কুরআনের অনুবাদ (আরবি: ترجمة القرآن ; ইংরেজি: Translations of the Qur'an) বলতে ইসলামের ধর্মগ্রন্থ কুরআনকে আরবি ছাড়া অন্যান্য ভাষায় ব্যাখ্যা করা বোঝায়। কুরআনকে উৎপত্তিগতভাবে আরবিতে লেখা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে একে বেশির ভাগ আফ্রিকীয়, এশীয় এবং ইউরোপীয় ভাষায় অনুবাদ করা হয়।[১]
কুরআন |
---|
ধারাবাহিক নিবন্ধশ্রেণীর অংশ |
আধুনিক ভাষাগুলোয় কুরআনকে অনুবাদ করা ইসলামী ধর্মতত্ত্বে সবসময় সমস্যার সৃষ্টি করেছে। কারণ মুসলিমগণ কুরআনকে অলৌকিক এবং অননুকরণীয় বলে মনে করেন (i'jaz al-Qur'an)। তারা বলেন কুরআন এর লেখাকে তার সত্যিকারের অবস্থা থেকে পরিবর্তিত করে অন্য ভাষায় লেখা উচিত নয়, অন্তত তার সাথে আরবি লেখা না যুক্ত করে প্রকাশ করা উচিত নয়। এছাড়া, একটি হিব্দ্রু বা আরমাইক শব্দের মত একটি আরবি শব্দের তার প্রসঙ্গের উপর ভিত্তি করে বিস্তৃত পরিসরের অর্থ থাকতে পারে। আধুনিক বিশ্লেষণী ইংরেজি, ল্যাতিন এবং রোমান্স ভাষাসমূহের সাথে তুলনা করে দেখা যায় এই বৈশিষ্ট্যটি সকল সেমিটিক ভাষাসমূহের বেলাতেই প্রযোজ্য। এর ফলে সেমিটিক ভাষাসমূহে রচিত কোন কিছুকে সঠিকভাবে অনুবাদ করা আরও কঠিন হয়ে যায়।[১]
ইসলামী ধর্মতত্ত্ব অনুসারে, কুরআন এর আবির্ভাব খুব নির্দিষ্টভাবে আরবি ভাষাতেই হয়েছে, এবং তাই কুরআনীয় আরবিতেই এর পাঠ করা উচিত। অন্য ভাষায় এটি অনুদিত হলে তা মানুষ দ্বারা রচিত হবে, এবং এরফলে মুসলিমদের মতে মূল আরবিতে লেখা গ্রন্থে যে পবিত্রতা ও অনন্যতা থাকে সেটা অনুদিত গ্রন্থে আর থাকবে না, কেননা এই অনুবাদগুলোতে সূক্ষ্মভাবে অর্থের পরিবর্তন ঘটে, তাই কুরআন এর অনুবাদকে অনুবাদ না বলে প্রায়ই "ব্যাখ্যা"[২] বা "অর্থের অনুবাদ" বলা হয় (এই "অর্থ" বলতে কুরআন এর বিভিন্ন আয়াতের বিভিন্ন অর্থের সমাহারকে বোঝানো হয় যেখানে এই আলাদা আলাদা অর্থগুলো একে অপরের থেকে ভিন্ন হতে পারে, এবং অনুবাদগুলোর ক্ষেত্রে এই স্বীকারোক্তির উল্লেখ থাকে যে, এই তথাকঠিত অনুবাদ একটি সাম্ভাব্য ব্যাখ্যা মাত্র, এবং এটিকে মূল কুরআন এর পূর্ণাঙ্গ সমতুল্য হিসেবে দাবি করা হচ্ছে না)। যেমন পিকথাল তার অনুবাদকে দ্য কুরআন (কুরআন) না লিখে দ্য মিনিং অফ দ্য গ্লোরিয়াস কুরআন (মহান কুরআন এর অর্থ) লিখেছিলেন।
কুরআন অনুবাদ করার কাজ সহজ নয়, অনেক আরব বক্তা নিশ্চিত করেন যে মূল আরবি ধর্মগ্রন্থেও কুরআন এর কিছু কথা বোঝা কঠিন। এটা যেকোন অনুবাদের আভ্যন্তরীন জটিলতার একটি অংশ, কারণ আরবি ও অন্যান্য সেমিটিক ভাষায় একটি শব্দে অনেক রকম অর্থ থাকতে পারে।[২] তাই সবসময়ই এই ভাষায় লেখা কোন কিছু বুঝতে এবং অনুবাদ করতে মানব বিচারের বিষয়টি উপস্থিত থাকে। শাস্ত্রীয় আরবি ও আধুনিক আরবিতে একই শব্দের ব্যবহারে অনেক পরিবর্তন চলে আসায় এই ব্যাপারটি আরও কঠিন হয়ে গেছে। এর ফলে, কুরআন এর আয়াতগুলো স্থানীয় আরবি ভাষাভাষীর কাছে পরিষ্কার স্পষ্ট বলে মনে হলেও তারা আধুনিক শব্দভাণ্ডার দ্বারা অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় সেই সব শব্দের দ্বারা কুরআনকে বুঝতে পারে না এবং তাদের জানা শব্দার্থগুলো কুরআন এর শব্দার্থগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে না।
কুরআন এর লেখার আসল অর্থ একই সাথে নবী মুহাম্মাদ এর জীবন এবং প্রাথমিক মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐতিহাসিক ঘটনাবলির উপরেও নির্ভর করবে যখন কুরআন এর আবির্ভাব ঘটে। এই বিষয়ে তদন্তের জন্য হাদিস ও সিরাত সম্পর্কিত বিস্তারিত জ্ঞানের প্রয়োজন হয়, যেগুলো নিজেই খুব ব্যাপক এবং জটিল। এর ফলে অর্থের অনিশ্চয়তায় আরেকটি নতুন মাত্রা যুক্ত হয় এবং অনুবাদের কোন ভাষাবিদ্যার নিয়মের দ্বারা এই অনিশ্চয়তাকে দূর করা যায় না।
কুরআন |
---|
ধারাবাহিক নিবন্ধশ্রেণীর অংশ |
কুরআনের প্রথম অনুবাদ করেন সালমান ফারসি, যিনি ৭ম শতকের প্রথম দিকে সূরা আল-ফাতিহাকে ফারসি ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।[৩] হাদিসে বর্ণিত রয়েছে, আবিসিনিয়া এর সম্রাট নেগুস এবং বাইজান্টাইন সম্রাট হেরাক্লিটাস এর কাছে মুহাম্মাদ এর কাছ থেকে চিঠি আসে যেখানে কুরআন এর আয়াত যুক্ত ছিল।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] যাই হোক, মুহাম্মাদ সা. এর জীবদ্দশায় কুরআন এর কোন অংশই সেই আবিসিনিয়া ও বাইজান্টাইন এর ভাষা বা অন্য কোন ভাষায় অনুবাদ করা হয়নি।[১]