কোভিড-১৯ মহামারি রোগটি সারা বিশ্বে দ্রুত ছড়িয়ে পড়া ও মানুষের মধ্যে সামাজিক ভাবে দূরত্ব তৈরি করা ছাড়াও স্বয়ংক্রিয়ভাবে এর এক সুদুর প্রসারী অর্থনৈতিক প্রভাব তৈরী করেছে। সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি যেভাবে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পরেছে, ঠিক সেভাবেই উৎপাদন-খাতের সরবরাহকে হ্রাস করে ব্যবসায়িক বাজারে মন্দাতা সৃষ্টি করেছে।[১] মহামারিটি বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি লোককে বন্দী (লকডাউন) রেখে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক মন্দা তৈরী করেছে।[২] মহামারিটিকে মোকাবিলার জন্য জনগণের আতঙ্কিত ক্রয়, কিছু কিছু পণ্যের ব্যবহারকে বৃদ্ধি করেছে। সেই সাথে চীনের মূল-ভূখণ্ডের কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর উৎপাদন কমেছে। ফলে বিশ্বজুরে নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি প্রত্যক্ষ হয়েছে।[৩] বহুমাত্রিকভাবে ঔষধের ঘাটতির খবর সহ,[৪] বিভিন্ন জায়গায় আতঙ্কিত ক্রয়ের কারণে খাদ্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর অপ্রতুলতা দেখা দিয়েছে।[৫][৬][৭] প্রযুক্তি খাত, বিশেষ করে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামাদি সরবরাহে বিলম্বের কথা সতর্ক করে রাখা হয়েছে।[৮]
চীনের মূল ভূখণ্ডের বাইরে কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় ২০২০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব শেয়ার বাজারগুলি হ্রাস পেয়ে যায়।[৯][১০] ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে, বিশ্বব্যাপী শেয়ার বাজারগুলি ২০০৮ এর আর্থিক সঙ্কটের পরে তাদের বৃহত্তম একক সপ্তাহের হ্রাস দেখতে পেয়েছিল। [১১][১২][১৩] ২০২০ সালের মার্চ মাসে বিশ্বব্যাপী শেয়ারবাজারগুলি ক্র্যাশ হয়ে এবং বিশ্বের প্রধান সূচকে কয়েক শতাংশ পড়েছে। মহামারিটি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তি, ফ্যাশন এবং ক্রীড়া জগতে সম্মেলন এবং ইভেন্টগুলি বাতিল বা স্থগিত করা হচ্ছে।[১৪] ভ্রমণ এবং বাণিজ্য শিল্পে আর্থিক প্রভাব এখনও অনুমান করা যায় না, এটি সম্ভবত বিলিয়ন কিংবা তারও বেশি বৃদ্ধি পাবে।
২০১৯ থেকে পশ্চিম টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েটে দামের উঠানামা। দামের পতনটি ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে শুরু হয়েছিল। ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল প্রথমবারের মতো মূল্য পতনের হার শূন্যের নীচে নেমে আসে। .[১৫]
মহামারিটি কাকতালীয়ভাবে অধিকমাত্রায় শুরু হয় চীনের নতুন বর্ষের উৎসব ছুনিয়ার ছুটিকালীন সময়ে জনগণের অধিক ভ্রমণের ভিত্তিতে এমনটি মনে করা হয়। জাতীয় ও আঞ্চলিক সরকার চীনের বার্ষিক নববর্ষের উৎসবসহ জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ের সকল ধরনের জনসমাগমসহ সামাজিক অনুষ্ঠানকে রদ করে দেয় এমনকি ডিজনিল্যান্ড ও সাংহাই ডিজনিল্যান্ডের মতো পর্যটন কেন্দ্রগুলোকেও বন্ধ ঘোষণা করে।[১৬][১৭] বেইজিংয়ের ফরবিডেন সিটি এবং ঐতিহ্যবাহী মন্দির মেলা সহ বৃহত্তর জমায়েত রোধ করতে চন্দ্র নববর্ষের পর্যটকদের আকর্ষণকারী অনেক অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল।[১৮] চীনের ৩১ টি প্রদেশ, পৌরসভা ও অঞ্চলগুলির মধ্যে ২৪ টিতে কর্তৃপক্ষ নববর্ষের ছুটিকে ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়, বেশিরভাগ কর্মস্থলগুলো সেই তারিখ পর্যন্ত পুনরায় না খোলার নির্দেশ দিয়েছিল।[১৯][২০] এই অঞ্চলগুলি দেশের ৮০% জিডিপি এবং ৯০% রফতানি কার্যক্রমের প্রতিনিধিত্ব করে।[২০] হংকং তার সংক্রামক রোগের প্রতিক্রিয়া সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত করে, ফলে জরুরি অবস্থা ঘোষণাসহ মার্চ অবধি স্কুল বন্ধ করে দেয় এবং নববর্ষ উদযাপনের সকল কার্যক্রম বাতিল করে।[২১][২২]
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক টেড্রোস অ্যাধনমের মতে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের চাহিদা ১০০ গুণ বেড়ে যায়। এই চাহিদার ফলে সরঞ্জামাদির দাম স্বাভাবিক দামের বিশ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায় এবং চার থেকে ছয় মাস পর্যন্ত চিকিৎসা সরঞ্জামাদি সরবরাহে বিলম্ব ঘটে।[২৩][২৪]
করোনাভাইরাস মন্দা একটি অর্থনৈতিক মন্দা বোঝায় যা বিশ্ব অর্থনীতিতে ২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে ঘটতে পারে।[২৫][২৬][২৭][২৮]
কিছু অর্থনীতিবিদ পরামর্শ দিয়েছেন যে ১৯৭০ এর পর প্রথমবারের মতো চীনের অর্থনীতি সংকুচিত হতে পারে। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে চীনের অর্থনীতির পরিষেবা খাতের জন্য কক্সিনের ক্রয় পরিচালন সূচক কমে ২৬.৫ এ চলে আসে, যা ২০০৫ সালে জরিপের পরে এটিই হচ্ছে রেকর্ডকৃত সর্বনিম্ন চিত্র,[২৯] এবং ফেব্রুয়ারিতে চীনে গাড়ি বিক্রয় কমেছে ৮৬%।[৩০] করোনাভাইরাসটি বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে শেয়ার বাজারগুলি ১৯৮৭ সালের পরে সবচেয়ে খারাপ ক্র্যাশ অনুভব করেছে।[৩০]
করোনভাইরাস মহামারির সাথে সম্পর্কিত স্টক, বন্ড এবং পণ্য (অপরিশোধিত তেল এবং স্বর্ণ সহ) বাজারগুলি সহ আর্থিক বাজারগুলিতে ব্যাপক বিস্তৃত এবং মারাত্মক প্রভাব রয়েছে। উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে রয়েছে রাশিয়া–সৌদি আরবের তেলের দামের যুদ্ধ, যার ফলে ২০২০ সালের মার্চ মাসে অপরিশোধিত তেলের দাম ধসে পড়ে এবং শেয়ারবাজারকে চুরমার করে দেয়। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি মনে করে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে আয় ২২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হ্রাস হতে পারে এবং কোভিড -১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাব কয়েক মাস বা এমনকি কয়েক বছর ধরে স্থায়ী হতে পারে বলে আশা করে।[৩০][৩১] কেউ কেউ প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম কমবে বলে আশা করছেন।[৩২]
যুক্তরাষ্ট্রে নতুন গাড়ির বিক্রয় ৪০% হ্রাস পেয়েছে।[৩৩] আমেরিকান বিগ থ্রি সকলেই তাদের মার্কিন কারখানাগুলো বন্ধ করে দিয়েছে।[৩৪] ইতোমধ্যে ডিজেলগেট-কেলেঙ্কারীর পাশাপাশি বৈদ্যুতিক গাড়িগুলির সাথে প্রতিযোগিতায় নড়বড়ে হয়ে পড়া জার্মানি অটোমোটিভ শিল্প কারখানাগুলো কোভিড-১৯ এর থাবায় বেশ সংকটে পড়ে।[৩৫] বোয়িং ও এয়ারবাস কয়েকটি কারখানায় উৎপাদন স্থগিত করে দিয়েছে।
মহামারিটি বিশ্বব্যাপী শিল্প ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খাতগুলিতে আকষ্মিক এবং যথেষ্ট প্রভাব ফেলেছিল। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সঙ্কট এবং এর ফলে উদ্ভূত অনিশ্চয়তার কারণে বিভিন্ন সংস্থার অপারেশন ব্যবস্থাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল এবং পাশাপাশি একক এবং উভয়ই চাকরিজীবী এবং স্বতন্ত্রজীবি- এই ক্ষেত্র জুড়ে। ২০২০ সালের মার্চ মাসের মধ্যে, বিশ্বজুড়ে বেশিরভাগ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলি অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিল (বা কমপক্ষে তাদের পরিষেবাকে সীমিত করেছে) প্রদর্শনী, ইভেন্ট এবং পারফরম্যান্স বাতিল বা স্থগিত করা হয়েছিল। অনেক ব্যক্তি অস্থায়ীভাবে বা স্থায়ীভাবে চুক্তি বা চাকরি হারিয়ে ফেলেছে বিভিন্ন ধরনের সতর্কতা এবং আর্থিক সহায়তা উপলব্ধ। অনুরূপভাবে, শিল্পীদের জন্য সরকার এবং দাতব্য প্রতিষ্ঠানের আর্থিক উদ্দীপনা ক্ষেত্র এবং দেশের উপর নির্ভর করে ব্যাপক মাত্রায় বিভিন্ন স্তরের সমর্থন সরবরাহ করেছে। অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলিতে, যেখানে চারুকলা জিডিপির প্রায় ৬.৪% অবদান রাখে, সেখানে ব্যক্তি এবং অর্থনীতির উপর এ প্রভাবগুলি বেশ উল্লেখযোগ্যই হয়ে থাকে।[৩৬][৩৭]