কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ | |
---|---|
![]() গেরহার্ড ভন কুগেলগেনের তুলিতে কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখের প্রতিকৃতি (আনু. ১৮১০-১৮২০); ৫৩.৩ × ৪১.৫ সে.মি; তৈলচিত্র। | |
জন্ম | |
মৃত্যু | ৭ মে ১৮৪০ | (বয়স ৬৫)
জাতীয়তা | জার্মান |
পরিচিতির কারণ | চিত্রাঙ্কন |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | দ্য মঙ্ক বাই দ্য সি (১৮০৮–১৮১০), চক ক্লিফস অন রগ্যান (১৮১৮), ওয়ান্ডারার অ্যাভব দ্য সি ফগ (১৮১৮), মুনরাইজ ওভার দ্য সী (১৮২২) |
আন্দোলন | রোমান্টিকতা |
কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ (৫ সেপ্টেম্বর ১৭৭৪ - ৭ মে ১৮৪০) ঊনবিংশ শতকের জার্মানির একজন রোমান্টিক ল্যান্ডস্কেপ চিত্রকর, সাধারণভাবে যিনি তার প্রজন্মের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ জার্মান শিল্পী হিসেবে স্বীকৃত।[২] তিনি তার মধ্যযুগীয় রূপকধর্মী (allegorical) ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্যাবলীর চিত্রকর্মের জন্য সর্বাধিক পরিচিত। তার এসব শিল্পকর্মে রাতের আকাশ, সকাল বেলার কুয়াশা, নিষ্ফলা বৃক্ষ কিংবা গথিক জাতির ধ্বংসাবশেষের আড়ালে সচরাচর গভীর ধ্যানে নিমজ্জমান ছায়ামূর্তিকে সিলুয়েশনের মাধ্যমে চিত্রায়িত করা হয়েছে। [৩] ফ্রিডরিখ মূলত প্রকৃতির গহীন ধ্যানমগ্নতা নিয়ে কাজ করেছেন। ফ্রিডরিখের প্রায়-প্রতীকী ও প্রথা বিরোধী (anti-classical) চিত্রকর্ম প্রাকৃতিক জগতে একটি বিষয়ভিত্তিক ও আবেগময় প্রতিক্রিয়া পৌঁছে দিতে চেয়েছে। গুণগতভাবে ফ্রিডরিখের চিত্রকর্মগুলো সুবিস্তৃত ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে একটি মানবিক সত্ত্বার উপস্থিতিকে ক্ষুদ্রায়িত পার্সপেক্টিভে[৪] উপস্থাপন করে থাকে। এ উপস্থাপনা এমনই যে এখানে ছায়ামূর্তিগুলোকে একটি মাত্রায় হ্রাস করা হয় যেগুলোকে কলা ইতিহাসবিদ ক্রিস্টোফার জন মারে “আধ্যাত্মিকতার প্রতি দর্শকের নিমগ্নদৃষ্টি” বলে মূল্যায়ন করেছেন।[৫]
ফ্রিডরিখের জন্ম বাল্টিক সাগরের তীরবর্তী গ্রাইফসওয়াইল্ড (Greifswald) শহরে যা ছিল তৎকালীন সুইডিশ পমরনিয়ার (Pomerania) অন্তর্ভুক্ত। ড্রেসডেনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে তিনি ১৭৯৮ সাল পর্যন্ত কোপেনহেগেনে অধ্যয়ন করেন। তিনি এমনই এক সময়ে বয়ঃপ্রাপ্ত হন যখন ইউরোপ জুড়ে মোহমুক্তির বর্ধিঞ্চু একটি ভাবধারাকে বস্তুবাদী সমাজ সমেত আধ্যাত্মিকতার নতুন এক উপলব্ধিতে উত্তরণের ইন্ধন যোগানো হচ্ছিল। আদর্শের এই পরিবর্তনকে সচরাচর প্রাকৃতিক জগতের পুনর্মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়েছে, যেখানে ফ্রিডরিখ, জে.এম.ডব্লিউ টার্নার এবং জন কনস্টাবলের মতো শিল্পীরা প্রকৃতিকে "মানব সভ্যতার কৃত্রিমতার বিরুদ্ধে একটি স্বর্গীয় সৃষ্টি" রূপে প্রকাশে উদগ্রীব ছিলেন।[৬]
ফ্রিডরিখের সৃষ্টিকর্ম ক্যারিয়ারের শুরুতে তাকে খ্যাতি এনে দেয় এবং সমকালীন ব্যক্তিত্বদের মধ্যে ভাস্কর ডাভিড ডি'অ্যাঙ্গাজ তাকে এমনই এক ব্যক্তি হিসেবে অবিহিত করেছেন যিনি আবিষ্কার করেছেন "ল্যান্ডস্কেপের করুন পরিণতি” (the tragedy of landscape)।[৭] সে যাই হোক, শেষ বয়সে তার সৃষ্টিকর্ম জনপ্রিয়তা হারায়, আর তিনি সকলের অগোচরে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন।[৮] বিগত ঊনবিংশ শতকে যখন জার্মানি আধুনিকায়নের দিকে ধাবিত হচ্ছিল, তখন জরুরী প্রয়োজনীয়তার এক নব চেতনা তার নিজস্ব ললিতকলার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করে আর ফ্রিডরিখের নিস্তব্ধতার ধ্যানমগ্ন চিত্রায়ন প্রতিভাত হয়ে পড়ে অতীত যুগের সৃষ্টিরূপে। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ছিলেন সকলে অগোচরে। বার্লিনে ১৯০৬ সালে ফ্রিডরিখের বত্রিশটি চিত্রের একটি প্রদর্শনী বিংশ শতকের গোড়ায় তার চিত্রকর্মের পুননবায়নকৃত উপলব্ধি ও পুনর্মূল্যায়নকেই বহন করে নিয়ে আসে। ১৯২০ এর দশকের মধ্যেই অভিব্যক্তিবাদীদের দ্বারা শিল্পীর চিত্রকর্মসমূহ আবিষ্কৃত হয় এবং ১৯৩০ এর দশকে ও ১৯৪০ এর দশকের শুরুতে অধিবাস্তববাদীরা ও অস্তিত্ববাদীরা তার সৃষ্টি হতে ধারণা নিতেন। আবার ১৯৩০ এর দশকের গোড়ায় নাৎসিবাদের উত্থানও ফ্রিডরিখের জনপ্রিয়তার পুনর্জাগরণ ঘটায়, কিন্তু তার কাজে একটি জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান নাৎসি আন্দোলনের মাধ্যমে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা হলে ঐ জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ে যায়।[৯] এমতবস্থা গত ১৯৭০ এর দশক পর্যন্ত বজায় ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি একজন জার্মান রোমান্টিক আইকন ও আন্তর্জাতিকভাবে একজন গুরুত্বপূর্ণ চিত্রশিল্পী হিসেবে পুনরায় খ্যাতি অর্জন করলেন।
কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ জার্মানির বাল্টিকসাগরের তীরবর্তী পূর্বতন সুইডিশ ডোমিনিয়নের পমরনিয়ার (Pomerania) গ্রাইফসওয়াইল্ডে ১৭৭৪ সালের ৫ সেপ্টেম্বরে জন্ম গ্রহণ করেন।[১০] মোমবাতি ও সাবান প্রস্তুতকারী পিতা এডলফ গটলেইব ফ্রিডরিখের কঠোর লুথেরান ধর্মবিশ্বাস অনুসারে তিনি বেড়ে ওঠেন। তিনি তার পিতামাতার দশজন সন্তানের মধ্যে ষষ্ঠ।[৬] তাদের পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে পাওয়া তথ্যসমূহ পরস্পরবিরোধী; কিছু সূত্র মোতাবেক এই সন্তানেরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে শিক্ষা লাভ করেছেন, আবার কিছু সূত্র বলছে তারা অনপেক্ষ দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হয়েছেন, যেখানে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কিনতেই তাদের হিমশিম খেতে হত।[১১] অল্প বয়সেই তিনি মৃত্যুর সাথে পরিচিত হয়ে ওঠেন। ১৭৮১ সালে যখন তার বয়স সাত বছর তার মা সফি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।[১২] এক বছর পর তার বোন এলিজাবেথ মারা যান[১৩] এবং দ্বিতীয় বোন মারিয়া টাইফাস জ্বরে ভুগে ১৭৯১ সালে মারা যান।[১১] ১৭৮৭ সালে যখন তার ভাই জোহান ক্রিস্টোফার মারা গেল, তের বছর বয়সে তিনি যখন এই ছোট ভাইকে জমাটবাঁধা হ্রদের বরফে পরে ডুবে যাওয়ার মর্মান্তিক র্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হলেন তখন যুক্তিযুক্তভাবেই তার শৈশবে ঘটে গেল সবচেয়ে ভয়ংকর ট্রাজেডি।[১৪] কিছু বিবরণ অনুযায়ী, কাসপার ডাভিড নিজেও বরফে বিপদে পড়েছিলেন আর তাকে উদ্ধার করতে গিয়ে জোহান ক্রিস্টোফার অকালে ঝরে পড়েন।[১৫]
ফ্রিডরিখ ১৭৯০ সালে তার নিজ শহরের গ্রাইফসওয়াইল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্পী জোহান গটফ্রাইড কুইস্ট্রপের ব্যক্তিগত ছাত্র হিসেবে কলাশাস্ত্রে আনুষ্ঠানিক অধ্যয়ন শুরু করেন। বর্তমানে তার সম্মানার্থে বিশ্ববিদ্যালয়টির কলা বিভাগের নামকরণ করা হয়েছে কাসপার-ডাভিড-ফ্রিডরিখ-ইনস্টিটিউট। কুইস্ট্রপ তার ছাত্রদেরকে বহির্বিভাগ অঙ্কন ভ্রমণে নিয়ে যেতেন, যার ফল স্বরূপ ফ্রিডরিখ তার জীবনের শুরুতেই জীবন হতে অঙ্কনে উদ্বুদ্ধ বা প্রণোদিত হয়েছেন। ধর্মতত্ত্ববিদ লডউইগ গটহার্ড কোসেগার্টেন যিনি শিখিয়েছিলেন যে, প্রকৃতি হচ্ছে ঈশ্বরের প্রকাশ, কুইস্ট্রপের মাধ্যমে ফ্রিডরিখ তার সাক্ষাৎ পান এবং পরবর্তীতে তার দ্বারা প্রভাবিত হন। ১৭শ শতকের জার্মান শিল্পী অ্যাডাম এলশেইমার যার শিল্পকর্মে ল্যান্ডস্কেপের আয়ত্তাধীন ধর্মীয় বিষয়াবলী ও রাত্রি সংক্রান্ত বিষয়াবলী প্রায়শই অন্তর্ভুক্ত থাকত, তার কাজের সাথে কুইস্ট্রপ ফ্রিডরিখকে পরিচয় করিয়ে দেন। এছাড়াও এ সময়ে তিনি সুইডিশ অধ্যাপক থমাস থরিল্ড এর সাথে সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে অধ্যয়ন করেন। চার বছর পর ফ্রিডরিখ প্রখ্যাত কোপেনহেগেন অ্যাকাডেমিতে প্রবেশ করেন, এখানে তিনি জীবন হতে চিত্রাঙ্কন কাজের পূর্বে প্রাচীন ভাস্কর্যসমূহের ছাঁঁচের নকল বা প্রতিরূপ তৈরির মাধ্যমে তার শিক্ষা শুরু করেন। কোপেনহেগেন শহরে বসবাস তরুণ এ চিত্রশিল্পীকে রয়াল পিকচার গ্যালারির ১৭শ শতকের ডাচ ল্যান্ডস্কেপ চিত্র সংগ্রহে প্রবেশের সুযোগ প্রদান করে। এই শিক্ষায়তনে তিনি ক্রিস্টোফার অগাস্ট লরেন্টজেন এবং ল্যান্ডস্কেপ চিত্রশিল্পী জেন্স জু (Jens Juel) এর ন্যায় শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে অধ্যয়ন করেন। এই শিল্পীগণ ছিলেন স্টার্ন উন্ড ড্র্যাং (Sturn und Drang বা ঝড় ও পীড়ন) আন্দোলন দ্বারা প্রভাবিত এবং স্ফুটনোন্মুখ রোমান্টিক নন্দনতত্ত্ব ও ক্ষীয়মাণ নব্য-ধ্রুপদী ভাবাদর্শের নাটকীয় প্রবলতা ও গূঢ়ার্থবাচক রীতির (expressive manner) মধ্যবিন্দুকে তারা প্রতিনিধিত্ব করতেন। এহেন পরিবেশে মেজাজ ছিল সর্বোচ্চ আর অনুভাব (influence) ছিল আইসল্যান্ডিয় কিংবদন্তি এদ্যা (Edda), ওসিয়েন ও নস পুরাণের (Ossian and Norse mythology) কবিতার মত নির্ঝর দ্বারা চিত্রায়িত।
ফ্রিডরিখ ১৭৯৮ সাল থেকে ড্রেসডেনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। প্রথম দিকে তিনি এচিংয়ের মাধ্যমে ছাপচিত্র তৈরির[১৭] এবং কাঠখোদাইয়ের নকশার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান; খোদাইয়ের কাজটা তার আসবাবপত্র নির্মাতা ভাই করে দিত। ১৮০৪ সালের মধ্যেই তিনি আঠারোটি এচিং ও চারটি খোদাই কাঠের চিত্র তৈরি করেন; স্পষ্টতই এগুলো খুবই কম তৈরি করা হয় আর বিতরণ করা হয় শুধু বন্ধুদের মধ্যেই।[১৮] শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রে তার এসব হঠাৎ হঠাৎ অভিযান সত্ত্বেও তিনি মূলত কালি, জলরঙ ও সেপিয়া নিয়ে কাজের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। প্রথম দিকে ল্যান্ডস্কেপ উইথ টেম্পল ইন রুইনস (১৭৯৭) এর মত কিছু ব্যতিক্রমী কাজ করলেও তার সুনাম আরও ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত না পাওয়া পর্যন্ত তিনি তেলরঙ নিয়ে বিস্তারিতভাবে কাজ করেন নি।[১৯] ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্য তথা ল্যান্ডস্কেপ ছিল তার সর্বাধিক প্রিয় ও অগ্রগণ্য বিষয়। ১৮০১ সালের শুরুতে বাল্টিক উপকূল, বোহেমিয়া ভূখণ্ড, কেরকোনশ্যে পাহাড় এবং হাৎস পর্বতমালায় ঘন ঘন যাওয়া-আসার ফলে তিনি এসবের প্রতি অনুপ্রাণিত হন।[২০] মূলত উত্তর জার্মানির ভূপ্রাকৃতিকদৃশ্য নির্ভর তার এসব চিত্রকর্মে ক্ষুদ্র বন, পাহাড়, পোতাশ্রয়, সকালের কুয়াশা এবং প্রকৃতির এক ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণভিত্তিক আলোর অন্যান্য ইফেক্টগুলো চিত্রিত হয়েছে। রুগেন দ্বীপের খাড়া উঁচু পাহাড়, ড্রেসডেনের চারপাশ ও এলব্যা (Elba) নদীর মত মনোরম দৃশ্যাবলীর স্কেচ এবং গভীর অনুসন্ধানের ভিত্তিতে এসব শিল্পকর্ম গড়ে উঠেছে। ফ্রিডরিখ প্রায়ই একচেটিয়াভাবে পেন্সিলের মাধ্যমে তার অনুসন্ধানী কার্যাদি পরিচালনা করেছেন, উপরন্তু তিনি সেগুলো করেছেন ভূসংস্থানিক তথ্যাদি প্রদানের মাধ্যমে। তথাপি ফ্রিডরিখের মধ্যযুগীয় চিত্রকর্মগুলোর বৈশিষ্ট্য নির্ধারকরূপে আকাশের যে সূক্ষ্ম ইফেক্টসমূহ দেখা যায় সেগুলো ছিল স্মৃতি থেকে আহরিত।[২১] মেঘ ও জলে চন্দ্র-সূর্যের আলো ও আলোকসজ্জার চিত্রায়নের মাধ্যমে এই ইফেক্টসমূহ তাদের শক্তি পেয়েছে; বাল্টিক উপকূলের অনন্য আলোকীয় প্রপঞ্চ এই ইফেক্টসমূহ এর আগে কখনোই এত জোরালোভাবে চিত্রিত করা হয়নি।[২২]
জোহান উল্ফগ্যাং ভন গ্যোটে কর্তৃক আয়োজিত ওয়েমার প্রতিযোগিতায় তিনি ১৮০৫ সালে পুরস্কার অর্জন করলে একজন শিল্পী হিসেবে তার সুনাম প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐ সময়ে ওয়েমার প্রতিযোগিতাটি মাঝারি মানের ও এখন-বিস্মৃত শিল্পীদেরকে নব্য ধ্রুপদী ও ছদ্মবেশী গ্রিক ধারার মধ্যে অমৌলিক মিশ্রণের মাধ্যমে আঁকতে উদ্বুদ্ধ করে তোলে। প্রতিযোগিদের তালিকার নিম্ন মান গোয়েথের সুনামের জন্য ক্ষতিকর প্রতিভাত হওয়া শুরু করে। যার ফলে ফ্রিডরিখ তার প্রসেশন অ্যট ডন (Procession at Dawn) ও ফিশার-ফোক বাই দ্য সি (Fisher-Folk by the Sea) এ দুটো সেপিয়া অঙ্কন নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করলে এই কবি (গোয়েথে) অত্যন্ত উৎসাহের সাথে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আর লেখেন, “ আমরা অবশ্যই নিরপেক্ষভাবে এই ছবিতে শিল্পীর সম্পদশালী উপস্থিতির প্রশংসা করব। অঙ্কনটিতে খুব ভাল কাজ করা হয়েছে, এর অগ্রগমণ সুনিপুণ আর যথাযথ..... তাঁর বর্ণনায় সমন্বিত হয়েছে স্থৈর্য, অধ্যবসায় ও পরিচ্ছন্নতার এক চমৎকার কাজ..... সুনিপুণ জল রঙ..... এছাড়াও তা প্রশংসাযোগ্য।”
১৮০৮ সালে চৌত্রিশ বছর বয়সে, ফ্রিডরিখ তার প্রধান চিত্রশিল্পের প্রথমটি শেষ করেন। বলা হয়ে থাকে যে, বেদীশিল্পের (altarpiece) অন্তর্ভুক্ত ক্রস ইন দ্য মাউনটেনস (Cross in the Mountains) চিত্রকর্মটি যা এখন তেৎসেন বেদী (Tetschen Altar) নামে পরিচিত তা পরে বোহেমিয়া অঞ্চলের তেৎসেন শহরের একটি পারিবারিক ভজনালয়ের (chapel) জন্য অনুমোদন পেয়েছিল। এই ধরনের শিল্পকর্মগুলোতে একাকী ও পাইন বৃক্ষ দ্বারা পরিবেষ্টিত পাহাড়ের শীর্ষদেশের পরিলেখে একটি বধকাষ্ঠ বা ক্রুশের চিত্রায়ণ করা হয়েছে। বিতর্কিতভাবে, খ্রিস্ট্রীয় শিল্পকলায় প্রথমবারের জন্য বেদীশিল্পে একটি ল্যান্ডস্কেপ প্রদর্শিত হল। কলা ইতিহাসবিদ লিন্ডা সীজেলের মতে ফ্রিডরিখ পূর্বে যে বহু সংখ্যক অঙ্কন করেছেন, যেগুলো প্রকৃতির জগতে বধকাষ্ঠ চিত্রায়িত করেছে, ফ্রিডরিখের কলাকৌশল (design) হল তার এসব অঙ্কনেরই "যুক্তিপূর্ণ পরম উৎকর্ষ"।
যদিও ফ্রিডরিখের বেদীশিল্প (altarpiece) খুব সাধারণভাবে উৎসাহহীনতার সাথে গৃহীত হয়, তা সত্ত্বেও ব্যাপক প্রচারণা পাওয়ার জন্য এটিই ছিল তার প্রথম চিত্রশিল্প। শিল্প সমালোচক ব্যাসিলিয়াস ভন র্যামড'আর ধর্মীয় প্রেক্ষিতে ফ্রিডরিখের ল্যান্ডস্কেপের প্রয়োগকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করলে শিল্পীর বন্ধুরা প্রকাশ্যে এর প্রতিবাদ করে। ল্যান্ডস্কেপ চিত্রশিল্প অশ্লীল অর্থ বহন করতে পারে এ ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন ফ্রিডরিখ একথা লিখেন যে,“এটা হবে এক বাস্তবিক অনুমান, যদি ল্যান্ডস্কেপ চিত্রশিল্প নিঃশব্দে গুটি গুটি পায়ে গীর্জায় প্রবেশ করত আর হামাগুড়ি দিয়ে বেদীতে উঠত।” ফ্রিডরিখ ১৮০৯ সালে একটি কর্মসূচির মাধ্যমে তার অভিপ্রায়ের বিবৃতি দিয়ে সন্ধ্যাকালীন সূর্যরশ্মিকে পবিত্র পিতার (Holy Father) আলোর সাথে তুলনা মাধ্যমে, নিজস্ব প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এই বিবৃতি সেই সময়কে নির্দেশ করে যখন ফ্রিডরিখ তার নিজ কাজের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা ও অর্থ নথিভুক্ত করেন এবং সেই সময়কে নির্দেশ করে যখন চিত্রাঙ্কন কিছু দালালি মাঝে সীমাবদ্ধ ছিল ক্রমান্বয়ে তিনিও যা গ্রহণ করেন।
প্রুসিয়ান রাজপুত্র কর্তৃক ফ্রিডরিখের দুটি চিত্রশিল্পের ক্রয়ের মাধ্যমে তিনি ১৮১০ সালে বার্লিন অ্যাকাডেমির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮১৬ সালে তখনও তিনি নিজেকে প্রুশিয়ান কর্তৃপক্ষ হতে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করতেন এবং ঐ বছরের জুনে তিনি স্যাক্সন নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেন। স্থানান্তরিত হওয়ার এ প্রত্যাশা ফ্রিডরিখের পূরণ হয় নি; যেহেতু স্যাক্সন সরকার ছিল আধা-ফরাসি, অন্যদিকে তার চিত্রকলাকে মোটের উপর স্বাদেশিকরূপে এবং সুস্পষ্টভাবেই ফরাসি বিরোধী হিসেবে দেখা হত। সে যাই হোক, ফ্রিডরিখ তার ড্রেসডেন ভিত্তিক বন্ধু গ্রাফ ভিৎসজিয়াম ভন ইক্সটেট (Graf Vitzthum von Eckstädt) এর সহায়তায় নাগরিকত্ব অর্জন করেন, এবং ১৮১৮ সালে ১৫০ থ্যালারের (thaler) বিনিময়ে স্যাক্সন অ্যাকাডেমির বাৎসরিক সদস্যপদ লাভ করেন। যদিও তিনি পূর্ণাঙ্গ অধ্যাপনা প্রাপ্তির আশা করতেন, তবুও কখনোই তাকে এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি, যেহেতু জার্মান লাইব্রেরি অব ইনফরমেশন অনুসারে, "তাঁর চিত্রকলা খুবই ব্যক্তিকেন্দ্রিকরূপে উপলব্ধি হয়েছিল, তাঁর দৃষ্টিকোণ এতই স্বতন্ত্র ছিল যে ছাত্রদের মাঝে তা কার্যকর উদাহরণ হিসেবে সরবরাহ করা যেত না।" রাজনীতিও ফ্রিডরিখের ক্যারিয়ারের বাঁধা হিসেবে ভূমিকা পালন করে থাকতে পারে: এর নিয়ামক ছিল সন্দেহাতীতভবে তার জার্মান বিষয়বস্তু ও বেশভূষা, যুগের কর্তৃত্ববাদী আধা-ফরাসি মনোভাবের সাথে যেগুলো বারংবার সংঘর্ষিত।
১৮১৮ সালের ১৮ জানুয়ারি ফ্রিডরিখ ড্রেসডেন শহরের ডায়ারের পঁচিশ বছর বয়সী মেয়ে ক্যারোলাইন বোমারকে বিয়ে করেন। এই দম্পতির তিনটি সন্তান হয়েছিল; এদের মধ্যে প্রথম জন এমা, ১৮২০ সালে যে মায়ের কোলে আসে। শারীরতত্ত্ববিদ ও চিত্রশিল্পী কার্ল গুস্তাভ ক্যারাস তার জীবনী সংক্রান্ত রচনায় উল্লেখ করেছেন যে, বিবাহ ফ্রিডরিখের জীবন কিংবা ব্যক্তিত্ব কোনটিতেই তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি, বরং তখনও ঐ সময়ের ক্যানভাসসমূহ, এমনকি মধুচন্দ্রিমার পরে আঁকা চক ক্লিফস অন রগ্যান চিত্রটিও, চপলতার এক নয়া অনুভূতি প্রদর্শণ করে, যেখানে তার প্যালেট আরও অত্যুজ্জ্বল ও স্বল্প নিরাভরণ হয়েছে। এই সময়ের চিত্রকর্মগুলোতে মানব চরিত্রের উপস্থিতি ক্রমবর্ধমানহারে নজরে পড়ে, সীজেল একে ব্যাখ্যা করেছেন এমন এক প্রতিফলনরূপে যা, "মানব জীবনের, বিশেষত তার পরিবারের গুরুত্ব, এখন যা তার ভাবনাকে উত্তরোত্তর পরিব্যাপ্ত করে রাখে, এবং তার বন্ধুরা, তার স্ত্রী, এবং তার শহরের অধিবাসিরা এগুলোই ফ্রিডরিখের শিল্পকলায় পৌনঃপুনিক বিষয়বস্তু হিসেবে দৃষ্টিগোচর হয়।"
এর কাছাকাছি সময়েই তিনি রাশিয়ায় দুটো উৎস থেকে আনুকূল্য প্রাপ্ত হন। ১৮২০ সালে গ্রান্ড ডিউক নিকোলাই পাভলোভিচ তার স্ত্রী আলেকজান্ডার ফিয়েডোরোভনা'র নির্দেশে ফ্রিডরিখের স্টুডিও ভ্রমণ করেন এবং তার কিছু চিত্রকলা নিয়ে সেন্ট পিটার্সবার্গে ফিরে যান; এই বিনিময় পৃষ্ঠপোষকতার যে সূত্রপাত ঘটায় তা অনেক বছর ধরে অব্যাহত থাকে। এর অনধিক কাল পরেই ১৮২১ সালে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার এর শিক্ষক, কবি ভ্যাসিলি জিকভস্কি (Vasily Zhukovsky) ফ্রিডরিখের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তার মাঝে নিজের আত্মার খোঁজ পান। জিকভস্কি কয়েক দশক ধরে ফ্রিডরিখের শিল্পকর্ম নিজে কিনে এবং রাজ পরিবারে তার শিল্পকর্মের সুপারিশ করে উভয় প্রক্রিয়ায় তাকে সাহায্য করেন, ফ্রিডরিখের ক্যারিয়ারের শেষ পর্যন্ত তার এমন সহযোগিতা দুরবস্থাগ্রস্থ ও দরিদ্র শিল্পীর কাছে অমূল্য প্রমাণিত হয়েছে। জিকভস্কি তার বন্ধুর চিত্রকলা সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, "এগুলো তাদের স্পষ্টতার মাধ্যমে আমাদেরকে পরিতৃপ্ত করে, এদের প্রত্যেকে আমাদের মনে একটি স্মৃতি জাগরূক করে।"
ফ্রিডরিখ রোমান্টিক যুগের আরেক নেতৃস্থানীয় জার্মান চিত্রশিল্পী ফিলিপ অটো রঞ্জ'র সাথেও পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও তিনি জর্জ ফ্রিডরিখ কার্স্টিং (Georg Friedrich Kersting) এর বন্ধু ছিলেন এবং তিনি তার অনলঙ্কৃত স্টুডিওতে কার্স্টিংকে তার এক শিল্পকর্মে চিত্রায়িত করেন। এছাড়া নরওয়েজিয়ান চিত্রশিল্পী জোহান ক্রিস্টিয়ান ক্লোসেন ডালের (Johan Christian Clausen Dahl, 1788–1857) সাথেও তার বন্ধুত্ব ছিল। ডাল ফ্রিডরিখের শেষ জীবনে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হন এবং ফ্রিডরিখের ছবিগুলোই একমাত্র দুষ্প্রাপ্য বস্তু তিনি শিল্পক্রেতা জনগণের মধ্যে এই বলে আতঙ্ক প্রকাশ করতেন। কবি জিকভস্কি যেমন ফ্রিডরিখের মনস্তাত্ত্বিক থিমের তারিফ করেন, তেমনিভাবে ডাল ফ্রিডরিখের ল্যান্ডস্কেপগুলোর বর্ণনাত্মক বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করেন এই মন্তব্য করে, "শিল্পী ও বোদ্ধাগণ ফ্রিডরিখের শিল্পে কেবল এক প্রকার রহস্যই (mystic) খুঁজে পেয়েছেন, কারণ স্বয়ং তাঁরা শুধু এটাই খুঁজে থাকেন ..... তাঁরা দেখেননি প্রকৃতি নিয়ে ফ্রিডরিখের বিশ্বস্ত ও ন্যায়নিষ্ঠ গবেষণা, যার সবকিছুতে তিনি প্রতিনিধিত্ব করেছেন।"
মৃত্যু ও শেষ জীবনের আবেশকে প্রতিফলনলেন মাধ্যমে এ সময় ফ্রিডরিখ লাগাতার স্মারক স্তম্ভের এবং সমাধিসৌধের ভাস্কর্যের স্কেচ আঁকেন, এমনকি ড্রেসডেনের কবরস্থানের কিছু সমাধিস্তম্ভ শিল্পের (funerary art) নকশাও তিনি তৈরি করেন। ১৯৩১ সালে মিউনিখেরগ্লাস প্যালেস আগুনে পুড়ে ধ্বংস হলে এবং পরবর্তীতে ১৯৪৫ সালে ড্রেসডেনে বোমা হামলা হলে এসব কাজের কিছু কিছু নষ্ট হয়ে যায় তথা হারিয়ে যায়।
ফ্রিডরিখের জীবনের শেষ পনের বছরে অবিচল গতিতে নিশ্চিতরূপে তার খ্যাতির পতন ঘটে। গোড়ার দিকের রোমান্টিসিজমের ভাবাদর্শ সমকালীন ফ্যাশনকে অতিক্রম করে অগ্রসর হলে, শিল্পীকে গুণের সংস্পর্শ হতে বিচ্ছিন্ন অদ্ভুত-খাপছাড়া ও ভগ্নহৃদয় এক চরিত্ররূপেই দেখা হত। ধীরে ধীরে তার পৃষ্ঠপোষকরা দূরে সরে যায়। ১৮২০ সালের পূর্বেই তিনি নিভৃতচারীরূপে বসবাস করতেন এবং বন্ধুরা তাকে বর্ণনা করেন "নিঃসঙ্গদের মধ্যে সর্বাধিক নিঃসঙ্গ" হিসেবে। জীবনের শেষ পর্যন্ত তিনি আপেক্ষিক দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করেন। তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন এবং বনভূমি ও মাঠে একাকী হেঁটে হেঁটে দিন ও রাতের দীর্ঘ সময় পার করতেন, প্রায়শই সূর্যোদয়ের পূর্বে পায়চারি শুরু করতেন।
১৮৩৫ এর জুনে ফ্রিডরিখ তার জীবনে প্রথম স্ট্রোক করেন, এতে তিনি মাইনর লিম্ব প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়ে পেইন্টিং করার সামর্থ্য বিপুল পরিমাণে হারান। যার ফল স্বরূপ, তৈলচিত্র নিয়ে কাজের ক্ষেত্রে তিনি একেবারে অপারগ হয়ে পড়েন এবং তৎ পরিবর্তে জল রঙ, সেপিয়া ও পূর্বতন রচনার ঘষামাজার (reworking) মধ্যে তার শিল্পকর্ম সীমাবদ্ধ হয়ে যায়।
হাতের পুরো শক্তি হ্রাস পেলেও তার লক্ষ্য অটুট থেকে যায়। তখনও তিনি সী-শোর বাই মুনলাইট (Seashore by Moonlight, ১৮৩৫-৩৬) এর মত একটি চূড়ান্ত ব্ল্যাক পেইন্টিং তৈরী করতে সক্ষম ছিলেন। ভন (Vaughan) এর বর্ণনা অনুসারে, "এটি শিল্পীর সমুদয় সৈকতের মধ্যে অন্ধকারতম, যার সুরের ঐশ্বর্য তাঁর ভূতপূর্ব চাতুরতার অভাবকে পূরণ করছে।"
এ সময় থেকেই তার অন্য কিছু শিল্পকর্মে মৃত্যুর প্রতীক দৃষ্টিগোচর হয়। স্ট্রোকের কিছু সময় পরেই রাশিয়ার রাজ পরিবার তার প্রথম দিকের কিছু সৃষ্টিকর্ম কিনে নেয়। এ উপার্জন তাকে টেপলিৎজ (বর্তমান চেজ রিপাবলিক) ভ্রমণের ও আরোগ্য লাভের সুযোগ করে দেয়।
১৮৩০ এর মধ্যম পর্যায়ে ফ্রিডরিখ প্রতিকৃতির (portraits) একটি সিরিজ আঁকা শুরু করেন এবং নিজেকে প্রকৃতির মাঝে পর্যবেক্ষণ করতে ফিরে আসেন। যাই হোক শিল্প ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ভন (William Vaughan) নীরিক্ষা করেন এভাবে, "তিনি নিজেকে অত্যন্ত পরিবর্তিত একজন মানুষ হিসেবে দেখতে পান। তিনি দেখতে পান যে, তিনি আর আগের মত ঋজুকায়, উদ্দীপক ব্যক্তিত্ব নন; তিনি বৃদ্ধ, স্পন্দনহীন..... তিনি চলাফেরা করেন ন্যুব্জ্য হয়ে; এ উপলব্ধি তাঁর ১৮১৯ সালের টু মেন কন্টেমপ্লেটিং দ্য মুন কাজের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে।"
১৮৩৮ এর আগে তিনি কেবলমাত্র ক্ষুদ্র পরিসরে কাজ করতে পারতেন। এ সময় তিনি ও তার পরিবার দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করছিলেন আর ক্রমবর্ধমানভাবে বন্ধুদের দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিলেন।
ফ্রিডরিখ ১৮৪০ এর ৭ মে ড্রেসডেনে মারা যান, এবং শহরের কেন্দ্র হতে পূর্ব দিকের ট্রিনিটি কবরস্থানে (Trinitatis-Friedhof) তাকে সমাহিত করা হয়, যেখানে মূল অ্যাভিনিউএর বৃত্তকার সীমানার কেন্দ্র হতে উত্তর-পশ্চিমে তার সরল সমতল সমাধিপ্রস্তর শুয়ে রয়েছে। পনের বছরের কিছু সময় পূর্বে তিনি এই কবরস্থানেরই সিংহদ্বারের চিত্রাঙ্কন করেন।
মৃত্যুর আগে থেকেই তার সুনাম ও খ্যাতি ক্ষীণ হয়ে হয়ে আসতে থাকে, আর পৃথিবী ছেড়ে তার চলে যাওয়া শৈল্পিক সম্প্রদায়ে খুব সামান্যই নজরে পড়েছে। তার শিল্পকর্ম নিশ্চিতভাবেই তার জীবদ্দশাতেই স্বীকৃতি লাভ করে, কিন্ত তা কখনোই ব্যাপক পরিসরে নয়। তৎকালীন (contemporary) শিল্পকলায় ভূদৃশ্যাবলীর ঘনিষ্ঠ অধ্যয়ন তথা ব্যাপক চর্চা এবং প্রকৃতির আধ্যাত্মিক উপাদানসমূহের প্রতি ঝোঁকপ্রবণতা ছিল মামুলি বিষয়, সেখানে তার শিল্পকর্মগুলো এতই মৌলিক ও স্বকীয় ছিল যে সেগুলো ভালভাবে বোঝাই যেত না। ১৮৩৮ এর আগে তার আর কোন শিল্পকর্ম বিক্রি হয়নি কিংবা সমালোচকদের মনোযোগও আকর্ষণ করতে পারেনি। রোমান্টিক আন্দোলন প্রথম যুগের ভাবাদর্শকে পাশ কাটিয়ে দূরে সরে যায়, যা শিল্পীকে প্রতিষ্ঠা পেতে সহায়তা করে।
ফ্রিডরিখের মৃত্যুর পর কার্ল গুস্তাভ ক্যারস তার সম্মানার্থে কয়েকটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ রচনা করেন, এতে তিনি ল্যান্ডস্কেপ চিত্রাঙ্কন নিয়মাবলীর ফ্রিডরিখ-রূপান্তর বর্ণনা করেন। যাই হোক, ক্যারসের প্রবন্ধগুলো ফ্রিডরিখকে দৃঢ়ভাবে তার সময়েই উপন্যস্ত করে, তবে ক্রমপ্রবাহমান ঐতিহ্যে কখনোই নয়। তার শুধুমাত্র একটি চিত্রকর্মই ছাপচিত্র হিসেবে পুনরুৎপাদন করা হয়েছিল এবং এর মাত্র কয়েকটি প্রতিরূপ তৈরি করা হয়েছিল।
ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্যের নবাগত শিল্পীরা প্রকৃতিতে শত ডিগ্রি আবর্তের মধ্যে যা দেখে সেটি তারা মাত্র পয়তাল্লিশ ডিগ্রির দৃষ্টিকোণে পরস্পরের উপর নির্দয়ভাবে চাপিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, প্রকৃতি যা বৃহৎ পরিসরে স্বতন্ত্র করে রেখেছে নবাগতরা সেটি এমন এক সংকীর্ণ পরিসরে সংকুচিত করে ফেলে যা দর্শনার্থীর মনে প্রতিকূল ও অশান্তিকর প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়ে তার চোখকে ঠেসে ঠেসে ভরিয়ে ফেলে আর অতিরিক্ততা হেতু অবসাদগ্রস্ত করে তোলে।
— কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ[২৪]
সম্পূর্ণ নব্য রীতিতে ল্যান্ডস্কেপের কল্পনা ও চিত্রাঙ্কন ছিল ফ্রিডরিখের বুনিয়াদি নবোন্মেষ। শুধু ধ্রুপদী ধারণার আলোকে মনোরম দৃশ্যের আনন্দময় উপভোগের অনুসন্ধানই নয় বরং চরম উৎকর্ষতার একটি বিশেষ মুহূর্ত যা প্রকৃতির গভীর চিন্তনের মাঝে স্বতঃস্ফূর্ত আধ্যাত্মিকতার এক পুনর্মিলন সেই মুহূর্তটির অন্বেষণের জন্যও তিনি উদগ্রীব ছিলেন। মানবিক নাটকীয়তার অধীনস্থ কোন প্রেক্ষাপট থেকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আবেগপ্রবণ বিষয়বস্তুতে ভূদৃশ্যকে শিল্পে রূপান্তরের ক্ষেত্রে ফ্রিডরিখ ছিলেন যান্ত্রিক।[২৪] ফ্রিডরিখের চিত্রাঙ্কনে সচরাচর রাকেনফিগার অর্থাৎ পশ্চাদবয়বের প্রয়োগ ঘটেছে, যেখানে একজন ব্যক্তিকে কোন দৃশ্য গভীর পর্যবেক্ষণরত অবস্থায় তার অন্তরাল হতে অবলোকন করা হয়। পর্যবেক্ষককে এখানে নিজেকে রাকেনফিগারের আসনে স্থাপনে উদ্বুদ্ধ করা হয় যাতে মনে হয় তিনি যেন প্রকৃতির চরম উৎকর্ষময় ক্ষমতাকে উপলব্ধি করছেন আর এই দৃশ্যটি যেন অন্য আরেকজন অনুভব ও আদর্শরূপে কল্পনা করছেন।[২৫] ফ্রিডরিখ die romantische Stimmungslandschaft অর্থাৎ রোমান্টিক মেজাজে সমৃদ্ধ ভূদৃশ্যের ধারণার সৃজন করেছেন।[২৬] তার শিল্পকর্মে শিলাময় সমুদ্র তট, অরণ্য ও পার্বত্য-দৃশ্যের মত ভৌগোলিক বিষয়াবলীর বিস্তৃত পরিসরের এক পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণের উপস্থিতি পাওয়া যায়। ধর্মীয় বিষয়-বস্তু প্রকাশে তিনি বহুবার ভূপ্রাকৃতিকদৃশ্যের ব্যবহার করেছেন। তার সময়ে সর্বাধিক-পরিচিত অধিকাংশ চিত্রাঙ্কন ধর্মীয় মরমিবাদের অভিব্যক্তি বা বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গণ্য হত।[২৭]
ফ্রিডরিখ বলেছেন, "একজন শিল্পী তাঁর সম্মুখে কী দেখছেন শুধু এটাই নয়, বরং শিল্পী নিজের মাঝে কী দেখছেন সেটাও তার অঙ্কন করা উচিত। তথাপি তিনি যদি নিজের মাঝে কোন কিছু খুঁজে নাই পান, তাহলে তিনি চোখের সামনে যা দেখছেন সেটা আঁকা থেকে তার নিবৃত থাকা উচিত। অন্যথায় সেই ছবিগুলি হবে ভাঁজ পর্দার আসবাব (folding screens) মতো যেখানে কেবল রুগ্ন বা মৃতের উপস্থিতি পাওয়ারই প্রত্যাশা করা যায়।"[২৯] ঈশ্বরের উপস্থিতির সাক্ষ্য বহনকারী সুবিস্তৃত আকাশ, ঝড়, কুয়াশা, অরণ্য, ধ্বংসস্তুপ ও ক্রুশ ফ্রিডরিখের ল্যান্ডস্কেপের বহুল ব্যবহৃত উপাদান। গ্রিক পুরাণের শ্যারনের ধারণার অনুকরণে উপকূল থেকে দূরগামী নৌকা এবং উঁচু-সরু বৃক্ষের ব্যবহারের মাধ্যমে তার শিল্পকর্মে মৃত্যুর সাঙ্কেতিক দ্যোতনা ঘটলেও দ্য অ্যাবি ইন দ্য ওকউড (১৮০৮-১০) এর মত চিত্রগুলিতে মৃত্যুর ব্যাপারটি আরও প্রত্যক্ষভাবে দৃশ্যমান হয়েছে। শিল্পীর এই চিত্রে ধ্বংসস্তুপের মাঝে উন্মুক্ত সমাধি ছাড়িয়ে গীর্জার তোরণ দিয়ে একটি বধকাষ্ঠের দিকে একদল সন্ন্যাসীর কফিন বহন করার দৃশ্য লক্ষণীয়।
ভূমির কঠিন ও নিষ্প্রাণভাব ফুটিয়ে শীতকালীন দৃশ্যের ল্যান্ডস্কেপ অঙ্কনকারী প্রথম শিল্পীদের মধ্যে তিনি একজন। ফ্রিডরিখের শীতকালীন দৃশ্যগুলো ধর্মীয় ভাবপ্রবণ ও নিস্তব্ধ —— শিল্প ইতিহাসবিদ হারমান বীনকেন এর মতানুসারে, ফ্রিডরিখ এমনই সব শীতকালীন দৃশ্য এঁকেছেন যেগুলোতে “অদ্যাবধি কেউ পা রাখেন নি। নিকট-পুরোনো শীতকালীন সব চিত্রের বিষয়-বস্তু নিজেই শীতকালীন-জীবনের তুলনায় কম শীতকালীন ছিল। ১৭শ ও ১৮শ শতাব্দীতে স্কেটারদের ভিড়, পর্যটকের মত মোটিফকে শিল্পকলা থেকে বাদ দেওয়া অসম্ভব কল্পনা ছিল .... ফ্রিডরিখই প্রথম প্রাকৃতিক জীবনের সম্পূর্ণ আলাদা ও স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য অনুভব করেছেন। অনেকগুলো স্বরের বদলে তিনি একটিরই সন্ধান করেছেন, আর তাই, তাঁর ল্যান্ডস্কেপে তিনি বিমিশ্র রাগকে অধীনস্থ করেছেন একটি একক মৌলিক সুরে।”
মৃত্যুকে প্রতীকায়িত করার মাধ্যমে অনাবৃত ওক গাছ, কাটা গাছের গোড়া ফ্রিডরিখের চিত্রাঙ্কনের উপাদান হিসেবে ঘুরে ফিরে এসেছে যেমন: র্যাভন ট্রী (আনু. ১৮২২), ম্যান অ্যান্ড উম্যান কন্টেমপ্লেটিং দ্য মুন (১৮২৪), এবং উয়িলো বুশ আন্ডার অ্যা সেটিং সান (১৮৩৫) এর মত চিত্রগুলো। হতাশার অনুভূতির বিরুদ্ধে ফ্রীডরিখের মুক্তিকামী প্রতীকগুলো: বধকাষ্ঠ ও পরিচ্ছন্ন আকাশ যা প্রতিশ্রুতি দেয় শাশ্বত জীবনের এবং ক্ষীণ চাঁদ যা ইঙ্গিত দেয় আাশা ও খ্রীষ্টের ক্রমবর্ধমান নৈকট্যের। এছাড়াও পারমার্থিক আশার ইঙ্গিতরূপে, সমুদ্র নিয়ে আঁকা তার চিত্রগুলোতে নোঙরকে সচরাচর তীরভূমিতে দেখা যায়। জার্মান সাহিত্য পণ্ডিত অ্যালিস কুজনিয়ার ফ্রিডরিখের চিত্রাঙ্কনে খুঁজে পেয়েছেন এক অনাধ্যাত্মিকতা (temporality) – সময় উত্তরণের এক আহ্বান, যা দৃশ্য-কলায় (visual arts) কদাচিৎ দৃষ্টিগোচর হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দ্য অ্যাবি ইন দ্য ওকউড চিত্রে উন্মুক্ত সমাধি থেকে বধকাষ্ঠের দিকে ও দিগন্ত পানে সন্ন্যাসীদের গমন ফ্রিডরিখের এই বার্তা জ্ঞাপন করে যে, মৃত্যুর পর মানুষের জীবনের চূড়ান্ত গন্তব্য বিদ্যমান।
ল্যান্ডস্কেপের সুস্পষ্ট থিম গঠনের মাধ্যমে ঊষা ও গোধূলি দিয়ে, ফ্রিডরিখের জীবনের শেষ সময়গুলো উদীয়মান হতশাবাদ দ্বারা বৈশিষ্ট্যায়িত হয়েছে। ভয়ঙ্কর স্মরণিকত্ব প্রকাশের ফলে তার শিল্প কর্ম গভীর হয়েছে। এই সময়ের দ্য রেক অব দ্য হোপ— যা দ্য পোলার সী বা দ্য সী অব আইস (১৮২৩-২৪) নামেও পরিচিত–– খুব সম্ভবত এই চিত্র ফ্রিডরিখের ভাবনা ও লক্ষ্যের সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা, যদিও এমন মৌলিক পদ্ধতির এই শিল্পকর্মটি সাদরে গৃহীত হয়নি। ১৮২৪ এ কাজ শেষ হওয়া এ চিত্রে আর্কটিক মহাসাগরে জাহাজডুবির একটি নির্মম দৃশ্য ফুটে উঠেছে। তার আঁকা চুনাপাথরের ন্যায় সাদা-উজ্জ্বল (travertine-colored) ভাসমান বরফস্তরের করাল গ্রাসে চর্বিত কাঠের জাহাজের টুকরো টুকরো পিষ্ট খণ্ডাংশের ছবি চাক্ষুষ দৃশ্য অপেক্ষা রূপকধর্মী অর্থ ব্যাখ্যা করে: জগতের অপরিসীম ও অবিচলিত ঔদাসিন্যে চূরমার মানুষের আকাঙ্ক্ষার দুর্বল আর্তনাদরূপে।
নন্দনতত্ত্বের উপর ফ্রিডরিখের লেখা ভাষ্য ১৮৩০ সালে নীতিবাক্য (aphorisms) হিসেবে সংকলন করা হয়; এতে তিনি শিল্পীর জন্য শিল্পীর স্বীয় ব্যক্তিত্বের অন্তর্দশনাত্মক সূক্ষ্মানুসন্ধানের সাথে প্রাকৃতিক পর্যবেক্ষণের মেল-বন্ধন ঘটানোর প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেছেন। তার সর্বাধিক-পরিচিত টিপ্পনী থেকে শিল্পীর জন্য পরামর্শ, “তোমার দেহগত চোখ বন্ধ কর যাতে করে প্রথমে পারমার্থিক চোখে নিজের ছবি দেখতে পাও। তারপর অন্ধকারে যা দেখলে তা দিনের আলোয় নিয়ে আস যাতে তা অন্যের প্রতি বাইরে থেকে অন্তরে সাড়া দিতে পারে।” প্রকৃতি নিয়ে আঁকা যেসব চিত্রাঙ্কনে ধূর্ততার আশ্রয় নিয়ে সামর্থ্যকে অতিক্রম করার চেষ্টা করা হয়েছিল (overreaching) তিনি এর সবগুলোই সর্বাংশে-সম্পূর্ণরূপে (in its totality) তিনি প্রত্যাখান করেছেন; এসবের মধ্যে সমকালীন চিত্রশিল্পী যেমন অ্যাডরিয়ান লডউইগ রিখটার (১৮০৩-৮৪) ও জোসেফ অ্যান্টন কখ (১৭৬৪–১৮৩৯) এর সৃষ্টিকর্মও রয়েছে।
ফ্রিডরিখের জীবন ও শিল্প দুটোই নিঃসঙ্গতার দুর্বহ ভাবনা দিয়ে অঙ্কিত বলে মাঝে মাঝে কারও মনে হয়েছে। শিল্প ইতিহাসবিদগণ ও সমকালীন কিছু ব্যক্তিত্ব পৌঢ়ে শিল্পীর এমন নীরস-নিরানন্দ দৃষ্টিভঙ্গির পিছনে যৌবনে স্বজনদের বিচ্ছেদকে কারণ হিসেবে গণ্য করেন। অপরদিকে তার পাণ্ডুর ও পশ্চাৎপদ দৃষ্টিগোচরতা "উত্তরের স্বল্পভাষী ব্যক্তি" এই লোক-প্রচলিত ধারণাকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছে।
ফ্রিডরিখ ১৭৯৯ সালে, ১৮০৩-৫ সালে, আনুমানিক ১৮১৩ সালে, ১৮১৬ সালে এবং ১৮২৪ ও ১৮২৬ সালের মধ্যভাগ এসব বিভিন্ন পর্যায়ে বিষণ্নতায় ভোগেন। এই বিভিন্ন সময়ে তার সৃজিত শিল্পকর্মগুলোতে লক্ষ্যণীয়ভাবে কিছু বিষয়বস্তুগত পালা-পরিবর্তন বিদ্যমান যা শকুন, পেঁচা, সমাধিক্ষেত্র ও ধ্বংসস্তুপের মত মোটিফ ও চিহ্নসমূহের আবির্ভাব ঘটিয়েছে। যখন ১৮২৬ সালে তিনি বর্ণের আরও অস্পষ্ট ও নিঃশব্দ প্রয়োগ করেন তখন থেকে এই মোটিফগুলো তার কাজের ফলাফলের স্থায়ী বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত হয়ে যায় । ক্যারস ১৯২৯এ লিখেন, ফ্রিডরিখ "আধ্যাত্মিক অনিশ্চয়তার ঘন অন্ধকার মেঘে পরিবেষ্টিত", যদিও পূর্বোল্লিখিত শিল্প ইতিহাসবিদ এবং তত্ত্বাবধায়ক হুবার্টাস গ্রাসনার, ফ্রিডরিখের শিল্পকর্মে, ফ্রিম্যাসনরি ও ধর্ম দ্বারা অনুপ্রাণিত ইতিবাচক ও প্রাণোদ্দীপক বিষয় (life-affirming subtext) খুঁজে পেয়ে, এ ধারণার ভিন্ন মত পোষণ করেন।
১৮১৩ সালে ফ্রান্সের পমর্যানিয়া ডোমিনিয়ন দখলের সময়, ফ্রিডরিখের শিল্পকর্মে জার্মান লোকসাহিত্যের মোটিফগুলো, শিল্পীর দেশপ্রেম ও অসন্তোষের প্রতিফলনের মাধ্যমে ক্রমাগত লক্ষণীয় হয়ে উঠে। ফরাসি-বিরোধী জার্মান জাতীয়তাবাদী ফ্রিডরিখ জার্মান সংস্কৃতি, রীতি ও পুরাকথার উদযাপনে দেশীয় ভূদৃশ্যের বিষয়বস্তুগুলোর প্রয়োগ করতেন। আর্নস্ট মরিটজ আর্ন্ড ও থিওডর কর্নারের নেপোলিয়ন-বিরোধী কাব্য এবং অ্যাডাম মুলার ও হেনরিখ ভন ক্লাইস্ট'র দেশাত্মবোধক সাহিত্যের মাধ্যমে তিনি অনুপ্রাণিত হন। ফরাসি বিরোধী যুদ্ধে নিহত তিনজন বন্ধুর মৃত্যু দ্বারা ও ক্লাইস্টের “ডি হারমানশ্ল্যাখট” (১৮০৮) নাটকের দ্বারা আন্দোলিত হয়ে ফ্রিডরিখ কিছু সংখ্যক ল্যান্ডস্কেপ চিত্রাঙ্কনের কাজ হাতে নেন, শুধুমাত্র রাজনৈতিক অর্থ প্রকাশের অভিপ্রায়ে — শিল্পকলার ইতিহাসে যা ছিল প্রথম ঘটনা।
ওল্ড হিরোস গ্রেভস (১৮১২) চিত্রে আরমিনিউস'র নাম খোদিত একটি জীর্ণ স্মৃতিস্তম্ভ, জাতীয়তাবাদের প্রতীকরূপে, জার্মান গোষ্ঠী-সর্দারকে আহ্বান করছে, যেখানে ভূতলশায়ী বীরদের চারটি করব অর্ধোন্মুক্ত; নির্দেশ করছে তাদের আত্মার চিরমুক্তির। একটি গুহার সম্মুখে, প্রস্তর-বেষ্ঠিত গুহার নিচে গভীরে দুজন ফরাসি সৈনিক ক্ষুদ্র পরিসরে দৃশ্যমান; নির্দেশ করছে ওরা যেন স্বর্গ থেকে বহু দূরে। আরেকটি রাজনৈতিক চিত্রাঙ্কন, ফার ফরেস্ট উইথ দ্য ফ্রেঞ্চ ড্র্যাগুন অ্যান্ড দ্য র্যাভন (আনু. ১৮১৩) এ চিত্রিত হয়েছে, ঘন জঙ্গলে ক্ষুদ্রকায় এক নিরুদ্দিষ্ট ফরাসি সৈনিক, যেখানে কাটা গাছের গুড়ির উপর একটি দাঁড়কাক বসে আছে — সর্বনাশের ভবিষ্যদ্বক্তা হিসেবে, ফ্রান্সের প্রতীক্ষিত পরাজয়ের প্রতীকরূপে।
অন্যান্য রোমান্টিক চিত্রশিল্পীদের পাশাপাশি ফ্রিডরিখও ল্যান্ডস্কেপ চিত্রাঙ্কনকে পাশ্চাত্য শিল্পকলার একটি প্রধান শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করেন। ফ্রিডরিখের রীতি সমকালীনদের মধ্যে জোহান ক্রিস্টিয়ান দাল'র (১৭৮৮-১৮৫৭) চিত্রাঙ্কনকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করেছে। পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে আর্নল্ড বখলিন (১৮২৭-১৯০১) তার শিল্পকর্মের দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হন এবং রাশিয়ানদের মধ্যে ফ্রিডরিখের শিল্পকর্মের বলিষ্ঠ উপস্থিতি অনেক রাশিয়ান চিত্রশিল্পীকে প্রভাবিত করে, বিশেষ করে আর্কহিপ কু'ইনজি (আনু. ১৮৪২-১৯১০) এবং আইভান শিশ্কিন (১৮৩২- ৯৮) তাদের মধ্যে অন্যতম। আমেরিকান চিত্রশিল্পীদর মধ্যে যেমন অ্যালবার্ট পিঙ্কহ্যাম রাইডার (১৮৪৭-১৯১৭), রাল্ফ ব্লেকলক (১৮৪৭-১৯১৯), হাডসন রিভার স্কুল চিত্রের শিল্পী থমাস কোল (১৮০১-১৮৪৮) ও লুমিনিজম ধারার (New England Luminists) চিত্রশিল্পের আঁকিয়েরা ফ্রিডরিখের আধ্যাত্মিকতার দ্বারা পূর্বেই প্রভাবিত হন।
বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণে ফ্রিডরিখ, নরওয়েজিয়ান শিল্প ইতিহাসবিদ আন্ড্রিয়্যাস অবার্ট (১৮৫১-১৯১৩) কর্তৃক পুনঃআবিষ্কৃত হন। অবার্ট শিল্পীর কল্পনাপ্রবণ ও রূপকধর্মী ল্যান্ডস্কেপের মূল্যায়ন করেন এবং তার লেখা ফ্রিডরিখকে আধুনিক পণ্ডিত হিসেবে প্রতীকীবাদী চিত্রশিল্পীদের নিকট পরিচয় করিয়ে দেয়। নরওয়েজিয়ান প্রতীকীবাদী এডভার্ড মাঞ্চ (১৮৬৩-১৯৪৪), ১৮৮০ এর দশকে কোন একবার বার্লিন ভ্রমণের সময় ফ্রিডরিখের শিল্পকর্ম দেখে থাকতে পারেন। ১৮৯৯এ মুদ্রিত মাঞ্চ এর "দ্য লোনলি ওয়ানস" চিত্রটি ফ্রিডরিখের Rückenfigur (back figure) এর প্রতিধ্বনি, যদিও মাঞ্চ'র এই শিল্পকর্মে, বিশাল ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্য থেকে লক্ষ্যবিন্দু সরে গিয়েছে ছবি পুরোভাগের দুটো ভগ্নহৃদয় মানবমূর্তির মধ্যে পারস্পরিক বিচ্যুতির অনুভূতির দিকে।
১৯০৬ সালে বার্লিনে রোমান্টিক-যুগের শিল্পকর্মের এক প্রদর্শনীতে ফ্রিডরিখের বত্রিশটি শিল্পকর্মকে মুখ্য বিষয়রূপে দেখানো হলে তার আধুনিক পুনর্জাগরণ গতিবেগ লাভ করে। তার ল্যান্ডস্কেপগুলো জার্মান শিল্পী ম্যাক্স আর্নস্ট (১৮৯১–১৯৭৬) এর শিল্পকর্মের উপর এক শক্তিশালী প্রভাব ফেলে এবং এর ফলে অন্যান্য অধিবাস্তববাদীরা ফ্রিডরিখকে তাদের আন্দোলের একজন অগ্রদূত হিসেবে দেখা শুরু করেন। বেলজিয়ান চিত্রশিল্পী রেনে ম্যাগরিট (১৮৯৮–১৯৬৭) ১৯৩৪ সালে তার দ্য হিউম্যান কন্ডিশন শিল্পকর্মের মাধ্যমে ফ্রিডরিখের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন; এ চিত্রটি দর্শকের উপলব্ধি ও ভূমিকাকে প্রশ্ন করার মাধ্যমে ফ্রিডরিখের শিল্পের মোটিফকে প্রত্যক্ষভাবে প্রতিধ্বনিত করে। কয়েক বছর পর ১৯৩৯ সালে অধিবাস্তববাদী সাময়িকী মিনোটার (Minotaure) এ শিল্প সমালোচক মারি ল্যান্ডসবার্গার, ফ্রিডরিখের শিল্পকর্মকে শিল্পীদের জন্য এক সুদূর বিস্তৃত পরিসর হিসেবে উল্লেখ করেন। আর্নস্ট'র প্রতি অত্যন্ত আগ্রহান্বিত গুণমুগ্ধ পল ন্যাশ (১৮৮৯–১৯৪৬) এর আঁকা টোটেস মিয়ার (Totes Meer বা মৃত সাগর, ১৯৪০-৪১) চিত্রকর্মটিতে The Wreck of Hope (বা The Sea of Ice) এর প্রভাব সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়। মার্ক রথকো (১৯০৩-১৯৭০), গেরহার্ড রিখটার (জন্ম ১৯৩২), গটহার্ড গবনার (১৯৩০-২০১৩), আনজেল্ম কিফার (জন্ম ১৯৪৫) সহ বিংশ শতাব্দীর অন্যান্য প্রধান শিল্পীগণ কর্তৃক ফ্রিডরিখের শিল্পকর্ম অনুপ্রেরণা হিসেবে উদাহৃত হয়েছে। এছাড়াও লেখক স্যামুয়েল বেকেট (১৯০৬-৮৯) ফ্রিডরিখের রোমান্টিক চিত্রগুলো বেছে নিয়েছেন; ম্যান অ্যান্ড উম্যান কন্টেমপ্লেটিং দ্য মুন এর সামনে দাড়িয়ে যিনি বলেন, “এটিই হল ওয়েটিং ফর গডট এর উৎস, আপনি জানেন।” (ওয়টিং ফর গডট হল লেখকের একটি নাটক)।
শিল্প ইতিহাসবিদ রবার্ট রোজেনব্লুম ১৯৬১ সালে মূলত আর্টনিউজে প্রকাশিত তার দ্য অ্যাবস্ট্রাক্ট সাবলাইম নিবন্ধে মার্ক রথকো'র অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রাঙ্কনের সাথে ফ্রিডরিখ ও টার্নার উভয়েরই রোমান্টিক ল্যান্ডস্কেপ চিত্রাঙ্কনের মধ্যে তুলনাঙ্কন করেন। বিশেষ করে ফ্রিডরিখের ১৮০৯ এর দ্য মঙ্ক বাই দ্য সি, টার্নারের দ্য ইভনিং স্টার ও রথকোর ১৯৫৪ এর লাইট, আার্থ অ্যান্ড ব্লু চিত্রগুলোকে রোজেনব্লুম দর্শন ও অনুভূতির ঘনিষ্ট সম্পর্কের প্রকাশক হিসেবে বর্ণনা করেন। রোজেনব্লুম এর মতে, "ফ্রিডরিখ ও টার্নারের ন্যায় রথকো আমাদেরক, উৎকৃষ্টতার (sublime) সৌন্দর্যবেত্তাদের আলোচিত আকারহীন অস্পষ্ট অসীমতার দোরগোড়ায় নিয়ে যান। ফ্রিডরিখের শিল্পকর্মে ক্ষুদ্র সন্ন্যাসী আর টার্নারের ক্ষেত্রে ধীবর, একজন সর্বেশ্বরবাদী ঈশ্বরের বিশালতা ও তাঁর সৃষ্টিসমূহের সীমাহীন ক্ষুদ্রতার মধ্যে মর্মভেদী বৈপরীত্যকে প্রতিষ্ঠা করে। রথকোর বিমূর্ত ভাষায়,---- বাস্তব দর্শক ও অতীন্দ্রিয় ভূপ্রাকৃতিক দৃশ্যের উপস্থাপনার মধ্যে সহানুভূতির সেতুবন্ধনের ন্যায় আক্ষরিক বর্ণনার আর কোন প্রয়োজনই নেই; এখানে আমরা নিজেরাই সমুদ্রের সামনের ঐ সন্ন্যাসীটি, এসব বৃহৎ ও নিঃশব্দ ছবির সামনে নীরবে ও গভীর ধ্যানে দাড়িয়ে, এখানে যেন আমরা দেখছি সূর্যাস্ত কিংবা জ্যোৎস্না শোভিত রাত।
বর্তমানকালীন শিল্পী ক্রিস্টিয়ান পুলি (জন্ম ১৯৮৩) চিলির ইতিহাস পুনর্ব্যাখ্যায়নকারী (reinterpreting) তাঁর ল্যান্ডস্কেপগুলোর জন্য অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ফ্রিডরিখের শিল্পকর্ম থেকে।
১৮৯০ সাল পর্যন্ত, বিশেষকরে ফ্রিডরিখের বন্ধুর মৃত্যুর পর কয়েক দশক যাবত তাঁর শিল্পকর্ম প্রায় বিস্মৃত হয়ে সকলের অন্তরালে ছিল। তবুও ১৮৯০ এর আগেই, বিশেষ করে মধ্য ইউরোপে তাঁর শিল্পকর্মের প্রতীকীবাদ সত্য বলে শৈল্পিক মেজাজে কড়া নাড়তে শুরু করে। যাই হোক, নতুন এক মনোযোগ আকর্ষণ ও মৌলিকত্বের স্বীকৃতি সত্ত্বেও "চিত্রশৈল্পিকতার প্রভাবের" প্রতি তার কদরহীনতা এবং তাকে প্রত্যর্পণ করা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পৃষ্ঠপোষকতা (thinly rendered surfaces) ঐ সময়ের সিদ্ধান্তের (theories) সাথে বিরোধপূর্ণ ছিল।
কেউ আমার দৃঢ়-প্রত্যয়ের বিরুদ্ধে গেলেও যুগের দাবির প্রতি বশ্যতা স্বীকার করার মতো দুর্বল আমি নই। আমার চারপাশটা আমি একটি কাকুনে আবৃত করে নিয়েছি; অন্যদেরও তাই করতে দিয়েছি। আমি এর বিচারের ভার দিব সময়কে; সময়ই বলে দেবে এটা থেকে কী বের হবে, দ্যুতিময় প্রজাপতি না শূককীট।
— কাসপার ডাভিড ফ্রিডরিখ[৩২]
১৯৩০ এর দশকব্যাপী ফ্রিডরিখের শিল্পকর্মকে নাৎসি আদর্শবাদের উত্তরণে ব্যবহার করা হত এবং এর মাধ্যমে এই রোমান্টিক শিল্পীকে নাৎসি জাতীয়তাবাদী ব্লুট উন্ড বুড্ন (রক্ত ও মাটি) স্লোগানের অন্তর্ভুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। নাৎসিবাদের সাথে তাকে সংযুক্ত করে দেওয়ার ফলে দশকের পর দশক লেগে যায় তার সুনাম পুনরুদ্ধার হতে। আধুনিকতাবাদের সংকীর্ণ সংজ্ঞা হতে প্রতীকীবাদের প্রতি তার আস্থার এবং (সত্যিটা এই যে) তার শিল্পকর্মের বাইরে ছিটকে পড়া তার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামায় বড় ভূমিকা রেখেছে। ১৯৪৯ এ শিল্প ইতিহাসবিদ কেনেথ ক্লার্ক লিখেন যে, "ফ্রিডরিখ তাঁর সময়ের এমন প্রাণহীন শীতল কৌশলে শিল্প চর্চা করতেন যা আধুনিক চিত্রাঙ্কনের কোন বিদ্যালয়কে কদাচিৎ অনুপ্রাণিত করতে পারত।" এবং তিনি ধারণা করেন যে, কাব্যের পর যা কিছু সর্বোত্তম শিল্পী চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে তাই প্রকাশের চেষ্টা করতেন। ক্লার্ক কর্তৃক ফ্রিডরিখের বর্জন শিল্পীর সুনামহানীর মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়ে গত ১৯৩০ এর দশকব্যাপী অব্যাহত থাকে।
হলিউডের কয়েকজন পরিচালক (তাদের মধ্যে ওয়াল্ট ডিজনিও আছেন) ফ্রিডরিখের চিত্রাবলী গ্রহণ করলে, জার্মান চলচ্চিত্র জগতের প্রভু যেমন ফ্রিৎজ লাং ও এফ. ডব্লিউ. মুর্নাও হরর ও ফ্যান্টসি চলচ্চিত্রের জন্য এসব চিত্রাবলীর নির্মাণ করলে ফ্রিডরিখের মর্যাদার আরও অবনমন ঘটে। তার পুনর্বাসন হয়েছে ধীরগতিতে, কিন্তু ওয়ার্নার হফম্যান, হেলমুট বোর্শ-সুপন ও সিগ্রিড হিঞ্জের ন্যায় সমালোচক ও পণ্ডিতদের লেখনীর মাধ্যমে তাতে গতি আসে। এসব পণ্ডিত ফ্রিডরিখের শিল্পকর্মের উপর আরোপিত রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগকে সফলতার সাথে বাতিল ও খণ্ডন করে একে সম্পূর্ণরূপে এক শিল্পৈতিহাসিক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। নতুন প্রজন্মের সমালোচক ও শিল্প ইতিহাসবিদদের সুনজর লাভ করায় ১৯৭০এর দশক আসতে না আসতেই পুনরায় বিশ্বব্যাপী বড় বড় গ্যালারিতে তার প্রদর্শনী শুরু হয়ে যায়।
আজ তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি সুপ্রতিষ্ঠিত। তার স্বদেশ জার্মানিতে তিনি এখন জাতীয় আইকন এবং পাশ্চাত্য জগৎব্যাপী শিল্প ইতিহাসবিদ ও শিল্পবোদ্ধাদের নিকট উচ্চ মর্যাদাসীন। তাকে সচরাচর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার এক বিশাল চরিত্র হিসেবে দেখা হয়। ভনের মতানুসারে, "তিনি সন্দেহের সাথে সংগ্রামকারী একজন বিশ্বাসী, অন্ধকার দ্বারা অধিষ্ঠিত সৌন্দর্যের একজন উদযাপক। পরিশেষে, তাঁর চিত্রাবলীর বাধ্যকারী আহ্বানের মাধ্যমে, কৃষ্টির ওপারে পৌঁছে গিয়ে, তিনি সকল ব্যাখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছেন। যথার্থরূপেই তিনি একটি প্রজাপতির মতই উদিত হয়েছেন, যে প্রজাপতিটি আর কখনোই আমাদের দৃষ্টি থেকে উধাও হবেনা—— যা আমাদের প্রত্যাশা।”
ফ্রিডরিখ একজন ফলপ্রসূ শিল্পী ছিলেন। তিনি ৫০০ এরও বেশি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শিল্পকর্ম সৃজন করেন। সমকালীন রোমান্টিক ভাবাদর্শের সমানতালে তিনি তার চিত্রগুলোকে বিশুদ্ধ নান্দনিকতার বহিঃপ্রকাশরূপে বাস্তবায়নে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন, তাই তিনি তার সৃষ্টিকর্মের শিরোনামগুলো যাতে খুব বর্ণনাত্মক ও স্মৃতি-উদ্দীপক না হয়ে যায় সে ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। যেমন: স্টেজেস অব লাইফ শিরোনামটি ফ্রিডরিখ নিজে দেননি, তার কোন এক পুনরূজ্জীবনকালে এ শিরোনামটি গ্রহণ করা হয়; শিরোনামটি আজকের দিনের আরও-আক্ষরিক শিরোনামগুলোর সম পর্যায়ের। তার শিল্পকর্মগুলোর সময় নির্ধারণ করতে গেলে জটিলতা বৃদ্ধি পায়, তিনি প্রায়শই তার ক্যানভাসগুলোতে তাৎক্ষণিকভাবে নাম বা তারিখ বসাতেন না যা এই জটিলতার জন্য আংশিকভাবে দায়ী। তা সত্ত্বেও ফ্রিডরিখ তার কাজের ফলাফলের বিস্তারিত বিবরণ একটি নোটবুকে টুকে রাখতেন; পণ্ডিতেরা তার চিত্রগুলোর পরিপূরক তারিখ নির্ধারণে এ নোটবুক ব্যবহার করেছেন।
বহিঃস্থ ভিডিও | |
---|---|
![]() | |
![]() | |
![]() all from Smarthistory |