যেসব ব্যাকটেরিয়া গ্রাম স্টেইনিং পদ্ধতিতে পজিটিভ ফলাফল দেয়, ব্যাকটেরিওলজিতে তাদেরকে গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া বলা হয়। প্রথাগতভাবে গ্রাম স্টেইনিং পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীরের উপর ভিত্তি করে, এদেরকে দুইটি বৃহৎ গোষ্ঠীতে শ্রেণীভুক্ত করা করা হয়।
গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া গ্রাম-পদ্ধতিতে ব্যবহৃত ক্রিস্টাল ভায়োলেট রঞ্জক দিয়ে রঞ্জিত হয় এবং অপটিকাল মাইক্রোস্কোপের নিচে দেখলে পার্পল বর্ণ প্রদর্শন করে; কারণ বিবর্ণ করার (decolorization) পর্যায়ে বাকি নমুনা থেকে স্টেইন ধুয়ে ফেলার পরেও ব্যাকটেরিয়া কোষ প্রাচীরের পুরু পেপটিডোগ্লাইকান (Peptidoglycan) স্তরটি তা ধরে রাখতে পারে।
অপরদিকে, গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়া বিবর্ণ করার (decolorization) পরে বেগুনী বর্ণ ধরে রাখতে পারে না। কারণ এই পর্যায়ে ব্যবহৃত অ্যালকোহল গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার বহিঃস্থ ঝিল্লিকে বিনষ্ট করে, ফলে কোষ প্রাচীরটি ছিদ্রযুক্ত হয়ে আর ক্রিস্টাল ভায়োলেট রঞ্জক ধরে রাখতে পারে না। তাদের পেপটিডোগ্লাইকান (Peptidoglycan) স্তরটি অনেক পাতলা এবং একটি অন্তঃস্থ কোষঝিল্লি ও বহিঃস্থ কোষঝিল্লির মধ্যে স্যান্ডউইচকৃত অবস্থায় থাকে, যার ফলে তারা কাউন্টারস্টেইন (সাধারণত স্যাফ্রানিন ইংরেজিতে Safranin বা ফুকসিন ইংরেজিতে Fuchsine) গ্রহণ করে এবং লাল বা গোলাপী বর্ণ প্রদর্শন করে।
যেসব অ্যান্টিবায়োটিকের লক্ষ্যবস্তু কোষ প্রাচীর, তাদের দ্বারা গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার তুলনায় বেশি আক্রান্ত হয় কারণ গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার পুরু পেপটিডোগ্লাইকান (Peptidoglycan) স্তর থাকলেও বহিঃস্থ কোষঝিল্লি নেই। [১]
সাধারণভাবে, নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়াতে উপস্থিত রয়েছে:[২]
কেবল কিছু প্রজাতির ক্যাপসুল থাকে, যা সাধারণত পলিস্যাকারাইড দিয়ে গঠিত। এছাড়া, শুধু কয়েকটি প্রজাতি ফ্লাজেলাযুক্ত (Flagellate)। আর ফ্লাজেলা থাকলেও তা সাধারণত দুটি মাত্র বেসাল বডি রিঙ (Basal body ring)-এর উপর ভিত্তি করে থাকে, যেখানে গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়াতে চারটি থাকে। গ্রাম-পজিটিভ ও গ্রাম-নেগেটিভ উভয় ব্যাকটেরিয়াতে একটি পৃষ্ঠস্থ স্তর থাকে যা এস-লেয়ার (S-layer) হিসেবে পরিচিত। গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ায়, এস-স্তরটি পেপটিডোগ্লাইকান স্তরের সাথে সংযুক্ত থাকে। গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার এস-স্তরটি সরাসরি বহিঃস্থ ঝিল্লির সাথে সংযুক্ত থাকে। কোষ প্রাচীরে টিকোয়িক এসিডের উপস্থিতি গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার একটি নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্য। এসব এসিডসমূহের মধ্যে কয়েকটি হল লিপোটিকোয়িক এসিড (Lipoteichoic acids), কোষ ঝিল্লিতে যাদের লিপিড উপাদান পেপটিডোগ্লাইকান স্তরের অ্যাঙ্করিংয়ে সহায়তা করে।
কোষের আকারের পাশাপাশি, দ্রুত সময়ের মধ্যে ব্যাকটেরিয়ার প্রজাতিসমূহের ভেতর পার্থক্য নির্ণয় করতে , গ্রাম স্টেইনিং পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। এ ধরনের স্টেইনিং পদ্ধতি, সাথে বৃদ্ধির জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান ও অ্যান্টিবায়োটিক সংবেদনশীলতা পরীক্ষা এবং অন্যান্য ম্যাক্রোস্কোপিক ও শারীরবৃত্তীয় পরীক্ষা মিলে ব্যাকটেরিয়ার শ্রেণিবিন্যাস ও উপবিভাজনের পূর্ণ ভিত্তি তৈরি করে (উদাহরণস্বরূপ,বার্গির ম্যানুয়ালের [৩] চিত্র এবং 1990-পূর্ববর্তী সংস্করণ দেখুন [৪])।
ঐতিহাসিকভাবে, গ্রাম স্টেইনিং পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে মনেরা রাজ্যকে (Kingdom Monera) প্রধানত চারটি ভাগে বিভক্ত করা হতঃ ফিরমিকিউটস (Firmicutes; স্টেইনিং পদ্ধতিতে পজিটিভ), গ্র্যাসিলিকিউটস (Gracilicutes; স্টেইনিং পদ্ধতিতে নেগেটিভ), মলিকিউটস (Mollicutes; স্টেইনিং পদ্ধতিতে নিরপেক্ষ) এবং মেন্ডোকিউটস (Mendocutes; স্টেইনিং পদ্ধতিতে পরিবর্তনশীল)।[৫] ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত অণুজীববিদ কার্ল ওয়েস (Carl Woese) ও সহযোগী এবং সহকর্মীদের '১৬ এস রাইবোসোমাল আরএনএ' (16S ribosomal RNA)-এর ফাইলোজেনেটিক স্টাডির ভিত্তিতে, গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার "মোনোফাইলি" (Monophyly)-কে চ্যালেঞ্জের করা হয়,[৬] বিশেষত চিকিৎসা ও সাধারণ অধ্যয়নে এই অণুজীবগুলোর ব্যাপক সংশ্লিষ্টতার কারণে। ১৬এস সিকোয়েন্সগুলোর আণবিক অধ্যয়নের (Molecular studies) ভিত্তিতে কার্ল ওয়েস বারোটি ব্যাকটেরিয়া পর্বের (Bacterial phyla) স্বীকৃতি দেন। এর ভেতর গ্রাম-পজিটিভ ছিল দুটি এবং তাদেরকে বিভক্ত করা হয়েছিল DNA তে গুয়ানিন ও সাইটোসিনের পরিমাণের অনুপাত অনুযায়ী। উচ্চ জি + সি (High G+C) বিশিষ্ট ফাইলাম অ্যাকটিনোব্যাকটেরিয়া (Actinobacteria) দ্বারা গঠিত ছিল এবং নিম্ন জি + সি বিশিষ্ট ফাইলাম ছিল ফিরমিকিউটস দ্বারা। অ্যাকটিনোব্যাকটেরিয়াতে অন্তর্ভুক্ত গণসমূহ হচ্ছে-করিনেব্যাকটেরিয়াম (Corynebacterium), মাইকোব্যাকটেরিয়াম (Mycobacterium) , নোকার্ডিয়া (Nocardia), এবং স্ট্রেপটোমাইসেস (Streptomyces)। নিম্ন জি + সি বিশিষ্ট ফিরমিকিউটসগুলোতে জিসির পরিমাণ (GC content) থাকে ৪৫-৬০%, তবে পরিমাণে অ্যাকটিনোব্যাকটেরিয়ার তুলনায় কম। [২]
ঐতিহ্যগতভাবে গ্রাম স্টেইন ধরে রাখার ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে ব্যাকটেরিয়াকে গ্রাম-পজিটিভ এবং গ্রাম-নেগেটিভ নামক দুটি প্রধান গ্রুপে বিভক্ত করা হলেও, এই শ্রেণিবিন্যাস পদ্ধতিটি দ্ব্যর্থক, কারণ এটি দ্বারা তিনটি স্বতন্ত্র বিষয় বোঝায় (যথাঃ স্টেইনিং পদ্ধতির ফলাফল, এনভেলপের গঠন ও ট্যাক্সোনমিক গ্রুপ), অগত্যা কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া প্রজাতির ক্ষেত্রে সবগুলো বিষয়কে একত্রে মেশানো যায় না।[৭][৮][৯][১০] গ্রাম-পজিটিভ এবং গ্রাম-নেগেটিভ স্টেইনিং প্রতিক্রিয়াও একটি নির্ভরযোগ্য বৈশিষ্ট্য নয়, কারণ এই দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়া ফাইলোজেনেটিকভাবে সুসংগত গ্রুপ (phylogenetic coherent group) গঠন করে না। যাইহোক, যদিও গ্রাম স্টেইনিং প্রতিক্রিয়া একটি অভিজ্ঞতালব্ধ মানদণ্ড, এটি নির্ভর করে ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীরের আল্ট্রাস্ট্রাকচার এবং রাসায়নিক গঠনে লক্ষণীয় পার্থক্যসমূহের উপর, যেগুলো চিহ্নিত হয় বহিঃস্থ লিপিড ঝিল্লির উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি দ্বারা।[১১]
সমস্ত গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া একটি একক-ইউনিট (single-unit) লিপিড ঝিল্লি দ্বারা বেষ্টিত, এবং সাধারণত, তারা পেপটিডোগ্লাইকানের একটি পুরু স্তর (২০-৮০ মিমি) ধারণ করে, যার ফলে তারা গ্রাম স্টেইন ধরে রাখতে সক্ষম হয়। একাধিক অন্যান্য ব্যাকটেরিয়া যারাও একক ঝিল্লি দ্বারা আবদ্ধ, কিন্তু পেপটিডোগ্লাইকান স্তর না থাকার কারণে (যেমন- মাইকোপ্লাজমাস, Mycoplasmas) অথবা কোষ প্রাচীরের গঠনের কারণে গ্রাম স্টেইন ধরে রাখতে অক্ষম—তারাও গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক প্রদর্শন করে। একক কোষঝিল্লি দ্বারা আবদ্ধ ব্যাকটেরিয়া কোষগুলোর জন্য, "মনোডার্ম (monoderm) ব্যাকটেরিয়া" বা "মনোডার্ম প্রোক্যারিওটস" শব্দটি প্রস্তাব করা হয়েছে।[৭][১১]
ক্লাসিক্যাল অর্থে ছয়টি গ্রাম-পজিটিভ গণ (Genus) সাধারণত মানুষের মধ্যে রোগ সৃষ্টি করে। এদের মধ্যে স্ট্রেপ্টোকোক্কাস (Streptococcus) ও স্ট্যাফাইলোকক্কাস (Staphyloccus) হল কক্কাই (গোলাকার)। বাকিসব ব্যাসিলাই (দণ্ডাকৃতির) এবং স্পোর গঠনের ক্ষমতার উপর ভিত্তি করে তাদেরকে বিভক্ত করা যেতে পারে। স্পোর গঠনে অক্ষম হচ্ছে-করিনেব্যাকটেরিয়াম (Corynebacterium) এবং লিস্টেরিয়া (Listeria যা একটি কক্কোব্যাসিলাস)। ব্যাসিলাস (Bacillus) এবংক্লোস্ট্রিডিয়াম (Clostridium) স্পোর গঠনে সক্ষম। [১২] স্পোরগঠনকারী ব্যাকটেরিয়াকে শ্বসনের উপর ভিত্তি করে পুনরায় বিভক্ত করা যেতে পারে: ব্যাসিলাস একটি ঐচ্ছিক অবায়ুজীবী (Facultative anaerobe) আর ক্লোস্ট্রিডিয়াম একটি বাধ্যতামূক বায়ুজীবী (Obligate anaerobe)। [১৩] এছাড়াও Rathybacter, Leifsonia এবং Clavibacter তিনটি গ্রাম-পজিটিভ গণ, যারা উদ্ভিতের রোগ সৃষ্টি করে। গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়া নবজাতক শিশুদের গুরুতর এবং কখনো কখনো মারাত্মক সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। [১৪]
"অনুভূমিক জিন স্থানান্তর" (Horizontal gene transfer)-এর জন্যে দরকারী তিনটি প্রক্রিয়ার মধ্যে রূপান্তর(Transformation) অন্যতম। রূপান্তরের মাধ্যমে এক্সোজেনাস জেনেটিক উপাদান একটি দাতা ব্যাকটিরিয়াম থেকে একটি গ্রহীতা ব্যাকটেরিয়ামে যায়। অপর দুটি প্রক্রিয়া হচ্ছে কনজুগেশন (দুটি ব্যাকটেরিয়া কোষের ভেতর সরাসরি সংযোগের মাধ্যমে জিনগত উপাদানের স্থানান্তর প্রক্রিয়া) এবং ট্রান্সডাকশন (একটি ব্যাকটিরিওফাজ ভাইরাস, দাতা ব্যাকটেরিয়ার DNA একটি গ্রহীতা পোষক ব্যাকটিরিয়ামের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়)। [১৫] রূপান্তর প্রক্রিয়ায়, জেনেটিক উপাদান মধ্যবর্তী মাধ্যমের ভিতর দিয়ে যায় এবং এর গ্রহণ সম্পূর্ণরূপে গ্রহীতা ব্যাকটেরিয়ামের উপর নির্ভর করে।
২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৮০ প্রজাতির ব্যাকটিরিয়া রূপান্তর করতে সক্ষম বলে জানা গিয়েছিল, গ্রাম-পজিটিভ এবং গ্রাম-নেগেটিভ ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা প্রায় সমান সমান ছিল; তবে এই সংখ্যা অতিরঞ্জিতও হতে পারে কারণ বেশীরভাগ রিপোর্টে সঠিকমাত্রায় তথ্যসংযোজন ছিল না।[১৫] গ্রাম-পজিটিভ ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে রূপান্তর ঘটে এমন মেডিক্যালি গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি যেমন স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনিয়া, স্ট্রেপ্টোকক্কাস মিউট্যান্স, স্ট্যাফাইলোকক্কাস অরিয়াস এবং স্ট্রেপ্টোকোক্কাস স্যানগুইনিস এবং গ্রাম-পজিটিভ মৃত্তিকার জীবাণু ব্যাসিলাস সাবটিলিস, ব্যাসিলাস সেরিয়াস এর অধ্যয়ন করা হয়েছে । [১৬]