কাষ্ঠল উদ্ভিদ হল সেইসকল উদ্ভিদ যাদের গঠনগত কাঠামো কোষসমষ্টি অর্থাৎ কলায় কাষ্ঠল অংশ থাকে বা উৎপন্ন হয় এবং সেই কাষ্ঠল অংশ পরিনত হয়য়ে সাধারণত শক্ত কাণ্ডের রূপ নেয়। এই শক্ত কাষ্ঠল কাণ্ডকে চলিত ভাষায় গাছের গুঁড়িও বলা হয়। সরল ভাষায় যেসকল উদ্ভিদ থেকে কাঠ পাওয়া যায় তারাই কাষ্ঠল উদ্ভিদ হিসাবে পরিচিত। অন্যান্য মরসুমি উদ্ভিদের বিপরীতে, কাষ্ঠল উদ্ভিদ শুকনো মরসুমে বা ঠান্ডা আবহাওয়ায় ভালোভাবেই মাটির উপর বেঁচে থাকতে পারে।[১]
কাষ্ঠল উদ্ভিদ সাধারণত বৃক্ষ, গুল্ম এবং লতানো প্রকৃতির হয়। এগুলি সাধারণত বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ, যাদের কাণ্ড এবং গভীরতর বৃহৎ শিকড় অংশ গৌণ জাইলেম কলা থেকে উৎপাদিত কাঠে্র মাধ্যমে সুদৃঢ়ভাবে গঠিত হয়। এই গাছগুলির প্রধান কাণ্ড, বৃহৎ শাখা এবং শিকড় সাধারণত বাকলের একটি স্তর দ্বারা আবৃত থাকে। কাঠ আসলে কাষ্ঠল উদ্ভিদেরই একটি কাঠামোগত কলা যা এই উদ্ভিদের কাণ্ড অংশ গঠন করে এবং বছরের পর বছর ধরে মাটির উপর এই কাষ্ঠল কাণ্ড অংশের বৃদ্ধির সাথে সাথে উদ্ভিদের উচ্চতা বাড়াতে সহায়ক হয়, যার ফলস্বরুপ কাষ্ঠল উদ্ভিদের কিছু প্রজাতি দীর্ঘতম স্থলজ উদ্ভিদ হিসাবে পরিচিত।
অন্যান্য বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদের মত কাষ্ঠল উদ্ভিদেরও সুপ্ত সময়কাল আছে যখন এই উদ্ভিদের কোনপ্রকার বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়না। কাষ্ঠল উদ্ভিদের ক্ষেত্রে সাধারণত সেই সময়টা হল শীতকাল যখন আবহাওয়া শীতল থাকে এবং পরিবেশের উষ্ণতা কম থাকে। নিরক্ষীয় ও ক্রান্তীয় অঞ্চলে শীতকালের সময়কাল খুবই সামান্য তাই এই অঞ্চলে কাষ্ঠল উদ্ভিদের সুপ্ত সময়কাল সাধারণত সেইসময় হয় যখন বাতাসের আর্দ্রতা অপেক্ষাকৃত কম থাকে। যদি কাষ্ঠল উদ্ভিদ পর্ণমোচী প্রকৃতির হয় তাহলে সুপ্ত সময়কালের পর পাতা ঝরার সময়কাল আবির্ভূত হয়। চিরহরিৎ বৃক্ষ সাধারণত তাদের সমস্ত পাতা একবারে ঝরায়না, তার পরিবর্তে এরা ক্রমবর্ধমান মরসুমের সাথে সাথে অল্প অল্প করে তারা তাদের পাতা ঝরায়। তবে সুপ্ত সময়কালে এদের বৃদ্ধি কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে সারা বছর উষ্ণ তাপমাত্রা থাকার কারণে সেই স্থানের বনাঞ্চল ও অন্যান্য অঞ্চলের গাছপালা সাধারণত চিরহরিৎ প্রকৃতির হয়।
পাতা ঝরার মাসগুলিতে একটি পর্ণমোচী বৃক্ষের প্রতিটি কাণ্ড তাদের পাতাগুলিতে খাদ্য এবং জলের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এর ফলে তাদের পাতার ক্লোরোফিল নষ্ট হোয়ে জাওয়ার ফলে তাদের রঙ পরিবর্তন হয়। পাতা ও কাণ্ডের মধ্যে কিছু বিশেষ কোষ গঠিত হয় যারা তাদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, যার ফলে পাতাগুলি সহজেই ঝরে যায়। কিন্ত চিরহরিৎ গাছ এভাবে তাদের সমস্ত পাতা ঝরায়না এবং এরা এদের সুপ্ত সময়কালেও খুব কমই নিষ্ক্রিয় থাকে। বসন্তকালে শিকড়গুলি পুনরায় পাতায় পুষ্টি পাঠানো শুরু করে।
উষ্ণ আবহাওয়া ও আর্দ্র মরসুমের সাথে যখন গাছের বৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ ফিরে আসে তখন উদ্ভিদ নতুন পাতা ধরে এবং কুঁড়ি ভেঙ্গে নতুন ফুল আসে। এর সাথে সাথে পুরনো মরসুমের কাষ্ঠল অংশের মুকুল থেকেও নতুন ডালপালা বৃদ্ধি হয়। শীতল জলবায়ুতে কাণ্ডের বেশিরভাগ বৃদ্ধি বসন্ত এবং গ্রীষ্মের শুরুতে ঘটে। সুপ্ত সময়কাল শুরু হলে কাঠের নতুন বর্ধিত অংশ শক্ত এবং কাষ্ঠল হয়ে ওঠে। একবার নতুন বৃদ্ধি পাওয়া অংশটি শক্ত কাঠে পরিনত হয়ে গেলে তা কখনই আর দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধি পায়না কিন্তু গাছের জীবনকাল চলাকালীন কাষ্ঠল অংশটি প্রস্থে অবশ্যই বৃদ্ধি পায়।
বেশিরভাগ কাষ্ঠল উদ্ভিদ শীতল মরসুমে তাদের সংবহনতান্ত্রিক কলা গঠনের মাধ্যমে তাদের কাণ্ড অংশে বৃদ্ধি বলয় বা বর্ষ বলয় গঠন করে। এই বলয়গুলির বাইরের অংশে কেবলমাত্র জীবিত কোষ দেখা যায় কিন্ত এদের ভিতরের অংশের কোষগুলি সব মৃত এবং এরা কেবলমাত্র গঠন কাঠামোর অবলম্বন হিসাবে কাজ করে।
কাণ্ডের আগার বা অগ্রভাগের মুকুল থেকে কাণ্ডের প্রাথমিক বৃদ্ধি হয়। কাণ্ডের আগার সাথে সাথে বিভিন্ন শাখাপ্রশাখার সংযোগস্থলে কিছু কৌণিক মুকুল বের হয় যারা কাণ্ডের অগ্রভাগের মুকুলের বৃদ্ধিকে প্রতিরোধ করে যতক্ষণ না কোন মানুষের দ্বারা বা প্রাকৃতিক কারণে সেই কৌণিক মুকুলগুলিকে কেটে ফেলা হয়। এই কৌণিক মুকুলগুলি না থাকার ফলে আগার মুকুলগুলিকে প্রতিরোধ করার মত কোন বাঁধা থাকেনা এবং সেই আগার মুকুল থেকে দ্রুত গাছের বৃদ্ধি হয়। বিশেষত এই কৌণিক মুকুলগুলি যদি বসন্তের সময় কাটা হয় তাহলে গাছের বৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত হয়। গ্রীষ্মের শেষের দিকে এবং শরতের শুরুর দিকে, মরসুমের সর্বাধিক সক্রিয় বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গেছে এবং তখন গাছের কোন অংশ ছাঁটাইয়ের ফলেও খুব কম নতুন কোনও বৃদ্ধি হয়। সুপ্ত সময়কাল শুরু হলে শীতের মুকুল প্রস্ফুটিত হয়। উদ্ভিদের উপর নির্ভর করে, এই মুকুলগুলি থেকে হয় নতুন পাতার বৃদ্ধি হয় অথবা নতুন ফুল বা ফল বের হয়।
বিস্তৃত পাতার গাছগুলির তুলনায় দেবদারু জাতীয় সরু পাতার গাছগুলির বৃদ্ধিতে কৌণিক মুকুল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এইকারণেই দেবদারু জাতীয় গাছে শাখাপ্রশাখা এবং বড় আকৃতির পাতার পরিবর্তে একটি লম্বা কাষ্ঠল শক্ত গুঁড়ি এবং সরু সরু সূচের মত পাতা দেখা যায়।
কাষ্ঠল উদ্ভিদের যত বৃদ্ধি হয় ততই তার নিচের অংশে কাণ্ড ও শাখাপ্রশাখায় পাতা কমতে থাকে এবং বেশিরভাগ নতুন পাতা গাছের আগার দিকে বের হয় এবং একটি ছাতার মত আচ্ছাদন সৃষ্টি করে যা একপ্রকারে কাণ্ডের নিচের অংশে নতুন পাতা বেরোতে বাঁধা দেয়। গাছের কোনও বিশেষ শাখার যদি গাছকে দুর্বল করে দেয় তাহলে গাছের শিকড় সেই শাখায় খাদ্য ও জলের সরবরাহ বন্ধ করে সেই শাখাকে দুর্বল করে দেয় এবং কালক্রমে তা গাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
কাষ্ঠল উদ্ভিদের মাটির নিচের শিকড় বা মূল অংশ প্রত্যেক বৃদ্ধির অনুকূল ঋতুতে কাণ্ড অংশের সাথে সাথেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। মূল অংশটি অভিকর্ষের অভিমুখে বৃদ্ধি পায় এবং তার থেকে কিছু পার্শ্বীয় শাখাপ্রশাখা মূল বের হয়। বৃদ্ধির অনুকূল ঋতু শেষ হোয়ে গেলে মূলের বর্ধিত অংশ কাণ্ডের মতই কাষ্ঠল এবং শক্ত হয়ে যায় এবং আগামী অনুকূল ঋতুর আগমন অবধি দৈর্ঘ্যে বৃদ্ধির প্রক্রিয়া হ্রাস পায়। কিন্তু তখন মূলের প্রস্থের দিকে বৃদ্ধি হয় এবং মাটির উপরের অংশের বিপরীতে খুব সামান্য পরিমানে হলেও সুপ্ত সময়কালে মূলের দৈর্ঘ্যে সামান্য বৃদ্ধি হয়। শীতকালে যতক্ষণ তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি ফারেনহাইট (২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) -এর উপর থাকবে ততক্ষণ মূলের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।
কাঠ মূলত জাইলেম কোষের সমন্বয়ে গঠিত হয় এবং কোষের বাইরের আবরণ বা কোষের দেয়াল সেলুলোজ এবং লিগিনিন দিয়ে তৈরি হয়। জাইলেম একটি সংবহনতান্ত্রিক কোষ যা গাছের মূল থেকে কাণ্ডের মাধ্যমে শাখাপ্রশাখা ও পাতায় খাদ্য ও জল সরবরাহ করে। বেশিরভাগ কাষ্ঠল উদ্ভিদ প্রত্যেক বছর কাঠের নতুন স্তর তৈরি হয় এবং এইভাবেই প্রত্যেক বছর গাছের কাণ্ড বা গুঁড়ির প্রস্থে বৃদ্ধি ঘটে এবং গুঁড়ির সবচেয়ে বাইরের অংশ অর্থাৎ বাকলের নিচের দিকে অবস্থিত সংবহনকারী ক্যাম্বিয়াম স্তরের অভ্যন্তরের দিকে নতুন কাঠের স্তর তৈরি হয়। যাইহোক কিছু বিশেষ একচেটিয়া প্রকৃতির উদ্ভিদ যেমন পাম, খেজুর জাতীয় গাছে কাষ্ঠল অংশ কাণ্ডের অভ্যন্তরের দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। কাণ্ডের ব্যাস বৃদ্ধির মরসুমে অবিচ্ছিন্নভাবে বৃদ্ধি পায় এবং সুপ্ত সময়কালে থেমে থাকে।[২]
নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, কাঠের গাছগুলি ক্ষয়ে যেতে পারে এবং কালক্রমে প্রস্তরবৎ কঠিন হয়ে পরে।
লিনিয়াসের স্পেসি প্ল্যান্টারামের উপর ভিত্তি করে একটি কাষ্ঠল উদ্ভিদের প্রতীক , এটি শনি গ্রহেরও জ্যোতির্বৈজ্ঞানীক প্রতীক চিহ্ন।[৩]