রহস্য ধর্ম, রহস্য গোষ্ঠী, পবিত্র রহস্য বা কেবল রহস্য ছিল গ্রেকো-রোমান জগতের একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় যাতে কেবল দীক্ষাপ্রাপ্তরাই (mystai) অংশগ্রহণ করতে পারত। এই ধর্মের মূল বৈশিষ্ট্য হল দীক্ষার বিবরণ এবং আচার অনুশীলনের সাথে সম্পর্কিত গোপনীয়তা, যা বাইরের লোকদের কাছে প্রকাশিত নাও হতে পারে। গ্রেকো-রোমান প্রাচীনত্বের রহস্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিল এলিউসিনীয় রহস্যবাদ, যা অনেক প্রাচীন, এমনকি গ্রীক অন্ধকার যুগেরও পূর্বের ছিল। রহস্যবাদী সম্প্রদায়গুলো লেট অ্যান্টিকুইটি বা শেষ প্রাচীন যুগে বিকাশ লাভ করে; রোমান সম্রাট জুলিয়ান বা জুলিয়ান দি অ্যাপোস্টেট (ধর্মত্যাগী জুলিয়ান) খ্রিস্টীয় ৪র্থ শতকে তিনটি পৃথক রহস্যবাদী সম্প্রদায়, বিশেষ করে মিত্রবাদের দ্বারা দীক্ষিত হয়েছিলেন বলে জনা যায়। গ্রেকো-রোমান রহস্যবাদের গোপনীয় প্রকৃতি এবং খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতক থেকে রহস্যবাদী সম্প্রদায়গুলো খ্রিস্টীয় রোমান সাম্রাজ্যের দ্বারা নিপীড়িত হতে থাকায়, এই ধর্মগুলোর ধর্মচর্চা সম্পর্কে বিভিন্ন বিবরণ, চিত্র এবং আন্তঃসাংস্কৃতিক অধ্যয়নের মাধ্যমেই জানতে হয়। "গোপনীয়তা এই ধর্মগুলোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়ে থাকায়, আমরা বিভিন্ন রহস্যবাদী বিশ্বাস সম্পর্কে কমই অবহিত"।[১] এই রহস্যবাদ্গুলো সম্পর্কে অনেক তথ্য এসেছে প্রাচীন রোমের বিশিষ্ট লেখক ও পণ্ডিত মার্কাস টেরেন্টিয়াস ভারোর (খ্রিস্টপূর্ব ১১৬-২৭ অব্দ) কাছ থেকে ।
জাস্টিন মার্টার ২য় শতাব্দীতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেন যে, এই রহস্যবাদগুলো আসলে সত্য ধর্মের শয়তান বা দৈত্যসংক্রান্ত অনুকরণ। এবং সত্য বিশ্বাসের "দৈত্যাদিসংক্রান্ত অনৈতিক নকল", এবং "মোজেস যেমনটা বলেছেন, এই শয়তানরা জুপিটারের কন্যা প্রোসারপিনা হয়ে মানুষকে উত্তেজিত করে, যাতে তারা তাকে কোরে (গ্রিক নারী মূর্তি) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে"। (ফার্স্ট অ্যাপোলজি)। প্রথম থেকে চতুর্থ শতাব্দীর মধ্যে, খ্রিস্টধর্ম রহস্যবাদগুলোর সাথে সরাসরি প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। সেই সময় "রহস্যবাদী সম্প্রদায়গুলোও খ্রিস্টীয় বাণীর গ্রহণের ক্ষেত্রে খ্রিস্টধর্মের অ-ইহুদি দিগন্তের একটি অন্তর্নিহিত উপাদান হিসেবে কাজ করে।" তৃতীয় শতাব্দীর শুরু থেকে, বিশেষ করে সম্রাট কনস্ট্যান্টাইনের সময় থেকে রহস্যবাদী ধর্মগুলোর উপাদানগুলো মূলধারার খ্রিস্টান চিন্তায় অন্তর্ভুক্ত হতে শুরু করে, উদাহরণস্বরূপ যা ডিসিপ্লিনা আরকানিতে প্রতিফলিত হয়।
ইংরেজি শব্দ 'mystery' উৎপত্তিগতভাবে গ্রিক বহুবচন Mystêria হিসেবে প্রথম দেখা যায়, পরে এটি ল্যাতিন শব্দ mysterium হিসেবে বিকশিত হয়, যেখান থেকে ইংরেজি শব্দটি এসেছে। গ্রিক শব্দ mystêrion (একবচনে) এর ব্যুৎপত্তি পুরোপুরি পরিষ্কার নয়, যদিও পণ্ডিতগণ মনে করেন শব্দটি গ্রিক শব্দ myo থেকে এসেছে যার অর্থ হচ্ছে "বন্ধ করা", মূলত চোখ বন্ধ করাকে বোঝায়, আর চোখ বন্ধ করার পর আমরা রহস্যের জগতে চলে যাই।[২] সাম্প্রতিককালের কিছু হিট্টাইট পণ্ডিত প্রস্তাব করেছেন, গ্রিক শব্দটি এসেছে হিট্টাইট ক্রিয়াপদ munnae থেকে, যার অর্থ হচ্ছে "গোপন করা, লুকিয়ে রাখা, দৃষ্টি থেকে আড়াল করা"।[৩]
রহস্যবাদ ছিল হেলেনবাদী ধর্মের তিনটি প্রকরণের একটি, অন্য দুটি ছিল সম্রাট কাল্ট বা কোন জাতি বা রাষ্ট্র সম্পর্কিত জাতিগত ধর্ম, এবং দার্শনিক ধর্ম যেমন নব্যপ্লেটোবাদ।
এই হেলেনবাদী ধর্মের এই তিনটি প্রকরণ ধর্মতত্ত্বকেও তিনটি ভাগে ভাগ করে - ভারো এর নাগরিক ধর্মতত্ত্ব বা রাজনৈতিক ধর্মতত্ত্ব, যা রাষ্ট্রধর্ম এবং সমাজে এর স্থিতি আরোপনমূলক প্রভাব নিয়ে বিবেচনা করে; প্রাকৃতিক ধর্মতত্ত্ব যা প্রকৃতি ও স্বর্গীয়তার মধ্যকার দার্শনিক অনুমান বিষয়ে চিন্তা করে; এবং পৌরাণিক ধর্মতত্ত্ব, যা পুরাণ ও ধর্মীয় আচার বিষয়ে চিন্তা করে।
রহস্যবাদগুলি এভাবে নাগরিক ধর্মের প্রতিযোগী নয়, বরং পরিপূরক ছিল। কোনও ব্যক্তি সহজেই রাষ্ট্রীয় ধর্মের রীতিনীতিগুলির সাথে জড়িত হতে পারতেন, আবার এক বা একাধিক রহস্যবাদের দীক্ষাও নিতে পারতেন, একই সাথে কোন নির্দিষ্ট দার্শনিক সম্প্রদায়ের সাথেও জড়িত থাকতে পারতেন।[৪] গণধর্মের বিভিন্ন বিষয় যেমন বলিদান, আচারগত ভোজন, এবং আচারগত পবিত্রকরণ রহস্যবাদেও ছিল, কিন্তু রহস্যবাদগুলোতে অতিরিক্ত উপাদানও উপস্থিত ছিল যা গোপনে সংঘটিত হত, এবং কেবল তারাই তাতে অংশ নিতে পারতেন যারা সেই রহস্যবাদে দীক্ষিত হতেন। রহস্যবাদী সম্প্রদায়গুলো প্রাচীন ধর্মীয় রীতি সংরক্ষণের জন্য একটি যথাযোগ্য স্থান হিসেবে কাজ করে।
যদিও ইতিহাসবিদরা সমস্ত রহস্যবাদী ধর্মকে শ্রেণিবদ্ধ করার জন্য একটি কঠোর সংজ্ঞা তৈরির প্রচেষ্টা ছেড়ে দিয়েছেন, তবুও রহস্যবাদী সম্প্রদায়গুলিকে বেশ কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্যের দ্বারা সংজ্ঞায়িত করা যেতে পারে। সমস্ত রহস্যবাদী উপাসক সম্প্রদায় তাদের অনুশীলনের গোপনীয়তায় জোর দেয় এবং একটি নতুন সদস্যের দলে যোগদানের ক্ষেত্রে একটি আবেগীয় দীক্ষার রীতি অনুসরণ করে। সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশগ্রহণ করতেন, তারা রাতের বেলায় জমায়েত হতেন, জমায়েতের পূর্বে পবিত্রকরণের ব্যবস্থা থাকত, অংশগ্রহণের জন্য পরিশোধের বাধ্যবাধকতা ছিল, ইহকাল ও পরকালের জন্য পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি ছিল, এবং পুরনো রহস্যবাদী জমায়েতের স্থান সর্বনিকটস্থ নগর থেকে পরিবর্তনশীল দূরত্বে অবস্থান করত। এছাড়া, মিত্রবাদী উপাসক সম্প্রদায় ছাড়া অন্যান্য রহস্যবাদের সদস্যের সকলেই সকলের কাছে মুক্ত ছিল, যাদের মধ্যে নারী ও পুরুষ, দাস ও স্বাধীন নাগরিক, তরুণ ও বৃদ্ধ ইত্যাদি ছিল। সকল ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্যই খরচ ছিল, যার ফলে অনেকেই যোগদান করতে পারত না। আর যদিও রহস্যবাদগুলো গোপন ছিল, সেগুলো খুব বেশি রহস্যময় ছিল না।[৫]
এই কারণে, প্রাচীন গ্রিক রহস্যবাদগুলোর সম্পর্কে আমাদের মধ্যে যেসব ধারণা রয়েছে সেগুলোকে বোঝা হয়েছে সাধারণ ইন্দো-ইউরোপীয় ধর্ম ও সমান্তরালে ইন্দো-ইরানীয় ধর্মের নির্দিষ্ট বিষয়ের প্রতিফলন হিসেবে। গ্রেকো-রোমান প্রাচীন যুগের রহস্যবাদী সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে রয়েছে এলিউসিনীয় রহস্যবাদ, ডায়োনিসীয় রহস্যবাদ, এবং অর্ফিক রহস্যবাদ। ধর্মীয় ক্ষেত্রে রোমানরা অন্যান্য জাতিদের থেকে যেসব দেবদেবীর ধারণাকে গ্রহণ করেছিল তাদেরকেও রহস্যবাদে পূজা করা হতে থাকে, এদের মধ্যে ছিল মিশরীয় দেবী আইসিস, মিথ্রবাদী রহস্যবাদের পারস্য দেবতা মিথ্রাস বা মিথ্র, থ্রেসীয় বা ফ্রিজীয় সাবাজিয়াস এবং ফ্রিজীয় সিবেলি।
এলিউসিনীয় রহস্যবাদ ছিল রহস্যবাদী কাল্টগুলোর মধ্যে প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে বিখ্যাত, এবং এটি এক সহস্রাব্দেরও বেশি সময় ধরে স্থায়ী ছিল। খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীর শেষভাগে যখনই তারা প্রথম উৎপত্তি লাভ করুক না কেন, তারা অর্ফিকবাদ দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, এবং লেট এন্টিকুইটি বা প্রাচীন কালের শেষ পর্যায়ে তারা রূপকায়িত হয়ে উঠেছিল।[৫]
অ্যাটিক দিনপঞ্জিতে বিড্রোমিয়ন (সেপ্টেম্বর/অক্টোবর) মাসের ১৫ তারিখে এথেন্সের আগোরাতে প্রায় ৩,০০০ সম্ভাব্য দীক্ষাপ্রার্থীগণ একত্রিত হতো, যারা গ্রিক ভাষায় কথা বলত এবং কখনো হত্যা করেনি (যেহেতু পবিত্রতার উপর জোর দেওয়া হত, এই নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রে তারা অন্তর্ভুক্ত ছিল যাদের আত্মা 'অপবিত্র')। দিয়াসিয়া এবং থেসমোফোরিয়ার মত অন্যান্য বড় উৎসবে প্রত্যাশিত দীক্ষাপ্রাপ্তগণ তাদের নিজস্ব বলিদানের পশু নিয়ে আসত এবং উৎসবের সূচনা হলে এর ঘোষণা শুনত। পরের দিন, তারা সমুদ্রে গিয়ে নিজেদের এবং প্রাণীদেরকে পবিত্র করত। তিন দিনের বিশ্রামের পর দেমেতের ও তার কন্যা পার্সিফোনের মন্দিরের শোভাযাত্রার জন্য ১৯ তারিখে তারা আগোরায় পুনরায় একত্রিত হত। দু'জন এলিউসিনীয় পুরোহিতানী শোভাযাত্রার সামনের দিকে থাকতেন, অনুষ্ঠানের বাকি অংশের প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় বস্তুসমূহ হাতে নিয়ে অনেক গ্রিক তাদেরকে অনুসরণ করতেন, এবং শোভাযাত্রাটি কয়েক ঘণ্টাব্যাপী ১৫ মাইল দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে এলিউসিস শহরে পৌঁছত যা বারবার উৎযাপন, নৃত্য ইত্যাদির জন্য থেমে যেত। দীক্ষার্থীরা শহরে যাওয়ার পথে মশাল বহন করত। শহরে পৌঁছবার পর তারা মন্দিরে (স্যাংকচুয়ারি) নাচতেন। পরের দিন শুরু হত বলিদানেরমাধ্যমে, এবং সূর্যাস্তের সময় দীক্ষার্থীরা টেলেস্টেরিওন নামক দালানের যেত যেখানে দীক্ষাগ্রহণ অনুষ্ঠিত হত। দীক্ষার্থীরা নিজেদেরকে ধৌত করে শুদ্ধ হত এবং প্রত্যেকে নিভে যাওয়া মশালসমূহের গন্ধকে ঘিরে নিরবতা সহকারে বসতেন। দীক্ষাদান দুটি রাতেরও বেশি সময় নিতে পারত। যদি তাই হয়, তবে প্রথম রাত হত দেমেতেরের প্রতি হোমারীয় স্তোত্রের পুরাণ অনুযায়ী হেডিস দ্বারা পার্সিফোনের অপহরণ (যেখানে পার্সিফোনকে অপহরণ করা হয় এবং তার মা দেমেতের তাকে অনুসন্ধান করতে থাকেন, এবং যখন তার কন্যা ফিরে আসেন, দেমেতের এই জীবন ও এর পরবর্তী জীবনে উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন) ও উর্বরতার নিশ্চয়তা সমেত পার্সিফোনের ফিরে আসার পুরাণ কেন্দ্রিক, এবং দ্বিতীয় রাত হত এপোপটেইয়া (রহস্যবাদের উচ্চতর মাত্রা) কেন্দ্রিক, যেখানে সংগীত, নৃত্য, এবং সম্ভবত একটি লিঙ্গ প্রদর্শন অন্তর্ভুক্ত থাকত, যা দর্শকদের কাছে ছিল দক্ষ এলিউসিনীয় পুরোহিতদের দ্বারা সম্পাদিত ভীতিকর অভিজ্ঞতা, এবং এর চূড়ান্ত পর্যায়ে দেমেতেরের মূর্তি, গমের একটি মঞ্জরি, এবং কৃষিসম্পদের "জন্ম" প্রদর্শন করা হত। সুতরাং, এই রহস্যবাদগুলি উর্বরতা এবং কৃষির সাথে সংযুক্তি ছিল।[৫] দুই সহস্রাব্দ জুড়ে এত মানুষ কীভাবে এলিউসিনীয় রহস্যবাদের সমাপ্তি অনুষ্ঠানে ধারাবাহিকভাবে আনন্দদায়ক অবস্থার অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে, তার ব্যাখ্যা হিসেবে অসংখ্য পণ্ডিত প্রস্তাব করেছেন যে এলিউসিনীয় রহস্যবাদের এই ক্ষমতা আসত কাইকিয়ন থেকে যা একটি এনথিওজেন হিসেবে কাজ করত। [৬]
দীক্ষা সমাপ্তির দিনটিকে প্লেমোকোয়াই (Plemochoai) বলা হত ( একটি পাত্র দিয়ে তর্পন (দেবদেবীর উদ্দেশ্যে জল বা সশ্যাদি ঢালা) করার পর), এবং নতুন সদস্যরা তখন পুরোহিতদের মতো মেদিগাছের রেথ (মাথায় পরার রিং আকৃতির মুকুট) পরতে পারতেন। অবশেষে দীক্ষাপ্রাপ্তগণ স্থান ত্যাগ করতেন এবং প্যাক্স (paks) বা কংকস (konks) উচ্চারণ করতেন, যা অনুষ্ঠানের সমাপ্তিকে নির্দেশ করত। ভ্রমণের সময় নতুন সদস্যরা যে পোশাক পরিধান করত তা শিশুদের জন্য সৌভাগ্যের কম্বল হিসেবে ব্যবহৃত হত, অথবা সম্ভবত তাদের মন্দিরে প্রদান করা হত। [৫]
দ্বিতীয় সবচেয়ে বিখ্যাত রহস্যবাদ ছিল সামোথ্রেস দ্বীপের রহস্যবাদগুলো, এগুলো সমুদ্রের বিপদ থেকে নাবিকদের সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দিত, এবং বেশিরভাগ অংশগ্রহণকারীরা পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি থেকে দীক্ষা নিতে আসত। এই রহস্যবাদগুলো সম্পর্কে যেসব তথ্য জানা গেছে তার পরিমাণ এলিউসিনীয় রহস্যবাদ সম্পর্কিত জানা তথ্যগুলোর থেকে কম এবং এই রহস্যবাদ আরও পরবর্তীকালে প্রচলিত ছিল (হেলেনবাদী এবং রোমান সময়কালের প্রচলিত ছিল)। জানা যায়, সামোথ্রেসীয় রহস্যবাদ এলিউসিনীয় রহস্যবাদের বিষয়বস্তুকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ধার করেছে ('মিস্টেরি' শব্দটি সহ), সেই সাথে, প্রত্নতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক উপাত্তসমূহ সামোথ্রেসে যা ঘটেছিল তার আরও বেশি ব্যাখ্যা দিয়ে চলেছে। এই আচারগুলি পার্শ্ববর্তী দ্বীপে অন্যদের সাথে যেমন কাবেইরির দেবদেবীদের রহস্যবাদের সাথে যুক্ত ছিল। ম্যাসিডোনের দ্বিতীয় ফিলিপ এবং তার স্ত্রী অলিম্পিয়াস সামোথ্রেসে দীক্ষা অনুষ্ঠানের সময় দেখা করেছিলেন বলে জানা গেছে।[৭] হেরাক্লেস, জেসন, ক্যাডমাস, অর্ফিয়াস এবং ডায়োস্ক্যুরি, সবাইকে এখানেই দীক্ষা দেওয়া হয়েছিল বলে জানা গেছে। সামোথ্রেসের দেব-দেবীদের বেনামে চিহ্নিত হওয়ার প্রবণতা দেখা যায় যেমন "সামোথ্রেসীয় দেবতা", "সামোথ্রেসের দেবতারা", "মহান দেবতারা" ইত্যাদি উল্লেখ করা হয়েছিল, কারণ তারা কে ছিলেন তা পুনর্গঠন করা কঠিন, যদিও তাদের সাথে প্রায়ই কাবেইরি এর তুলনা করা হত।[৫]
এলিউসিসের মত, সামোথ্রেসে দীক্ষা দানের অনুষ্ঠান বছরের সংকীর্ণ কিছুদিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না এবং এটি এপ্রিল থেকে নভেম্বর পর্যন্ত চলত (জাহাজ চলাচলের মৌসুম) এবং সম্ভবত জুনে এদের একটি বড় অনুষ্ঠান সংঘটিত হত তবে তা সম্ভবত দুই রাতেরও বেশি সময় ব্যাপী চলত। সামোথ্রেসে দীক্ষার্থীরা পূর্ব দিক থেকে সামোথ্রেসের মন্দিরে (স্যাংকচুয়ারি) প্রবেশ করত, যেখানে তারা টালি পাথর ও ৫টি ধাপের গ্র্যান্ডস্ট্যান্ড (বৃত্তাকার মাঠ বা মঞ্চের চারদিকে গ্যালারি) যুক্ত ৯ মিটার ব্যাসের বৃত্তাকার স্থানটিতে প্রবেশ করত এখন রঙ্গমঞ্চীয় বৃত্ত (থিয়েটারাল সার্কেল) নামে পরিচিত। রোমান ঐতিহাসিক লিভি লিখেছেন, দীক্ষার্থীরা এখানে একটি ঘোষণা শুনত যেখানে বলা হত অপরাধ ও রক্তপাত যার হাত দিয়ে সংঘটিত হয়েছে সে দীক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না বা দীক্ষাপ্রাপ্তরা এরকম কাজ করতে পারবে না। এলিউসিসের মতো এখানেও সম্ভবত আচার অনুষ্ঠানের শুরুতে বলির অনুষ্ঠান হত, যেখানে বলিদানের পশুটি ছিল সম্ভবত মেষ বা ভেড়া। দীক্ষার্থীরা এমন একটি ভবনে চলে যেতেন যেখানে রাতের বেলা মশাল নিয়ে প্রকৃত দীক্ষা অনুষ্ঠান সংঘটিত হত, যদিও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা এটি কোন ভবন ছিল সে বিষয়ে অনিশ্চিত কেননা হল অফ কোরাল ড্যান্সারস, হিয়েরন, অ্যানাক্টোরন ও দ্বিতীয় আরসিনই এর রোটুন্ডা সহ অনেক ভবনেই এই অনুষ্ঠান সংঘটিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। তৃতীয় শতাব্দীতে, রোমের হিপপলিটাস তার রিফিউটেশন অফ অল হেরেসিস গ্রন্থে এখানকার কিছু মূর্তির ব্যাপারে গূঢ়তত্ত্ববাদী (নস্টিক) লেখকের টানা সংক্ষিপ্তসারের উল্লেখ করেছেন;
সামোথ্রেসীয়ডেড় অ্যানক্টোরনে দু'জন নগ্ন পুরুষের মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, উভয় হাত স্বর্গের দিকে প্রসারিত হয়েছিল এবং তাদের জননেন্দ্রিয় উত্থিত ছিল, ঠিক যেমন কাইলিনির হার্মিসের মূর্তি। পূর্বোক্ত মূর্তিদ্বয় হ'ল আদিম পুরুষ এবং পুনজন্মপ্রাপ্তের মূর্তি, একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি সকল ক্ষেত্রে সেই মানুষটির সাথে একাকার হয়ে যাবে।
তথ্যের ঘাটতির কারণে দীক্ষা চলাকালে কী ঘটেছিল তা জানা যায়না, যদিও সেখানে এলিউসিনীয় রহস্যবাদের মতই নৃত্য থাকতে পারে, যা হারমোনিয়ার অনুসন্ধানের পুরাণের সাথে সম্পর্কিত ছিল। দীক্ষা শেষে, দীক্ষাপ্রাপ্তদেরকে পার্পল বা বেগুনী রং এর ফিলেট (মাথায় বাধার ফিতা) পরিধান করত। দ্বিতীয় রাতেওএই অনুষ্ঠান হত যাকে এপোপটেইয়া বলা হয়, সেক্ষেত্রে "সাধারণ প্রাথমিক পবিত্রকরণের অনুষ্ঠান এবং উৎসর্গ" সংঘটিত হত, যদিও এর সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়না, তবে এটি এলিউসিনীয় রহস্যবাদের এপোপটেইয়া এর সদৃশ হয়ে থাকতে পারে, এবং চূড়ান্ত পর্যায় বা ক্লাইম্যাক্সে মহান আলোর প্রদর্শন হয়ে থাকতে পারে।[৫]
প্রথম রাতের দীক্ষা সমাপ্ত হত একত্রে ভোজনের মাধ্যমে, এবং প্রত্নতাত্ত্বিকগণ সামোথ্রেসের কাল্টের সাথে সম্পর্কিত অনেক ভোজনকক্ষ আবিষ্কার করেছেন। তর্পনের জন্য যে বাটি ব্যবহার করা হত তা ফেলে রাখা হত, এই কাল্টের স্থানে এরকম হাজার হাজার তর্পনের পাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। অংশগ্রহণকারীরা প্রায়ই অন্যান্য বস্তুগুলোকে ফেলে আসত, যেমন বাতি। এছাড়া বেগুনী ফিলেট ছাড়াও সেখানে ফ্লে রাখা 'সামোথ্রেসীয় অঙ্গুরীয় বা রিং'-ও পাওয়া গেছে (এটা ছিল সোনার প্রলেপ দেয়া চুম্বকায়িত লৌহ অঙ্গুরীয়) এবং কোন কোন দীক্ষার্থী মন্দিরের স্টোয়াতে (ছাউনিযুক্ত হাঁটার পথ) তাদের দীক্ষাগ্রহণের রেকর্ড রেখে যেত। দ্বিতীয় রাতের দীক্ষানুষ্ঠানও ভোজন দ্বারাই সমাপ্ত হত।[৫]
আধুনিক পণ্ডিতেরা রহস্যবাদী ধর্মের উপর খ্রিস্টধর্মের নির্ভরশীলতার সরল ধারণা প্রত্যাখ্যান করেন। [৮] খ্রিস্টধর্ম নিজে যদি রহস্যবাদী কাল্ট নাও হয়ে থাকে, তবুও খ্রিস্টধর্মের উৎপত্তিতে রহস্যবাদী কাল্টগুলোর ব্যাপক প্রভাব ছিল - এই ধারণাটি ১৯শ শতকের শেষ ও ২০শ শতকের শুরুর দিকের জার্মান পণ্ডিতদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। এই প্রবণতা আংশিকভাবে ছিল খ্রিস্টধর্মের ইতিহাসের সমালোচনামূলক ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি (যেমন ডেভিড স্ট্রসের ডাস লেবেন জেসু (১৮৩৫-৬)) এবং খ্রিস্টধর্মের উৎপত্তিকে তার পৌত্তলিক পরিবেশ থেকে ব্যাখ্যা করতে চাওয়া পণ্ডিতদের মধ্যকার ধর্মনিরপেক্ষ প্রবণতার ফলাফল। উদাহরণস্বরূপ, পণ্ডিতেরা টারসাসের একটি মিথ্রবাদী রহস্যবাদী কাল্ট থেকে পলের ধর্মতত্ত্ব প্রতিপাদনের প্রচেষ্টা শুরু করেন, যদিও সেখানে কোন রহস্যবাদের অস্তিত্ব ছিল না এবং ১ম শতাব্দীর শেষ হওয়ার আগে কোন মিথ্রবাদী রহস্যবাদের অস্তিত্ব ছিল না।[৯] পণ্ডিতদের মনোভাব পরিবর্তিত হতে শুরু করে যখন মিশরবিদ্যা একটি শিক্ষায়তনিক শাখা হিসেবে প্রতীয়মান হতে শুরু করে এবং ১৯৫২ সালে আর্থার নক কর্তৃক একটি বৈপ্লবিক প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, যেখানে নিউ টেস্টামেন্ট বা নবপুস্তকে রহস্যবাদী পরিভাষাসমূহের প্রায় অনুপস্থিতি সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়।[১০] যদিও কেউ কেউ খ্রিস্টধর্মে আচার-অনুষ্ঠান যেমন অভিসিঞ্চন এবং ইউক্যারিস্টের উৎপত্তিকে রহস্যবাদী ধর্মের সাথে সম্পর্কিত করার চেষ্টা করেছেন, এটা প্রমানিত হয়েছে যে অভিসিঞ্চনের উৎপত্তি বরং ইহুদি ধর্মের শুদ্ধিকরণ আচারেই নিহিত এবং প্রাচীন বিশ্বে কাল্ট খাদ্য এত ব্যাপক ছিল যে তাদের উৎপত্তি যে কোন একটি উৎস থেকেই দেখানো যায়। রহস্যবাদী ধর্মগুলো থেকে খ্রিস্টধর্মের বিষয়বস্তুর উদ্ভবের অনুসন্ধানও ব্যর্থ হয়েছে; তাদের অনেকগুলোরই (যেমন এলিউসিনীয় এবং সামোথ্রেসীয় রহস্যবাদ) কোন বিষয়বস্তু ছিল না, বরং এগুলো দীক্ষানুষ্ঠানের সময় বিভিন্ন বস্তু দেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।[১১]
আধুনিক গবেষণায় দেখা যায় যে খ্রীষ্টধর্ম কোন রহস্যবাদী ধর্ম না হলেও এটিকে প্রারম্ভিক খ্রিস্টধর্মের বিরোধীরা রহস্যবাদী ধর্মগুলোর সাথে তুলনা করেছিলেন, যেমন লুসিয়ান[১২] এবং সেলসাস।[১৩] জাস্টিন মার্টার সহ অধিকাংশ প্রথম দিকের খ্রিস্টানরা এই রহস্যবাদগুলোর বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করেন। জাস্টিন খ্রিস্টধর্মকে পৌত্তলিক ধর্মের সাথে তুলনা করেছেন, কিন্তু পণ্ডিতেরা তার এই তুলনার অগভীরতার জন্য তার সমালোচনা করেছেন। অন্যদিকে, যখন কনস্ট্যান্টাইন রোমান সাম্রাজ্যের সম্রাট হন এবং খ্রিস্টধর্মকে বৈধ করেন, খ্রিস্টানরা পৌত্তলিক নির্যাতনের ভয় হারিয়ে ফেলেন এবং প্রথমবারের মত রহস্যবাদী ধর্মগুলো থেকে কিছু ধারণা খ্রিস্টান চিন্তার মূলধারায় পরিণত হয়।[১১]