায় সমস্ত লিখিত বিষয়ে পাস করলেও প্র্যাকটিক্যালে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অকৃতকার্য হন। ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে তাকে জিবিএমসি (গ্র্যাজুয়েট অফ বেঙ্গল মেডিক্যাল কলেজ) ডিগ্রি দেওয়া হয়। তিনি ছিলেন প্রথম ভারতীয় মহিলা যিনি পাশ্চাত্য চিকিৎসারীতিতে চিকিৎসা করবার অনুমতি পান।[৩] মেডিক্যাল কলেজে পড়াকালীন তিনি সরকারের স্কলারশিপ পান যা ছিল মাসে ২০ টাকা।
তিনি পাঁচ বছর মেডিক্যাল কলেজে পড়াশোনা করার পর[৪] বিলেত যাবার আগে ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কিছুদিন লেডি ডাফরিন মহিলা হাসপাতালে মাসিক ৩০০ টাকা বেতনে কাজ করেছিলেন। ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে রাজমাতার চিকিৎসার্থে নেপাল যান। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে বোম্বে শহরে কংগ্রেসের পঞ্চম অধিবেশনে প্রথম যে ছয় জন নারী প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছিলেন কাদম্বিনী ছিলেন তাদের অন্যতম একজন। পরের বছর তিনি কলকাতার কংগ্রেসের ষষ্ঠ অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন। কাদম্বিনী ছিলেন কংগ্রেসের প্রথম মহিলা বক্তা। কাদম্বিনী গান্ধীজীর সহকর্মী হেনরি পোলক প্রতিষ্ঠিত ট্রানসভাল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম সভাপতি এবং ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত মহিলা সম্মেলনের সদস্য ছিলেন। ১৯১৪ সালে তিনি কলকাতায় সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের অধিবেশনে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এই অধিবেশন মহাত্মা গান্ধীর সম্মানের জন্য আয়োজন করা হয়েছিল।[৫] কাদম্বিনী চা বাগানের শ্রমিকদের শোষণের বিষয়ে অবগত ছিলেন এবং তিনি তার স্বামীর দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন যিনি আসামের চা বাগানের শ্রমিকদের কাজে লাগানোর পদ্ধতির নিন্দা করেছিলেন। কবি কামিনী রায়ের সাথে কাদম্বিনী দেবী ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে বিহার এবং ওড়িশার নারীশ্রমিকদের অবস্থা তদন্তের জন্য সরকার দ্বারা নিযুক্ত হয়েছিলেন।
তিনি হিন্দু রক্ষণশীল সমাজের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে রক্ষণশীল বাংলা পত্রিকা বঙ্গবাসী তাকে পরোক্ষ ভাবে খারাপ ভাষায় সম্বোধন করেছিল। কাদম্বিনী এর বিরুদ্ধে মামলা করে জেতেন। বঙ্গবাসী পত্রিকার সম্পাদক মহেশ চন্দ্র পালকে ১০০ টাকা জরিমানা এবং ছয় মাসের জেল দেওয়া হয়।
আট সন্তানের মা হওয়ার কারণে সংসারের জন্যও তাকে বেশ সময় দিতে হতো। তিনি সূচিশিল্পেও নিপুণা ছিলেন। বিখ্যাত আমেরিকান ইতিহাসবিদ ডেভিড কফ[৬] লিখেছেন, "গাঙ্গুলির স্ত্রী কাদম্বিনী ছিলেন তার সময়ের সবচেয়ে সফল এবং স্বাধীন ব্রাহ্ম নারী। তৎকালীন বাঙালি সমাজের অন্যান্য ব্রাহ্ম এবং খ্রিস্টান নারীদের চেয়েও তিনি অগ্রবর্তী ছিলেন। সকল বাধার ঊর্ধ্বে উঠে মানুষ হিসেবে নিজেকে জানার তার এই ক্ষমতা তাঁকে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলা জনগোষ্ঠীর কাছে অনুপ্রেরণার উৎসে পরিণত করে।"[৭]
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩রা অক্টোবর কাদম্বিনী বসু গঙ্গোপাধ্যায়ের একটি অপারেশন সেরে বাড়ি ফেরার পথে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু হয়।