গুজ একাদশ শতাব্দীতে স্থাপিত পশ্চিম তিব্বতের একটি প্রাচীন রাজ্য বিশেষ। দক্ষিণ পশ্চিম জাংস্কার, উত্তর কিন্নর ও স্পিতি উপত্যকার বিশাল এলাকা এই রাজ্যের অধীনে ছিল। শতদ্রু নদীর তীরে কৈলাশ পর্বতের অদূরে লাসা শহর থেকে ১,২০০ মাইল (১,৯০০ কিমি) পশ্চিমে থোলিং শহরে এই রাজ্যের রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ পরিলক্ষিত হয়।
পশ্চিম তিব্বতের এই অঞ্চলটি গুজ রাজ্য স্থাপনের পূর্বে ঝাংঝুং নামক প্রাচীন রাজ্যের অধীনে ছিল। তাবো বৌদ্ধবিহারে প্রাপ্ত বেশ কিছু লিপি থেকে এই কথা প্রমাণ হয় যে, দশম শতাব্দীর পূর্বে এই অঞ্চলে অতিব্বতীয় নামের প্রচলন ছিল। পরবর্তীকালে তিব্বতীদের অধীনে আসার পর এই অঞ্চলটিতে তিব্বতী নামের প্রচলন শুরু হয়।[১][২]
তিব্বতের অন্তিম সম্রাট খ্রি-উ-দুম-ব্ত্সান বা গ্লাং-দার-মাকে বৌদ্ধ ধর্ম বিরোধী সম্রাট হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। কথিত আছে, তিনি তিব্বত সাম্রাজ্যে বহু বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের হত্যা করেছিলেন।[৩][৪] পদ্মসম্ভবের পঁচিশজন শিষ্যের মধ্যে একজন ল্হা-লুং-দ্পাল-গ্যি-র্দো-র্জে বৌদ্ধ ধর্ম রক্ষার উদ্দেশ্যে আনুমানিক ৮৪১ খ্রিষ্টাব্দে গ্লাং-দার-মাকে হত্যা করেন। [৫] :৭১[৬]:১৬৮ গ্লাং-দার-মার মৃত্যুর পর দুই স্ত্রীর দুই পুত্র য়ুম-ব্র্তান (ওয়াইলি: yum brtan) এবং ওদ-স্রুং (ওয়াইলি: od srung) সাম্রাজ্যের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করলে তিব্বত সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। য়ুম-ব্র্তান মধ্য তিব্বতের দ্বুস অঞ্চল এবং ওদ-স্রুং গুজ অঞ্চলে শাসন করেন।[৫]:৭১[৭]:১১৭ এই গৃহযুদ্ধের ফলে তিব্বতী রাজতন্ত্রের রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস পায়[৮]:৫৭ এবং তিব্বত অনেকগুলি পৃথক রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই রাজ্যগুলি একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় ১২৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিব্বতে কোন কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার অস্তিত্ব ছিল না।[৭]:১১৭ ওদ-স্রুংয়ের পুত্র দ্পাল-'খোর-ব্র্ত্সানের (ওয়াইলি: Dpal 'khor brtsan) ব্ক্রা-শিস-ব্র্ত্সেন-ব্র্ত্সান (ওয়াইলি: Bkra shis brtsen brtsan) এবং স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন (ওয়াইলি: Skyid lde nyima mgon) নামক দুই পুত্র ছিল। স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন পশ্চিম তিব্বত অঞ্চলের স্তোদ-ম্ঙ্গা-রিস অঞ্চলে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।[৯] তিনি লাদাখকে নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন এবং লাদাখি রাজবংশের সুত্রপাত করেন। সপ্তদশ শতাব্দীতে সম্পাদিত লা-দ্ভাগ্স-র্গ্যাল-রাব্স বা লাদাখের রাজাদের ধারাবিবরণীতে বলা হয় যে রাজা স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোন তার তিন পুত্রের মধ্য তার সাম্রাজ্য ভাগ করে দেন। এই বিবরণীতে বলা হয় তিনি তার তার জ্যৈষ্ঠ পুত্র দ্পাল-গ্যি-ঙ্গোনকে মার্যুল বা লাদাখ, হ্গোগের স্বর্ন খনি, রু-থোগ বা রুদোক, ল্দে-ম্চোগ-দ্কার-পো বা দেমচোক ও রা-বা-দ্মার-পো প্রদান করেন।[n ১] স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোনের অপর পুত্র ব্ক্রা-শিস-ম্গোন (ওয়াইলি: bKra shis mgon) পশ্চিম তিব্বত অঞ্চলে রাজত্ব করে গুজ এবং পু-হ্রাং নামক রাজ্য স্থাপন করেন। স্ক্যিদ-ল্দে-ন্যিমা-গোনের অপর পুত্র ও জাংস্কার রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ল্দে-গ্ত্সুগ-ম্গোনের পুত্রহীন অবস্থায় মৃত্যু হলে ৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ গুজ, পু-হ্রাং, জাংস্কার, স্পিতি, লাহুল এবং উত্তর কিন্নর অঞ্চলকে একত্র করে এক সংগঠিত রাজ্যের অধীশ্বর হন।[১১][১২]
ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ রাজত্বকালের শুরুতে ব্কা'-শোগ-ছেন-মো (ওয়াইলি: bka’ shog chen mo) নামক একটি আদেশ জারি করে তার রাজত্বকে ধর্মীয় ভিত্তিতে চালনা করবেন বলে স্থির করেন। সেই কারণে তিনি একাধারে রাজা ও লামা উভয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন।[১২][১৩] তিনি তিব্বতে দ্বিতীয়বার বৌদ্ধধর্ম প্রসারের জন্যও বিখ্যাত। তিনি কাশ্মীরে বৌদ্ধধর্ম শিক্ষার উদ্দেশ্যে তিব্বত থেকে একুশ জন শিক্ষার্থীকে পাঠান। সংস্কৃত থেকে তিব্বতী ভাষায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রন্থগুলির অনুবাদ করা তাদের এই শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য ছিল । কিন্তু উত্তর ভারতের প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে একুশজনের মধ্যে উনিশজন মারা যান। রিন-ছেন-ব্জাং-পো এবং লেগ্স-পা'ই-শেস-রাব (ওয়াইলি: legs pa'i shes rab) নামক অবশিষ্ট দুইজন পরবর্তীকালে তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে সহায়ক হন। রিন-ছেন-ব্জাং-পো বহু সংস্কৃত গ্রন্থের তিব্বতী ভাষায় অনুবাদ করেন এবং লাদাখ অঞ্চলে বহু বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন।[১৪] ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ থোলিং বৌদ্ধবিহার নির্মাণ করেন। তার একটি আদেশের ফলে থোলিং অঞ্চলে বসবাসকারী যাযাবর ও কৃষিজীবী মানুষেরা এই বৌদ্ধবিহারের খরচ চালানোর জন্য কর প্রদান করতে বাধ্য থাকত।[১৪]
ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদ কয়েক জন দূতের হাতে প্রচুর স্বর্ণ উপঢৌকন দিয়ে অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বত ভ্রমণের আমন্ত্রণ জানালে দীপঙ্কর সবিনয়ে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই সময় তিনি সীমান্ত অঞ্চলে সোনা সংগ্রহের জন্য গেলে কারাখানী খানাতের শাসক তাকে বন্দী করেন ও প্রচুর সোনা মুক্তিপণ হিসেবে দাবী করেন। তিনি তার পুত্র ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদকে মুক্তিপণ দিতে বারণ করেন এবং ঐ অর্থ অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে আনানোর জন্য ব্যয় করতে বলেন। বন্দীদশায় তার মৃত্যু হয়। ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদ গুজ রাজ্যের রাজা হয়ে গুং-থং-পা নামে এক বৌদ্ধ উপাসককে ও আরো কয়েক জন অনুগামীকে অতীশ দীপঙ্করকে তিব্বতে আনানোর দায়িত্ব দেন। এরা নেপালের পথে বিক্রমশীলা বিহারে উপস্থিত হন এবং দীপঙ্করের সাথে সাক্ষাৎ করে সমস্ত সোনা নিবেদন করে ভূতপূর্ব রাজা ব্যাং-ছুব-য়ে-শেস'-ওদের বন্দী হওয়ার কাহিনী ও তার শেষ ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করলে অতীশ দীপঙ্কর অভিভূত হয়ে তিব্বত যাত্রা করেন।[১৫] এর ফলে পশ্চিম তিব্বতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব বিস্তার ঘটে।[২][১১][১৬]:৩৮৮, ৩৯৪[১৭] ১০৭৩ খ্রিষ্টাব্দে সা-স্ক্যা বৌদ্ধবিহার এবং ১১৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ম্ত্শুর-ফু বৌদ্ধবিহার স্থাপিত হয়। [১৮]:৩৭ এই সময় রাজধানী থোলিং বৌদ্ধধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ পীঠস্থানে পরিণত হয়।[১১]
১০৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ল্হা-লামা-ব্যাং-ছুব-ওদের পুত্র র্ত্সে-ল্দেকে (ওয়াইলি: rTse lde) দ্বাং-ল্দে (ওয়াইলি: dBang lde) নামক তার ভ্রাতুষ্পুত্র হত্যা করলে গুজ ও পু-হ্রাং নামে দুইটি পৃথক রাজ্যে তাদের রাজ্য ভেঙ্গে যায়। দ্বাং-ল্দে গুজ রাজ্য নিজের অধিকারে রাখেন।[১৬]:৫৩-৬৬ ১১৩৭ খ্রিষ্টাব্দে কারাখানী খানাতের আক্রমণে গুজ রাজ্যের রাজা ব্ক্রা-শিস-র্ত্সে (ওয়াইলি: bKra shis rtse) মৃত্যুবরণ করলে রাজ্য কয়েক বছরের জন্য বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে মঙ্গোল সম্রাটেরা এই অঞ্চলের প্রশাসনিক অধিকার দ্রিগুং বৌদ্ধবিহারকে দান করেন। কিন্তু ১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে গ্রাগ্স-পা-ল্দে (ওয়াইলি: grags pa lde) নামক এক শক্তিশালী রাজার অধীনে গুজ পুনরায় এক রাজ্যে পরিণত হয় এবং প্রতিবেশী য়া-র্ত্সে (ওয়াইলি: Ya rtse) রাজ্যকেও নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। ১২৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যু হলে এই অঞ্চলটি সা-স্ক্যা বৌদ্ধসম্প্রদায়ের কর্তৃত্বে চলে আসে। কিন্তু ১৩৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সা-স্ক্যা বৌদ্ধসম্প্রদায়ের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে পরিচিত মঙ্গোল ইউয়ান রাজবংশের পতন ঘটলে গুজের রাজারা আবার শক্তিশালী হয় এবং ১৩৭৮ খ্রিষ্টাব্দে পু-হ্রাং অধিকারে আনতে সমর্থ হয়। পরবর্তী সময়ে গুজ ও মুস্তাং রাজ্যের মধ্যে পু-হ্রাং অঞ্চলের মধ্যে বহু বছর বিবাদ চালু থাকলেও শেষ পর্যন্ত পু-হ্রাং গুজের অন্তর্ভুক্ত হয়। চতুর্দশ শতকের শেষ দিকে গুজের শাসকেরা লাদাখ অঞ্চল কিছু বছরের জন্য অধিকারে আনতে সমর্থ হয়। ১৪৯৯ খ্রিষ্টাব্দে গুজের শাসকেরা পশ্চিম মধ্য তিব্বতের নবনির্মিত রিন-স্পুংস-পা রাজ্যকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে গুজের রাজারা তিব্বতে শক্তিশালী হয়ে ওঠা দ্গে-লুগ্স ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি আনুগত্য দেখাতে শুরু করেন।
১৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে আন্তোনিও দে আন্দ্রাদে ও তার ভ্রাতা ম্যানুয়েল মারকুইস নামক দুই পর্তুগীজ যাজক ১৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে গুজ রাজ্যে পৌঁছন। আন্তোনিও রাজ্যের সেচ ও কৃষিব্যবস্থার উন্নতিতে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন এবং একটি গীর্জা নির্মাণ করে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করেন।[১৯] আন্তোনিওর লেখা একটি চিঠি থেকে জানা যায় যে, এই সময়ে গুজের কিছু সামরিক অধিকর্তা গুজের রাজাকে সিংহাসনচ্যূত করতে লাদাখীদের আমন্ত্রণ জানান। ১৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে লাদাখী সেনাবাহিনী গুজ রাজ্যের রাজধানী অবরোধ করেন। গুজের রাজা খ্রি-ব্ক্রা-শিস-গ্রাগ্স-পা-ল্দে (ওয়াইলি: khri bkra shis grags pa lde) তার বৌদ্ধধর্মাবলম্বী ভ্রাতার উপদেশে সমর্পণ করে গুজ রাজ্যকে লাদাখ রাজ্যের অধীনে করদ রাজ্যে পরিণত করেন।[২০] এই সিদ্ধান্তের পর গুজের শেষ রাজা খ্রি-ব্ক্রা-শিস-গ্রাগ্স-পা-ল্দেকে লাদাখে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানেই তার মৃত্যু হয়। এই অভিযানের গুজে নির্মিত সমস্ত গীর্জাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়[১৭] কথিত আছে, এই অভিযানে লাদাখী সেনাবাহিনী গুজের অধিকাংশ জনগণকেই হত্যা করে, মাত্র দুইশত জন প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।[২১] ১৬৭৯ খ্রিষ্টাব্দে পঞ্চম দলাই লামা গুজ তিব্বতের অধিকারে নিয়ে আসেন। এই যুদ্ধের পর রাজধানী প্রচন্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়।[২২] সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় বহু মূর্তি ও চিত্রকলাকে ধ্বংস করে দেওয়া হলেও[২২] বেশ কিছু অসাধারণ শিল্পকলা কোন ভাবে এই ধ্বংসলীলা থেকে বেঁচে গেছে।[২২]