কুমারটুলি কুমোরটুলি | |
---|---|
কলকাতার পাড়া | |
স্থানাঙ্ক: ২৩°৪৮′ উত্তর ৮৮°১৫′ পূর্ব / ২৩.৮° উত্তর ৮৮.২৫° পূর্ব | |
দেশ | ভারত |
রাজ্য | পশ্চিমবঙ্গ |
শহর | কলকাতা |
ওয়ার্ড |
|
নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন | শোভাবাজার সুতানুটি |
সময় অঞ্চল | IST (ইউটিসি+5:30) |
এলাকা কোড | +91 33 |
কুমারটুলি, কথ্য উচ্চারণে কুমোরটুলি, কলকাতার উত্তরভাগে অবস্থিত একটি পাড়া। এই অঞ্চলটি ‘পটুয়াপাড়া’ বা মৃৎশিল্পীদের বসতি অঞ্চল হিসেবে বিখ্যাত। কুমারটুলি অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের দক্ষতার কথা সর্বজনবিদিত। কলকাতার এই অঞ্চল থেকে দেবীদেবতার প্রতিমা কেবলমাত্র শহরের সর্বজনীন ও ঘরোয়া পুজোর জন্যই সরবরাহ করা হয় না, অনেক ক্ষেত্রেই তা দেশের বাইরেও রপ্তানি করা হয়। কুমারটুলি পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত হস্তশিল্প (মৃৎশিল্প) কেন্দ্রও বটে।
শোভাবাজার সুতানুটিতে অবস্থিত কুমোরটুলি ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে। ১৭ শতকের গোরা থেকে কুমোরটুলির ইতিহাস ওয়েব্যাক মেশিনে আর্কাইভকৃত ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে যখন কৃষ্ণনগর থেকে কুমোররা এসে বসবাস করতে শুরু করেছিল কলকাতায়। প্রথম দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল ১৬০৬ সালে। অবিভক্ত বাংলার নদিয়া জেলার মহারাজা ভবানী মজুমদার দুর্গাপুজোর প্রচলন করেন। পরে নবদ্বীপ,শান্তিপুর, কৃষ্ণনগর(পূর্ব নাম রেউই গ্রাম) থেকে কুমোররা ভালো আয়ের আসায় এই কলকাতায় বসবাস করতে শুরু করেন। এরপর ১৭৫৭ সালে শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেব কলকাতায় দুর্গাপুজো শুরু করেন। তখনকার দিনে কুমোররা জানত না যে সিংহ কি রকম দেখতে হয় তাই রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ির দুর্গা প্রতিমায় সিংহের জায়গায় ঘোড়ার রূপ দেওয়া হয়। সেটির প্রচলন আজ অব্দি অব্যাহত। [১]
১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে জয়লাভের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোনিবেশ করে। গোবিন্দপুর গ্রামে কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই অঞ্চলের বাসিন্দাদের সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সুতানুটি অঞ্চলে। গোবিন্দপুরের ধনিক সম্প্রদায় পাথুরিয়াঘাটা ও জোড়াসাঁকো অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে। এর পাশাপাশি গড়ে ওঠে অন্যান্য কয়েকটি অঞ্চলও।[২]
কোম্পানির ডিরেক্টরদের আদেশানুসারে জন জেফানিয়া হলওয়েল ‘কোম্পানির মজুরদের জন্য পৃথক পৃথক অঞ্চল’ (‘separate districts to the Company’s workmen’) বণ্টন করেন। এইভাবে কলকাতার দেশীয়দের অঞ্চলগুলি বিভিন্ন পেশাভিত্তিক পাড়ায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এইভাবেই শুঁড়িপাড়া, কলুটোলা, ছুতারপাড়া, আহিরীটোলা ও কুমারটুলি প্রভৃতি অঞ্চলের উৎপত্তি ঘটে।[৩]
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বড়বাজার অঞ্চলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে উত্তর কলকাতার মৃৎশিল্পীরা শহর ছেড়ে চলে যান।[৪] কিন্তু কুমারটুলির পটুয়ারা, যাঁরা গঙ্গামাটি সংগ্রহ করে মাটির পাত্র ইত্যাদি তৈরি করে সুতানুটি বাজারে (অধুনা বড়বাজার) বিক্রি করতেন, তারা টিকে যান। পরবর্তীকালে তারা ধনী সম্প্রদায়ের বাড়ির পূজার নিমিত্ত দেবদেবীর প্রতিমা নির্মাণ করতে শুরু করেন। কলকাতা ও বাইরে বারোয়ারি বা সার্বজনীন পূজার প্রচলন হলে পূজাকমিটিগুলি কুমারটুলি থেকে প্রতিমা সংগ্রহ করতে থাকেন।[৫]
কুমারটুলি পাড়ায় অতীতের কলকাতার বহু বিশিষ্ট ব্যক্তির বাসস্থান ছিল। ১৭০০ সালে কুমারটুলির নন্দরাম সেন কলকাতার প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত হন। তাকে ব্ল্যাক ডেপুটি বলা হত।[৬] কুমারটুলি অঞ্চলে বর্তমানে তার নামে একটি রাস্তা আছে। পরবর্তী ব্ল্যাক ডেপুটি গোবিন্দরাম মিত্র এই অঞ্চলে ৫০ বিঘা (১৬ একর) জমিতে এক বিরাট প্রাসাদোপম বাড়ি নির্মাণ করেছিলেন।[৭]
লৌকিক ছড়ায় উল্লিখিত বনমালী সরকারের বাড়ি ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত কুমারটুলিতে অবস্থিত ছিল। কুমারটুলিতে তার নামে একটি গলিপথ রয়েছে।[৮] এছাড়া কলকাতার বিখ্যাত মৃৎশিল্পীদের অধিকাংশই কুমারটুলিতে বাস করেন।
জনপ্রিয় লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছেলেবেলা কেটেছিল এই অঞ্চলে। একটি ইংরেজি পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,
কলকাতা পৌরএলাকার ৯ নং ওয়ার্ডে কুমারটুলি অবস্থিত। এই অঞ্চলের পূর্বে রবীন্দ্র সরণি ও পশ্চিমে হুগলি নদী। পাড়াটি আহিরীটোলা ও শোভাবাজারের মধ্যবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত।[১০] পুরনো কলকাতার মানচিত্রে এই অঞ্চলটিকে শ্যামপুকুর, বড়তলা, জোড়াসাঁকো ও জোড়াবাগান থানা এবং হুগলি নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রদর্শিত হয়েছে।[১১]
কুমারটুলির শিল্পীদের দুর্গাপ্রতিমার বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। বর্তমানকালে কুমারটুলির দুর্গাপ্রতিমা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, জাপান, ইতালি, মালয়েশিয়া, সুইডেন এবং আফ্রিকার প্রবাসী বাঙালিদের কাছে সরবরাহ করা হয়। ১৯৮৪ সালে প্রতিমা শিল্পী গোরা চাঁদ পাল এর প্রথম তৈরি করা মাটির দুর্গাপ্রতিমা লন্ডনে রপ্তানি করা হয়। যেটা শিল্পপতি লক্ষী মিত্তালের পুজো বলে পরিচিত। প্রেরণের ক্ষেত্রে আদর্শ ছিল।[১২]
২০০৬ সালে কুমারটুলি থেকে ১২,৩০০টি দুর্গাপ্রতিমা সরবরাহ করা হয়। প্রতি বছর বিশ্বের ৯৩টি দেশে কলকাতার এই পটুয়াপাড়া থেকে প্রতিমা প্রেরণ করা হয়ে থাকে। এই সংখ্যা বর্তমানে আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেক পূর্ব ইউরোপীয় দেশ, যেখানে পূর্বে ধর্মীয় উৎসব নিষিদ্ধ ছিল, সেখান থেকেও এখন অনেক বরাত আসে। কুমারটুলি শিল্পী সংঘের এক মুখপাত্রের মতে, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, রাশিয়া, অস্ট্রিয়া ও পোল্যান্ড থেকে অনেক অনাবাসী ভারতীয় কলকাতায় এসে দুর্গাপ্রতিমা কিনে নিয়ে যান। আবার বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া, বেঙ্গলি অ্যাসোসিয়েশন অফ গ্রেটার শিকাগো, দক্ষিণী, সংস্কৃতি, গার্ডেন স্টেট পূজা কমিটি অফ নিউ জার্সি, ইস্ট কোস্ট দুর্গা পূজা কমিটি অফ নিউ ইয়র্ক প্রভৃতি সংস্থার পক্ষ থেকে মার্কিননিবাসী ভারতীয়েরা কুমারটুলিতে এসে প্রতিমা পছন্দ করে নিয়ে যান। এছাড়া কলকাতায় অনাবাসীদের প্রতিমা কেনায় সাহায্য করার জন্য শতাধিক এজেন্টও কাজ করেন।[১৩]
যদিও কুমারটুলির প্রতিমাশিল্পীরা অনেকেই দারিদ্র্যের মধ্যে দিনযাপন করেন। কুমারটুলির প্রতিমাশিল্পীদের মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় হলেন মোহনবাঁশী রুদ্রপাল ও তার দুই পুত্র সনাতন রুদ্রপাল ও প্রদীপ রুদ্রপাল, গোরা চাঁদ পাল, প্রদ্যোৎ পাল, রাখাল পাল, গণেশ পাল, অলোক সেন, কার্তিক পাল, কেনা পাল প্রমুখ। বর্তমান যুগে ‘থিম শিল্পী’দের রমরমা সত্ত্বেও সনাতন প্রতিমার গুণগ্রাহী আজও কুমারটুলির মৃৎশিল্পীদের দিয়ে প্রতিমা নির্মাণ করান। পুরুষদের পাশাপাশি কুমারটুলিতে প্রায় ৩০ জন মহিলা প্রতিমাশিল্পী রয়েছেন। এঁদের মধ্যে মিনতি পাল, সোমা পাল, কাঞ্চী পাল ও চম্পারাণী পাল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এঁরা দীর্ঘকাল ধরে প্রতিমানির্মাণ শিল্পের সঙ্গে জড়িত।[১৪] কুমারটুলি অঞ্চলের নিজস্ব সর্বজনীন দুর্গাপূজার সূচনা হয় ১৯৩৩ সালে। সেযুগের বিশিষ্ট প্রতিমাশিল্পী গোপেশ্বর পাল ছিলেন কুমারটুলি সর্বজনীনের প্রতিমার নির্মাতা।[১২]