কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ | |
---|---|
জন্ম | আনুমানিক ১৬০০-১৬১০ খ্রি: |
মৃত্যু | |
জাতীয়তা | বাঙালি |
অন্যান্য নাম | কৃষ্ণানন্দ ভট্টাচার্য্য |
পেশা | সাধক, তন্ত্রসাধক |
পরিচিতির কারণ | তন্ত্রসার, বৃহত্ তন্ত্রসারের রচয়িতা, দক্ষিণাকালীর মূর্তি ও পূজা পদ্ধতির সংস্কার করেন |
কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ (জন্ম: আনুমানিক ১৬০০-১৬১০ খ্রি:) ছিলেন সপ্তদশ শতকের এক উচ্চস্তরের তন্ত্রসাধক, যিনি নদিয়া জেলার নবদ্বীপ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তন্ত্রশাস্ত্রে সুপণ্ডিত এই তন্ত্রসাধক ১৭০ টি গ্রন্থ থেকে নির্যাস গ্রহণ করে বিখ্যাত "তন্ত্রসার" গ্রন্থটি রচনা করেন এবং সমগ্র দেশে এই গ্রন্থটি সমাদৃত হয়। কৃষ্ণানন্দ ছিলেন উদারচেতা, ধর্মবিষয়ে তাঁর কোনো গোঁড়ামি ছিল না। তাই তন্ত্রসার গ্রন্থে শৈব, গণপত্য, শাক্ত, বৈষ্ণব ও সৌর সম্প্রদায়ের তন্ত্রগ্রন্থগুলির সার গ্রহণ করে সন্নিবেশন হয়েছে।[১] তিনি তন্ত্র বিষয়ে তত্ত্ববোধিনী নামে আরও একটি গ্রন্থ লেখেন।
তাঁর প্রকৃত নাম কৃষ্ণানন্দ ভট্টাচার্য। তন্ত্র সাধনার আগম পদ্ধতিতে সিদ্ধি লাভ করে তিনি 'আগমবাগীশ' উপাধি পান। তিনি বাংলায় কালী সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ নামে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তিনি ছিলেন শ্রীশ্রী রামপ্রসাদ সেনের তন্ত্রগুরু। নবীন লেখক অভীক সরকারের এবং ইনকুইজিশন গ্রন্থের ছোটগল্প অনুসারে পূর্ব পশ্চিম দক্ষিণ একটি বাংলা আধিভৌতিক রহস্যকাহিনী মূলক চলচ্চিত্র জিও স্টুডিওর ব্যানারে প্রকাশিত হয়েছে অক্টোবর, ২০১৯ সালে। এই চলচ্চিত্রে কৃষ্ণানন্দর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন পরাণ বন্দ্যোপাধ্যায়।[২][৩]
বাংলা তথা নবদ্বীপের সুপণ্ডিত কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সপ্তদশ শতকের গোড়ার দিকে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম মহেশ্বর গৌড়াচার্য। কৃষ্ণানন্দ বাংলায় "কৃষ্ণানন্দ ভট্টাচার্য্য" নামেও পরিচিত। বিভিন্ন তথ্য থেকে পাওয়া যায় যে তিনি ১৬০০ থেকে ১৬১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেন। তন্ত্রসাধক কৃষ্ণানন্দ ১৬৩০ থেকে ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে বিখ্যাত তন্ত্রসার গ্রন্থটি রচনা করেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে, রাঢ়দেশে তন্ত্রশাস্ত্র রচনাকারদের মধ্যে আগমবাগীশের রচনা সবচেয়ে মার্জিত।
সুপ্রাচীন কাল থেকেই তন্ত্র সাধনক্ষেত্র হিসাবে নবদ্বীপের বিশেষ খ্যাতি ছিল। শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই নবদ্বীপের তন্ত্র সাধনা সাধারণ মানুষের কাছে বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল। এই অবস্থা চলেছিল কৃষ্ণানন্দের সময়কাল পর্যন্ত। এই সব দেখে সাধকশ্রেষ্ঠ ও পণ্ডিতপ্রবর কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ শুদ্ধাচারে তন্ত্র সাধনা প্রতিষ্ঠিত করা এবং ঘরে ঘরে শক্তি আরাধনা প্রবর্তন করার জন্য় কৃত সংকল্প হলেন। কৃষ্ণানন্দ তাঁর সাধনলব্ধ ঐশী শক্তির দ্বারা দৈবাদেশ পান ও সেই মতো তিনি মা কালীর শান্ত রূপ কল্পনা করেন। সেই রূপ দক্ষিণাকালী নাম খ্যাত। ভক্তিনম্র হৃদয়ে প্রাণের আকুতি নিয়ে সহজ সরল পদ্ধতিতে মায়ের সেই মঙ্গলময়ীরূপী বিগ্রহ তৈরি করে তিনিই বাংলার ঘরে ঘরে মা কালীর পূজার প্রচলন করেন।
প্রচলিত মত ও ইতিহাসবিদদের সমর্থন অনুযায়ী, কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে প্রথম দক্ষিণাকালীর রূপ কল্পনা করেন। বর্তমানে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মা কালীর রূপেই সম্পূর্ণ বাংলা ও তার বাইরে কালী পূজা হয়। তার আগে কালীমূর্তি পূজার প্রচলন ছিলনা।[৪][৫]
কৃষ্ণানন্দ দীপান্বিতা অমাবস্যায় একই দিনে ছোট আকারের কালীমূর্তি নির্মাণ করে রাত্রে পূজার্চনা শেষে ভোরে বিসর্জন দিতেন। এই কারণে লোকে বলতো "আগমবাগীশি কাণ্ড"। কথাটি প্রবাদে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীতে তাঁর পূজিত দেবী আগমেশ্বরী মাতা নামে প্রতিবছর নবদ্বীপে পূজিত হয়।[৬][৭]
কৃষ্ণানন্দ মা কালীর রূপ কীভাবে পেলেন, এই নিয়ে বাংলার ঘরে ঘরে এক প্রচলিত শ্রুতি পাওয়া যায়। ক’দিন ধরেই পুজোয় বসে কালীসাধক কৃষ্ণানন্দ বায়না করেন,
“ | এ বার সাকার রূপে দেখা দাও মা, মূর্তি গড়ে তোমার অর্চনা করি! | ” |
সন্তানের আকুতি মা ফেলতে পারলেন না। বিধান দিলেন, মহানিশার অবসানে প্রাতঃমুহূর্তে কৃষ্ণানন্দ প্রথম যে নারীমূর্তি দর্শন করবেন, সেই মূর্তিই হবে ইচ্ছাময়ীর যথার্থ সাকার মূর্তি। পরের দিন ভোরে গঙ্গাস্নানে বেরিয়ে কৃষ্ণানন্দ দেখলেন, এক দরিদ্র বধূ গাছের গুঁড়ির উপর নিবিষ্ট মনে ঘুঁটে দিচ্ছেন। বাঁ হাতে গোবরের মস্ত তাল, ডান হাত উঁচুতে তুলে ঘুঁটে দিচ্ছে। নিম্নবর্গীয় কন্যা, গাত্রবর্ণ কালো, বসন আলুথালু, পিঠে আলুলায়িত কুন্তল, কনুই দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে গিয়ে সিঁদুর লেপ্টে গেছে। এ হেন অবস্থায় পরপুরুষ কৃষ্ণানন্দকে দেখে লজ্জায় জিভ কাটলেন সেই বধু।— এই ছবিটিই মানসপটে এঁকে গঙ্গামাটি নিয়ে মূর্তি গড়তে বসলেন কৃষ্ণানন্দ। কৃষ্ণানন্দের এই মূর্তিই পরবর্তীতে দুই বাংলায় জনপ্রিয় হয়ে উঠল।[৮]
এছাড়াও কথিত আছে, কৃষ্ণানন্দ কোনো এক ধনী নবশাকের বাড়ি দুর্গাপূজা করতে গিয়েছিলেন; সেখানে দুর্গাপূজার শেষে ওই বাড়ির কর্তা নিজের অহংবোধের বশবর্তী হয়ে কৃষ্ণানন্দকে বলেন যে তিনি প্রতিমার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেননি। কৃষ্ণানন্দ ক্রুদ্ধ হয়ে বলেন যে তিনি যদি প্রাণপ্রতিষ্ঠা না করে থাকেন এক্ষুনি তার প্রমাণ দেবেন; কিন্তু প্রমাণ হওয়ার পরে ওই গৃহের কেউ আর জীবিত থাকবেনা। কর্তা সম্মতি জানালে কৃষ্ণানন্দ একটি কুশি ছুঁড়ে দেন দেবী প্রতিমার ঊরুতে। সঙ্গে সঙ্গে প্রতিমার ঊরু ফেটে রক্তপাত হয়; এবং ওই গৃহের প্রত্যেকেও মুখে রক্ত উঠে তৎক্ষণাৎ মারা যান।
অনেক ইতিহাসবিদ তাকে চৈতন্যদেবের সমসাময়িক বলে মনে করেন। বৃন্দাবনদাস বিরচিত চৈতন্যভাগবতের বিবরণ থেকে পাওয়া যায়- গঙ্গাদাস পণ্ডিতের টোলে পাঠ গ্রহণের সময় মুরারি গুপ্ত, কমলাকান্ত এবং কৃষ্ণানন্দ চৈতন্যদেবের সহাধ্যায়ী ছিলেন-
“ | যত পড়ে গঙ্গাদাস পণ্ডিতের স্থানে। সবাকারে ঠাকুর চালেন অনুক্ষণে।। |
” |
আসলে চৈতন্যভাগবতে উল্লিখিত কৃষ্ণানন্দের পরিচয় জ্ঞাপন উদ্ধৃতিটি গবেষকদের নজর এড়িয়ে যাওয়ায় এই বিকৃতি ঘটে। কৃষ্ণানন্দের পরিচয় জ্ঞাপন উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে-
“ | রত্নগর্ভ আচার্য বিখ্যাত তার নাম। প্রভুর পিতার সঙ্গে জন্ম এক গ্রাম।। |
” |
অর্থাৎ, চৈতন্যভাগবতে উল্লিখিত কৃষ্ণানন্দ ছিলেন জন্মলগ্ন থেকেই কৃষ্ণভক্ত, শাক্ত নন। তার তিন ভাই ছিলেন- কৃষ্ণানন্দ, জীব ও যদুরাম। বর্তমান ইতিহাসবিদরা এই বিষয়টি বিশ্লেষন করে উক্ত ভ্রমটি দূর করেন।[৯] কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ সম্পর্কে এশিয়াটিক সোসাইটির পত্রিকায় ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে তথ্যনিষ্ঠ আলোচনা করেছেন ড: দীনেশচন্দ্র সরকার। ড: দীনেশচন্দ্র সরকার লিখেছেন[১০]
In any case, however, there is no doubt, that Tantrasara was composed by the great Krishnananda Agambagisa Bhattacharya some time in the seventeenth century. It may not be improbable that Krishnananda flourished in circa 1595-1675 A.D. and composed the Tantrasara in the earlier part of his life.
১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে নবদ্বীপ পুরাতত্ব পরিষদ পত্রিকায় যজ্ঞেশ্বর চৌধুরীও তথ্যপ্রমাণ সহকারে প্রমাণ করেছেন যে, ১৬০০-১৬১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কৃষ্ণানন্দ জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৬৩৫-১৬৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে তন্ত্রসার রচনা করেন।[১১]