গুরু গোবিন্দ সিং | |
---|---|
![]() বাজপাখি হাতে ও খালসা বাহিনী পরিবৃত গুরু গোবিন্দ সিংের প্রতিকৃতি; আনুমানিক ১৮৩০ সাল, পাঞ্জাব; এশিয়ান আর্ট মিউজিয়াম অফ সান ফ্রান্সিসকোয় রক্ষিত। | |
অন্য নাম | দশম নানক[১] |
ব্যক্তিগত তথ্য | |
জন্ম | গোবিন্দ রাই ৫ জানুয়ারি, ১৬৬৬ |
মৃত্যু | ৭ অক্টোবর ১৭০৮ | (বয়স ৪১)
মৃত্যুর কারণ | ক্ষত রক্ত |
ধর্ম | শিখধর্ম |
দাম্পত্য সঙ্গী | মাতা জিতো, মাতা সুন্দরী ও মাতা সাহিব দেবন |
সন্তান | অজিত সিং জুঝর সিং জোরাওয়ার সিং ফতেহ সিং |
পিতামাতা | গুরু তেগ বাহাদুর, মাতা গুজরি |
যে জন্য পরিচিত | খালসার প্রতিষ্ঠাতা জাপ সাহিব, চণ্ডী দি বর, তব-প্রসাদ সবাইয়ে, জাফরনামা, বাচিত্তর নাটক, অকাল উসতৎ, চৌপাই রচয়িতা |
অন্য নাম | দশম নানক[১] |
ধর্মীয় জীবন | |
পূর্বসূরী | গুরু তেগ বাহাদুর |
উত্তরসূরী | গুরু গ্রন্থ সাহিব |
গুরু গোবিন্দ সিং (পাঞ্জাবি: ਗੁਰੂ ਗੋਬਿੰਦ ਸਿੰਘ, আ-ধ্ব-ব: [ɡʊɾu ɡobɪn̪d̪ sɪ́ŋɡ]) (২২ ডিসেম্বর, ১৬৬৬ - ৭ অক্টোবর, ১৭০৮) ছিলেন শিখধর্মের দশম গুরু। তিনি বর্তমান ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। গুরু গোবিন্দ ১৬৭৫ সালের ১১ নভেম্বর মাত্র নয় বছর বয়সে পিতা গুরু তেগ বাহাদুরের স্থলাভিষিক্ত হন। তিনি ছিলেন শিখ জাতির নেতা, যোদ্ধা, কবি ও দার্শনিক। শিখ সমাজে গুরু গোবিন্দ হলেন আদর্শ পৌরুষের প্রতীক। তিনি তার উচ্চশিক্ষা, দক্ষ অশ্বচালনা, সশস্ত্র যুদ্ধবিদ্যায় পটুতা ও চারিত্র্য দাক্ষিণ্যের জন্য প্রসিদ্ধ।[২]
শিখদের আদর্শ ও দৈনন্দিন জীবনে গুরু গোবিন্দ সিংহের জীবন ও শিক্ষার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। তার খালসা প্রবর্তন শিখ ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তিনি মুঘল ও শিবালিক পার্বত্য অঞ্চলের মুঘল সহকারী রাজাদের সঙ্গে কুড়িটি আত গোবিন্দই শেষ মানব শিখ গুরু। ১৭০৮ সালের ৭ অক্টোবর তিনি শিখধর্মের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ গুরু গ্রন্থ সাহিবকে শিখদের পরবর্তী এবং চিরস্থায়ী গুরু ঘোষণা করেন। তার চার ছেলে ছিল: অজিত সিং, জুহর সিং, জোরাওয়ার সিং, ফতেহ সিং।
গোবিন্দ সিং ছিলেন নবম শিখ গুরু গুরু তেগ বাহাদুর এবং মাতা গুজরির একমাত্র পুত্র । তিনি ১৬৬৬ সালের ২২ ডিসেম্বর বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন যখন তার পিতা বাংলা ও আসাম সফর করছিলেন ।[৩] গুরু গোবিন্দ সিং যখন জন্মগ্রহণ করে ছিলেন তখন তার নাম ছিল গোবিন্দ রাই এবং যেখানে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর জীবনের প্রথম চার বছর অতিবাহিত করেছিলেন সেই বাড়ির জায়গাটিকে চিহ্নিত করে তখত শ্রী পাটনা হরিমন্দর সাহেব স্থাপিত হয় । গুরু গোবিন্দ সিং তার জীবনের প্রথম ৫ বছর পাটনা শহরে কাটান।
একবার পাটনা শহরের রাজা ফতে চাঁদ ও তার রানী, যারা সন্তানহীন ছিলেন, শিব দত্ত এর কাছে আসেন এবং একজন সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতে বলেন। শিব দত্ত তাদের শিশু গুরু গোবিন্দ সিং এর সাথে দেখা করতে ও তার আর্শিবাদ নিতে বলেন। গুরু গোবিন্দ সিং এর সাথে দেখা করার পর রানী তাকে ছেলে সন্তানের জন্য আর্শিবাদ দিতে অনুরোধ করেন, এতে গুরু গোবিন্দ সিং হাসি দিয়ে বলেন যে তাদের ছেলে সন্তানের দরকার কি, তাকেই তারা ছেলে হিসাবে ডাকতে পারেন। এর পর হতে রানী তাকে ছেলে মর্যাদা দেন এবং তাকে ছেলে বলে ডাকতেন। গুরু গোবিন্দ সিং তখন প্রায়ই তাদের প্রসাদে এ যেতেন ও খেলা করতেন। রানী তাকে ও তার খেলার সাথীদের পুরি ও ছোলার ডাল রান্না করে দিতেন। আজও সেই প্রসাদে পুরি ও ছোলার ডাল রান্না করা হয় এবং তা গরীব মানুষের মাঝে বিতরন করা হয়। প্রসাদটি এখন গুরুদোয়ারাতে পরিনত হয়েছে। নওয়াব করিম বখশ ও রহিম বখশ তাকে পছন্দ করতেন এবং গুরু গোবিন্দ সিংকে একটি গ্রাম ও বাগান উপহার দিয়েছিলেন।
গুরু তেগ বাহাদুর আনন্দপুর নগরী এর সূচনা করেন ১৬৬৫ সালে, বিলাসপুরের(কাহলুর) শাসকের হতে জমি ক্রয় এর মাধ্যমে। তার পূর্ব ভারত ভ্রমণ শেষ হলে তিনি তার পরিবারকে আনন্দপুর আসতে বলেন।
1670 সালে, তার পরিবার পাঞ্জাবে ফিরে আসে এবং 1672 সালের মার্চ মাসে তারা উত্তর ভারতের হিমালয়ের পাদদেশে চক নানকিতে চলে যায়, যাকে শিবালিক রেঞ্জ বলা হয়, যেখানে তিনি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন।
গুরু গোবিন্দ সিং ১৬৭২ সালে আনন্দপুরে পৌছান। গুরু গোবিন্দ সিং শুরুর শিক্ষা জীবনে পাঞ্জাবি, সংস্কৃতি, পারসিক, আরবি ভাষা শিখেন, এবং একজন সেনা হিসাবে প্রশিক্ষণ নেন। তিনি হিন্দি ও সংস্কৃত পাটনা শহরে শিক্ষা লাভ করেন। আনন্দপুরে, তিনি পাঞ্জাবি শিখেন সাহিব চাঁদ, ও পারসিক কাজী পীর মুহাম্মদের থেকে।
এপ্রিল ১৬৮৫ সালে, গুরু গোবিন্দ সিং বাসস্থান বদল করে পানোটাতে যান সিমুর রাজ্যর রাজা মাত প্রকাশ এর অনুরোধে। সিমুর রাজ্যর ইতিহাস অনুসারে, গুরু গোবিন্দ সিং আনন্দপুর নগরী ত্যাগ করতে বাধ্য হন ভিম চাঁদ এর সাথে মতবিরোধ থাকার জন্য, এবং টোকা নামক স্থানে চলে যান। টোকা নামক স্থান হতে তিনি নাহান(সিমুর রাজ্যর রাজধানীতে) চলে যান। তিনি নাহান, হতে পানোটাতে গমন করেন।
সিমুর রাজ্যর রাজা মাত প্রকাশ অনুরোধ করেন গুরু গোবিন্দ সিংকে তার রাজ্যতে আসার জন্য যাতে করে রাজা ফতে সাহ যিনি গুরওয়ালের শাসক ছিলেন তার বিপক্ষে যাতে পদ ও অবস্থান সুরক্ষিত হয়। রাজা মাত প্রকাশ এর অনুরোধে, গুরু গোবিন্দ সিং পানোটাতে একটি দুর্গ নির্মাণ করেন তার অনুসারীদের সাহায্যে খুবই অল্প সময় এর মাঝে। তিনি তার সেনাবাহিনীতে সেনা সংখ্যা বাড়াতে থাকেন। পানোটাতে গুরু গোবিন্দ সিং তিন বছর অবস্থান করেন এবং অনেক শ্লোক রচনা করেন। সিমুর রাজ্যর রাজা মাত প্রকাশ এবং গুরওয়ালের রাজা ফতে সাহের মাঝে উত্তেজনা বাড়তে থাকে ,এবং পানোটা এর কাছাকাছি স্থান থেকে অবশেষ এ ভাংগানী এর যুদ্ধ শুরু হয়। ১৮ সেপ্টেম্বর ১৬৮৮ সালে গুরওয়ালের রাজা ফতে সাহ আক্রমণ শুরু করেন। এই যুদ্ধে রাজা গুরু গোবিন্দ সিং জয় লাভ করেন।
এটি ছিল নাহার খানের নেতৃত্বে মুঘল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে; সেনাপতি নাহার খানকে হত্যা করা হয়, শিখের পক্ষে থাকাকালীন গুরুর বাকি দুই বড় ছেলে - অজিত সিং এবং জুজহার সিং, অন্যান্য শিখ সৈন্যদের সাথে এই যুদ্ধে নিহত হন।
পণ্ডিতদের মতে, আনন্দপুরে সশস্ত্র শিখদের বিস্তারের ফলে এই যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল, ক্রমবর্ধমান সৈন্যসংখ্যা রসদ সরবরাহের ঘাটতি তৈরি করেছিল। এর ফলে শিখরা স্থানীয় গ্রামগুলিতে খাদ্য এবং চর্যার সরবরাহর জন্য অভিযান চালায়, যা নাটকীয়ভাবে স্থানীয় পাহাড়ি রাজাদের হতাশ করেছিল যারা জোট গঠন করেছিল । আওরঙ্গজেব তখন শিখ প্রতিরোধকে ধ্বংস করার জন্য 1704 সালের মে মাসে দুই জেনারেল, ওয়াজির খান এবং জাবেরদাস্ত খানের সাথে একটি বৃহত্তর সেনাবাহিনী পাঠান। এই যুদ্ধে ইসলামী বাহিনী যে পন্থা অবলম্বন করেছিল তা হল আনন্দপুরের বিরুদ্ধে মে থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ অবরোধ করা, বারবার যুদ্ধের সাথে সাথে সমস্ত খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া। কিছু শিখ পুরুষ 1704 সালে আনন্দপুর অবরোধের সময় গুরুকে পরিত্যাগ করে এবং তাদের বাড়িতে পালিয়ে যায় এবং তারা পরবর্তীতে গুরুর সেনাবাহিনীতে পুনরায় যোগ দেয় এবং 1705 সালে তার সাথে যুদ্ধ করে মারা যায়। শেষের দিকে, গুরু, তার পরিবার এবং অনুগামীরা আনন্দপুর থেকে নিরাপদ পথের আওরঙ্গজেবের প্রস্তাব গ্রহণ করেন। দুই দলে আনন্দপুর ত্যাগ করার সময়, মুঘল সৈন্য আক্রমণ করে, এবং মাতা গুজরি এবং গুরুর দুই ছেলে - জোরাওয়ার সিং এবং ফতেহ সিং - মুঘল সেনাবাহিনীর হাতে বন্দী করা হয়। ২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর ১৭০৪ সালের দিকে, ছোট ছেলে, সাহেবজাদা ফতেহ সিং , ৬ বছর বয়সী এবং জোরওয়ার সিং , ৯ বছর, যদি তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাহলে নিরাপদ পথের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, যা তারা প্রত্যাখ্যান করেছিল; এবং পরবর্তীকালে, উজির খান তাদের দেয়ালে জীবন্ত কবর দিয়ে হত্যা করেন । শিশুদের ঠাকুরমা মাতা গুজরিও সেখানেই মারা যান। দন্ডনের স্থানে বর্তমানে গুরুদুয়ারা ফতেহগড় সাহেব অবস্থিত।
ওয়াজির খান , মুসলিম সেনাপতি এবং সিরহিন্দের নবাব , যার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গুরু বেশ কয়েকটি যুদ্ধ করেছিলেন, দুই আফগান, জামশেদ খান এবং ওয়াসিল বেগকে গুরুর সেনাবাহিনীকে অনুসরণ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন যখন তারা বাহাদুরের সাথে সাক্ষাতের জন্য অগ্রসর হয়েছিল। দু'জন গোপনে গুরুকে অনুসরণ করেন যার সৈন্যরা ভারতের দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে ছিল এবং শিবিরে প্রবেশ করে যখন শিখরা কয়েক মাস ধরে গোদাবরী নদীর কাছে অবস্থান করছিল। তারা গুরুর কাছে প্রবেশ করে এবং জামশেদ খান তাকে নান্দেদে একটি মারাত্মক ক্ষত দিয়ে ছুরিকাঘাত করেন । সেই আঘাতের ক্ষতেই গুরুর মৃত্যু হয়। বর্তমানে সেখানে হুজুর সাহেব অবস্থিত।