ক্ষেপণবিজ্ঞান বলতে বলবিজ্ঞানের একটি শাখাকে বোঝায় যেখানে প্রক্ষিপ্ত বস্তুর (প্রাস) উৎক্ষেপণ, উড্ডয়নকালীন আচরণ এবং এর অভিঘাতের ফলাফল অধ্যয়ন করা হয়। প্রক্ষিপ্ত বস্তুগুলির মধ্যে পাল্লাযুক্ত অস্ত্রে ব্যবহৃত গোলাবারুদ বা যুদ্ধোপকরণ যেমন গুলি, পথনির্দেশনাহীন বোমা, রকেট, ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অন্য ভাষায়, অভীষ্ট কর্মদক্ষতা অর্জনের লক্ষ্যে প্রক্ষিপ্ত বস্তু নকশাকরণ ও এগুলির গতি বৃদ্ধিকরণের বিজ্ঞান বা কলাই হলো ক্ষেপণবিজ্ঞান।
একটি নিক্ষেপী বস্তু বলতে ভরবেগবিশিষ্ট একটি অবাধে গতিশীল বস্তুকে বোঝায় যার উপরে বেশ কিছু বল কাজ করতে পারে, যেমন বন্দুকের নলের ভেতরে উচ্চচাপযুক্ত গ্যাস কর্তৃক কিংবা প্রচালক নলমুখ কর্তৃক প্রযুক্ত বল, বন্দুক বা কামানের নলমধ্যস্থ ঘূর্ণন বলের (রাইফেলিং বল) কারণে সৃষ্ট উল্লম্ব বল, এবং উড্ডয়নের সময় অভিকর্ষ বল ও বায়ুর পিছুটান বল।
একটি নিক্ষেপী ক্ষেপণাস্ত্র বলতে এমন এক ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রকে বোঝায় যেটি তার শক্তিচালিত উড্ডয়নের শুধুমাত্র তুলনামূলকভাবে সংক্ষিপ্ত প্রারম্ভিক দশাতে পথনির্দেশনা লাভ করে এবং এর গতিপথের পরবর্তী পর্যায়গুলিতে চিরায়ত বলবিজ্ঞানের সূত্রগুলি মেনে চলে। এর বিপরীতে একটি গতিনিয়ন্ত্রিত ক্ষেপণাস্ত্রকে (ক্রুজ মিসাইল) সেটির শক্তিচালিত উড্ডয়নের সময় একটি স্থির-ডানাযুক্ত উড়োযানের মতো বায়ুগতিবৈজ্ঞানিক উপায়ে পথনির্দেশনা প্রদান করা হয়।
প্রাচীনতম নিক্ষেপী বস্তুগুলি ছিল পাথর ও বর্শা,[১][২] এবং নিক্ষেপ লাঠি।
৬৪,০০০ বছর আগেকার পাথরের আগাযুক্ত প্রক্ষেপের প্রাচীনতম প্রমাণ পাওয়া গেছে বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার সিবুডু গুহ থেকে। এই ধরনের অস্ত্র ধনুক দ্বারা চালিত হতেও পারে বা নাও হতে পারে (যেমন অ্যাটলাট)।[৩]
তীর ছুঁড়তে ধনুকের ব্যবহারের প্রাচীনতম নিদর্শনগুলি প্রায় ১০,০০ বছর আগেকার; কিছু পাইনকাঠের তীর পাওয়া গেছে হামবুর্গের উত্তরে আহরেন্সবুর্গ উপত্যকায়। তাদের গোড়ায় অগভীর খাঁজ ছিল। তার থেকে বোঝা যায় যে তাদের একটি ধনুক থেকে ছোঁড়া হয়েছে।[৪] এখন পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া প্রাচীনতম ধনুকটি প্রায় ৮,০০০ বছর পুরানো। এটি পাওয়া গেছে ডেনমার্কের হোমগার্ড জলাশয়ে।
মনে করা হয় আমেরিকাতে তীরন্দাজি এসেছিল প্রায় ৪,৫০০ বছর আগে এবং সেটি এনেছিল সুমেরু অঞ্চলীয় কানাডা এবং গ্রিনল্যান্ডের প্রথম মানব বাসিন্দারা।
বন্দুক হিসাবে চিহ্নিত অস্ত্রের প্রথম ব্যবহার দেখা গিয়েছিল চীনে প্রায় ১০০০ খ্রিস্টাব্দে। এর প্রযুক্তিটি দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে এশিয়ার বাকী অংশে এবং ১৩শ শতাব্দীর মধ্যে ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।[৫]
অভিজ্ঞতাজনিত বিকাশের এক সহস্রাব্দ পরে, ১৫৩১ সালে, ক্ষেপণবিদ্যা বিষয়টি নিয়ে প্রাথমিকভাবে ইতালীয় গণিতবিদ নিকোলো তারতাইলিয়া অধ্যয়ন করেছিলেন এবং এর বিকাশ ঘটিয়েছিলেন,[৬][৭] যদিও তিনি ইবনে সিনা এবং স্যাক্সনির অ্যালবার্ট দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ছোট ছোট ভাগে সরলরৈখিক গতির ব্যবহার করছিলেন, তবে তাঁর ব্যবহারে একটু নতুনত্ব ছিল। তিনি সরল রেখাগুলিকে একটি বৃত্তাকার চাপ দিয়ে সংযুক্ত করেছিলেন। গ্যালিলিও ১৬৩৮ সালে যৌগিক গতির তত্ত্বটি প্রতিষ্ঠা করেন,[৮] ব্যালিস্টিক বক্ররেখার অধিবৃত্তসদৃশ আকারের প্রাপ্ত নীতি ব্যবহার করে তিনি এই তত্ত্বের আকার দিয়েছিলেন।[৯] ১৬৮৭ সালে ফিলোজফি ন্যাচারালিস প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা প্রকাশের সাথে সাথে আইজ্যাক নিউটন ক্ষেপণ তত্ত্বকে একটি শক্ত বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়াছিলেন।
'ব্যালিস্টিক' শব্দটি গ্রিক শব্দ βάλλειν ব্যালেইন থেকে এসেছে, যার অর্থ "নিক্ষেপ"
প্রক্ষেপ হল কোন স্থানে (শূন্যস্থান অথবা তা নয়) বল দ্বারা প্রক্ষিপ্ত কোনও বস্তু। যদিও স্থানের মধ্য দিয়ে গতিতে থাকা যে কোনও বস্তুকেই (উদাহরণস্বরূপ একটি নিক্ষিপ্ত বেসবল) প্রক্ষিপ্ত বলা যায়, এই শব্দটি দিয়ে সাধারণত একটি ব্যাপ্তিযুক্ত অস্ত্র বোঝায়।[১০][১১] প্রক্ষেপণের উড়ান পথ বিশ্লেষণ করতে গাণিতিক গতির সমীকরণসমূহ ব্যবহৃত হয়।
প্রক্ষেপণগুলির উদাহরণের মধ্যে রয়েছে বল, তীর, গুলি, কামানের গোলা, রকেট, ইত্যাদি।
ছোঁড়া অর্থ হল হাত দিয়ে একটি প্রক্ষেপণকে নিক্ষেপ করা। যদিও কিছু অন্যান্য প্রাণী ছুঁড়তে পারে, তবুও উচ্চতর নৈপুণ্য এবং ভাল সময় জ্ঞানের কারণে মানুষ অস্বাভাবিকভাবে ভাল ছুঁড়তে পারে, এবং বিশ্বাস করা হয় যে এটি একটি বিবর্তিত বৈশিষ্ট্য। ২০ লক্ষ বছর আগেকার মানুষেরও হাতে করে ছোঁড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।[১৩] অনেক ক্রীড়াবিদের মধ্যেই ছোঁড়ার বেগ প্রতি ঘণ্টায় ৯০ মাইল দেখা গেছে। শিম্পাঞ্জি যে গতিতে ছুঁড়তে পারে এটি তার থেকে অনেক বেশি, শিম্পাঞ্জির বেগ প্রায় প্রতি ঘণ্টায় ২০ মাইল।[১৩] যতক্ষণ না কোনও বস্তুকে ছোঁড়া হচ্ছে, ততক্ষণ এই ক্ষমতা, মানবের কাঁধ পেশী এবং টেন্ডনের স্থিতিস্থাপকতা সংরক্ষণ করার ক্ষমতা প্রতিফলিত করে।[১৩]
একটি গুলতি হল একটি প্রক্ষেপণ অস্ত্র। সাধারণত একটি ভোঁতা প্রক্ষেপণ, যেমন একটি পাথর বা কাদামাটি নিক্ষেপ করতে ব্যবহৃত হয় যেটিকে বলা যায় "স্লিং-বুলেট"।
একটি গুলতির দুটি দৈর্ঘ্যের দড়ির মাঝখানে একটি ছোট কাঠামো বা থলি থাকে। গুলতির পাথর ঐ থলিতে রাখা থাকে। মাঝের আঙুল বা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠটি একটি দড়ির শেষে একটি ফাঁসের মধ্যে স্থাপন করা হয়, এবং অন্য দড়ির শেষে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ এবং তর্জনীর মাঝখানে একটি হাতল রাখা হয়। এরপর গুলতিটিকে দুলিয়ে সঠিক সময়ে হাতলটি ছেড়ে দেওয়া হয়। এর ফলে প্রক্ষেপণটি মুক্ত হয়ে লক্ষ্যের দিকে উড়ে যায়।
একটি ধনুক হল নমনীয় উপাদানের একটি কাঠির টুকরা যেটি তীর নামে পরিচিত বায়ুগতিসংক্রান্ত প্রক্ষেপণগুলি নিক্ষেপ করে। একটি তন্তু এর দুই প্রান্তে বাঁধা হয় এবং যখন তন্তুটি পেছনে টানা হয়, কাঠির প্রান্তটি বক্র হয়ে যায়। যখন তন্তুটি ছেড়া দেওয়া হয়, তখন বক্র কাঠির স্থিতি শক্তি তীরের গতিশক্তিতে রূপান্তরিত হয়।[১৪] ধনুর্বিদ্যা হল ধনুক থেকে তীর ছোঁড়ার শিল্প বা খেলা।[১৫]
অবক্ষেপক হল এমন একটি যন্ত্র যেটি বিস্ফোরক যন্ত্রেরর সহায়তা ছাড়াই একটি অনেকটা দূরত্বে একটি প্রক্ষেপণকে নিক্ষেপ করতে ব্যবহৃত হয় — বিশেষত বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় অবরোধ ইঞ্জিন।[১৬] অবক্ষেপকের ব্যবহার প্রাচীন কাল থেকেই হয়ে আসছে, কারণ যুদ্ধের সময় এটি অন্যতম কার্যকর প্রক্রিয়া হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিল। অবক্ষেপক আবিষ্কার করেছিলেন প্রাচীন গ্রিক মানুষজন।[১৭][১৮]
একটি বন্দুক সাধারণত একটি নলাকার অস্ত্র বা অন্য যন্ত্র যার মাধ্যমে প্রক্ষেপণ বা অন্যান্য উপাদান মুক্ত করার জন্য ব্যবস্থা করা হয়।[১৯] প্রক্ষেপণটি কঠিন, তরল, গ্যাস, বা শক্তি হতে পারে। এটি মুক্ত বা আবদ্ধ হতে পারে। গুলি এবং কামানের কার্তুজ মুক্ত হয়ে নিক্ষিপ্ত হয়, যেখানে টিজার শলা এবং তিমি টেটা প্রক্ষেপকের সাথে আবদ্ধ থাকে। অভিক্ষেপের মাধ্যম নকশা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়, তবে সাধারণত গ্যাসের চাপের ক্রিয়া দ্বারা প্রভাবিত হয়। এই গ্যাস উৎপাদিত হয় একটি চালক যন্ত্রের দ্রুত দহনের মাধ্যমে অথবা যান্ত্রিক উপায়ে সংকুচিত এবং সঞ্চিত করে এই চাপ সৃষ্টি করা হয় যেটি চাপদণ্ডের মত একটি মুখ-খোলা নলের অভ্যন্তরে অবক্ষেপকের কাজ করে। আবদ্ধ গ্যাস নলের দৈর্ঘ বরাবর চলনশীল প্রক্ষেপণের গতি বৃদ্ধি করে, এবং নলের মুখে গ্যাসের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবার পর প্রক্ষেপণের চলন বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত বেগ প্রদান করে। বিকল্পভাবে, বৈদ্যুতিন চৌম্বকীয় ক্ষেত্র উৎপাদনের মাধ্যমে উৎপন্ন ত্বরণ ব্যবহার করা যেতে পারে যেক্ষেত্রে নলের বদলে প্রদর্শক বেড়া ব্যবহার করা যেতে পারে।
রকেট হল একটি ক্ষেপণাস্ত্র, বা মহাকাশযান, বা উড়োজাহাজ বা অন্য কোন যানবাহন যেগুলি একটি রকেট ইঞ্জিন থেকে ধাক্কা পায়। রকেটের ইঞ্জিনের নিষ্কাশন, ব্যবহারের আগে, সম্পূর্ণরূপে রকেটের অভ্যন্তরে ব্যবহৃত চালক যন্ত্র থেকে আসে।[২০] রকেট ইঞ্জিনগুলি ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া নীতি দ্বারা কাজ করে। রকেট ইঞ্জিনগুলি তাদের নিষ্কাশনটিকে অত্যন্ত দ্রুত পিছনে নিক্ষেপ করে রকেটগুলিকে সামনের দিকে এগিয়ে দেয়।
স্বল্প গতির ব্যবহারের জন্য রকেট তুলনামূলকভাবে অকার্যকর হলেও, এগুলি তুলনামূলকভাবে হালকা ও শক্তিশালী, ব্যাপক ত্বরণ উৎপন্ন করতে সক্ষম এবং যথেষ্ট দক্ষতার সাথে অত্যন্ত উচ্চ গতি অর্জন করতে পারে। রকেটগুলি বায়ুমণ্ডলের মধ্যে খুব একটা নির্ভরশীল না হলেও মহাকাশে খুব ভাল কাজ করে।
সামরিক এবং বিনোদনমূলক কাজে রকেটের ব্যবহারের তথ্য অন্তত ১৩শ শতকের চীনে পাওয়া গেছে।[২১] বিশ শতকের আগে পর্যন্ত রকেটের তাৎপর্যপূর্ণ বৈজ্ঞানিক, আন্তঃগ্রহ এবং শিল্প ব্যবহার হয়নি। এরপর রকেটবিজ্ঞান হল নভশ্চরণযুগের জন্য সক্ষম প্রযুক্তি,- চাঁদে অবতরণ সহ। এখন রকেট ব্যবহার করা হয় আতশবাজি, অস্ত্রসম্ভার, নিক্ষিপ্ত আসন, উৎক্ষেপক যান, কৃত্রিম উপগ্রহ, মানব মহাশূন্য যাত্রা এবং মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য।
রাসায়নিক রকেট গুলি হল সবচেয়ে সাধারণ ধরনের উচ্চ কার্যকারিতাসম্পন্ন রকেট এবং তারা সাধারণত রকেট চালক গ্যাসের দহন করে নিষ্কাশিত হয়। রাসায়নিক রকেটগুলি প্রচুর পরিমাণে এমন শক্তি সঞ্চয় করে যেগুলি সহজেই নির্গত হতে পারে, এবং খুব বিপজ্জনক হতে পারে। তবে, সাবধানতা নিয়ে নকশা তৈরি, পরীক্ষা, নির্মাণ এবং ব্যবহার ঝুঁকি হ্রাস করে।