কুমারসম্ভবম্ বিশিষ্ট সংস্কৃত কবি ও নাট্যকার কালিদাস বিরচিত একটি কাব্য। এই কাব্যের মূল উপজীব্য তারকাসুর বধের নিমিত্ত শিব ও পার্বতীর পুত্ররূপে কার্তিকেয়ের জন্মবিবরণ। কাব্যটির রচনাকাল সঠিক জানা না গেলেও এটিকে গুপ্তযুগের রচনা বলে মনে করা হয়। কাব্যের বিষয়বস্তু গৃহীত হয়েছে রামায়ণ, মহাভারত ও বিভিন্ন পুরাণগ্রন্থ থেকে। সপ্তদশ সর্গবিশিষ্ট এই কাব্যের অষ্টম বা নবম সর্গের পরবর্তী অংশটিকে অনেক বিশেষজ্ঞই পরবর্তীকালের প্রক্ষিপ্ত সংযোজন মনে করে থাকেন।
কুমারসম্ভবম্ নামটির অর্থ হল "কার্তিকেয়ের জন্মবৃত্তান্ত"। উল্লেখ্য, "কুমার" হিন্দু দেবসেনাপতি কার্তিকেয়ের অপর নাম এবং সংস্কৃত ভাষায় "সম্ভব" কথাটির অর্থ জন্ম।[১] জ্যোতিভূষণ চাকীর মতে, কাব্যটির নামকরণের উৎস হল বাল্মীকি রচিত রামায়ণের নিম্নোক্ত শ্লোকটি:[২]
এষ তে রামগঙ্গায়াঃ বিস্তরোঽভিহিতো ময়া।
কুমারসম্ভবশ্চৈব ধন্য পুণ্যস্তয়ৈব চ।। (১।৩৭।৩১)বঙ্গানুবাদ: "রাম! এই আমি [বিশ্বামিত্র] তোমাকে গঙ্গার বৃত্তান্ত ও কার্ত্তিকেয়ের উৎপত্তি সবিস্তারে কহিলাম। এই পৃথিবীতে যে মনুষ্য কার্তিকেয়ের ভক্ত হয়, সে দীর্ঘ আয়ু ও পুত্র-পৌত্র লাভ করিয়া তাঁহার সহিত এক লোকে বাস করিয়া থাকে।" [৩]
হিন্দুপুরাণে কার্তিকেয়ের একাধিক নাম প্রচলিত রয়েছে। অধ্যাপিকা অমিতা চক্রবর্তীর মতে, এই সকল নামের মধ্যে থেকে কুমার নামটির গ্রহণ তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি মৎস্যপুরাণের একটি শ্লোকের[৪] উল্লেখ করে দেখিয়েছেন "কুৎসিত দৈত্যদের নিধনকর্তাই হলেন কু-মার"।[৫]
কুমারসম্ভবম্ কাব্যের মূল কাহিনিটি রামায়ণ, মহাভারত, মৎস্যপুরাণ, ব্রহ্মাপুরাণ, সৌরপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও শিবপুরাণ থেকে গৃহীত।[১] মহাভারতের বনপর্বে কাহিনিটি বিশদ আকারে বর্ণিত হয়েছে; এছাড়া অনুশাসনপর্ব ও শল্যপর্বেও এর উল্লেখ রয়েছে।[১] শিবপুরাণ ও কুমারসম্ভবম্ কাব্যের কাহিনিবর্ণনা ও বহু শ্লোকের মধ্যে হুবহু মিল পাওয়া যায়; অনুমিত হয় পুরাণকার এই ক্ষেত্রে কালিদাসের রচনার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।[১] তবে রামায়ণ ও মহাভারতের বর্ণনার সঙ্গে কালিদাসের বর্ণনার কিছু অমিল পাওয়া যায়। আবার পুরাণ ও উপপুরাণগুলির কাল যথাযথ নির্ণয় সম্ভবপর হয়নি বলে, কালিদাস পুরাণ দ্বারা আদৌ প্রভাবিত হয়েছিলেন কিনা সেকথা নিশ্চিত করে বলা যায় না।[১][২]
জ্যোতিভূষণ চাকীর মতে, কুমারসম্ভবম্ কাব্যের মূল উৎস ব্রহ্মপুরাণ, কালিকাপুরাণ ও শিবপুরাণ। এছাড়াও স্কন্দপুরাণের "শিবরহস্য" অংশের সঙ্গেও এই কাব্যের সাদৃশ্য লক্ষিত হয়।[২]
কুমারসম্ভবম্ কাব্য মোট সতেরোটি সর্গে বিভক্ত। অপরমতে মূল কাব্যটি মোট বাইশটি সর্গে লিখিত হয়েছিল।[১] তবে গবেষকগণ সম্পূর্ণ কাব্যটিকে কালিদাসের রচনা বলে মনে করেন না। প্রথম আটটি সর্গই যে কালিদাসের রচনা এই ব্যাপারে পণ্ডিতেরা একমত।[২] অবশ্য অন্য একটি মতে, কালিদাস সপ্তম সর্গ পর্যন্ত এই কাব্য রচনা করেছিলেন।[১] ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরও সপ্তম সর্গ পর্যন্তই কালিদাসের রচনা বলে মনে করতেন।[৬] টীকাকার মল্লিনাথ ও অরুণগিরি অষ্টম সর্গ পর্যন্ত টীকা রচনা করেছেন।[১]
কুমারসম্ভবম্ কাব্যের প্রথম সর্গে রয়েছে: দক্ষ প্রজাপতির কন্যা দাক্ষায়ণী সতী পিতার মুখে স্বামী শিবের নিন্দা শুনে প্রাণত্যাগ করেন। কালান্তরে তিনি গিরিরাজ হিমালয় ও তার পত্নী মেনকার কন্যা পার্বতীর রূপে পুনরায় জন্মগ্রহণ করেন। পার্বতী যৌবনপ্রাপ্ত হলে দেবর্ষি নারদ গিরিরাজের নিকট পার্বতীর পতি রূপে শিবের নাম উত্থাপন করেন। এদিকে সতীর দেহত্যাগের পর শিব হিমালয়ের গুহায় নিভৃতে তপস্যায় রত। পিতার নির্দেশে পার্বতী তাই দুই সখিকে নিয়ে শিবের পূজার্চনায় রত হলেন।
কাব্যের দ্বিতীয় সর্গে স্থান পেয়েছে তারকাসুরের কাহিনি। পার্বতী যখন শিবের আরাধনায় মগ্ন সেই সময় তারকাসুরের অত্যাচারে নিপীড়িত দেবগণ স্বর্গভ্রষ্ট হয়ে ব্রহ্মার শরণাপন্ন হলেন। ব্রহ্মা তাদের বললেন, ইতঃপূর্বে তারকাসুরের তপস্যায় সৃষ্টি ছাড়খাড় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় তিনি সেই অসুরকে দেবতাদের অবধ্য হওয়ার বর দিয়েছিলেন। তবে ভবিষ্যতে কোনো শিশু তার যুদ্ধ করতে এলে, সে সেই শিশুর হাতে পরাস্ত হবে, এমন অঙ্গীকারও তিনি তারকাসুরকে দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন। এই জন্য ব্রহ্মা দেবতাদের বললেন:
তস্যাত্মা শিতিকণ্ঠস্য সৈনাপত্যমুপেত্য বা।
মোক্ষ্যতে সুরবন্দীনাং বেনীবীর্য-বিভূতিভিঃ।।
(কুমারসম্ভবম্ ২।৬১)অর্থাৎ, উমা ও নীলকণ্ঠের পুত্র দেবসেনাপতি হয়ে বন্দিনী স্বর্গনারীদের উদ্ধার করবেন। অতএব মহাদেব যাতে পার্বতীর প্রতি আকৃষ্ট হন সেই চেষ্টাই করা উচিত।
তৃতীয় সর্গ থেকে অষ্টম সর্গের মধ্যে নানা ঘাতপ্রতিঘাতে শিব ও পার্বতীর বিবাহ সম্পন্ন হওয়ার কাহিনি বর্ণিত হয়েছে। ইন্দ্রের আদেশে ঋতুরাজ বসন্তকে সঙ্গে নিয়ে কাম শিবের ধ্যানভঙ্গ করতে গেলেন। পার্বতী শিবের সম্মুখে পূজা দিতে উপস্থিত হলে, কাম পুষ্পশর নিক্ষেপ করে শিবের হৃদয়ে কামনার সঞ্চার করতে গেলেন। কিন্তু কামের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হল। রুষ্ট শিব তৃতীয় নয়নের অগ্নিতে কামকে ভস্ম করলেন। স্বামীর শোকে কামপত্নী রতি আত্মবিসর্জন দিতে গেলে সহসা দৈববাণী হল – শিব ও পার্বতীর বিবাহ হলে শিবের বরে কামদেব পুনরায় প্রাণ ফিরে পাবেন। আশ্বস্তা হয়ে রতি তার সংকল্প পরিত্যাগ করলেন।
এদিকে আপন রূপলাবণ্যে অভীষ্ট দেবতাকে জয় করতে অসমর্থ হয়ে পার্বতী কঠোর তপস্যায় রত হলেন। পার্বতীর তপশ্চর্যায় প্রীত হয়ে শিব তরুণ সন্ন্যাসীর বেশে তাকে পরীক্ষা করতে এলেন। অবশেষে শিবের প্রতি পার্বতীর ঐকান্তিক নিষ্ঠায় সন্তুষ্ট হয়ে শিব তার সম্মুখে আত্মপ্রকাশ করলেন এবং তাকে পত্নীরূপে কামনা করলেন। অরুন্ধতী সহ অঙ্গিরা, বশিষ্ট, অত্রি প্রমুখ সপ্তঋষি হিমালয়ের নিকট শিব ও পার্বতীর বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। হিমালয় সানন্দে সেই প্রস্তাব অনুমোদন করলেন। হিমালয়ের রাজধানী ও কৈলাসে উৎসবের সাড়া পড়ে গেল। শুভদিনে শিব ব্যাঘ্রচর্মে সজ্জিত হয়ে, বাহন নন্দীর পৃষ্ঠে আরোহণ করে, অষ্টমাতৃকা, মহাকালী ও প্রমথগণকে সঙ্গে নিয়ে বিবাহযাত্রা করলেন। শিব ও পার্বতীর বিবাহে পৌরোহিত্য করলেন সপ্তঋষিগণ। সঙ্গীত পরিবেশন করলেন গন্ধর্বগণ। তারপর বরবধূ ফিরে এলেন কৈলাসে।
নবম সর্গের উপজীব্য অগ্নির অভিশপ্ত হওয়ার ইতিবৃত্ত। কৈলাসের অরণ্য ও গিরিগুহায় শিব-পার্বতীর মধুর দাম্পত্য জীবনের দিনগুলি অতিবাহিত হতে লাগল। একদিন গিরিগুহায় উভয়ে রতিক্রিয়ার মগ্ন, এমন সময় সেখানে আবির্ভাব ঘটল অগ্নির। তার উপস্থিতিতে শিবের বীর্য সহসা স্খলিত হল। পার্বতী সেই শিবশক্তি ধারণে অক্ষম হয়ে তা অগ্নিতে নিক্ষেপ করলেন। এদিকে রতিক্রিয়ায় বাধাদানের জন্য ক্রুদ্ধ শিব ও পার্বতী অগ্নিকে অভিশাপ দিলেন। অগ্নি বিকৃতরূপ ধারণ করলেন।
দশম সর্গে অগ্নি অন্যান্য দেবতাদের নিকট উপস্থিত হয়ে সকল বৃত্তান্ত জানালে তারা গঙ্গায় স্নান করে অগ্নিকে পবিত্র হতে বললেন। অগ্নি গঙ্গায় শিবের বীর্য নিক্ষেপ করে নিজের পূর্বরূপ ফিরে পেলেন। এরপর ছয় কৃত্তিকা গঙ্গাস্নান করতে এলে শিববীর্যের তেজ তাদের শরীরে সংক্রমিত হয়ে তারা গর্ভবতী হলেন। লজ্জিতা কৃত্তিকারা নিকটস্থ শরবনে গর্ভমোচন করে প্রস্থান করলে ছয় কৃত্তিকার নিক্ষিপ্ত গর্ভ থেকে ছয়মুখবিশিষ্ট এক তেজোময় শিশুর জন্ম হল – ইনিই ষড়ানন কার্তিকেয়।
একাদশ সর্গে রয়েছে: কিছুকাল গঙ্গাই এই পুত্রকে পালন করলেন। পরে শিব ও পার্বতী সেখানে এলে শিশুটির প্রতি পার্বতীর আগ্রহ জাগল। তা দেখে শিব পার্বতীর নিকট শিশুটির জন্মবৃত্তান্ত বর্ণনা করলেন। পার্বতী শিশুটিকে কোলে নিয়ে তাকে স্তন্যপান করালেন। শিশুটি তার স্তন্যপান করে নবজীবন লাভ করল এবং মাত্র ছ’দিনেই নবযৌবন প্রাপ্ত হয়ে সর্বশাস্ত্র ও শস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠল।
দ্বাদশ সর্গে তারকাসুর পীড়িত ইন্দ্র কৈলাসে উপস্থিত হয়ে শিবকে প্রণাম করে বললেন:
স্তুত্যা পুরাস্মাভিরুপাসিতেন পিতানমঽএতি নিরূপিতং নঃ।
সেনাপতিঃ সংযতি দৈত্যমেতং পুরঃ স্মরারাতি সুতো নিহন্তি।।
(কুমারসম্ভবম্ ১২।৪৭)অর্থাৎ, পূর্বে পিতামহ ব্রহ্মার উপাসনা করায় তিনি জানিয়েছিলেন, মদনভস্মকারী মহাদেবের পুত্র সেনাপতি হয়ে ঐ দৈত্যকে পরাস্ত করবেন।
ইন্দ্র শিবের কাছে প্রার্থনা করলেন যাতে তিনি কার্তিকেয়কে প্রেরণ করে তারকাসুরকে ধ্বংস করতে সহায়তা করেন। শিব পুত্রকে আদেশ করলেন দেবতাদের উদ্ধার করার জন্য। কুমারও পিতৃআজ্ঞা শিরোধার্য করে স্বর্গলোকের পথে যাত্রা করল।
কুমারসম্ভবম্ কাব্যের প্রায় পঞ্চাশজন টীকাকারের উল্লেখ পাওয়া যায়। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নরহরি, ভরতসেন, ভরতমল্লিক, মল্লিনাথ, বল্লভদেব, গোবিন্দরাম, জিনভদ্রসুরি, দক্ষিণাবর্তনাথ, বিদ্যামাধব, অরুণগিরিনাথ, সরস্বতী তীর্থ, হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ, জীবানন্দ প্রমুখ।[১]
কুমারসম্ভবম্ কাব্যের অষ্টম সর্গে হরপার্বতীর সম্ভোগ-শৃঙ্গারের যে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে প্রাচীনপন্থী গবেষকগণ তার বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ এনেছেন। তাদের মতে এই রচনাংশটুকু কালিদাসের মৌলিক রচনা নয়, কোনো অজ্ঞাতনামা লেখকের সংযোজন। ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য এই বর্ণনাকে "কামশাস্ত্রের প্রথানুগ বর্ণনামাত্র" বলে উল্লেখ করেছেন।[১]
দীপ্তো মারয়িতুং দৈত্যান্ কুৎসিতান্ কনকচ্ছবিঃ।
এতস্মাৎ কারণাদ্ধেব কুমারশ্চাপি সোঽভবৎ।। (মৎস্যপুরাণ ১৫৮।৪১)