গুয়াদালকিবির নদী (স্পেনীয় – Río Guadalquivir; রিও গুয়াদালকিবির; আরবী – الوادي الكبير; আল-ওয়াদি আল-কবির; "বড় নদী"[১][২]) হল দক্ষিণ স্পেনের আন্দালুসিয়া স্বশাসিত অঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী। নদীটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪০০ মিটার ঊর্ধ্বে স্পেনের খায়েন প্রদেশের সিয়েরা দে কাথোর্লা পর্বতের কানিয়াদা দে লাস ফুয়েন্তেস থেকে উৎপন্ন হয়ে মূলত পশ্চিমে ও কিছুটা দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে কাদিথ প্রদেশের সানলুকা দে বারামেদা শহরের কাছে সমুদ্রে পড়েছে।[৩] উৎস থেকে মোহনা পর্যন্ত ৬৫৭ কিলোমিটার লম্বা[৪] এই নদীটি ইবেরীয় উপদ্বীপের পঞ্চম দীর্ঘতম নদী[৩] (তেজো, এবরো, দোরু ও গুয়াদিয়ানার পর)। নদীটি স্পেনের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী, যার গতিপথ সম্পূর্ণরূপেই স্পেনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বর্তমানে কাদিথ উপসাগর থেকে সেভিয়া পর্যন্ত নদীটি নৌ চলাচলযোগ্য; রোমান যুগে এই নদীপথে এমনকি কর্দোবা ও কখনও কখনো আন্দুখার পর্যন্ত যাতায়াত ও বাণিজ্য চলত।[৩] আন্দালুসিয়ার মধ্যে দিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম অভিমুখে এর গতিপথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসখ্যাত নগর ও বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল আন্দুখার, কর্দোবা ও সেভিয়া। একাদশ শতাব্দীতে আরবরা আল-ওয়াদি আল-কবির ("বড় নদী") বলে এর নতুন নামকরণ করার আগে পর্যন্ত বেতিস (Baetis বা Betis) নামে এই নদী পরিচিত ছিল।
নদীটি বর্তমানে গুয়াদালকিবির নদী হিসেবে পরিচিত। এই নামটি আসলে নদীটির আরবী নাম আল-ওয়াদি আল কবির-এর অপভ্রংশ। কিন্তু একাদশ শতাব্দীর আগে এই নাম বা তার মূল আরবী নামটিও খুব বেশি পরিচিত ছিল না। ইতিহাসের নানা পর্বে নদীটি অন্যান্য নানা নামে পরিচিত ছিল।
এখানে আরও উল্লেখ্য যে, আল-ইদ্রিসি ১১৫৪ খ্রিস্টাব্দে আঁকা তাঁর পৃথিবীর মানচিত্রে এই নদীটিকে উল্লেখ করেছেন নার আগতাম নামে; অন্যদিকে অন্যান্য কিছু আরব লেখক, যেমন - ইবন আল-খাতিব বা আল-রাব্বিনির লেখায় এই নদী শুধুমাত্র সেভিয়ার নদী হিসেবেই উল্লিখিত হয়েছে।[৫]
গুয়াদালকিবির নদীর উপনদীগুলির এক বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল - এর দুই পারের উপনদীগুলির মধ্যে চোখে পড়ার মতো বিভিন্নতা। আসলে এর উপত্যকার দুই দিকে অবস্থিত সিয়েরা মোরেনা পর্বতমালা ও কর্দিয়েরাস বেতিকাস উচ্চভূমির মধ্যে ভৌগোলিক পার্থক্যের কারণেই আমরা দুই পারের উপনদীগুলির মধ্যে এই বিভিন্নতা দেখতে পাই।
গুয়াদালকিবির নদীর বামদিক থেকে আসা উপনদীগুলি ডানদিক থেকে আসা উপনদীগুলির তুলনায় তুলনামূলকভাবে লম্বা; এইসব নদীগুলি প্রায় প্রতিটিই দক্ষিণপূর্ব থেকে উত্তরপশ্চিমবাহী; এরা সাধারণভাবে কর্দিয়েরাস বেতিকাস উচ্চভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসে সমতলে নেমে আসে ও গুয়াদালকিবির উপত্যকায় এসে মিলিত হয়ে একধরনের নদীর নেটওয়ার্ক তৈরি করে।
অন্যদিকে ডানদিকের উপনদীগুলি, সাধারণভাবে এদের একত্রে মারিয়ানিকোস বলে অভিহিত করা হয়, তুলনামূলকভাবে কিছুটা ছাড়া ছাড়া; আলাদা আলাদা করে নিজের মতো প্রায়শই প্রায় একই দূরত্ব অতিক্রম করে এসে তারা গুয়াদালকিবির নদীতে এসে পড়ে। এগুলি্র বেশিরভাগেরই উৎপত্তি সিয়েরা মোরেনা পর্বতমালার ঢালে; সেখানকার পাথুরে জমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খাত বেয়ে তারা সরাসরি গুয়াদালকিবির নদীতে এসে মিশেছে।[৮]
নদী | প্রদেশ | দৈর্ঘ্য (কিমি) | পার্শ্ব |
---|---|---|---|
আগুয়াসথেবাস[৯] | খায়েন | ২০ | বামপার্শ্ব |
থেরেথুয়েলো অথবা দে লা বেগা দে কাথোরলা[৯] | খায়েন | ২৪ | বামপার্শ্ব |
ছোট গুয়াদিয়ানা[১০] | গ্রানাদা ও খায়েন | ১৮২ | বামপার্শ্ব |
খান্দুলিয়া[১০] | খায়েন | ৪৯ | বামপার্শ্ব |
তোরেস[১০] | খায়েন | ২৫ | বামপার্শ্ব |
গুয়াদাবুইয়োন[১০] | ঙ্খায়েন | ৭৪ | বামপার্শ্ব |
সালাদো দে আর্খোনা[১০] | খায়েন | ৪৮ | বামপার্শ্ব |
গুয়াদাখোথ[১০] | খায়েন ও কর্দোবা | ১১৪ | বামপার্শ্ব |
খেনিল[১০] | গ্রানাদা, কর্দোবা, মালাগা ও সেভিয়া | ৩৩৭ | বামপার্শ্ব |
করবোনেস[১০] | মালাগা, কাদিথ ও সেভিয়া | ৫৮ | বামপার্শ্ব |
গুয়াদাইরা[১০] | সেভিয়া | ৮৯ | বামপার্শ্ব |
সালাদো দে মোরোন[১০] | সেভিয়া | ৬২ | বামপার্শ্ব |
বরসা[৯] | খায়েন | ১১ | ডানপার্শ্ব |
আগুয়ামুলাস[৯] | খায়েন | ৮.৫ | ডানপার্শ্ব |
ওরনস[৯] | খায়েন | ১০ | ডানপার্শ্ব |
গুয়াদালিমার[১০] | খায়েন ও আলবাথেতে | ১৬৭ | ডানপার্শ্ব |
গুয়াদালেন (গুয়াদালিমার নদীর উপনদী)[১০] | থিউদাদ রেয়াল ও খায়েন | ১২৭ | ডানপার্শ্ব |
গুয়াদিয়েল[১০] | খায়েন | ৩৪ | ডানপার্শ্ব |
রুমব্লার[১০] | থিউদাদ রেয়াল ও খায়েন | ৭০ | ডানপার্শ্ব |
খান্দুলা[১০] | থিউদাদ রেয়াল ও খায়েন | ৯০ | ডানপার্শ্ব |
ইয়েগুয়াস[১০] | থিউদাদ রেয়াল, কর্দোবা ও খায়েন | ৭৬ | ডানপার্শ্ব |
আরেনোসো[১০] | কর্দোবা | ৪১ | ডানপার্শ্ব |
গুয়াদালমেইয়াতো[১০] | কর্দোবা | ১১১ | ডানপার্শ্ব |
গুয়াদিয়াতো[১০] | কর্দোবা | ১২৩ | ডানপার্শ্ব |
বেমবেথার[১০] | বাদাখোথ ও কর্দোবা | ১১১ | ডানপার্শ্ব |
রেতোরতিও[১০] | কর্দোবা ও সেভিয়া | ৪১ | ডানপার্শ্ব |
উয়েথনার[১০] | সেভিয়া | ৬১ | ডানপার্শ্ব |
বিয়ার[১০] | বাদাখোথ ও সেভিয়া | ১১৭ | ডানপার্শ্ব |
রিবেরা দেল উয়েলভা[১০] | উয়েলভা ও সেভিয়া | ৬১ | ডানপার্শ্ব |
গুয়াদিয়ামার[১০] | সেভিয়া | ৬০ | ডানপার্শ্ব |
গুয়াদালকিবির উপত্যকায় সর্বাধিক বৃষ্টিপাত হয় শীতকালে। নদীর উচ্চগতিতে হওয়া এই বৃষ্টিপাতের জল বিভিন্ন উপনদীগুলির মাধ্যমে গুয়াদালকিবির নদীকে পুষ্ট করে। এছাড়া বসন্তকালে সিয়েরা মোরেনার বরফ গলার হার বৃদ্ধি পেলে সেই জলও গুয়াদালকিবির নদীর মাধ্যমেই প্রবাহিত হয়। এই দুইরকম জলে পুষ্ট হলেও নদীতে জলের জোগান সর্বদা সমান থাকে না। নদীর উচ্চগতিতে জলের এই অনিয়মিত জোগানের পরিমাণ ৫.১ ও নিম্নগতিতে মোহনার কাছে ৩.৪০।
গুয়াদালকিবির নদীর বন্যা এক নিয়মিত ব্যাপার। বিশেষ করে সেভিয়া প্রদেশের নিচু সমভূমিতে এর প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। তবে নদীর জলে বন্যার এই সমস্যা বর্তমানে আন্দালুসিয়ার রাজধানী অঞ্চলে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু কর্দোবা, আন্দুখার, মনতোরো, লোরা দেল রিও ও নদী উপত্যকার অন্যান্য শহর ও অঞ্চলে এই সমস্যা এখনও যথেষ্ট প্রকট। ১৯৯৬'এর ডিসেম্বর, ১৯৯৭'এর ডিসেম্বর, এবং ২০১০'এর ফেব্রুয়ারি ও ডিসেম্বরের বন্যা এই সমস্যারই সাক্ষী। বিংশ শতাব্দীর ভয়াবহতম বন্যা হয় এই অঞ্চলে ১৯৬৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে; কর্দোবায় তখন জলপ্রবাহের হার দাঁড়ায় ৫৪০০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড ও সেভিয়ায় ৬৭০০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড। এরপর থেকে গুয়াদালকিবির উপত্যকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য যে নতুন নীতি প্রনয়ণ করা হয় তার মূল লক্ষ্যই হল মূল নদী বা তার কোনও উপনদীতেই জলস্ফীতির এই হার যাতে আর কখনও ফিরে না আসে। সেই উদ্দেশ্যে মূল নদী ও তার বিভিন্ন উপনদীতে বাঁধ নির্মাণ করে অতিরিক্ত প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় ও বড় বড় জলাধার নির্মিত হয়। এর ফলে জলস্ফীতির সমস্যা যে অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে তার প্রমাণ - ১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে বন্যার সময়েও সেভিয়ায় জলপ্রবাহের হার যথাক্রমে ৩৮১০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড ও ৩২৩৪ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড'এর উপরে ওঠেনি।[১১] আরও সাম্প্রতিক কালে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারিতে বন্যার সময় কর্দোবায় জলপ্রবাহের হার ছিল ২৪০০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড ও সেভিয়ায় ৩১৭৪ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড; ঐ বছরেরই ডিসেম্বরে গুয়াদালকিবিরিরের অন্যতম বড় উপনদী খেনিলের অস্বাভাবিক জলস্ফীতির কারণে (১০০০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড'এরও বেশি) সেভিয়ায় জলপ্রবাহের হার দাঁড়ায় ৩৫৮৪ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড।[১২][১৩]