গ্রামীণ ডানোন ফুডস হলো ২০০৬ সালে শুরু হওয়া একটি সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। এটি সংক্ষেপে গ্রামীণ ডানোন হিসেবেও সমধিক পরিচিত। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে পুষ্টিহীন শিশুদের প্রধান পুষ্টিচাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলা হয়। লাভ-ক্ষতিহীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে একে গড়ে তোলা হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের এক শতাংশ শেয়ার গ্রহীতাদের দেওয়ার নিয়ম থাকলেও, ২০০৯ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানের বোর্ড সদস্যরা আর্থিক লাভের অর্থ প্রতিষ্ঠানে ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।[১]
২০০৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ ইউনূসকে ডানোন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফ্রাঁ রিব্যুঁ সাক্ষাতের আমন্ত্রণ জানান। ২০০৫ সালের ১২ অক্টোবর ফরাসি রেস্তোরাঁ লা ফন্টেঁ গ্যেইলঁতে তাদের সাক্ষাৎ হয়। সেখানে ইউনূস বাংলাদেশের দরিদ্র শিশুদের পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের জন্য গ্রামীণ ও ডানোনের মধ্যে একটি যৌথ প্রকল্পের প্রস্তাব দেন। ফ্রাঁ রিব্যু ইউনূসের প্রস্তাবে “সামাজিক ব্যবসায়” আদলের এই প্রকল্পে অংশগ্রহণে সম্মত হন।[২] এরই ধারাবাহিকতায় সামাজিক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে গ্রামীণ ডানোন ফুড প্রতিষ্ঠিত হয়।[৩] প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের পুষ্টিসুবিধা বঞ্চিত জনগণের কাছে দৈনিক চাহিদা পূরণের উপযোগী পুষ্টি উপাদান নিশ্চিত করা এবং দারিদ্র্য নিরসনে সামাজিক ব্যবসায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান কোনো লভ্যাংশ পাবে না।[৪]
গ্রামীণ ডানোনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ব্যাপক সাড়া ফেলে এবং জিনেদিন জিদানের মতো প্রমুখ ফরাসি ফুটবল খেলোয়াড় এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।[৫]
২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গ্রামীণ ডানোনের নেতৃত্ব দেন কোরিন বাজিনা; তার পর ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এরিক ইপাভেচ, ২০১৭ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত ভেলেরি মাজোঁ প্রতিষ্ঠানের প্রধান ছিলেন। ২০২০ থেকে গ্রামীণ ডানোনের নেতৃত্বে রয়েছেন দীপেশ নাগ।
গ্রামীণ ডানোন “শক্তি দই” নামে একটি দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন করে, যাতে বাংলাদেশের শিশুদের পুষ্টি চাহিদা পূরণের জন্য প্রোটিন, ভিটামিন, লৌহ, ক্যালসিয়াম, জিংক ও অন্যান্য মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট থাকার কথা বলা হয়। প্রধানত শিশুদের উদ্দেশ্য বাজারজাতকৃত শক্তি দইয়ের ৫০ গ্রাম কাপের বাজারমূল্য ১০ টাকা এবং ৮০ গ্রাম কাপের বাজারমূল্য ৪০ টাকা।
গ্রামীণ ডানোন ফুডসের উদ্দেশ্য হলো ব্যবসায় ও স্থানীয় মানুষদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য নিরসন করা। এজন্য প্রতিষ্ঠানের পণ্য উৎপাদনের প্রধান কাঁচামাল দুধ ইত্যাদি স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা হয়। গ্রামীণ ডানোন ফুডসের পিতৃপ্রতিষ্ঠানগুলো এখান থেকে লভ্যাংশ উত্তোলন না করার বিষয়ে সম্মত হয়েছে। পরিবর্তে এই অর্থ দেশের কল্যাণ ও উন্নয়নে বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছে। এই কারণে একে “সামাজিক ব্যবসায়” বলা হচ্ছে।[৪]
২০০৬ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দশ বছরে গ্রামীণ ডানোনের ৫০টি উৎপাদন কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল।[৬] বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে ২৩০ কিলোমিটার (১৪০ মাইল) উত্তরে বগুড়া জেলায় এর প্রথম কারখানা স্থাপন করা হয়। এটি ৭,০০০ বর্গফুট (৬৫০ বর্গমিটার) আয়তনের একটি ছোটখাট কারখানা ছিল।[৭] ২০০৬ সালে এর উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৩,০০০ কিলোগ্রাম (৬,৬০০ পাউন্ড) দই। ২০০৮ সাল নাগাদ সক্ষমতা বাড়িয়ে ১০,০০০ কিলোগ্রাম (২২,০০০ পাউন্ড) করার পরিকল্পনা ছিল। প্রথম কারখানা স্থাপনের সাথে সাথে ওই অঞ্চলে কয়েকশত গবাদিপশু খামারি ও সরবরাহের জন্য কর্মসংস্থান গড়ে ওঠার কথা বলে হয়েছিল।[৪] কিন্তু ২০১১ সাল নাগাদ প্রতিষ্ঠানের দ্বিতীয় কোনো কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি।[৮]
গ্রামীণ ডানোন শক্তি দইয়ের জন্য কঠোরভাবে গুণমান নিয়ন্ত্রণ করে। উৎপাদক থেকে ভোক্তা পর্যায়ের গ্রাহক পর্যন্ত শীতল সরবরাহ শৃঙ্খল (কোল্ড চেইন) বজায় রাখা হয়। কিন্তু যানজট প্রভৃতি কারণে বাংলাদেশে শীতল সরবরাহ শৃঙ্খল বজায় রাখা অনেক ব্যয়সাপেক্ষ। পরিবহন ব্যয়ের কারণে প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি পায়, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত ব্রেক-ইভেন সাম্যাবস্থা অর্জন করতে পারেনি।