খালিদ মিশাল (আরবি: خالد مشعل, প্রতিবর্ণীকৃত: Khalid Mishal) জন্ম ২৮ মে ১৯৫৬) একজন ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক নেতা যিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রধান।
১৯৮৭ সালে হামাস প্রতিষ্ঠার পর মিশাল সংগঠনের কুয়েতি শাখার নেতা হন।[১] ১৯৯২ সালে তিনি হামাসের পলিটব্যুরোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য[২] এবং এর চেয়ারম্যান হন। ২০০৪ সালের বসন্তে ইসরায়েল শেখ আহমেদ ইয়াসিন এবং তার উত্তরসূরি আবদেল আজিজ আল-রানতিসি উভয়কেই হত্যা করার পরে তিনি হামাসের স্বীকৃত প্রধান হন।[৩] তার নেতৃত্বে হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি আইনসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। ২০১৭ সালে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর হামাসের পলিটব্যুরো চেয়ারম্যানের পদ থেকে সরে দাঁড়ান মিশাল।[৪][৫]
১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধের সময় থেকে তিনি নির্বাসনে রয়েছেন।
মিশাল ১৯৫৬ সালে জর্ডান অধিকৃত পশ্চিম তীরের সিলওয়াদে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সিলওয়াদ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন।[২] তার পিতা আব্দুল কাদির মাশাল একজন কৃষক ছিলেন[৬] এবং ১৯৫৭ সালে কুয়েতে কৃষি কাজ এবং ইমাম হিসেবে কাজ করার জন্য চলে আসেন। তিনি ফিলিস্তিনি গেরিলা নেতা আবদুল কাদির আল-হুসাইনির সাথে ১৯৩৬-১৯৩৯ আরব বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করেছিল।[২]
১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধের পরে, ইসরায়েল পশ্চিম তীর দখল করলে, তার পরিবার জর্ডানে পালিয়ে যায়[৭] এবং এক বা দুই মাস পরে তারা কুয়েতে আবদুল কাদিরে যোগদান করে,[২] যেখানে মাশাল উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়া শেষ করে।[৮] তিনি ১৯৭০-এর দশকের গোড়ার দিকে আবদুল্লাহ আল-সেলিম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন[৯] এবং ১৯৭১ সালে মুসলিম ব্রাদারহুডে যোগ দেন।[২][১]
মাশাল ১৯৭৪ সালে কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন,[২] এবং শীঘ্রই ছাত্র রাজনীতিতে জড়িত হন। তিনি ১৯৭৭ সালে ফিলিস্তিনি ছাত্র ইউনিয়নের (জিইউপিএস) নির্বাচনে ইসলামিক জাস্টিস লিস্টের (কায়েমাত আল-হক আল-ইসলামিয়া) নেতৃত্ব দেন।[২] তালিকাটি মুসলিম ব্রাদারহুডের একটি অংশ ফিলিস্তিনি ইসলামী আন্দোলনের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছিল।[২] জিইউপিএস নির্বাচন বাতিল করা হয়। তিনি ১৯৭৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে।
স্নাতক হওয়ার পরে, মশাল একজন শিক্ষক হন এবং ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কুয়েতে পদার্থবিজ্ঞান পড়ান।[২] ১৯৮৩ সালে ফিলিস্তিনি ইসলামী আন্দোলন একটি আরব রাষ্ট্রে একটি অভ্যন্তরীণ, বন্ধ সম্মেলন আহ্বান করে, যার মধ্যে পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা এবং আরব রাষ্ট্র থেকে ফিলিস্তিনি শরণার্থী প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত ছিল। সম্মেলনে হামাস গঠনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।[২] মাশাল এই প্রকল্পের নেতৃত্বের অংশ ছিলেন। ১৯৮৪ সালের পরে, তিনি পূর্ণ-সময়ের ভিত্তিতে এই প্রকল্পে নিজেকে নিবেদিত করেন। ১৯৯০ সালের আগস্টে ইরাক যখন কুয়েত আক্রমণ করে, তখন তিনি এবং কুয়েতে হামাসের বাকি নেতৃত্ব জর্ডানে স্থানান্তরিত হন।[১০]
মাশাল হামাসের পলিটব্যুরোর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন, এবং ১৯৯৫ সালে তার পূর্বসূরি মুসা মোহাম্মদ আবু মারজুকের কারাবাসের পরে ১৯৯৬ সালে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।[১০]
১৯৯৭ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার নির্দেশে মোসাদের এজেন্টরা তাকে হত্যার চেষ্টা করে। এজেন্টরা ভুয়া কানাডিয়ান পাসপোর্টে এবং পর্যটকের ছদ্মবেশে জর্ডানে প্রবেশ করেছিল। তাদের মধ্যে দুজন জর্ডানের রাজধানী আম্মানে হামাসের অফিসের প্রবেশদ্বারে অপেক্ষা করছিল এবং মাশাল যখন তার অফিসে প্রবেশ করতে যাবে, তখন তাদের মধ্যে একজন পেছন থেকে এসে মিশালের বাম কানে একটি ডিভাইস দিয়ে কানে অভিনব বিষ প্রয়োগ করে।[১১][১২][১৩] হামলার আগে মিশালের দেহরক্ষীরর কাছে তাদের গতিবিধি সন্দেহজনক ছিল এবং এজেন্টদের তাড়া করতে এবং তাদের ধরতে সক্ষম হয়।[৭] এক সাক্ষাত্কারে তিনি এই হামলাকে "আমার কানে প্রচণ্ড আওয়াজ হয়..." যা ধরাম শব্দ ও বৈদ্যুতিক শকের মতো বলে বর্ণনা করেছেন।[৭] প্রাথমিকভাবে, তিনি ভেবেছিলেন যে এজেন্টরা তাকে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়েছে তবে পরে তিনি তীব্র মাথা ব্যথা অনুভব এবং বমি করতে শুরু করেন। তাকে জর্ডানের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় যেখানে তার অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে।
ঘটনার পরপরই জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় হুসেইন নেতানিয়াহুকে বিষের প্রতিষেধক হস্তান্তরের দাবি জানান, কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার এবং আটক মোসাদের এজেন্টদের বিচারের হুমকি দেন।[১৪] বাদশাহ হুসেইন আশঙ্কা করেছিলেন যে হামাসের একজন নেতার মৃত্যু তার দেশে দাঙ্গা সৃষ্টি করবে, এমনকি গৃহযুদ্ধও। নেতানিয়াহু তা প্রত্যাখ্যান করে এবং ঘটনাটি দ্রুত রাজনৈতিক সংকট তৈরি করে। ইসরায়েল-জর্ডান সম্পর্কের দ্রুত অবনতির সাথে সাথে বাদশাহ হুসেইন হুমকি দিয়েছিলেন যে মিশাল মারা গেলে দুই দেশের মধ্যে ১৯৯৪ সালের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি বাতিল করা হবে।[১২] মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন হস্তক্ষেপ করে এবং নেতানিয়াহুকে প্রতিষেধক ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করেন।[১৫]
মোসাদের প্রধান ড্যানি ইয়াটম নেতানিয়াহুর সম্মতি নিয়ে জর্ডানে উড়ে যান এবং মাশালের চিকিৎসার প্রতিষেধক নিয়ে আসেন।[১৩] কিং হুসেন মেডিকেল সেন্টারের চিকিৎকরা, যেখানে মিশাল কোমায় ছিলেন, মিশালের লক্ষণগুলি ওপিওয়েড ওভারডোজের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে পর্যবেক্ষণ করেন।[১৬] ডাক্তারদের প্রতিষেধক প্রয়োগ করার ফলে মিশালের জীবন বেঁচে যায়।
অভ্যন্তরীণ আইডিএফ সূত্রের ভিত্তিতে রোনেন বার্গম্যানের বলেন যে, মিশালের প্রতিষেধক কেবল মাত্র মোসাদ কিডন (স্পেশাল এলিট) এজেন্টকে মুক্তি দিয়েছে যারা হত্যার চেষ্টা করেছিল। অভিযানে জড়িত মোসাদের আরও অন্তত ছয় জন এজেন্ট ইসরাইল দূতাবাসে লুকিয়ে ছিলেন। ইসরায়েল আহমেদ ইয়াসিন এবং অন্যান্য বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দীকে মুক্তি দিলেই বাদশাহ হুসেইন তাদের মুক্তি দেবেন।[১৭]
২০০৮ সালের একটি সাক্ষাত্কারে, মাশাল তার জীবনের প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলেছিলেন: "[এই ঘটনা] আমাকে জীবন সম্পর্কে আরও ইতিবাচক করে তুলেছে। মৃত্যুর মুখে আমি আরও সাহসী হয়ে উঠেছি। আমার বিশ্বাস আরও দৃঢ় হয়েছে যে একজন মানুষ তার সময় না আসা পর্যন্ত মারা যায় না। অর্থাৎ আল্লাহ যখন সিদ্ধান্ত নেবেন, তখন আমি মরব, মোসাদ যখন সিদ্ধান্ত নেবে তখন নয়। এটি আমাকে আমার দায়িত্ব পালনে আরও দৃঢ় করে তুলেছে।[১৮]
১৯ সালের আগস্টে জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ হামাসের 'বহিরাগত নেতৃত্ব'কে বহিষ্কার করেন।[২] বাদশাহ আশঙ্কা করেছিলেন যে হামাস এবং তার জর্ডানের মিত্রদের কার্যক্রম ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এবং ইসরায়েলের মধ্যে শান্তি আলোচনাকে বিপন্ন করবে এবং হামাসকে জর্ডানের অভ্যন্তরে অবৈধ ক্রিয়াকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগ আনেন।[১৯]
১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে, কর্তৃপক্ষ ইরান সফর থেকে ফিরে আসার সময় মিশাল এবং ইব্রাহিম ঘোষেহ সহ বেশ কয়েকজন হামাস নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং তাদের বিরুদ্ধে একটি অবৈধ সংগঠনের সদস্য হওয়া, অস্ত্র মজুদ করা, সামরিক মহড়া পরিচালনা করা এবং জর্ডানকে প্রশিক্ষণ ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করার অভিযোগ আনা হয়,[১৯][২০] যা তারা অস্বীকার করে।[১৯] মিশালকে জর্ডান থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং প্রাথমিকভাবে কাতারকে তার আবাসস্থল করা হয়।[২১] ২০০১ সালে তিনি সিরিয়ার দামেস্কে চলে যান।[১]
হামাস ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনি আইনসভা নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে।
কোয়ার্টেটের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,জাতিসংঘ,ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়া) চাপ উপেক্ষা করে মিশাল ২৯ শে জানুয়ারী ২০০৬ সালে ঘোষণা করেন যে হামাসের নিরস্ত্র হওয়া কোনও পরিকল্পনা নেই তবে হামাস অন্যান্য ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর সাথে অস্ত্রসহ যোগ দিতে এবং "যে কোনও স্বাধীন রাষ্ট্রের মতো" একটি সেনাবাহিনী গঠন করতে ইচ্ছুক।[২২] ফলে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী শৌল মোফাজ মিশালকে হত্যার হুমকি দেয়।[২৩]
"Netanyahu in spotlight as assassination plot unravels"। CNN। ১৯৯৭। Archived from the original on ৮ মার্চ ২০০৮। সংগ্রহের তারিখ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০৩।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link) উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: বট: আসল-ইউআরএলের অবস্থা অজানা (link)
Barnard, Anne; Mourtada, Hania (২ অক্টোবর ২০১২)। "Syrian State TV Lashes Out at Hamas Leader"। The New York Times। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০২০।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Sebastian, Tim (১৯ এপ্রিল ২০০৪)। "Hamas: Khaled Meshaal"। BBC News। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০২০।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Bowen, Jeremy (৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৬)। "Transcript: Khaled Meshaal interview"। BBC News। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০২০।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
"Navigating the Winds of Change"(পিডিএফ)। The Majalla। 1573: 36–38। জুন ২০১২। ৩০ জুলাই ২০১৩ তারিখে মূল(পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৪ এপ্রিল ২০১৩।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
"Profile: Khaled Meshaal of Hamas"। BBC News। ৮ ফেব্রুয়ারি ২০০৬। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২০।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Bensman, Todd (১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৬)। "Hamas's Rock Star"। Washington Examiner। সংগ্রহের তারিখ ৩১ অক্টোবর ২০২০।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Abu Hilalah, Yaser (৩০ জানুয়ারি ২০১৩)। "Kill Him Silently"। Al Jazeera। ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৩০ জানুয়ারি ২০১৩।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Tesch, Noah; Lotha, Gloria (৮ সেপ্টেম্বর ২০২০)। "Khaled Meshaal - Biography & Facts"। Encyclopædia Britannica। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০২০।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Altman, Alex (৪ জানুয়ারি ২০০৯)। "Hamas Leader Khaled Mashaal"। Time। সংগ্রহের তারিখ ১ নভেম্বর ২০২০।উদ্ধৃতি টেমপ্লেট ইংরেজি প্যারামিটার ব্যবহার করেছে (link)
Mishal's Luck, review by Adam Shatz of the book Kill Khalid: The Failed Mossad Assassination of Khalid Mishal and the Rise of Hamas by Paul McGeough, London Review of Books, 14 May 2009