কারামেহের যুদ্ধ | |||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: ক্ষয়কারক যুদ্ধ | |||||||
একটি ইসরায়েলি ট্যাংক দমন করার পর রাজা হুসেইন | |||||||
| |||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||
ইসরায়েল (আইডিএফ) | |||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||
লেভি এশকোল উজি নারকিস মোশে ডায়ান |
রাজা হুসেইন আমের খাম্মাশ মশুর হাদিথা আসাদ ঘানমা ইয়াসির আরাফাত আবু ইয়াদ আবু জিহাদ আবু আলি ইয়াদ | ||||||
শক্তি | |||||||
প্রায় ১৫০০০[৪] ১টি পদাতিক ব্রিগ্রেড ১টি প্যারাট্রুপ ব্যাটেলিয়ন ১টি প্রকোশলী ব্যাটেলিয়ন ৫টি আর্টিলারি ব্যাটেলিয়ন) |
২য় সাঁজোয়া বিভাগ[৬] | ||||||
হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি | |||||||
ইসরায়েল: ২৮[৯]– ৩৩ জনের মৃত্যু[১০]৬৯[৯] – ১৬১ জন আহত হয়[১০] ২৭টি ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ৪টি ট্যাংক ফেলে আসা হয়[১০] ২টি এপিসি (সাঁজোয়াযুক্ত সৈন্যবাহক)[৫] ২টি যানবাহন<[৫] ১টি বিমান[১০] |
জর্দান:
৪০[১১]- ৮৪ জনের মৃত্যু[১০] ১৫৬ জনের মৃত্যু[১০] ~১০০ জন আহত হয় ১৪১ জন বন্দি হয়[১০] | ||||||
১৭৫টি ভবন ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়[১০] |
কারামেহের যুদ্ধ (আরবি: معركة الكرامة) ছিল ১৯৬৮ সালের ২১শে মার্চে ক্ষয়কারক যুদ্ধ চলাকালে জর্দানের কারামেহ শহরে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) এবং ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থা (পিএলও) ও জর্দানি সশস্ত্র বাহিনীর (জেএএফ) যৌথবাহিনীর মধ্যে সংঘটিত ১৫ ঘণ্টার একটি সামরিক যুদ্ধ।[৪] এটি পিএলও শিবিরে দুটি সমকালীন অভিযানের একটি হিসেবে ইসরায়েল দ্বারা পরিকল্পিত হয়েছিল। দুটি অভিযানের একটি কারামেহ্তে এবং অন্যটি দূরবর্তী সাফি গ্রামে পরিচালিত হয়েছিল, যাদের সাংকেতিক নাম যথাক্রমে অপারেশন ইনফার্নো (হিব্রু ভাষায়: מבצע תופת) এবং অপারেশন আসুতা (מבצע אסותא), তবে প্রথম অভিযানটি একটি পুরোদস্তর যুদ্ধে পরিণত হয়।[১৫]
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পর, পিএলও তাদের ঘাঁটি জর্দানে সরিয়ে নেয় এবং সীমান্তবর্তী কারামেহ শহরে সদর দপ্তর প্রতিষ্ঠা করে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গেরিলা আক্রমণের পদক্ষেপ নেয়।[৪] আইডিএফ দাবি করে যে, তাদের আক্রমণের কারণ ছিল কারামেহের সংগ্রামী পিএলও শিবির ধ্বংস করা এবং ইয়াসির আরাফাতকে প্রতিশোধ হিসেবে বন্দি করা। যদিও ধারণা করা হয়ে থাকে, আইডিএফ ফিলিস্তিনি ফেদাইনদের (ফেদাইন, যার অর্থ আত্মত্যাগী) প্রতি জর্দানের সমর্থনের জন্য জর্দানকে শায়েস্তা করতে চেয়েছিল।[১৬] ইসরায়েল ধারণা করেছিল জর্দান সেনাবাহিনী যুদ্ধে যোগদান থেকে বিরত থাকবে, কিন্তু জর্দানি সেনারা তাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে ভারী কামান মোতায়ন করে।[১৭] ইসরায়েলিরা এক দিনব্যাপী যুদ্ধের পর কারামেহ শিবিরের অধিকাংশ ধ্বংস করে এবং ১৪০ জন পিএলওর সদস্যকে বন্দি করার পর সৈন্যদের প্রত্যাহার করে।[৩] এ যুদ্ধের ফলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রেজ্যুলেশন ২৪৮ গৃহীত হয়, যা সর্বসম্মতিক্রমে ইসরায়েলকে অস্ত্র বিরতি লঙ্ঘ্ন ও সামরিক শক্তির অসামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবহারের জন্য দায়ি করে।[১৮]
উভয়পক্ষ বিজয় ঘোষণা করে। কৌশলগত দিক দিয়ে যুদ্ধটি ইসরায়েলের অনুকূলে যায়[১৩] এবং তাদের কারামেহ শিবির ধ্বংসের অভিপ্রায় সফল হয়।[৯] অপরদিকে, অপেক্ষাকৃতভাবে অধিক ক্ষয়ক্ষতি ইসরায়েলিদের নিকট একটি অপ্রত্যাশিত ও বিবেচনাযোগ্য় বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয়।[৪] ইসরায়েল তিনজন মৃত সৈন্যকে এবং কিছু সামান্য ক্ষতিগ্রস্ত ট্যাংক উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়, যেগুলো পরবর্তীতে আম্মানে জর্দানিদের দ্বারা কুচকাওয়াজে সাড়ম্বরে প্রদর্শন করা হয়।[১৯] যুদ্ধটিতে প্রথমবারের মত ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের দ্বারা আত্মঘাতী বোমাহামলাকারীদের নিয়োজন চিহ্নিত করা হয়।[২০] যদিও ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলিদের ক্ষতিসাধনে সীমিত সাফল্য লাভ করে, রাজা হুসেইন তাদের কৃতিত্ব নিতে অনুমতি দেন।[২১]
যুদ্ধের পরে হুসেইন ঘোষণা করেন, "আমি মনে করি আমরা এমন একটি অবস্থানে পোঁছাতে পারি যেখানে আমরা সকলেই ফেদায়িন।" ফিলিস্তিনিরা আরব বিশ্বে যুদ্ধটির ব্যাপক প্রশংসা ও স্বীকৃতিকে নিজেদের জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যবহার করে। পরবর্তী সময়ে জর্দানের ফেদায়িনদের প্রতি আরব দেশসমূহের সমর্থনের জোয়ার আসে।[২২] পরিণামে পিএলওর শক্তি বৃদ্ধি পেতে শুরু করলে, ফেদায়িনরা খোলাখুলিভাবে হাশেমী রাজতন্ত্র উৎখাত করার ঘোষণা দেয়। অবশেষে ১৯৭০ সালে কালো সেপ্টেম্বরের ঘটনাপ্রবাহের সময় আসন্ন উত্তেজনা ফেদায়িনদের জর্দান থেকে লেবাননে বিতাড়িত হতে তরান্বিত করে।[১৭]
ছয়দিনের যুদ্ধের পূর্বে ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলি লক্ষ্যবস্তুকে পশ্চিম তীর এবং জর্দান থেকে কিছু আক্রমণ করত, যেগুলোর ফলস্বরূপ ইসরায়েল প্রতিশোধ গ্রহণে অভিযান পরিচালনায় সংকল্পবদ্ধ হয়। এসব অভিযান প্রতিশোধমূলক অভিযান হিসেবে পরিচিত হয়।[২৩] ১৯৬৭ সালের জুনে ছয় দিনের যুদ্ধের মাধ্যমে জর্ডান থেকে পশ্চিম তীর দখলের পর ইসরায়েল সেখানকার অবশিষ্ট ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী ফাতাহের সংযোগ বিনষ্ট করে। ১৯৬৮ সালের গোড়ার দিকে ফাতাহ দলের গেরিলারা জর্দানের পাড়ের ঘাঁটি থেকে ইসরায়েলে আক্রমণ পরিচালনা শুরু করে। এসব আক্রমণের বেশিরভাগই ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী দ্বারা প্রতিহ্ত করা হয়। মাঝে মাঝে, জর্দানি সেনাবাহিনী, পদাতিক ও আর্টিলারি বিভাগ ফাতাহ বাহিনীকে রক্ষামূলক গুলিবর্ষণ করে সাহায্য করে। ফলশ্রুতিতে আইডিএফ ও জর্দানি সেনাবাহিনীর মধ্যে ঘন ঘন প্রত্যক্ষ খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়।[৪]
ইসরায়েলে সামরিক গোয়েন্দা অধিদপ্তরের প্রধান আহারন ইয়ারিভ ঘোষণা করেন যে একটি আক্রমণ ফাতাহের প্রতিপত্তির অনেক ক্ষতিসাধন করতে পারে। অন্যদিকে, ইসরায়েলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবা ইবান ও তার কার্যালয়ের প্রধান গিদিয়োন রাফায়েল মনে করেন জর্দান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার ভালো সম্পর্কের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধচারণ করতে পারে। তারা আরো মনে করেন ইসরায়েল আক্রমণ পরিচালনা করলে অনেক নির্দোষ বেসামরিক নাগরিকের মৃত্য হতে পারে এবং এতে ইসরায়েলের রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তাদের এ ভাবনার জন্য ইসরায়েলি সেনাপ্রধান হাইম বার-লেভ দক্ষতার সাথে আক্রমণ পরিচালনার অঙ্গীকার করেন। যার ভিত্তিতে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশে দায়ান আক্রমণের জন্য একটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য আবেদন করেন। কিন্তু মন্ত্রিপরিষদ তার এ আবেদন খারিজ করে। ১৩ই ডিসেম্বরে পরবর্তী রাতে অপারেশন কারামেহ পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এ অভিযানের দায়িত্ব দেয়া হয় প্যারাট্রুপ সৈন্যদলের ৩৫তম ব্রিগেড এবং সায়েরেত মাটকাল নামক বিশেষ বাহিনীর উপর। কিন্তু অভিযানটি স্থগিত করা হয় এবং ১২ই মার্চ অভিযানটি সম্পন্ন করার নতুন সময় নির্ধারিত হয়। তবে আবারও অভিযানটি বাতিল করা হয়।[৫] ডায়ান অন্য মন্ত্রীদের সতর্ক করেন যে একটি বাস একটি খনির কাছে আক্রমণের শিকার হতে পারে।[২৪] ১৮ই মার্চ আরাভার বেয়ার ওরার একটি খনির নিকটে একটি স্কুল বাস বিস্ফোরিত হয়। এ বিস্ফোরণে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক লোক মারা যায় এবং দশজন শিশু নিহত হয়।[৭] আর এটি ছিল তিন মাসের মধ্যে ফাতাহের ৩৮তম অভিযান।[১৭] সেই রাতেই ইসরায়েলি মন্ত্রিপরিষদ কারামেহে আক্রমণের অনুমোদন চূড়ান্ত করে।[২৫] যুক্তরাষ্ট্র আক্রমণটিকে প্রতিহত করার জন্য রাজা হুসেইনের পক্ষ থেকে ইসরায়েলকে বার্তা পাঠায় এতে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী লেভি এশকোল মন্ত্রিপরিষদে পুনরায় সভা আহবান করলে কেবল জাতীয় ধর্মীয় দলের নেতা হাইম-মোশে শাপিরা মৌখিকভাবে আক্রমণ পরিচালনার বিরোধিতা করেন। ইসরায়েলি শিক্ষামন্ত্রী জালমান আরান আক্রমণের বিরুদ্ধে থাকলেও তিনি মৌখিক প্রতিবাদ থেকে বিরত থাকেন।[২৪]
৪ঠা মার্চ জর্দানি গোয়েন্দারা সীমান্তে ইসরায়েলিদের তৎপরতা শনাক্ত করেন।,আইডিএফ এর সৈন্যরা অ্যালেনবি সেতু (এখন রাজা হুসেইন সেতু নামে পরিচিত) এবং ডামিয়া সেতুর (এখন এডাম সেতু নামে পরিচিত) নিকট জড়ো হতে শুরু করে। এর জবাবে জর্দান এসব সেতুর কাছে এবং কারামেহের আশেপাশে ১ম পদাতিক বিভাগকে নিয়োজিত করে।[২৬] ১৭ই মার্চ ডায়ান সতর্ক করেন যে ফেদায়িনরা নতুন ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রস্তুতি নিচ্ছে, যার বিরুদ্ধে জর্দান পদক্ষেপ না নিলে ইসরায়েল কঠোরতম পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য হবে।"[২৭]
২০শে মার্চের মধ্যে জর্দান অ্যালেনবি ও ডামিয়া সেতুর মধ্যে ইসরায়েলি ৭ম সাঁজোয়া ব্রিগেড, ৬০তম সাঁজোয়া ব্রিগেড, ৩৫তম প্যারাট্রুপ ব্রিগেড, ৮০তম পদাতিক ব্রিগেড, একটি যুদ্ধ প্রকৌশলী ব্যাটেলিয়ন এবং পাঁচটি আর্টিলারি ব্যাটেলিয়নের উপস্থিতি শনাক্ত করে। জর্দানিরা মনে করে যে ইসরায়েলিরা আম্মানে আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল এবং এজন্য জর্দানি সেনারা সেতুগুলোর নিকটে ৬০তম সাঁজোয়া বিভাগ ও ১ম পদাতিক বিভাগসহ অবস্থান নেয়।.[২৬]
ইসরায়েলি সৈন্যদল ভিন্ন দায়িত্ব নিয়ে চারটি ভাগে বিভক্ত হয়। সৈন্যদলের অধিকাংশ দক্ষিণ দিক থেকে অ্যালেনবি সেতু পার করে কারামেহে পৌঁছানোর পরিকল্পনা করে। দ্বিতীয় দলটি ডামিয়া সেতু পার করে উত্তর দিক থেকে কারামেহ শহরে প্রবেশ করে সাঁড়াশি আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। প্যারাট্রুপার দল হেলিকপ্টারে চড়ে শহরে অবতরণ করার নকশা করে। চতুর্থ দলটির পরিকল্পনা ছিল রাজা আবদুল্লাহ সেতুতে ভিন্নমুখী আক্রমণ পরিচালনা করে কারামেহের জর্দানি সৈন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা এবং মূল আক্রমণকে সুরক্ষা প্রদান করা।[২৬]
২১শে মার্চ ভোর ৫ঃ৩০ টায় ইসরায়েলি বাহিনী একসঙ্গে তিনটি সেতুতে আক্রমণ করে।[২৮] যুদ্ধ প্রকৌশলীগণ উত্তরে একটি পনটুন সেতু তৈরি করে এবং সৈন্যদল নদী পার করে। ইসরায়েলি সৈন্যদল অ্যালেনবি সেতু পার করে শুনাত নিমরিনের দিকে অগ্রসর হয়।[২৯]
ভোর ৬ঃ৩০ টায় ইসরায়েলি হেলিকপ্টার প্যারাট্রুপার ব্যাটেলিয়নের অধিকাংশ কারামেহ শহরের উত্তরে অবতরণ করাতে শুরু করে।[৩০] প্যারাট্রুপাররা শহর ঘিরে ফেলার পর একটি ইসরায়েলি বিমান ফাতাহের উদ্দেশ্যে লিফলেট ছড়ানোর কথা থাকলেও প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে প্যারাট্রুপারবাহী হেলিকপ্টারগুলো বিশ মিনিট দেরি করে। ফাতাহ কমান্ডো ও জর্দানি আর্টিলারির সহায়তায় জর্দানি নিয়মিত বাহিনী প্যারাট্রুপারদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে।[৩১] দক্ষিণ দিক থেকে ইসরায়েলি বাহিনী কারামেহ শহরের দিকে অগ্রসর হলে তাদেরকে সাঁজোয়া, আর্টিলারি ও এন্টি ট্যাংকের সাহায্যপ্রাপ্ত জর্দানি পদাতিক বাহিনীর মোকাবিলা করতে হয়। ইসরায়েলি বিমানবাহিনী বিমান হামলা চালালেও তা পরিখায় অবস্থানরত জর্দানিদের বেশি ক্ষতিসাধন করতে ব্যর্থ হয়। পরিখায় অবস্থান করে জর্দানিরা ইসরায়েলিদের প্রবল আক্রমণ প্রতিহত করে।[২৯]
দক্ষিণে জর্দানি আর্টিলারির গোলাবর্ষণ ইসরায়েলিদের আবদুল্লাহ সেতুর কাছে আরেকটি পনটুন সেতু তৈরিতে বাধা দেয়। ফলে সেখানে ইসরায়েলিদের গতিরোধ করা সম্ভব হয়।[৮] অ্যালেনবি সেতু পার করার পর, ৭ম সাঁজোয়া ব্রিগেড শুনা থেকে তিনদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে এক বা একাধিক দল উত্তরে কারামেহ শহরের দিকে অগ্রসর হয়। একটি পদাতিক ব্যাটেলিয়ন ও একটি ট্যাংক ব্যাটেলিয়ন সল্ট রোডে (লবণ পরিবহন করার ঐতিহাসিক বাণিজ্যপথ) প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য পূর্বের দিকে অগ্রসর হয়। আরেকটি পদাতিক ব্যাটেলিয়ন আবদুল্লাহ সেতু ভাঙ্তে অন্য সৈন্যদলকে সাহায্য করতে অগ্রগমন করে।[২]
ইসরায়েল বাহিনী অ্যালেনবি সেতু পার করে সেতুটি ভেঙে ভোর ৭টার আগেই কারামেহ শহরে প্রবেশ করে[১০] সকাল ৮টার মধ্যেই ইসরায়েলি বাহিনী শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ইসরায়েলিরা পিএলওর ঘাঁটিটি তাদের অনুমানের চেয়ে বড় হিসেবে আবিষ্কার করে।[৩২] প্যারাট্রুপারদের সাথে মিলিত হয়ে ইসরায়েলি বাহিনী ১ম বিভাগের কেন্দ্রীয় ব্রিগেড এবং ফাতাহের কিছু যোদ্ধাদের সাথে মারাত্মক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। প্যারাট্রুপারদের কিছু অংশ এবং সাঁজোয়া বাহিনী ফাতাহ শিবিরে অভিযান চালাতে অগ্রসর হয়। প্যারাট্রুপাররা বেশিরভাগ শিবির ধ্বংস করে ফেলে। ইয়াসির আরাফাতসহ অনেক ফিলিস্তিনি পূর্ব দিকে পলায়ন করে।[২] ইসরায়েলের একটি ছোট পদাতিক ও সাঁজোয়া বাহিনী অ্যালেনবি সেতুতে থাকা ইসরায়েলি বাহিনীকে রাজা আবদুল্লাহ সেতুতে নিয়োজিত জর্দানি বাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষার চেষ্টা করে। জর্দানিরা কিছু অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ করে, কিন্তু ইসরায়েলিরা তা প্রতিরোধ করে।[১০]
ইসরায়েলি পদাতিক এবং অস্ত্রবাহী একটি বড় বাহিনী আল সাল্ত থেকে অ্যালেনবি সেতু পর্যন্ত রাস্তা অবরোধ করতে পূর্ব দিকে গিয়েছিল এবং তারা কারামেহের প্রতিরক্ষায় যোগ দেওয়ার চেষ্টা করে জর্ডানের ৬০তম আর্মার্ড ব্রিগেডের মুখোমুখি হয়েছিল। ফলস্বরূপ যুদ্ধে, জর্ডানীয়রা কোন ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক ধ্বংস না করেই আটটি প্যাটন ট্যাঙ্ক হারিয়েছিল, তারপর খনন করতে এবং ইসরায়েলিদের উপর গুলি চালিয়ে যেতে পাহাড়ে ফিরে আসে।[১০] ইসরায়েলি বিমান বাহিনী জর্ডানের আর্মার এবং আর্টিলারি অবস্থানের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালায় কিন্তু গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে পারেনি।[১০] পরের দুই ঘণ্টার মধ্যে, মুসরি-কারামেহ সড়ক, সাল্ত সড়ক এবং আবদুল্লাহ সেতুর পূর্ব দিকে জর্ডানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি আর্টিলারি গোলাবর্ষণ এবং বিমান হামলা শুরু হয়। ইসরায়েলিরা বিমান হামলা ও আর্টিলারি দিয়ে কারামেহের উপর তাদের দখল সুসংহত করে এবং শিবিরটি ধ্বংস করতে শুরু করে। মোট ১৭৫টি ঘর বিস্ফোরণে উড়িয়ে দেওয়া হয়।[১০]
ইতিমধ্যে, সাফি গ্রামের কাছে মৃত সাগরের দক্ষিণে কয়েকটি ছোট গেরিলা ঘাঁটির বিরুদ্ধে অপারেশন আসুতার তৎপরতা বাড়ছিল, সেখানে একটি বিদ্যালয়ের বাসটি মাইনে আঘাতে বিধ্বস্ত হয়েছিল। এখানে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর ঘনিষ্ঠ সহায়তায় ইসরায়েলি স্থল বাহিনীর সৈন্যরা তাদের স্থাপিত ঘাঁটি হতে হামলা চালায়। হামলায় জর্ডানের প্রায় ২০ জন সৈন্য ও পুলিশ সদস্য এবং ২০ জন ফাতাহ যোদ্ধা নিহত হয় এবং ২৭ জনকে বন্দী করা হয়। ইসরায়েলিদের কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।[১০] সম্পূর্ণ পিএলও বাহিনীকে ফাঁদে ফেলার আশায় হতাশ হয়ে ইসরায়েলিরা শীঘ্রই নিজেরা পিছু হটে, কিন্তু ইসরায়েলি ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার পথে তাদের লড়াই করতে হয়।[২৭] সকাল ১১:০০ এ ইসরায়েলিরা সেনা প্রত্যাহার করতে শুরু করে, সিকরস্কি এইচ-৩৪ হেলিকপ্টার সৈন্যদের সরিয়ে নিয়ে যায়;[৩৩] কারণ তাদের প্রতি যতটা সম্ভব সামরিক যানবাহন পুনরুদ্ধারের আদেশ ছিল। ফলে তারা শুধুমাত্র রাত ৮:৪০-এর মধ্যে তাদের সেনা প্রত্যাহার সম্পন্ন করেছে।[৩৪] তারা জর্ডানে রেখে যাওয়া দুটি ট্যাঙ্ক উদ্ধারের পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু পরে পরিকল্পনা বাদ দিয়ে ফিরে যায়।[৫]
জর্দানি সৈন্যরা আম্মানে কুচকাওয়াজে প্রদর্শিত ইসরায়েলি পরিত্যক্ত ট্রাক এবং ট্যাংক ঘিরে রয়েছে, যা পরবর্তীতে প্রদর্শনের জন্য হাশেমিত প্লাজায় রাখা হয় [৩৫]
ইসরায়েলিরা তাদের ফাতাহ শিবির ধ্বংসের উদ্দেশ্য পূরণে সফল হয়[৩২][৩৬] এবং কৌশলগত দিক দিয়ে যুদ্ধটি ইসরায়েলের আনুকুল্যে সমাপ্ত হয়।[১৩] এ অভিযানটি জর্দান নদীর পিএলওর সৈন্যদের দুর্বলতাকে স্পষ্ট করে তোলে এবং এজন্য তারা পর্বতের উপর সমবেত হতে শুরু করে। কারামেহের যুদ্ধে তাদের উপর আরোপিত চাপ পশ্চিম তীরে তাদের অভিযানকে আগের তুলনায় অনেক কঠিন করে তোলে।[৯] যদিও রাজনৈতিকভাবে ইসরায়েল সারাবিশ্ব দ্বারা সমালোচিত ও নিন্দিত হয়।
জাতিসংঘে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্থার গোল্ডবার্গ বলেন,
আমরা বিশ্বাস করি যে বর্তমানে সংঘটিত এ ধরনের সামরিক প্রতিক্রিয়া সহিংসতামূলক কর্মকাণ্ডের সীমা অতিক্রম করলে তা অত্যন্ত দুঃখজনক
তুলনামূলকভাবে অধিক ক্ষয়ক্ষতি আইডিএফ এর জন্য একটি বড় বিবেচনাযোগ্য বিষয় হিসেবে আবির্ভূত হয় এবং ইসরায়েলিরা এতে আশ্চর্যান্বিত হয়।[৪] যদিও ফিলিস্তিনিরা নিজেরা একা জয়ী হয়নি, তবু রাজা হুসেইন তাদেরকে কৃতিত্ব নিতে দেন।[২১][৩৭] কারামেহের যুদ্ধ ফাতাহ গোষ্ঠীকে প্রচারকার্যের বিস্তারে সাহায্য করে।[২৪]
জর্দান যুদ্ধটি জয়ের দাবি করে এবং বালকা গভর্নোরেটে ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ করে ইয়াসির আরাফাত বলেন,
আমরা যা করেছি তা হল পৃথিবীকে উপলব্ধি করিয়েছি যে ফিলিস্তিনিরা এখন আর উদ্বাস্তু নয় এবং লোকদের মধ্যে যারা তাদের ভবিষ্যতের লাগাম ধরে রেখেছে তারা নিজেদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অবস্থানে রয়েছে।
ফিলিস্তিনি এবং আরবরা যুদ্ধটিকে আইডিএফ-এর উপর একটি মানসিক বিজয় হিসেবে বিবেচনা করে। এরপর থেকে ফিলিস্তিনি গেরিলাদের ভর্তি করার সংখ্যা অত্যন্ত দ্রুত বাড়তে থাকে।[৩৮] ফাতাহের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫০০০ স্বেচ্ছাসেবক যুদ্ধের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে যোগ দেয়ার জন্য আবেদন করে।[২২] মার্চের শেষের দিকে, জর্দানে ২০০০০ জনের মত ফেদায়িন ছিল।[৩৯]
ইরাক এবং সিরিয়া কয়েক হাজার গেরিলার জন্য প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনার প্রস্তাব দেয়। পারস্য উপসাগরের দেশসমূহ কুয়েতের তত্ত্বাবধানে দশ হাজার নিবাসী ফিলিস্তিনি কর্মীদের বেতনের জন্য ৫% করের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। কেবল বৈরুত শহর থেকে লেবানন ৫০০,০০০ মার্কিন ডলারের তহবিল গঠন করে। ফিলিস্তিনি সংস্থাগুলো যুদ্ধে নিহত গেরিলাদের পরিবারকে জীবনকাল সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া শুরু করে।[৩৯] যুদ্ধের এক বছরের মধ্যে, ফাতাহ বিশ্বের প্রায় আশিটি দেশে তাদের শাখা প্রতিষ্ঠা করে।[৪০]
যুদ্ধের পরে ফাতাহ জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সামাজিক প্রকল্প গ্রহণে অংশ নেয়া শুরু করে।[৪১] কারামেহের যুদ্ধ এবং পরবর্তীতে পিএলওর শক্তি বৃদ্ধিকে ১৯৭০ সালের গৃহযুদ্ধ কালো সেপ্টেম্বরের অনুঘটক হিসেবে বিবেচনা করা হয়,[৪২] যার মাধ্যমে জর্দানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় চেষ্টাকারী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীদের লেবাননে বিতাড়িত করতে জর্দান সফল হয়।[১৭]
পরবর্তীতে, জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রেজ্যুলেশন ২৪৮ অনুমোদন করে যা জর্দানের এলাকায় ইসরায়েলি আক্রমণ এবং যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের জন্য ইসরায়েলকে দায়ি করে। নিরাপত্তা পরিষদে রেজ্যুলেশন ২৩৭ উত্থাপন করা হয় যা ইসরায়েলকে সামরিক এলাকায় জনসাধারণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আদেশ দেয়। রেজ্যুলেশনটি আরও বলে যে প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড সহ্য করা হবে না এবং এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পুনরাবৃত্তি নিরাপত্তা পরিষদকে সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ গ্রহণে বাধ্য করবে।[১৮]
এ যুদ্ধটি ছিল ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনের মধ্যকার প্রথম যুদ্ধ যেখানে ফিলিস্তিনিরা আত্মঘাতী বোমাহামলাকারীদের ব্যবহার করে।[২০] ২০১১ সালে আইডিএফ দ্বারা প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইসরায়েলি সরকারি দাবিকে অস্বীকার করা হয়। ইসরায়েলি সরকার দাবি করে যে অভিযানটি বাসে হামলার ঘটনার প্রতিশোধ হিসেবে পরিচালিত হয়েছিল। অন্যদিকে আইডিএফ এর প্রতিবেদনে স্পষ্ট হয় যে আইডিএফ বাসে হামলার ঘটনার এক বছর আগে ১৯৬৭ সালে এই অভিযান দুটির পরিকল্পনা গ্রহণ করে। প্রতিবেদনে আরও প্রকাশ পায় যে, আইডিএফ ১৯৬৬ সালে জর্দান নদী পারাপারের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করা শুরু করে, যে নদীটির পশ্চিম তীর আজও জর্দান নিয়ন্ত্রণ করে।[৫]
ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ ডঃ আশের পোরাতের মতে "অপারেশন থেকে স্পষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে যে জর্ডানের সেনাবাহিনীর সাথে লড়াই করা একটি ভুল ছিল।"[৪৩] হিব্রু দৈনিক হারেত্জের ২০১১ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে যুদ্ধটিকে "ইসরায়েলের সামরিক ইতিহাসের সবচেয়ে অন্ধকার অধ্যায়গুলির মধ্যে একটি" হিসাবে বর্ণনা করেছে।[৫]
আরব ইতিহাসবিদরা যুক্তি দেখান যে ইসরায়েল তার সামরিক ক্ষমতার উপর অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে কারামেহ যুদ্ধে যুক্ত হয়েছিল। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরায়েল আরবদের পরাজিত করার ঠিক পরে কারামেহ যুদ্ধ হয়েছিল। কারামেহে প্রবেশকারী ইসরায়েলি বাহিনীর আকার জর্ডানিয়রা অনুমান করেছিল যে ঠিক ১০ মাস আগে গোলান মালভূমি দখলের মত ইসরায়েল বালকা গভর্নরেট সহ জর্ডান নদীর পূর্ব তীর দখল করার পরিকল্পনা করছে। পরে গোলান মালভূমির মত বালকা গভর্নরেটকে ইসরায়েল আরবদের সাথে দর কষাকষির জন্য ব্যবহারের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারতো। জর্ডান দাবী করত, মোশে দায়ান পশ্চিম জর্ডান দখল করার আগের দিন ইসরায়েলি সাংবাদিকদের মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।[৪৪][৪৫]
কারামেহের যুদ্ধ অনেক শিল্পকর্ম, ডাকটিকিট এবং পোস্টারের বিষয় ছিল।[৪৬]