গাই ফক্স (//; ১৩ই এপ্রিল ১৫৭০ – ৩১শে জানুয়ারি ১৬০৬),[ক] গাইডো ফক্স নামেও পরিচিত। স্পেনীয়দের জন্য সংগ্রামকালে তিনি এই নাম গ্রহণ করেন। গাই ফক্স একজন ইংরেজ ক্যাথলিক এবং ১৬০৫ সালের গানপাউডার প্লটের পরিকল্পনাকারী। যদিও এই পরিকল্পনা পরবর্তীতে ভেস্তে গিয়েছিল।
ফক্সের জন্ম ও বেড়ে ওঠা ইয়র্ক শহরে। আট বছর বয়সেই তিনি পিতাকে হারান এবং তার মা একজন ক্যাথলিককে বিবাহ করেন। এরপর ফক্স ক্যাথলিক দীক্ষায় দীক্ষিত হন এবং মহাদেশ ত্যাগ করেন। ক্যাথলিকদের হয়ে তিনি ওলন্দাজ বিদ্রোহে অংশ নেন। ইংল্যান্ডের বিদ্রোহী স্পেনীয় ক্যাথলিকদের সাহায্যে তিনি স্পেনে ভ্রমণ করেন, তবে সেখানে এক্ষেত্রে কোন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। পরবর্তীতে তিনি থমাস উইন্টুরের সাক্ষাত পান এবং তার সাথে পুনরায় ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন।
উইন্টুর ফক্সকে রবার্ট ক্যাটসবাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। রবার্ট রাজা জেমস প্রথম কে হত্যা করে একজন ক্যাথলিক রাজাকে সিংহাসনে আসীনের পরিকল্পনা করছিলেন। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা মার্কিন যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট, হাউজ অব লর্ডের বেইসমেন্ট লীজ নেয়া হয়। ফক্সের দায়িত্ব ছিল বেইসমেন্টের গানপাউডার সংগ্রহ করে রাখা। একটি অজ্ঞাত চিঠি পেয়ে কর্তৃপক্ষ ৫ই নভেম্বর ওয়েস্টমিনিস্টার প্রাসাদে তল্লাশী চালায়। এসময় গাই ফক্স বিস্ফোরকসহ ধরা পড়েন। টানা জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনে ফক্স নিজেদের পরিকল্পনার কথা স্বীকার করেন। এরপর-পরই ৩১শে জানুয়ারি ফক্সের মৃত্যুদন্ডাদেশ দেয়া হয়। ফাসির কাষ্ঠাদেশ থেকে ঝুলন্ত ফক্স মাটিতে পড়ে ঘাড় ভেঙে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু বরণ করেন।
১৬০৫ সালের ৫ই নভেম্বরে ব্যর্থ হওয়া গানপাউডার প্লটের প্রতীক গাই ফক্স হয়ে উঠেন। যুক্তরাজ্যের ৫ই নভেম্বর আতসবাজী ও ফক্সের কুশপুত্তলিকা আগুন জ্বালিয়ে পালন করা হয়।
১৫৯১ সালে পিতৃসূত্রে পাওয়া সম্পত্তি ফক্স বিক্রি করে দেন।[খ] তিনি ইউরোপ জুড়ে ভ্রমণ করে ওলন্দাজ যুদ্ধে অংশ নেন। একজন ক্যাথলিক হিসেবে তিনি ওলন্দাজদের বিপক্ষে যুদ্ধ করেন।[১] ইংল্যান্ডের ক্যাথলিক বিদ্রোহীদের সাহায্য প্রার্থনায় তিনি স্পেনে যান। এইসময় তিনি নিজের নামের ইতালিয়ান রূপ, গাইডো ব্যবহার শুরু করেন। এই সময়ে রচিত স্মৃতিকথা ফক্স জেমস ১মকে "প্রচলিত ধর্মবিশ্বাসের বিরূদ্ধে" বলে মন্তব্য করেন। সেই বছরই জেমস ১ম ইংল্যান্ডের রাজা হন। [২] ফিলিপ ২য়র আদালত ফক্সকে কোন প্রকার সাহায্য দিতে অপারগতা জানায়। [২]
১৬০৪ সালে ফক্স একটি ছোট ইংরেজ ক্যাথলিক দলে সংস্পর্শে আসেন। এদের মধ্য দিয়েই ফক্সের সাথে রবার্ট ক্যাটসবাইয়ের পরিচয় হয়। তারা জেমস ১মকে হত্যা করে এলিজাবেথকে রাণী করার পরিকল্পনা করেন।[৩][২] ফক্সের প্রাক্তণ বিদ্যালয়কালীন বন্ধু ও ধর্ম প্রচারক অসওয়াল্লড টেসিমন্ড ফক্সকে "হাসিখুশি, ঝগড়া-ঝঞ্ঝাটবিহীন এবং বন্ধুবৎসল" বলে বর্ণনা করেন। টেসিমন্ড অবশ্য ফক্সকে যুদ্ধের ব্যাপারে উচ্চ দক্ষতা অস্মপন্ন বলেও উল্লেখ করেন। তার মতে ফক্সের ধার্মিকতা ও নিজের কাজের ব্যাপারে দায়িত্বজ্ঞানবোধের সমন্বয় ফক্সকে অন্যান্যদের মাঝে শ্রদ্ধার পাত্র করে তুলেছিল। কথাশিল্পী এন্টনিয়া ফ্রেসার ফক্সকে " ঘন লালচে চুল, সে সময়ের প্রচলিত স্টাইলের গোঁফ এবংলালচে-বাদামী দাঁড়িতে লম্বা ও শক্ত গড়নের পুরুষ" বলে আখ্যায়িত করেছেন। ফক্সের দৈহিক বৈশিষ্ট্যের চেয়ে তার বুদ্ধিমতাত ছিল আরো বেশি চমকপ্রদ যা তার শত্রুদের হতবুদ্ধি করে দিত বলে এই কথাশিল্পী ব্যক্ত করেছেন।
গ্রেফতার হওয়ার পর প্রথমে ফক্স নিজের পরিচয় জন জন্সন দেয়। এ অবস্থায় ফক্স সম্পূর্ণভাবে আত্মপক্ষ সমর্থন করছিলেন।[৪] এখানে তাকে এত বিপুল পরিমান গানপাউডার সংগ্রহে রাখার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, " তোমাদের নিজেদের পাহাড়ে বসবাসরত স্কচ ভিক্ষুকদের উড়িয়ে দিতে" বলে মন্তব্য করেন। [৫] তিনি নেদারল্যান্ডের ইয়র্কশায়ার থেকে আসা ৩৬ বছর বয়েসী ক্যাথলিক বলে নিজের পরিচয় দেন। এসময় তিনি মায়ের নাম এডিথ জ্যাকসন এবং পিতার নাম থমাস বলে উল্লেখ করেন। তার শরীরের ক্ষতচিহ্হের কারণ প্রশ্নকর্তা জানতে চাইলে তা প্লুরোসি রোগের কারণে বলে তিনি জানান। ফক্স ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবন উড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা এক পর্যায়ে স্বীকার করেন এবং পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়াতে আফসোস প্রকাশ করেন।স্বয়ং রাজা জেমস তার দৃঢ়তার প্রশংসা করেন। [২]
অবশ্য রাজা জেমসের প্রশংসা ফক্সকে নির্যাতন থেকে রক্ষা করতে পারেনি। বরং রাজার আদেশে ৬ই নভেম্বর থেকে "জন জন্সন"কে নির্যাতন করা শুরু হয়। [২] তাকে প্রথমদিকে হাল্কা নির্যাতনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, যেন পরে ধীরে ধীরে নির্যাতনের হার বাড়ানো হলে তা অসহ্যকর হয়ে উঠে। [২] ফক্সকে টাওয়ার অব লন্ডনে স্থান্তরিত করা হয়। রাজা নিজে ফক্সকে জিজ্ঞাসাবাদের প্রশ্ন তৈরি করেন।[২] ফক্সকে যে কক্ষে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় সেই কক্ষটি পরবর্তীতে গাই ফক্স রুম নামে পরিচিতি পায়। [৬]
স্যার উইলিয়াম ওয়াড, টাওয়ারের তৎকালীন লেফটেন্যান্ট ফক্সের জিজ্ঞাসাবাদ ও নির্যাতনের তদারকি করেছিলেন। তিনি আটক্কৃতকে তল্লাশি করে একটি চিঠি পান, যা গাই ফক্সের উদ্দেশ্যে ছিল। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে "জন্সন" নামধারী ফক্স নিরব থাকেন এবং নিজেদের পরিকল্পনা কিংবা চিটহির লেখক অন্য কোন সহচরের নাম প্রকাশ করেননি। [৭] ৬ই নভেম্বর তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নির্যাতন করা শুরু হলে এক পর্যায়ে তিনি নিজের দৃঢ় মনোবল হারাতে শুরু করেন। [২]
৭ই নভেম্বর ফক্স নিজের আসল পরিচয় প্রকাশ করেন। একই সাথে আরো পাঁচজন তার সাথে এই পরিকল্পনায় জড়িত বলে জানান। অবশয় অন্যান্য সহচরের নাম তিনি ৮ই নভেম্বর প্রকাশ করেন। একই সাথে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজকন্যা এলিজাবেথকে সিংহাসনে বসানোর কথাও জানান। [৭] স্বীকারোক্তির কাগজে ফক্সের স্বাক্ষর থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায় যে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তার উপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল।[২]
আটজন ষড়যন্ত্রকারীদের বিচার ১৬০৬ সালের ২৭শে জানুয়ারি শুরু হয়। ফক্স ওয়েস্টমিনিস্টার প্রাসাদের বাকী সাতজনের সাথে একই কক্খে ছিলেন। [গ] তার অন্যান্য সহচরের সাবাই নিজের দোষ স্বীকার করলেও গাই ফক্স শেষ অব্দি কোন দোষ স্বীকার করেননি। [২]
অবশ্য জুরিবোর্ড বিনা দ্বিধায় ফক্সকে দোষী সাব্যস্ত করে।লর্ড চীফ জাস্টিস স্যার জন পপহাম ফক্সের সর্বোচ্চ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করেন। [২] এটর্নী জেনারেল স্যার এডওয়ার্ড কোক দোষীদের মৃত্যুদণ্ড জারি করেন।[৪] [২]
১৬০৬ সালের ৩১শে জানুয়ারি ফক্স এবং আরো তিনজনের মৃত্যুদন্ডের প্রস্তুতি নেয়া হয়। [৯] তার সহচরদের মৃত্যুদণদ হয়ে গেলেও ফক্সকে সবার শেষে ফাঁসিতে চড়ানো হয়। ঘটনাক্রমে ফাসির মঞ্চ থেকে পড়ে গিয়ে ঘাড় ভেঙে ফক্সের মৃত্যু ঘটে। [২][১০] তৎকালীন নিয়মানুসারে শাস্তির অংশ হিসেবে ফক্সের দেহাবশেষ রাজ্যের চার কোনায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়েছিল।[১১] [১২]
ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক জেমস শারপে "পার্লামেন্টে সৎ উদ্দেশ্যে প্রবেশকারী শেষ ব্যক্তি" বলে বর্ণনা করেছেন। [১০]
উইলিয়াম হ্যারিসন আইসওর্থের ঐতিহাসিক প্রেমের গল্প গাই ফক্স;অথবা দি গানপাউডার (১৮৪১) পরিকল্পনা বইয়ে ফক্সের চরিত্রকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখা হয়েছে।[১৩] এর মাধ্যমেই ফক্স "কাল্পনিক চরিত্র হিসেবে" সাধারণ জনতার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া শুরু করে। ১৯০৫ সালে শিশুদের বইয়ে "নায়কের চরিত্রে" গাই ফক্সকে দেখানো হয়।.[৪] ঐতিহাসিক লুয়িস কলের মতে আধুনিক রাজনীতির সংস্কৃতিতে গাই ফক্স শক্তিশালী প্রতীক বলে অভিহিত করেন। [ঘ] ২০শ শতকের শেষে কমিক বই সিরিজ "ভি ফর ভেনেদেত্তা"য় ভি পরিহিত মুখোশ উক্ত প্রতীকের উদাহরণ হিসেবে রূপ নেয়। কমিক সিরিজের ভি চরিত্রটি কাল্পনিক ইংরেজ রাজ্যে ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালায়।[১৪]
টীকা