গামা ক্যামেরা, আরো বলা হয় সাইন্টিলেশন ক্যামেরা বা অ্যাঙ্গার ক্যামেরা একধরনের যন্ত্র যা গামা বিকিরণ নির্গমনকারী রেডিওআইসোটোপসমূহ ইমেজ করার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই প্রযুক্তিকে বলা হয় সাইন্টিগ্রাফি। সাইন্টিগ্রাফির কাজসমূহের মধ্যে রয়েছে ঔষধের উন্নয়ন এবং নিউক্লিয় মেডিকেল ইমেজিং যার ফলে মানবদেহের বা দেহে মেডিকেল উপায়ে প্রয়োগকৃত, নিশ্বাসের সাথে গৃহীত বা পাকস্থলীতে পরিপাককৃত গামা রশ্মি নির্গমনকারী রেডিওনিউক্লাইডসমূহর বণ্টন বিশ্লেষণ করা হয়।
একটি গামা ক্যামেরা তৈরি হয় এক বা তার চেয়ে বেশি জোড়া চেপটা স্ফটিক প্লেন (বা ডিটেক্টর) নিয়ে গঠিত যা একটি ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউবের শ্রেণিবিন্যাসের সাথে দৃষ্টি মিলিত হয়। এই সম্মিলন "মাথা" নামে পরিচিত এবং তা একটি গ্যান্ট্রি'র (ভার রক্ষার জন্য নির্মিত ইস্পাত-খাঁচার কাঠামো) ওপর স্থাপিত থাকে। গ্যান্ট্রি একটি কম্পিউটার ব্যবস্থার সাথে যুক্ত যা ক্যামেরার কাজ নিয়ন্ত্রণ করে এবং তার সাথে সাথেই অর্জিত ছবি অধিগ্রহণ এবং ধারণ করে।
ব্যবস্থাটি ক্যামেরার মধ্যকার ক্রিস্টাল কর্তৃক শোষিত গামা ফোটন ঘটনা সংগ্রহ করে বা গণনা করে। সাধারণত হালকাকরে বন্ধ করা খাঁচার মধ্যে সোডিয়াম আয়োডাইডের সাথে থেলিয়ামের ডোপিং করা একটি বড় চেপটা ক্রিস্টাল ব্যবহৃত হয়। গামা রশ্মি শনাক্ত করার জন্য উচ্চমাত্রার ধারণকারী এই মিশ্রণের পদ্ধতি ১৯৪৪ সালে স্যার স্যামুয়েল কুরান আবিষ্কার করেন।[১][২] তিনি তখন বার্কলির ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ম্যানহাটন প্রকল্প নিয়ে কাজ করছিলেন। নোবেল পুরস্কারজয়ী পদার্থবিদ রবার্ট হফস্টাডটার ১৯৪৮ সালে এই পদ্ধতির ওপর কাজ করেছিলেন।[১].
ক্রিস্টাল স্ফুলিঙ্গায়িত হয়ে গামা তেজস্ক্রিয়তার এ ঘটনা ঘটায়। যখন একটি গামা ফোটন রোগী (যার ওপর তেজক্রিয়ফার্মাসিউটিকাল প্রয়োগ করা হয়েছে) থেকে চলে যায়, এটি ক্রিস্টালের মধ্যে একটি আয়োডিন পরমাণুকে ধাক্কা দেয় এবং আলোর একটি হালকা ঝলক উৎপাদিত হয় যখন স্থানচ্যুত ইলেকট্রনটি আবারও ক্ষুদ্র শক্তি অবস্থাকে খুঁজে পায়। উত্তেজিত ইলেকট্রনটির প্রাথমিক অবস্থা ফটোইলেকট্রিক এফেক্ট এবং (বিশেষ করে গামা রশ্মির সাথে) কম্পটন এফেক্টের ন্যায়। আলোর ঝলকানি উৎপাদনের পর একে চিহ্নিত করা হয়। ক্রিস্টালের পিছনের ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউব (পিএমটিস) প্রতিপ্রভ ঝলকানি (ঘটনা) চিহ্নিত করে এবং একটি কম্পিউটার গণনার সমষ্টি নির্ণয় করে। কম্পিউটার পুনঃনির্মাণ করে এবং মনিটরে একটি আপেক্ষিক স্থানিক গণনা ঘনত্ব একটি দ্বিমাত্রিক ছবি প্রদর্শন করে। এই পুনঃনির্মিত ছবি বিভিন্ন অঙ্গ এবং কলায় তেজক্রিয় রেখক উপাদানসমূহের বণ্টন এবং আপেক্ষিক ঘনত্বর প্রতিচ্ছবি তৈরি করে।
১৯৫৭ সালে হল অ্যাঙ্গার প্রথম গামা ক্যামেরার উন্নয়ন ঘটান। তার সত্যিকার নকশাকে প্রায়শই অ্যাঙ্গার ক্যামেরা বলা হত এবং এখন বলা হয়ে থাকে। অ্যাঙ্গার ক্যামেরা ভ্যাকুয়াম টিউব ফটোমাল্টিপ্লায়ার (পিএমটি)-এর সেট ব্যবহৃত করে। সাধারণভাবে প্রতিটি টিউবের একটি 7.6 cm ব্যাসের উদ্ভাসিত মুখ থাকে এবং টিউবগুলো শোষণকারী ক্রিস্টালের পেছনে ষড়ভূজাকৃতির অবয়বে সাজানো থাকে। ফটোডিটেক্টরের সাথে সংযোগকৃত ইলেকট্রনিক সার্কিট তারের সাথে যুক্ত থাকে যেন তা হালকা প্রতিপ্রভা আপেক্ষিক আলোর প্রতিফলন ঘটাতে পারে এবং তা ষড়ভূজাকৃতির ডিটেক্টর অ্যারেরের সদস্যদের দ্বারা অনুভূত হয়। সকল পিএমটিসমূহ অনবরতভাবে একই (সম্ভাব্য) আলোর ঝলকানি বিভিন্ন কোণ থেকে নির্ণয় করে যা সত্যিকার ঘটনা থেকে তাদের অবস্থানের ওপর নির্ভর করে। এভাবেই প্রতিপ্রভার প্রতিটি ঝলকানির স্থানিক অবস্থান ভোল্টেজের প্যাটার্ণ হিসেবে আন্তঃসম্পর্কযুক্ত সার্কিট অ্যারেরের ওপর প্রতিফলিত হয়।
গামা রশ্মি এবং ক্রিস্টালের মিথষ্ক্রিয়ার অবস্থান ফটোমাল্টিপ্লায়ারসমূহের ভোল্টেজ সিগন্যাল প্রক্রিয়াজাত করে নির্ণয় করা হয়। সাধারণভাবে প্রতিটি ফটোমাল্টিপ্লায়ার টিউবের সিগন্যালের শক্তির অবস্থানের ভর থেকে এবং পরবর্তীতে প্রতিটি ভর নির্ণিত অবস্থানের গড় হিসেবে করে এই অবস্থান পাওয়া যায়। প্রতিটি ফটোমাল্টিপ্লায়ার থেকে ভোল্টেজের সমষ্টি গামা রশ্মির মিথষ্ক্রিয়ার শক্তির সমানুপাতিক, এভাবেই বিভিন্ন আইসোটোপের বা মধ্যকার বিক্ষিপ্ত ও সরাসরি ফোটনের ফলে বৈষম্য হয়।
চিহ্নিতকরণযোগ্য বস্তু (একজন ব্যক্তির পেশিকোষ যা প্রয়োগকৃত আন্তঃশিরীয় তেজক্রিয় পদার্থ থেলিয়াম-২০১ বা টেকনেটিয়াম-৯৯এম, সাধারণত মেডিসিনাল ইমেজিং এজেন্ট শোষণ করেছে) থেকে নির্গত হওয়া গামা রশ্মির স্থানিক তথ্য পাবার জন্য পরস্পরের সাথে সম্পর্কযুক্ত চিহ্নিত ফোটনসমূহ এবং সেইসাথে তাদের সৃষ্টির উৎস প্রয়োজনীয়।
প্রচলিত পদ্ধতি হল চিহ্নিতকারী ক্রিস্টার/পিএমটি অ্যারের-এর ওপর একটি কলিমেটর রাখা। কলিমেটর সীসার পুরু চাদর, সাধারণত ১-৩ ইঞ্চি পুরু, এবং সেইসাথে এর নিকটবর্তী হাজারো ছিদ্র থাকে। প্রতিটি ছিদ্র ফোটনকে সীমাবদ্ধ রাখে যা একটি শঙ্কু ক্রিস্টাল দিয়ে চিহ্নিত করা যায়; শঙ্কু বিন্দু যেকোন ছিদ্রের মধ্যকার রেখার কেন্দ্রে থাকে এবং কলিমেটরের বাইরের পৃষ্ঠ হতে প্রসারণ ঘটায়। তবে কলিমেটর ছবির মধ্যে যোগাযোগের উৎসসমূহের মধ্যে একটি; সীসা গামা ফোটনের ঘটনাকে পুরোপুরি গুঁড়ো করে না, সেখানে ছিদ্রসমূহের মধ্যে কিছু ক্রসটক থাকতে পারে।
লেন্স ভিন্ন, যেমনটা দৃশ্যমান আলোর ক্যামেরাতে ব্যবহৃত হয়, কলিমেটর ফোটন ঘটনার সবচেয়ে বেশি (>৯৯%) কেই গুঁড়ো করে এবং এভাবে ক্যামেরা ব্যবস্থার সংবেদনশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে। বিশাল পরিমাণ তেজক্রিয়তা অবশ্যই বর্তমান থাকে এবং এভাবে ক্যামেরার ব্যবস্থার যথেষ্ট প্রকাশ ঘটায় যেন প্রয়োজনীয় স্ফুলিঙ্গায়ন একটি ছবির বিন্দু তৈরি করতে পারে।
ছবি স্থানীয়করণের (পিনহোল, সিজিটি (গ্যাগনন ও ম্যাথিউস) এবং অন্যান্যর সাথে ঘুর্ণায়মানরত সরু কলিমেটরের টুকরো) অপর পদ্ধতিসমূহ প্রস্তাবিত এবং পরীক্ষিত হয়েছে; তবে কোনটাই দৈনন্দিত ক্লিনিকাল ব্যবহারের জন্য বিস্তৃত হয়নি।
শ্রেষ্ঠ বর্তমান ক্যামেরা ব্যবস্থার নকশা, কমপক্ষে ১.৮ সে.মি. বাদে ক্যামেরার মুখ থেকে ৫ সে.মি. দূরে গামা ফোটনের দুইটি পৃথক উৎস বিন্দুর মধ্যে পার্থক্য করতে পারে। স্থানিক রেজ্যুলেশন দ্রুতগতিতে ক্যামেরার মুখ থেকে বর্ধিত দূরত্ব কমিয়ে দেয়। এটি কম্পিউটার ইমেজের স্থানিক নির্ভুলতাকে সীমাবদ্ধ রাখে। এটি এক ধরনের ঝাপসা চিত্র যা পদ্ধতির অনেক বিন্দুর মাধ্যমে গঠিত হয়; সবচেয়ে পুরু হল বাম নিলয়ের (সাধারণ) হৃদপেশী, প্রায় ১.২ সে.মি. এবং বাম নিলয়ের অধিকাংশ পেশী ০.৮ সে.মি.। এরা সর্বদাই কলিমেটরের দিক থেকে ফুলে উঠছে প্রায় ৫ সে.মি. এর অধিক পর্যন্ত। ক্ষতিপূরণের জন্য অধিক ভাল চিহ্নিতকারী যন্ত্র "গেটিং" নামক হৃৎপিন্ডের সংকোচন চক্রর নির্দিষ্টাংশের স্ফুলিঙ্গায়ন গণনা করে। তবে পরবর্তীতে এরা পদ্ধতির সংবেদনশীলতা (System sensitivity)কে সীমাবদ্ধ রাখে।
সাইন্টিগ্রাফি ("সাইন্ট") হল গামা ক্যামেরা ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ রেডিওআইসোটোপসমূহ থেকে নির্গত হওয়া তেজক্রিয়তা ধারণ করে দ্বিমাত্রিক[৩] ছবি তৈরি করা।
গামা ক্যামেরা ব্যবহার করে এসপিইসিটি (সিঙ্গল ফোটন এমিশন কম্পিউটেড টোমোগ্রাফি; বাংলায় একক ফোটন নির্গমন গণনাকারী টোমোগ্রাফি) চিহ্নিতকরণ, যা নিউক্লিয় কার্ডিয়াক চাপ পরীক্ষায় ব্যবহৃত হয়। সাধারণত একটি, দুইটি বা তিনটি ডিটেক্টর বা মাথা ধীরে ধীরে রোগীর ধড়কে ঘিরে ঘুরপাক খায়।
একাধিক মাথাসম্বলিত গামা ক্যামেরাসমূহ পজিট্রন নির্গমনকারী টোমোগ্রাফি স্ক্যানকরণেও ব্যবহৃত হয় যদি তাদের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যার 'কাকতালীয়' (দুইটি ভিন্ন মাথার উপর যুগপত ঘটনা) চিহ্নিত করতে পারে। গামা ক্যামেরা পিইটি, পরিকল্পিত উদ্দেশ্য পিইটি স্ক্যানার ধারণকারী পিইটি ইমেজিং থেকে নিকৃষ্ট এবং ডিটেক্টর অঞ্চল উল্লেখযোগ্যভাবে ছোট। তবে, গামা ক্যামেরার কম খরচ দিয়ে এবং এর নমনীয়তা পিইটি স্ক্যানারের চেয়ে অধিক। এই পদ্ধতি বেশ লাভজনক যেখানে পিইটি স্ক্যানারের খরচ এবং সম্পদ সংশ্লেষ বিচার্য হবে না।