কান্নাগী | |
---|---|
কান্নাগী (তামিল: கண்ணகி), কখনও কখনও কান্নাকি লেখা হয়,[১] ছিলেন একজন কিংবদন্তি তামিল মহিলা যিনি তামিল মহাকাব্য সিলাপট্টিকারমের একটি কেন্দ্রীয় চরিত্র।[২] কান্নাগীকে এক সতী মহিলা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে যিনি তাঁর স্বামীর অবিশ্বস্ততা সত্ত্বেও তাঁর সাথেই থাকেন। তাঁর স্বামী সর্বস্ব হারিয়ে অনুতপ্ত হওয়ার পরে তাঁদের বিবাহ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা চলে। তাঁর স্বামীকে মিথ্যাভাবে ফাঁসানো হয় এবং ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া ছাড়াই শাস্তি দেওয়া হয়।[১] কান্নাগী প্রমাণ করে দেন অন্যায় হয়েছে এবং প্রতিবাদ করেন। তারপর মাদুরাইয়ের রাজা ও শহরকে অভিশাপ দেন, যার ফলে মাদুরাইয়ের অসাধু পাণ্ড্যিয়ান রাজার মৃত্যু হয়, যে রাজা তাঁর স্বামী কোভালানকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিলেন। কান্নাগীর অভিশাপের কারণে, যে সমাজ তাঁকে কষ্ট দিয়েছিল, মাদুরাই শহর পুড়ে যাওয়ায় তারা প্রতিফল পায়।[১] তামিল লোককাহিনীতে, কান্নাগীকে প্রতীক হিসেবে দেখা হয়, কখনও সতী দেবীর প্রতীক, হিন্দু মন্দিরে যাঁর ভাস্কর্য মূর্তির মাধ্যমে দর্শনার্থীদের মনে করিয়ে দেয় তাঁর পায়ের নূপুর ভেঙে ফেলা বা তাঁর রক্তঝরা স্তন ছিঁড়ে শহরের দিকে ছুঁড়ে ফেলা।[৩][৪]
জৈন রাজপুত্র ইলাঙ্গো আদিগাল দ্বারা রচিত প্রাচীনতম তামিল মহাকাব্য সিলপ্পাদিকারম তাঁকে কেন্দ্রীয় চরিত্র হিসাবে দেখায়।[৫]
কান্নাগী গল্পটি সর্বপ্রথম সঙ্গম যুগের নারিনাই ৩১২ কবিতায় দেখা যায়।[২] আরও বর্ধিত সংস্করণ দেখা যায় সঙ্গম-পরবর্তী যুগের তামিল মহাকাব্য সিলাপ্পাটিকারম ("নূপুরের মহাকাব্য) -এ।[১]
কান্নাগী ছিলেন পুহারের বণিক ও জাহাজের পোতনায়ক মানক্যনের কন্যা। তিনি ম্যাকাত্তুভানের ছেলে কোভালানকে বিয়ে করেন। কোভালানের পরিবার ছিল সমুদ্র পথের ব্যবসায়ী এবং তাঁরা সমুদ্র দেবী মণিমেকলাইকে পৃষ্ঠপোষক দেবতা হিসেবে মনে করতেন।[৬][৭] পরে, একজন নর্তকী মাধবীর সাথে কোভালানের দেখা হয় এবং তাঁদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কোভালান তাঁর সমস্ত সম্পদ নর্তকীর জন্য ব্যয় করতে প্ররোচিত হন। অবশেষে, নিঃস্ব, কোভালান তার ভুল বুঝতে পেরে স্ত্রী কান্নাগীর কাছে ফিরে আসেন। কোভালান মাদুরাইতে বাণিজ্য করেন, কান্নাগীর মূল্যবান পায়ের নূপুর বিক্রি করে নিজের ভাগ্য পুনরুদ্ধার করার আশা করেন।[৫]
মাদুরাই শাসন করতেন পাণ্ড্য রাজা নেদুঞ্জ চেলিয়ান প্রথম। কোভালান যখন নূপুর বিক্রি করার চেষ্টা করেছিলেন, তখন এটাকে রানির চুরি করা নূপুর বলে ভুল করা হয়েছিল। কোভালানের বিরুদ্ধে নূপুর চুরির অভিযোগ আনা হয়েছিল এবং অবিলম্বে রাজা বিনা বিচারে তাঁর শিরশ্ছেদ করেছিলেন। কান্নাগীকে এই কথা জানানো হলে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং রাজার কাছে রওয়ানা হন তাঁর স্বামীর নির্দোষীতা প্রমাণ করতে।
কান্নাগী রাজার দরবারে এসে কোভালানের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত করা পায়ের নূপুরটি ভেঙে ফেলেন এবং দেখান যে তাতে রুবি রয়েছে, অন্যদিকে রানির নূপুরে মুক্তো ছিল। ভুল বুঝতে পেরে, ন্যায়ের এত বড় ব্যর্থতা ঘটিয়ে রাজা লজ্জায় আত্মহত্যা করলেন। কান্নাগী অভিশাপ দেন যে পুরো মাদুরাই শহর পুড়ে যাবে। পাণ্ড্যদের রাজধানী শহরটিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল যার ফলে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। যাইহোক, দেবী মীনাক্ষীর অনুরোধে, কান্নাগী শান্ত হন এবং পরে, মোক্ষ লাভ করেন। গল্পটি কবি ইলাঙ্গো আদিগাল রচিত সিলাপ্পাটিকারমের মূল অংশ গঠন করেছে।[৮]
কান্নাগী বা কান্নাকি আম্মানকে সতীত্বের প্রতীক হিসাবে প্রশংসা করা হয় এবং নির্বাচিত অঞ্চলে দেবী হিসাবে পূজা করা হয়। তিনি শ্রীলঙ্কায় সিংহলি বৌদ্ধদের দ্বারা দেবী পাট্টিনি,[৯] শ্রীলঙ্কার তামিল হিন্দুদের দ্বারা কান্নাকি আম্মান এবং দক্ষিণ ভারতের কেরালা রাজ্যে কোডুঙ্গাল্লুর ভগবতী ও আতুকাল ভগবতী হিসাবে পূজিত হন। কেরালিরা বিশ্বাস করে কান্নাকি দেবী ভদ্রকালীর অবতার যিনি কোডুঙ্গালুরে পৌঁছেছিলেন এবং কোডুঙ্গালুর মন্দিরে মোক্ষ লাভ করেছিলেন।[১০][১১]
আরএস মানি পরিচালিত একটি তামিল মহাকাব্য চলচ্চিত্র কান্নাগী ১৯৪২ সালে মুক্তি পেয়েছিল। এটি ছিল মহাকাব্য শিলাপাধিগারম অবলম্বনে নির্মিত প্রথম তামিল চলচ্চিত্র। ১৯৬৪ সালে পরবর্তীতে পুম্পুহার নামে একটি অনুরূপ দ্বিতীয় চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। চেন্নাইয়ের মেরিনা সমুদ্র সৈকতে কান্নাগীর একটি মূর্তি আছে, তাঁর পায়ের নূপুর হাতে নিয়ে, এটি সিলাপ্পাটিকারমের একটি দৃশ্য চিত্রিত করে। এটি ২০০১ সালের ডিসেম্বরে ট্র্যাফিকের প্রতিবন্ধকতার কারণ দেখিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল।[১২][১৩] মূর্তিটি ২০০৬ সালের জুন মাসে পুনঃস্থাপিত হয়।[১৪][১৫]
২০১৬ সালের ৫ই মে শ্রীলঙ্কায় পাথ্থিনি নামে একটি সিংহলী চলচ্চিত্র মুক্তি পায়। দেবী পাথ্থনি বা কান্নাগীর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন পূজা উমাশঙ্কর।[১৬]