খাব্বাব ইবনুল আরাত (মৃত্যু ৩৯ হিজরি) মুহাম্মদের একজন অন্যতম সাহাবা। তিনি উম্মু আনমারের একজন দাস ছিলেন। তিনি আরবের একজন তরবারি নির্মাতা ছিলেন।
খাব্বাব ইবনুল আরাতের মূলনাম খাব্বাব এবং উপনাম/কুনিয়াত আবু আবদিল্লাহ ।তার পিতার নাম আরাত । তাঁর বংশ সম্পর্কে মতভেদ আছে। তিনি বনু তামীম গোত্রের সন্তান।[১] তবে কোন ইতিহাসবিদ বনু খুযায়া গোত্রের সন্তান বলে উল্লেখ করেছেন। খাব্বাব সৌদি আরবের নজদে জন্মগ্রহণ করেন।
বনু তামীম গোত্র পূর্বে স্বাধীন গোত্রই ছিলো ।তবে মক্কার অন্য গোত্র তাদের আক্রমণ করে বন্ধী অবস্থায় বিক্রি করে দিলে তারা দাসে পরিনত হয়।
এরপরে কোন এক বাজার থেকে বনু খুযায়া গোত্রের উম্মু আনমার নামে এক মহিলা তাকে কিশোর অবস্থাতেই খরিদ করে। খাব্বাব কিশোর বয়সেই তরবারি নির্মান শিখে ব্যবসায় সফলতা ও পরিচিতি লাভ করে । খাব্বাব তার ব্যবসায় সততা ও নিষ্ঠার পরিচয় রাখেন এবং তিনি ইসলাম পূর্ব যুগ থেকেই আরব সমাজের বিপর্যয় ও এ থেকে উদ্ধারের উপায় এসব সম্পর্কে ভাবতেন।
এর পর তিনি ইসলামের সংবাদ শোনার সাথে সাথেই ইসলাম গ্রহণ করেন । তিনি ইসলাম গ্রহণকারী সদস্যের মধ্যে ৬ষ্ঠ ছিলেন। এই জন্য তাকে সাদেসুল ইসলাম বলা হয়। তবে মুজাহিদের বর্ণনামতে, খাব্বাব ইসলামের ৩য় মুসলমান।(উসুদুল গাবা-২/৯৮, আল-ইসাবা-১/৪২৬)। এরপর মুহাম্মদ ও তার সাহাবারা আরকাম ইবন আবিল আরকামের গৃহ থেকে গোপনে ইসলামের দাওয়াত দিতেন।
খাব্বাব ইবনুল আরাত একজন দাস ছিলেন। তাই ইসলাম গ্রহণের সাথে সাথে তার উপর অমানসিক নির্যাতনের ইতিহাস নেমে আসে । খাব্বাব তার মালিক উম্মু আনমারের ভাই সিবা ইবনে আবদিল উযযা ও তার গোত্রের লোকদের দ্বারা অনেক নির্যাতনের স্বীকার হন । এছাড়াও অনন্য কুরাইশদের দ্বারাও বিভিন্ন সময় নির্যাতনের স্বীকার হন।[২] এজন্য তিনি ইসলামের জন্য নির্যাতিত হওয়া অন্যতম সাহাবা ছিলেন।
কিন্তু ধীরে ধীরে ইসলাম গ্রহণের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকলে আবু সুফিয়ান ইবন হারব, ওয়ালীদ ইবনুল মুগীরা, আবু জাহল প্রমুখ কুরাইশ নেতৃবৃন্দ মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নিলো সংখ্যা লঘু মুসলিমদের প্রতি অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিতে হবে।
খাব্বাব ইবনুল আরাত এর শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব পরলো সিবা ইবন আবদিল উযযা ও তার গোত্রের উপর। তারা খাব্বাবকে মধ্যাহ্ন সূর্যের প্রচণ্ড খরতাপের সময় মক্কার উপত্যকায় টেনে আনতো এরপর তাকে খালি গায়ে লোহার বর্ম পরাতো। প্রচণ্ড গরমে পিপাসায় তিনি কাতর বিমর্ষ হয়ে পরতেন। তারা আবার পাথর আগুনে গরম করে সেই পাথরের উপর খাব্বাবকে শুইয়ে দিত।[৩]
খাব্বাবের বর্ণনামতে,
একদিন তারা আমাকে ধরে নিয়ে গেল । তারা আগুন জ্বালিয়ে পাথর গরম করলো এবং সেই পাথরের উপর আমাকে শুইয়ে দিয়ে আমার উপর একজন তার পা দিয়ে আমাকে ঠেসে ধরে রাখলো । (হায়াতুস, সাহাবা-১/২৯২)। এভাবেই তিনি শুয়ে থাকতেন আর তার দুই কাধের চর্বি গলে বেয়ে পড়তো।
খলীফা উমরের খিলাফতকালে একদিন খাব্বাব ইবনুল আরাত উমরের নিকটে গেলেন। খলীফা অত্যধিক সম্মান দেখিয়ে উঁচু গদির ওপর বসতে দিয়ে কুরাইশদের হাতে তিনি যে নির্যাতন ভোগ করেছিলেন তা সম্পর্কে জানতে চাইলেন।
খাব্বাব ইবনুল আরাত সংকোচ বোধ করলেও শেষ পর্যন্ত খলীফার পীড়াপীড়িতে গায়ের চাদর সরিয়ে নিজের পিঠটি আলগা করে দিলেন,এবং বললেন, কুরাইশরা আগুন জ্বালিয়ে জলন্ত অঙ্গারের উপর আমাকে উলঙ্গ করে শুইয়ে দিতো। আমার পিঠের হাড় থেকে মাংস খসে পরে সেই গলিত চর্বিই সেই আগুন নিভিয়ে দিতো । (হায়াতুস সাহাবা-১/২৯২)
এ ঘটনায় তাঁর পিঠের চামড়া শ্বেতী-রোগীর মত হয়ে গিয়েছিল।
— হায়াতুস সাহাবা বর্ণনামতে,, (হায়াতুস সাহাবা-১/২৯২), (সীরাতু ইবন হিশাম, টীকা-১/৩৪৩)
দৈহিক নির্যাতনের সাথে সাথে কুরাইশরা তাঁকে ব্যঙ্গ বিদ্রূপ ও উপহাস করতো। অনেক লোক তার পাওনা পরিশোধ করতো না। ইবন ইসহাক বলেন, আস ইবনে ওয়ায়িল আস সাহমী নামক কুরাইশ তার থেকে কিছু তরবারি ক্রয় করে অর্থ পরিশোধ করেনি বরং উপহাস করেছিলো।
তারা কয়েকজন নির্যাতিত ব্যক্তি মুহাম্মাদের নিকট নিজেদের দুর্দশার কথা বললে মুহাম্মাদ তাদের ধৈর্য ধরতে বলেন ।[৫][৬]
মক্কায় অবস্থানকালে তিনি তাঁর সবটুকু সময় ইবাদাত ও দাওয়াতি কাজে ব্যয় করতেন। মক্কায় তখনও যারা ভয়ে নিজেদের ইসলাম গ্রহণের কথা প্রকাশ করেনি, তিনি গোপনে তাদের বাড়ীতে গিয়ে কুরআন শিক্ষা দিতেন।
উমরের বোন-ভগ্নিপতি ফাতিমা ও সাঈদকে তিনি গোপনে কুরআন শিক্ষা দিয়েছেন। যেদিন উমর মুহাম্মদকে হত্যার উদ্দেশ্যে বের হয়ে এবং পথে নুয়াইম ইবনে আবদুল্লাহর নিকট তার বোন-ভগ্নিপতির ইসলাম গ্রহণের খবর শুনে তাদের বাড়ীতে উপস্থিত হলেন, ঐ দিন তখন খাব্বাব ইবনুল আরাত তাদের কুরআন শিক্ষা দিচ্ছিলেন। উমরের উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি ফাতিমার বাড়ীর এক কোণে আত্মগোপন করেন। পরে উমর নমনীয় হলে খাব্বাব বের হয়ে আসেন এবং ইসলাম গ্রহণ করতে সাহায্য করেন।[৭][৮]
একদিন কুরাইশদের দুই নেতা আকরা ইবন হাবিস ও উয়াইনা ইবন আল-ফাযারি মুহাম্মদের নিকট এসে দেখলো, তিনি আম্মার ইবনে ইয়াসির, সুহাইব ইবনে সিনান, বিলাল ইবনে রাবাহ, খাব্বাব ইবনুল আরাত প্রমুখ দাস ও মুক্ত সাহাবাদের সাথে বসে আছে ।কুরাইশ নেতাদ্বয় মুহাম্মদকে বলল, হুজুর ! আমরা আরবের নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধি আপনার কাছে আসি। এই দাসদের সাথে আমরা একসঙ্গে বৈঠক করি এটা আমাদের আত্নসম্মানে লাগে। অনুগ্রহ করে আমরা যখন আপনার নিকট আসি আপনি দাসদের দূরে সরিয়ে রাখবেন। মুহাম্মদ এই প্রস্তাবে রাজি হয়ে যান।
আল্লাহ্ সঙ্গে সঙ্গে এই আয়াত নাজিল করেন-
"যারা তাদের প্রতিপালককে সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে ডাকে তাদের তুমি দূরে সরিয়ে দিওনা। তাদের কর্মের জবাবদিহির দায়িত্ব তোমার নয় এবং তোমার কোনো কর্মের জবাবদিহীর দায়িত্ব তাদের নয় যে, তুমি তাদের বিতাড়িত করবে। আর তা করলে তুমি যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হবে -- (সূরা আল আনআমঃ ৫২) ।”
পরে মুহাম্মদ এই প্রস্তাব প্রত্যাখান্য করেন এবং খাব্বাব বলেন, এর পর থেকে আমরা যখনই রাসুল সাথে বসতাম, আমরা না ওঠা পর্যন্ত তিনি উঠতেন না।[৯]
খাব্বাব দীর্ঘকাল মক্কার কুরাইশদের নির্যাতন ধৈর্যের সাথে সহ্য করে মক্কার মাটি আঁকড়ে থাকেন। অবশেষে মুসলমানদের হিজরত করা শুরু হলে তিনি প্রথম দিকেই মদীনায় হিজরাত করেন মদীনায় আসার পর মুহাম্মদ তাকে খিরাশ ইবনে সাম্মার সাথে মতান্তরে জিবর ইবনে উতাইকের তার সাথে দ্বীনী-ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে দেন।[১০] মদীনায় আসার পর খাব্বাব পূর্ণ শান্তি ও নিরাপত্তা পান।
মদিনায় তিনি মুহাম্মদের একান্ত সান্নিধ্য লাভের সুযোগ পান। বদর ও উহুদসহ সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহণ করেন। উহুদের যুদ্ধে তিনি উম্মু আনমারের ভাই সিবা ইবন আবদিল উযযা হামযার হাতে নিহত হন, খাত্তাব তার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন।
খাব্বাব ইবনুল আরাতের সারাটি জীবন দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত হলেও জীবনের শেষ ভাগে তার যথেষ্ট সচ্ছলতা আসে। খলিফা উমর ও উসমানের খিলাফতকালে যখন সকল সাহাবীর নিজ নিজ মর্যাদা অনুসারে ভাতা নির্ধারিত হয়, খাব্বাব তখন থেকে মোটা অঙ্কের ভাতা লাভ করেন। তখন প্রচুর অর্থ তাঁর হাতে জমা হলে তিনি এই সব অর্থ অভাবগ্রস্থ ও দরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।
তিনি মুহাম্মদ থেকে ৩৩ টি হাদীস বর্ণনা করেছেন। তম্মধ্যে তিনটি বুখারী ও মুসলিম উভয়ই বর্ণনা করেছেন। দুটি বুখারী ও একটি মুসলিম এককভাবে বর্ণনা করেছেন।
সাহাবা ও তাবেয়ীদের মধ্যে যে সকল উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব তাঁর নিকট থেকে হাদীস বর্ণনা করেছেন তাঁরা হলেনঃ
৩৭ হিজরিতে তিনি কুফায় রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন, বিভিন্ন চিকিৎসা সত্বেও রোগ দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে ও দীর্ঘদিন রোগ যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকেন।[১১][১২] অবশেষে ৩৯ হিজরিতে সিফফীন যুদ্ধের পর ৭২ বছর বয়সে কুফায় মৃত্যুবরণ করেন। খলিফা আলী নামাযে জানাযার ইমামতি করেন। এবং তার ইচ্ছা অনুসারে কুফা শহরের বাইরে তাকে কবর দেওয়া হয়।[১৩]