খাদ্য সংরক্ষণ (ইংরেজি: Food preservation) হল খাদ্যদ্রব্যকে ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক (যেমনঃ ঈস্ট) এবং অন্যান্য অণুজীবের আক্রমণ থেকে রক্ষা করে এবং খাদ্যের জারণ না ঘটতে দিয়ে এর পচন রোধ করে খাদ্যের স্বাদ ও গুণমান অক্ষুণ্ন রাখার প্রক্রিয়া।
খাদ্য সংরক্ষণ করার জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া উদ্ভাবিত হয়েছে। কিউরিং, পিকলিং, হিটিং, কুলিং, ফ্রিজিং ইত্যাদি খাদ্য সংরক্ষণের জনপ্রিয় কয়েকটি প্রক্রিয়া। এছাড়াও পূর্বে বেশকিছু প্রক্রিয়া অনুসৃত হত; এ প্রক্রিয়াগুলোতে তুলনামূকলভাবে বর্তমানের চেয়ে কম শক্তিপ্রয়োগ করলেও হত, এবং তা কম কার্বন নিঃসরণ করত।[১]
সভ্যতার বিকাশের সাথে সাথে ক্রমেই খাদ্য সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কৃষির বিকাশ থেকে শিল্প বিপ্লব পর্যন্ত খাদ্য সংরক্ষণের নানান প্রক্রিয়া বিকাশ লাভ করতে থাকে। প্রধানত ২ উপায়ে খাদ্য সংরক্ষণ করা হয়ঃ প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম। প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে খাদ্য সংরক্ষণের নানান প্রক্রিয়া আছে। এসব পদ্ধতিতে খাদ্য সংরক্ষণ করলে তা স্বাস্থ্যের উপরে কোনপ্রকার বিরূপ প্রভাব ফেলে না। কৃত্রিম উপায়ে খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে যেসব রাসায়নিক পদার্থগুলোকে সীমিত মাত্রায় ব্যবহার করতে হয়। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম উপায়ে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য যথাক্রমে প্রাকৃতিক প্রিজারভেটিভ্স ও কৃত্রিম প্রিজারভেটিভ্স ব্যবহৃত হয়।[২]
খাদ্যদ্রব্যের পচন রোধের জন্য যেসকল পদ্ধতি প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে, তার মধ্যে শুষ্ককরণ অন্যতম। প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১২, ০০০ সালে মধ্য-পূর্ব এবং প্রাচ্যে সূর্যালোকের সাহায্যে খাদ্যদ্রব্যকে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা হত। সবজি এবং ফলমূল স্বাভাবিকভাবেই সূর্যালোকের মাধ্যমে শুকিয়ে সংরক্ষণ করা গেলেও মধ্যযুগের বাড়িঘরের গঠনের কারণে বাড়ির ভেতরে যথেষ্ট পরিমাণে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পারত না। তাই অনেক সময় আগুনের সাহায্যও নেওয়া হত।[৩]
শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় খাদ্যদ্রব্যের পচনকারী এনজাইমের ক্ষতিকার প্রভাব এবং অনূজীবের বংশবিস্তার রোধ করার জন্য খাদ্যকে নিম্ন তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা হয়। গরম কিংবা প্রতিকূল আবহাওয়ায় এই পদ্ধতিতে দীর্ঘদিন খাদ্যের গুণাগুণ অক্ষুণ্ন রেখে সংরক্ষণ করা যায়।
হিমায়ন বর্তমান সময় পর্যন্ত সর্বাধিক ব্যবহৃত প্রক্রিয়া। অর্থনৈতিক এবং ঘরোয়া উভয়দিক থেকেই এই পদ্ধতি অত্যন্ত জনপ্রিয়। নানা ধরনের রান্না করা কিংবা না করা খাবার এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা যায়। হিমায়নের জন্য বাণিজ্যিকভাবে হিমাগার ব্যবহৃত হয়। এর মাধ্যমে এক সময়ের খাবার অন্য সময়ে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
উত্তাপন প্রক্রিয়ায় অধিক তাপমাত্রা সৃষ্টি করে অণুজীব জন্মাতে বাঁধা দেওয়া হয়। এটিও খাদ্য সংরক্ষণের অন্যতম জনপ্রিয় একটি প্রক্রিয়া।
কিউরিং খাদ্য সংরক্ষণের একটি বহুল ব্যবহৃত প্রক্রিয়া।[২] একে সল্টিংও বলা হয়।[৪] ফ্রিজ আবিষ্কারের পূর্বে এই পদ্ধতি অধিক জনপ্রিয় ছিল। এর মাধ্যমে লবণের দ্রবণ ব্যবহার করে মাছ-মাংস প্রভৃতিকে দীর্ঘদিন অবিকৃতভাবে সংরক্ষণ করা যায়। দীর্ঘসময় সংরক্ষণ করার জন্য এই দ্রবণের সাথে সামান্য পরিমাণে ল্যাকটিক এসিড যোগ করা হয়। ল্যাকটিক এসিড অণুজীবগুলোকে বংশবিস্তার করতে বাধা সৃষ্টি করে।[২]
অনেক দেশে বিভিন্ন ঋতুভেদে নানা রকম মাছ পাওয়া যায়, কিউরিং পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে সারা বছর এই মাছ পাওয়া যায়।[২] মধ্যযুগে এই পদ্ধতি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।
সুগার বা চিনি দিয়ে উৎকৃষ্টভাবে খাদ্য সংরক্ষণ করা হয়। সাধারণত ফল, আচার, জেলী, এপ্রিকট মারমালেট প্রভৃতি সংরক্ষণের জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। চিনির গাঢ় দ্রবণ দ্বারা এই পদ্ধতিতে খাদ্য সংরক্ষণ করা হয়।[২] চিনির গাঢ় দ্রবণে অণুজীব ভালোভাবে বৃদ্ধিলাভ করতে পারেনা। ফলে খাদ্যদ্রব্য দীর্ঘদিন ভালো থাকে।[৪]
খাদ্যের তাক জীবন বৃদ্ধি করার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে ধুমায়ন অন্যতম। এই পদ্ধতিতে উদ্ভিজ্জ উপাদান, যেমনঃ কাঠ পুড়িয়ে সৃষ্ট ধোঁয়া খাদ্যে প্রয়োগ করা হয়। এই উত্তপ্ত ধোঁয়া খাদ্যের অণুজীব ধ্বংস করে দেয়। মাছ-মাংস প্রভৃতি সংরক্ষণ করার জন্য ধুমায়ন পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।[৫] অনেক সময় মাছ-মাংসের কিউরিং করার পরে ধুমায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে এদের তাক জীবন আরো বৃদ্ধি করা হয়।
পিকলিং খাদ্য সংরক্ষণের অপর একটি জনপ্রিয় পদ্ধতি। তেলে ও ভিনেগারে দু'রকম ভাবে পিকলিং করা যায়।[৪]
তেলে পিকলিং করার জন্য (আচারজাতকরণ বলা হয়ে থাকে) খাদ্যকে সিদ্ধ করে প্রথমেই মশলাযুক্ত করা হয়। পরবর্তীতে তেলে নিমজ্জিত করে সংরক্ষণ করা হয়। এর ফলে সিদ্ধ করার তাপে অণুজীব বাঁচতে পারে না এবং তেল-মশলায় তা আর জন্মাতেও পারে না। বিভিন্ন প্রকার আচার, যেমনঃ আমের আচার, মিশ্র সবজির আচার ইত্যাদির জন্য এই পদ্ধতি অনুসৃত হয়ে থাকে।[৪]
ভিনেগারে পিকলিং করার জন্য খাদ্য থেকে বীজ সরিয়ে ভিনেগারে ডুবিয়ে বোতলজাত করা হয়ে থাকে। ভিনেগার কর্তৃক সৃষ্ট অম্লীয় পরিবেশে অণুজীব বাঁচতে পারেনা। রসুনের আচার, মরিচের আচার সংরক্ষণ করা হয় এই পদ্ধতিতে।[৪]
এই পদ্ধতিতে সোডিয়াম হাইড্রোক্সাইড (লাই) দিয়ে খাদ্যের পরিবেশকে অধিক ক্ষারীয় করে তোলা হয়, যার ফলে কোনপ্রকার ব্যাকটেরিয়া জন্মাতে পারে না। তবে এই পদ্ধতিতে খাবারের স্বাদ ও গন্ধ কিছুটা বিকৃত হয়। কিছু জলপাইয়ের রান্না সহ অন্যান্য কিছু খাদ্যের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়।
কৌটাজাতকরণ খাদ্যদ্রব্য সংরক্ষণের একটি আধুনিক ও উন্নত ধরনের পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে খাদ্যদ্রব্যকে বায়ুরোধী অবস্থায় বা আগুনে শোধিত করে সাধারণত প্রিজারভেটিভ যোগ করে কৌটার মধ্যে রেখে সংরক্ষণ করা হয়, যেন এর খাদ্যমান ও স্বাদ অক্ষুণ্ন থাকে। এই খাদ্যদ্রব্যকে বহুদিন পর্যন্ত ভালো রাখা যায়।[৬] এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অক্সিজেন দূর করে খাদ্যকে জারণের হাত থেকে রক্ষা করা যায়। এছাড়াও এনজাইম বিনষ্ট এবং অনাকাঙ্খিত ব্যকটেরিয়া ধ্বংসের জন্যেও এই পদ্ধতি অত্যন্ত কার্যকর।[৭] এই পদ্ধতিতে মাছ, মাংস, ফল, সবজি এমনকি দুধও দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা যায়। এই পদ্ধতি ব্লাঞ্চিং, একজস্টিং, সিলিং, স্টেরিলাইজিং সহ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়।[৬]
জেলীকরণের মাধ্যমে খাদ্য সংরক্ষণের জন্য জেলী গঠন করে এমন পদার্থসহ খাদ্যকে সংরক্ষণ করা হয়। জেলীজাতীয় পদার্থের মধ্যে রয়েছে মেইজ ময়দা, এরারুট, আগার ইত্যাদি। এই জেলী অনূজীব বিস্তারে বাঁধা দেয়। ফলে সংরক্ষিত খাদ্যের কোন প্রকার ক্ষতি হয়না। এই পদ্ধতিতে কৌটাজাত চিংড়ি, মুরগি ইত্যাদি সংরক্ষণ করা হয়। ভাপে সিদ্ধ মাংসকেও এই পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করা হয়।[৫]
খাদ্য সংরক্ষণের এই পদ্ধতিতে সাধারণত মাংসকেই সংরক্ষণ করা হয়। এক্ষেত্রে খাদ্যকে বায়ুরোধী অবস্থায় ব্রাইন (২% লবণের জলীয় দ্রবণ) মিশিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই ব্রাইন মিশানো বায়ুশূণ্য অবস্থায় অণুজীব জন্মাতে পারে না।[৫] বিংশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই পদ্ধতি ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল।
এছাড়াও খাদ্য সংরক্ষণের আরো নানান পদ্ধতি রয়েছে। তন্মধ্যে বিকিরণ, সংশোধিত বায়ুমণ্ডল, ইলেকট্রোপোরেশন, পাস্তূরীকরণ, বায়ো সংরক্ষণ উল্লেখযোগ্য।[৫][৮]
গাঁজন হল স্টার্চ এবং চিনির এলকোহলে পরিণত হওয়ার প্রক্রিয়া, যা কিছু অণুজীবের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। তবে গাঁজন শুধু এলকোহলই তৈরি করে না, এটি খাদ্য সংরক্ষণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতিও বটে। এটি খাদ্যকে আরো পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু করে তোলে। প্রক্রিয়াজাতকৃত খাদ্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিটামিনও বহন করে থাকে।
বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বিভিন্ন সময়ে পাওয়া যায়। যেমন বাংলাদেশে বর্ষাকালে অধিক পরিমাণে মাছ পাওয়া যায়। ইলিশ মাছ সহ আরো বেশকিছু ধরনের মাছ বর্ষাকালেই পাওয়া যায়। খাদ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে এদেরকে সংরক্ষণ করতে পারলে সারা বছরই আমিষের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হয়, মাছের দামও তুলনামূলকভাবে কম হয়।[২]
অধিকাংশ খাবারই পচনশীল। এদেরকে বেশিদিন মানসম্মত অবস্থায় দীর্ঘদিন রাখা সম্ভব হয়না। কিন্তু খাদ্যকে যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে এর মান দীর্ঘদিন, এমনকি কয়েক বছর পর্যন্ত অক্ষুণ্ন থাকে।[২]
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: invalid prefix (সাহায্য)।
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: invalid prefix (সাহায্য)।
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: invalid prefix (সাহায্য)।
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: invalid prefix (সাহায্য)।
|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: invalid prefix (সাহায্য)।|আইএসবিএন=
এর মান পরীক্ষা করুন: invalid prefix (সাহায্য)।টেমপ্লেট:খাদ্য সংরক্ষণ টেমপ্লেট:রান্নার পদ্ধতি টেমপ্লেট:ভোক্তার খাদ্য নিরাপত্তা