খঞ্জর (আরবি: خنجر, তুর্কি: Hançer, ফার্সি: خونگر, উর্দু: خنجر, বসনীয়: Handžar) ওমানে প্রথম তৈরী হওয়া একধরনের ঐতিহ্যবাহী চাকু[১]। এটি দেখতে অনেকটা ইংরেজি অক্ষর “J”-এর মত বক্রাকৃতির নাতিদীর্ঘ তলোয়ার, যা পুরুষেরা বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠানে পরিধান করে থাকে। মানের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন উপাদান দিয়ে এটি তৈরী করা হয়। ওমানের বাজারগুলোতে এটি বিক্রি করা হয়ে থাকে এবং ভ্রমণের স্মারকচিহ্ন হিসেবে পর্যটকদের মধ্যে এটি জনপ্রিয়। সুলতানাতের ঐতিহ্যের প্রতীক খঞ্জর ওমানের জাতীয় প্রতীক ও ওমানি রিয়ালে দেখতে পাওয়া যায়। এছাড়াও এটিকে ওমানের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর লোগো এবং বিজ্ঞাপনী চিত্রকল্পগুলোতেও দেখা যায়।
ওমানি খঞ্জর প্রথম কবে তৈরী হয়েছিল তা জানা না গেলেও ওমানের রুস'আস জিবাল অঞ্চলের মধ্যভাগে অবস্থিত সমাধিফলকে পাথরের খচিত খঞ্জরের যেসব চিত্র পাওয়া গিয়েছে সেগুলো ১৭০০ শতকের শেষদিকে সংঘঠিত ওয়াহাবি আন্দোলনের পুণর্জাগনের পূর্বের সময়কার বলে ধারণা করা হয়।[২] ১৬৭২ খ্রিষ্টাব্দের জুনে মাস্কাট সফর করা ডাচ প্রজাতন্ত্রের রবার্ট প্যাডব্রাগের বর্ণনায়ও খঞ্জরের উল্লেখ রয়েছে।[৩]
এই ধরনের চাকুর ব্যবহার অটোম্যান সাম্রাজ্যের মাধ্যমে বিস্তৃতি লাভ করেছিল। বলকান অঞ্চলে এটি হ্যান্ডসার নামে পরিচিত ছিল। সেখানে অটোম্যান রক্ষীরা এটি নিয়মিতভাবে ব্যবহার করতো। আর অটোম্যান শাসনের সমাপ্তির পরেও স্থানীয়রা এই চাকু ব্যবহার করতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই চাকুর নামানুযায়ী এসএস হ্যান্ডসারের ১৩তম ওয়াফেন মাউন্টেন ডিভিশনের (১ম ক্রোয়েশিয়ান) নামকরণ করা হয়েছিল। বসনিয় মুসলিমদের সাথে কিছু ক্যাথলিক ক্রোয়াট সৈন্যেদের নকশা করা ডিভিশনটির প্রতীকেও চাকুটি দেখা যায়। “خنجر” (বাংলা উচ্চারণ প্রয়োজন) শব্দটি পার্সি শব্দ خونگر (বাংলা উচ্চারণ প্রয়োজন) শব্দের আরব সংস্করণ।[৪]
মানের উপর নির্ভর করে বিভিন্ন ধাতু ও উপকরণ দিয়ে ওমানি খঞ্জর তৈরী করা হয়। সবচেয়ে ভালো মানের (সাধারণত রাজকীয়তার জন্য) খঞ্জর তৈরীতে সোনা বা রুপা ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে স্থানীয় কারিগররা সাধারণ খঞ্জর পিতল ও তামা দিয়ে তৈরী করেন।[৫] ছুরি রাখার জন্য সোনা খচিত খাপ বা কোষের ব্যবহার ঐতিহাসিকভাবে শুধুমাত্র উচ্চশ্রেণীর ওমানিদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। সৈয়দ ও হাশিমিয়রা সমাজে তাদের প্রতিপত্তি প্রদর্শনের জন্য হাতির দাঁতের তৈরী সাদা রঙের খাপ ব্যবহার করতো। ওমান ও আরবের নাজিব আলতারফেইন সাদাহরা সাধারণত একসাথে দুইটি খঞ্জর বহন করে।[৬] ঐতিহ্যগতভাবে এধরনের ছুরির নকশা এর ভবিষ্যৎ মালিকই নির্ধারণ করে থাকেন। এক্ষেত্রে কারিগরকে ছুরির মালিকের দেওয়া “বর্ণনা” ও “পছন্দের” বিষয়টি খেয়াল রাখতে হয়। একটি খঞ্জর তৈরী করতে তিন সপ্তাহ থেকে শুরু করে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।[৩]
খঞ্জরের মূল দুইটি অংশ হচ্ছে হাতল ও এর ধারালো অংশ।[৭] এতে ব্যবহৃত উপাদানগুলোর ওপর নির্ভর করে এর দাম নির্ধারণ করা হয়।[৬] একসময় গন্ডারের শিং আর আইভরিকে[৬] খঞ্জরের দামাট তৈরীতে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হতো বিধায় এগুলো প্রচুর পরিমাণে ব্যবহার করা হতো।[৭] যদিও আইভরি ও গন্ডারের শিং ক্রয়-বিক্রয়ে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে বর্তমানে কাঠ, প্লাস্টিক এবং উটের হাঁড় অধিক প্রচলিত।[৩][৬][৭] সাধারণত দামাটের উপরের অংশ সমতল হলেও রাজপরিবারের জন্য তৈরী করা খঞ্জরের দামাটের উপর অনেকটা ক্রুশ আকৃতির হয়ে থাকে।[৭]
ওমানি খঞ্জর মূলত পরিধানকারীর দেহের সামনের দিককার মধ্যভাগের কোমরবন্ধে গুঁজে রাখা হয়।[৮] একসময় এটি প্রাত্যহিক পোশাকের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হলেও[৯] বর্তমানে শুধুমাত্র “আচার অনুষ্ঠানে পরিধেয় চাকু” হিসেবে ব্যবহৃত হয়[১০] এবং বিয়ে, প্যারেড, আনুষ্ঠানিক বৈঠক এবং কুটনৈতিক অনুষ্ঠানসহ আনুষ্ঠানিক বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান পরিধান করা হয়।[৩][১১] দ্য আরব স্টাডিজ জার্নালে জন এম. উইলিসের “সর্বব্যাপী পুরুষত্বের চিহ্ন” আখ্যায়িত[১২] খঞ্জর “পুরুষত্ব, শক্তি ও ক্ষমতার প্রতীক”[৬] হওয়ার পাশাপাশি এটিকে পরিধানকারীর সামাজিক প্রতিপত্তির নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।[৩][৯] তাই পরিবারের লোকজন বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছানো তাদের পুত্রদের খঞ্জর প্রদান করে থাকে।[৯] তাছাড়া এটি বিয়েতে বরকে দেওয়া বহুল প্রচলিত উপহারগুলোর একটি হচ্ছে।[১৩]
প্রথমদিকে খঞ্জর মূলত আক্রমণ ও আত্মরক্ষার অস্ত্র হিসেবে তৈরী করা হলেও বর্তমানে এটি শুধুমাত্র উৎসব অনুষ্ঠান ও বিভিন্ন ব্যবহারিক কাজে ব্যবহৃত হয়।[৭] মরুভূমিতে শিকার এবং শিকার করা জন্তুর চামড়া ছাড়ানো, দড়ি কাটা ইত্যাদি বিভিন্ন ব্যবহারিক প্রয়োজনে এটি কাজে লাগানো হয়।[১১] কোন ব্যক্তি প্রতিশোধ গ্রহণ বা আত্মরক্ষার জন্য খাপ থেকে খঞ্জর বের করার পর যদি কোন রক্তপাত না করে তাহলে ওমানে সেটিকে “সামাজিক ট্যাবু” হিসেবে গণ্য করা হয়।[৯]
ওমানে বহুল প্রচলিত হওয়ার পাশাপাশি[৯] খঞ্জর ইয়েমেন ও আরব আমিরাতের পুরুষেরা তাদের "ঐতিহ্যবাহী পোশাকের" একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পরিধান করে থাকে।[১৪][১৫] এছাড়াও এটি সোক ওয়াকিফ, কাতারের দোহার মত পারস্য উপসাগরীয় এলাকাগুলোতে ব্যবহার ও বিক্রি হতে দেখা যায়।[১৬] পর্যটকদের মধ্যে খঞ্জর একটি জনপ্রিয় স্মারকচিহ্ন।[৩] তাছাড়া এটি সুলতানাতের সর্বাধিক বিক্রিত স্মারকবস্তু।[১৭]
খঞ্জর ওমানের ঐতিহ্যের প্রতীক। এটিকে ওমানের জাতীয় প্রতীকে দেখা যায়।[৩][৯][১৮] ১৮শ শতাব্দী থেকে আল সাইদ রাজবংশের কুলচিহ্ন হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।[৬] আর এরই ধারাবাহিকতায় এটিকে ওমানের জাতীয় প্রতীকের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।[৮] সুলতানাত প্রবর্তীত ডাকটিকিটের পাশাপাশি[৩] এটিকে ওমানি রিয়াল[৬] বিশেষ করে এক ওমানি রিয়ালের নোটেও দেখতে পাওয়া যায়।[১৯] এছাড়াও সরকারী ভবন এবং বিভিন্ন ট্রাফিক চত্ত্বরে খঞ্জরের প্রতিকৃতি দেখা যায়।[৩][৬]
২০০৮ সালে রিব্র্যান্ডিং[২০] করার পূর্ব পর্যন্ত দেশটির পতাকাবাহী[২১] ওমান এয়ারের লোগো[৩] এবং বিমানে[৬] খঞ্জরের চিত্র ব্যাপকহারে ব্যবহৃত হতো। ওমানে ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ওমেন্টালের লোগোতেও প্রতীকী খঞ্জর দেখা যায়। ২০১০ সালে টেলিযোগাযোগ কোম্পানিটি ওমান মোবাইলের সাথে একীভূত হওয়ার পরেও নিজেদের লোগোতে খঞ্জরের ব্যবহার অব্যাহত রাখে।[২২] এছাড়াও ওমানের সুলতান আর রাজপরিবারের মালিকানাধীন পারফিউম নির্মাতা প্রতিষ্ঠান অ্যামোয়াজ[২৩] তাদের তৈরী পারফিউমের বোতলের নকশায় এধরনের ছুরির আকৃতি ব্যবহার করে। তাদের গোল্ড ফর মেন পারফিউমের বোতলের ছিপির আকৃতি খঞ্জরের হাতলের আকৃতির আর গোল্ড ফর উইমেনের ছিপি রুয়ি মসজিদের গম্বুজের অনুরূপ।[২৪]