কুমিল্লা জেলা (আদিনাম কমলাঙ্ক এর অপভ্রংশ, যার অর্থ পদ্মফুলের দীঘি) বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এটি খাদি কাপড় ও রসমালাইয়ের জন্য বিখ্যাত। উপজেলার সংখ্যানুসারে কুমিল্লা বাংলাদেশের একটি “এ” শ্রেণিভুক্ত একটি জেলা।[২]
কুমিল্লা প্রাচীনকালে সমতট জনপদের অংশ ছিল। ১৭৩৩ সালে বাংলার নবাব সুজাউদ্দিন খান ত্রিপুরা রাজ্য বিজয় করে এর সমতল অংশ সুবাহ বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ত্রিপুরা দখল করে। ১৭৬৯ সালে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে কোম্পানী একজন তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ করে। তখন ঢাকা প্রদেশের অন্তর্গত ছিল কুমিল্লা। কুমিল্লাকে ১৭৭৬ সালে কালেক্টরের অধীনস্থ করা হয়। ১৭৯০ সালে কোম্পানী শাসনামলে ত্রিপুরা নামের জেলার সৃষ্টি হয় করা হয়। তৎকালে বর্তমান কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মনবাড়িয়া, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, শাহবাজপুর, হাতিয়া, ত্রিপুরার কিছু অংশ, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ ও মীরসরাই নিয়ে সমতল অঞ্চল নিয়ে ত্রিপুরা জেলা ও পার্বত্য অঞ্চল নিয়ে পার্বত্য ত্রিপুরা নামে ভাগ করা হয়, এই জেলার সদর দপ্তর স্থাপিত হয় কুমিল্লায়। ১৮২১ সালে ত্রিপুরা জেলাকে ভাগ করে বর্তমান নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষীপুর নিয়ে ভূলুয়া জেলা গঠিত হয়, যা পরবর্তীতে নোয়াখালী নামকরণ করা হয়। ১৯৬০ সালে সদর দপ্তরের নামানুসারে ত্রিপুরা জেলার নামকরণ করা হয় কুমিল্লা এবং তখন থেকে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও কালেক্টর পদটির নামকরণ জেলা প্রশাসক করা হয়। ১৯৮৪ সালে কুমিল্লার দু'টি মহকুমা চাঁদপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে পৃথক জেলা হিসেবে পুনর্গঠন করা হয়।[৪]
বর্তমান কুমিল্লা জেলা চট্টগ্রাম বিভাগের অধীনস্থ একটি জেলা। শুরুর দিকে এটি সমতট জনপদের অন্তর্গত হলেও পরবর্তীকালে এটি ত্রিপুরা রাজ্যের অংশ হয়েছিল। কুমিল্লা নামকরণের অনেকগুলো প্রচলিত মত রয়েছে। যার মধ্যে উল্লেখযাগ্য চৈনিক পরিব্রাজক ওয়াং চোয়াঙ কর্তৃক সমতট রাজ্য পরিভ্রমণের বৃত্তান্ত থেকে। তার বর্ণনায় কিয়া-মল-ঙ্কিয়া নামক যে স্থানের বিবরণ রয়েছে সেটি থেকে কমলাঙ্ক বা কুমিল্লার নামকরণ হয়েছে। এ অঞ্চলে প্রাপ্ত প্রাচীন নিদর্শনাদি থেকে জানা যায় খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে ত্রিপুরা গুপ্ত সম্রাটদের অধিকারভুক্ত ছিল।
মুক্তিযুদ্ধে কুমিল্লা ২ নং সেক্টর এর অন্তর্গত ছিল। ঢাকা এবং ফরিদপুরের কিছু অংশ, নোয়াখালী ও কুমিল্লা নিয়ে গঠিত হয়েছিল ২নং সেক্টর। এ সেক্টরের নেতৃত্ব দেন- মেজর খালেদ মোশাররফ (১০ এপ্রিল ১৯৭১ থেকে ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১) এবং মেজর এ.টি.এম. হায়দার (২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭২)।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন
বধ্যভূমি- সদর উপজেলার সদর রসুলপুর, বুড়িচং উপজেলার কালিকাপুর, লাকসাম উপজেলার বেলতলীতে বধ্যভূমি আছে। (উত্তর , পুইরা পুল-চান্দিনা উচ্চ বিদ্যালয়ের পূর্ব দিকে, চান্দিনা হাসপাতালের উত্তর-পশ্চিম কোণে, দাউদকান্দি থানার দক্ষিণে সাহাপাড়া ব্রীজ)
গণকবর - ১২টি (ব্রাহ্মণপাড়ার রেললাইন সংলগ্ন হরিমঙ্গল পুকুর পাড়, চান্দিনার কাশিমপুর শ্মশান ঘাট, মহিচাইল বাড়ই পাড়া ও কংগাই বড়বাড়ি, হোমনা ডিগ্রি কলেজের পাশে, বরুড়ার বটতলীর অদূরে নারায়ণপুর, দেবিদ্বার থানা সদর, পশ্চিমগাঁও, লাকসাম বিড়ি ফ্যাক্টরি ও লাকসাম রেলওয়ে জংশন, নাঙ্গলকোটের পরিকোট ও তেজের বাজার, মনোহরগঞ্জের হাসনাবাদ)
শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য সংস্কৃতির পাদপীঠ কুমিল্লা প্রাচীন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ জেলা হিসেবে এ উপমহাদেশে সুপরিচিত।
রসমালাই নামক বিখ্যাত মিষ্টি কুমিল্লায় তৈরি করা হয়। কুমিল্লার রসমলাই সারাদেশে এক নামে পরিচিত। দুধ, ছানা ও চিনির সমন্বয়ে তৈরি হয় এ মিষ্টান্ন যার প্রচলন কুমিল্লাতেই শুরু হয়। অন্যান্য দুগ্ধজাত দ্রব্যাদি প্রস্তুতের জন্যও কুমিল্লা বিখ্যাত। এছাড়াও কুমিল্লার বিখ্যাত খদ্দর (খাদি) শিল্পের জন্য। ১৯২১ সাল থেকে খদ্দর এ অঞ্চলে প্রচলিত। কুমিল্লার খদ্দর শিল্পগত উৎকর্ষে প্রচুর খ্যাতি লাভ করেছিল। এখান থেকে খদ্দর কাপড় কলকাতা ও বোম্বে পাঠানো হত। বাঁশের বাঁশির জন্য কুমিল্লা বিখ্যাত। কুমিল্লার হোমনার শ্রীমদ্দি গ্রাম উপমহাদেশের বাঁশের বাঁশির জন্য সুবিখ্যাত; শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশিপাড়ার বাঁশি বর্তমানে দেশ-বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে সগৌরবে। এছাড়াও তাঁত শিল্প, কুটির শিল্প, মৃৎশিল্প ও কারু শিল্প, ময়নামতির শীতল পাটি ইত্যাদি স্ব-স্ব ঐতিহ্যে স্বকীয়তা আজও বজায় রেখেছে।[৫]
ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট সহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে রেলযোগেও কুমিল্লা জেলায় যাতায়াত করা যায়। কুমিল্লা রেলস্টেশন ও লাকসাম রেলস্টেশন এ জেলার প্রধান দুইটি রেলস্টেশন। অন্যান্য রেলস্টেশনগুলোর মধ্যে রয়েছে নাঙ্গলকোট রেলস্টেশন, গুণবতী রেলস্টেশন, হাসানপুর রেলস্টেশন, নাওটি রেলস্টেশন, রাজাপুর রেলস্টেশন, শশীদল রেলস্টেশন, সালদানদী রেলস্টেশন।
এছাড়াও ঢাকা-নোয়াখালী রেল যোগাযোগ এই কুমিল্লা জেলার উপর দিয়েই হয়ে থাকে। এ পথে রেল যোগাযোগের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য স্টেশন ও রয়েছে সেগুলি হলো সোনাপুর, মাইজদী কোর্ট, চৌমুহনী, সোনাইমুড়ি, বিপুলাসার, নাথেরপেটুয়া, খিলা, লাকসাম জংশন ইত্যাদি।
নদীপথ
কুমিল্লা জেলায় নদীপথেও যোগাযোগ করা যায়। তবে সড়ক ও রেল যোগাযোগ সহজতর হওয়ায় নদীপথে শুধুমাত্র আঞ্চলিক যোগাযোগ হয়ে থাকে। এ জেলার একমাত্র নদীবন্দর দাউদকান্দি বাউশিয়া নদীবন্দর এবং এ জেলায় মোট ৩৪টি ফেরীঘাট রয়েছে।[১]
কুমিল্লা জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক। এ অঞ্চলের দারিদ্রতার হার ২০.৬%। এই জেলার অর্থনীতি ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে কৃষির মাধ্যমে। এ জেলার প্রায় ১১.৬% মানুষ ব্যবসার সাথে জড়িত। এখানে ২টি শিল্প নগরী রয়েছে। কুমিল্লায় রয়েছে বাখরাবাদ গ্যাস সিস্টেমস লিমিটেড এর মূল স্থাপনা এবং গ্যাস ফিল্ড।[১২]