কোষ জীববিদ্যা | |
---|---|
মাইটোকন্ড্রিয়া | |
ক্রিস্টা বা ক্রিস্টি (/ˈkrɪstə/; বহুবচন: ক্রিস্টে) হলো মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরীণ আবরণীর ভাঁজ। ক্রিস্টার নামকরণ লাতিন শব্দ "crest" বা "plume" থেকে এসেছে, কারণ এগুলো অভ্যন্তরীণ আবরণীকে ঝাঁকুনি বা ভাঁজযুক্ত আকার দেয়। ক্রিস্টা মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরীণ আবরণীর পৃষ্ঠের ক্ষেত্রফল বৃদ্ধি করে, যা এ্যারোবিক কোষীয় শ্বাসকার্যের হার বৃদ্ধি করে। ক্রিস্টা এটিপি সিন্থেস নামক একটি প্রোটিন ধারণ করে, যা এ্যারোবিক কোষীয় শ্বাসকার্যের সময় উৎপাদিত শক্তিকে এটিপিতে রূপান্তরিত করে। ক্রিস্টা সাইটোক্রোম নামক প্রোটিন ধারণ করে, যা ইলেকট্রন বাহক হিসেবে কাজ করে।
মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরীণ ঝিল্লি (Inner mitochondrial membrane) একটি জটিল কাঠামো যা কোষের শ্বসন প্রক্রিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই ঝিল্লির গঠন সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের ধারণা সময়ের সাথে সাথে বিকশিত হয়েছে। মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরীণ ঝিল্লি কীভাবে সংগঠিত হয় সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন।[১] এই গবেষণার ফলে তিনটি মডেল প্রস্তাব করা হয়েছে-
তুলনামূলক আলোচনা:
মডেল | বর্ণনা | সমালোচনা |
---|---|---|
বাফল মডেল | ঝিল্লি বাফলের মতো বাঁকানো | ঝিল্লির স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন |
সেপ্টা মডেল | ঝিল্লি স্থায়ী দেয়ালের মতো | ম্যাট্রিক্সের মিশ্রণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রশ্ন |
ক্রিস্টা জংশন মডেল | ঝিল্লি নলাকার সংযোগকারী দ্বারা সংযুক্ত | ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি দ্বারা সমর্থিত |
সাম্প্রতিক গবেষণা (২০১৯) মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্রিস্টা গঠনের ক্ষেত্রে নতুন আবিষ্কার করেছে। এই গবেষণায় দেখা গেছে যে ক্রিস্টার গোড়ায় ATP সিন্থেস দ্বি-মাত্রিক কাঠামোর (পূর্বে "মৌলিক কণিকা" বা "অক্সিসোম" নামে পরিচিত) সারিগুলো গঠিত হয়। এই দ্বি-মাত্রিকগুলো ঝিল্লি বাঁকাতে সাহায্য করে এবং সম্ভবত ক্রিস্টা গঠনের প্রথম ধাপ।[৪] দ্বি-মাত্রিকগুলো ক্রিস্টার বেসে অবস্থিত, যা ক্রিস্টার মূল অংশ। একটি মাইটোকন্ড্রিয়াল যোগাযোগ স্থান ক্রিস্টা সংগঠিতকারী সিস্টেম (MICOS) প্রোটিন জটিল ক্রিস্টা জংশন দখল করে। এই জটিলটি ক্রিস্টার স্থায়িত্ব এবং কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে। ওপিএ১ প্রোটিন সহ বিভিন্ন প্রোটিন ক্রিস্টা পুনঃনির্মাণে জড়িত। এই প্রোটিনগুলো ক্রিস্টার আকার এবং কাঠামো পরিবর্তন করতে সাহায্য করে।[৫]
ঐতিহ্যগতভাবে, ক্রিস্টাগুলিকে তিনটি আকারের ভিত্তিতে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়:[৬]
বিভিন্ন ধরনের কোষে বিভিন্ন ধরণের ক্রিস্টা দেখা যায়। এটি ধারণা করা হয় যে কোষের শ্বসন প্রয়োজনের উপর নির্ভর করে ক্রিস্টার আকার পরিবর্তিত হতে পারে।[৭]
মানবদেহে শক্তি উৎপাদনের প্রধান পথ হল শ্বসন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ইলেক্ট্রন পরিবহন তন্ত্র (electron transport chain)।
এনজাইমের সাহায্যে এনএডিএইচ (NADH) অক্সিডাইজ হয়ে এনএডি+ (NAD+), হাইড্রোজেন আয়ন (H+) এবং ইলেকট্রনে (e-) বিভক্ত হয়। একইভাবে, এফএডিএইচ (FADH2) অক্সিডাইজ হয়ে এফএডি (FAD) হাইড্রোজেন আয়ন এবং ইলেকট্রন উৎপাদন করে। এই ইলেকট্রনগুলো মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরীণ ঝিল্লিতে অবস্থিত ইলেকট্রন পরিবহন তন্ত্রের মধ্য দিয়ে যাত্রা করে। যাত্রাপথে, এই ইলেকট্রনগুলো বিভিন্ন প্রোটিনের সাথে যোগাযোগ করে ধাপে ধাপে শক্তি হারায়। এই শক্তি ব্যবহার করে, ইলেকট্রন পরিবহন তন্ত্র মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরীণ ঝিল্লি থেকে অভ্যন্তরীণ ঝিল্লি এবং বহিঃঝিল্লির মধ্যবর্তী স্থানে (যা ইন্টারমেমব্রেন স্পেস নামে পরিচিত) হাইড্রোজেন আয়ন (H+) পাম্প করে।
ইলেকট্রন পরিবহন তন্ত্রে ইলেকট্রন চলাচলের ফলে অভ্যন্তরীণ মাইটোকন্ড্রিয়াল ঝিল্লি জুড়ে একটি বিশেষ ধরনের শক্তি সঞ্চয় হয়। এই শক্তিকে ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল গ্রেডিয়েন্ট বলা হয়। এটি মূলত হাইড্রোজেন আয়ন (H+) এর ঘনত্বের পার্থক্য ও তড়িৎ চার্জের পার্থক্যের সম্মিলিত ফল।[৮] এই গ্রেডিয়েন্ট মূলত বিভব শক্তি ধারণ করে, যা মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরীণ ঝিল্লি জুড়ে প্রোটন-মোটিভ বল নামে পরিচিত। প্রোটন-মোটিভ বলের এই বিভব শক্তি কাজে লাগিয়ে মাইটোকন্ড্রিয়ায় কেমিওস্মোসিস নামক একটি প্রক্রিয়া ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় এটিপি সিন্থেস নামক একটি এনজাইম কমপ্লেক্স ঝিল্লির ভেতরে থেকে বাইরে হাইড্রোজেন আয়নগুলোকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে। এই ফিরে আসার প্রক্রিয়ায় এটিপি সিন্থেস এডিপি (ADP) থেকে এটিপি (ATP) তৈরি করে। এভাবেই ইলেক্ট্রোকেমিক্যাল গ্রেডিয়েন্টের বিভব শক্তি কোষের শক্তির মুদ্রা এটিপি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটিপি সিন্থেসের মাধ্যমে হাইড্রোজেন আয়নগুলো ঝিল্লির ভেতরে ফিরে আসে এবং পরবর্তীতে পানি (H2O) তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
মাইটোকন্ড্রিয়ায় শক্তি উৎপাদনের কেন্দ্রস্থলে থাকা ইলেকট্রন পরিবহন তন্ত্র সঠিকভাবে কাজ করতে এবং এটিপি তৈরি করতে ক্রমাগত ইলেকট্রনের সরবরাহের প্রয়োজন হয়। কিন্তু, যদি ইলেকট্রন তন্ত্রে প্রবেশ করে জমা হতে থাকে, তাহলে এক-মুখী পথে আটকে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। অর্থাৎ, পর্যাপ্ত গ্রহণকারী না থাকলে ইলেকট্রন জমা হয়ে তন্ত্রের কার্যকারিতা ব্যাহত করে। এই সমস্যার সমাধান করে অক্সিজেন (O₂)। অক্সিজেন শৃঙ্খলের শেষ প্রান্তে অবস্থান করে ইলেকট্রন গ্রহণ করে। এই গ্রহণের ফলে দুটি পানির (H₂O) অণু তৈরি হয়। অক্সিজেন ইলেকট্রন গ্রহণের ফলে ইলেকট্রন পরিবহন তন্ত্র স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে এবং ক্রমাগত এটিপি উৎপাদন করে। এই ইলেকট্রন পরিবহন তন্ত্র মাইটোকন্ড্রিয়ার ক্রিস্টা লুমেন ঝিল্লিতে অবস্থিত। এই ঝিল্লিটি মাইটোকন্ড্রিয়ার ভেতরে অবস্থিত এবং ক্রিস্টা নামক কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত।[৯]
প্রতিটি এনএডিএইচ (NADH) অণু ইলেকট্রন পরিবহন তন্ত্রের মাধ্যমে এডিপি (ADP) এবং ফসফেট গ্রুপ ব্যবহার করে মোট ৩টি এটিপি (ATP) তৈরি করতে পারে। একইভাবে, প্রতিটি এফএডিএইচ (FADH2) অণু মোট ২টি এটিপি উৎপাদন করতে পারে।
এর ফলে, গ্লাইকোলাইসিস এবং ক্রেবস চক্র থেকে আসা ১০টি এনএডিএইচ অণু এবং ২টি এফএডিএইচ অণু একসাথে কাজ করে এ্যারোবিক শ্বসনের সময় (একটি ইলেকট্রন পরিবহন তন্ত্র থেকে) মোট ৩৪টি এটিপি তৈরি করতে পারে। ইলেকট্রন পরিবহন তন্ত্র গ্লাইকোলাইসিসের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। ইলেকট্রন পরিবহন তন্ত্রের সাহায্যে প্রতিটি গ্লুকোজ অণু থেকে প্রাপ্ত শক্তির প্রায় ৬৫% এটিপিতে রূপান্তরিত হয়। অন্যদিকে, গ্লাইকোলাইসিস এককভাবে প্রায় ৩.৫% শক্তি এটিপিতে রূপান্তর করতে পারে।
মাইটোকন্ড্রিয়ার অভ্যন্তরীণ ঝিল্লির উপর ক্রিস্টা নামক কাঠামো থাকে। এই কাঠামো ঝিল্লির পৃষ্ঠতলকে অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। এই বিশাল এলাকা উপরে বর্ণিত রাসায়নিক বিক্রিয়াসমূহ ঘটতে সাহায্য করে। তবে সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে, ক্রিস্টার প্রান্তে ডাইমার হিসাবে অবস্থিত সক্রিয় এটিপি সিন্থেস কমপ্লেক্সই আসলে এটিপি উৎপাদনের মূল কারণ। এর অর্থ হলো, আসলে এটিপি উৎপাদনের জন্য খুব কমই ঝিল্লির প্রয়োজন হয়।
গাণিতিক মডেলের মাধ্যমে দেখা গেছে যে, সরু মাইটোকন্ড্রিয়ায় ক্রিস্টার আলোর প্রতিফলনও বিস্তারের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। এই তথ্য থেকে এখনো নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, ক্রিস্টা আলোর সাহায্যে এটিপি উৎপাদন করে। তবে, এটি একটি নতুন গবেষণা দিগন্ত খুলে দিয়েছে।[১০]