চর্যাপদ (IAST: Caryapāda) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সাহায্যে ১৯১৬ সালে প্রকাশিত হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ গান ও দোঁহা নামক গ্রন্থের চব্বিশ (মতান্তরে তেইশ) জন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যের রচিত চর্য্যাচর্য্যর্বিনিশ্চয়ের সাড়ে ছেচল্লিশটি গান। চর্যাপদে বৌদ্ধধর্মের গূঢ় সাধনপ্রণালী ও দর্শনতত্ত্ব নানা প্রকার রূপকের মাধ্যমে আভাসে ইঙ্গিতে ব্যক্ত হয়েছে। প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত এ পদগুলোর যেমন সাহিত্যিক মূল্য বিদ্যমান, তেমনি প্রাচীন বাঙালি সমাজের চিত্রও এতে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত।
বাংলা ভাষার পূর্ববর্তী রূপ অপভ্রংশ থেকে কোন মুহূর্তে এ ভাষা স্বপরিচয়ে চিহ্নিত হয়েছে তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা তর্কসাপেক্ষ হলেও সবাই বাংলা সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে চর্যাপদকেই স্বীকার করেন। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস চর্যাপদ থেকে শুরু। কিন্তু চর্যাপদের প্রথম রচনার কাল সম্পর্কেও পণ্ডিতেরা ঐকমত্যে পৌঁছাননি।
চর্যাপদ অনেক প্রাচীন সাহিত্যকর্ম হলেও এটির আবিষ্কার খুব বেশিদিনের কথা নয়। ১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে চর্যার একটি খণ্ডিত পুঁথি উদ্ধার করেন। মূলত ১৮৮২ সালে রাজা রাজেন্দ্র লাল মিত্র নেপালে সংস্কৃত বৌদ্ধ সাহিত্য গ্রন্থে চর্যাপদের অস্তিত্বের কথা বলেছিলেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন] আর সেই সূত্র ধরে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদ আবিষ্কারে উদ্দীপ্ত হন। ১৮৯৭ সালে বৌদ্ধ লোকাচার সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের জন্য তিনি প্রথমবার নেপাল ভ্রমণ করেন। ১৮৯৮ সালে তার দ্বিতীয়বার নেপাল ভ্রমণের সময় তিনি কিছু বৌদ্ধ ধর্মীয় পুঁথিপত্র সংগ্রহ করেন। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে তৃতীয়বার নেপাল ভ্রমণকালে চর্যাচর্যবিনিশ্চয় নামক একটি পুঁথি নেপাল রাজদরবারের অভিলিপিশালায় আবিষ্কার করেন। চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদের দোহা এবং অদ্বয় বজ্রের সংস্কৃত সহজাম্নায় পঞ্জিকা, কৃষ্ণাচার্য বা কাহ্নপাদের দোহা, আচার্যপাদের সংস্কৃত মেখলা নামক টীকা ও আগেই আবিষ্কৃত ডাকার্ণব পুঁথি একত্রে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে (শ্রাবণ, ১৩২৩ বঙ্গাব্দ) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোঁহা শিরোনামে সম্পাদকীয় ভূমিকাসহ প্রকাশ করেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।[১] হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মোট ৪৬টি পূর্ণাঙ্গ ও একটি খণ্ডিত পদ পেয়েছিলেন। পুঁথিটির মধ্যে কয়েকটি পাতা ছেঁড়া ছিল। প্রবোধচন্দ্র বাগচী চর্যার যে তিব্বতি অনুবাদ সংগ্রহ করেন তাতে আরও চারটি পদের অনুবাদসহ ওই খণ্ডপদটির অনুবাদও পাওয়া যায়। মূল পুঁথির পদের সংখ্যা ছিল ৫১।[২][৩] মূল তিব্বতি অনুবাদের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, মূল পুঁথির নাম চর্যাগীতিকোষ এবং এতে ১০০টি পদ ছিল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিটি চর্যাগীতিকোষ থেকে নির্বাচিত পুঁথিসমূহের সমূল টীকাভাষ্য।[৪].
আবিষ্কৃত পুঁথিতে চর্যা-পদাবলিয় যে নাম পাওয়া যায় সেটি হল 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়'। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থে এই নামটিই ব্যবহার করেছেন, সংক্ষেপে এটি ‘বৌদ্ধ গান ও দোহা’ বা ‘চর্যাপদ’ নামেও অভিহিত হয়ে থাকে।[৫] কিন্তু আবিষ্কৃত পুঁথিটি যেহেতু মূল পুঁথি নয়, মূল পুঁথির নকলমাত্র এবং মূল পুঁথিটি (তিব্বতি পুঁথি) যেহেতু এ পর্যন্ত অনাবিষ্কৃত, সেই কারণে পরবর্তীকালে চর্যা-পদাবলির প্রকৃত নাম নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়।
মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে চর্যার প্রথম পদের সংস্কৃত টীকাটি (শ্রীলূয়ীচরণাদিসিদ্ধরচিতেঽপ্যাশ্চর্যচর্যাচয়ে। সদ্বর্ত্মাবগমায় নির্ম্মল গিরাং টীকাং বিধাস্যে স্ফুটনম।।) উদ্ধৃত করে শ্লোকাংশের 'আশ্চর্যচর্যাচয়' কথাটিকে গ্রন্থনাম হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব রাখেন। তাঁর মতে, 'আশ্চর্যচর্যাচয়' কথাটিই নেপালী পুঁথি নকলকারীর ভুলবশত 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' হয়েছে। তবে এই মতের যথার্থতা বিষয়ে আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেহ প্রকাশ করেন।[৬] প্রবোধচন্দ্র বাগচী ওই একই সূত্র ধরে চর্যা-পুঁথির নাম 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়' রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু আচার্য অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এই মত খণ্ডন করে লিখেছেন, "'আশ্চর্যচর্যাচয়' নামটিও অযুক্তিযুক্ত নয়। কিন্তু 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' ও 'আশ্চর্যচর্যাচয়', দুই নামকে মিলিয়ে 'চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়' নামটি গ্রহণ করা যায় না। কারণ এই 'জোড়কলম' শব্দটি আধুনিক পণ্ডিতজনের পরিকল্পিত।"[৭]
আধুনিক গবেষকগণ তেঙ্গুর গ্রন্থমালা (Bastan-hgyar) থেকে অনুমান করেন মূল পুঁথিটির নাম ছিল চর্যাগীতিকোষ এবং তার সংস্কৃত টীকাটি 'চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' — অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই মত গ্রহণ করেছেন।[৮]
চর্যার রচনার সময়কাল নিয়েও ইতিহাস গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ও প্রবোধচন্দ্র বাগচীর মতে চর্যার পদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত। কিন্তু ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও রাহুল সাংকৃত্যায়ন এই সময়কালকে আরও ২০০ বছর পিছিয়ে দিয়ে চর্যার রচনাকাল খ্রিস্টীয় অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দী বলে মতপ্রকাশ করেছেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (৯৮০ – ১০৫৩ খ্রিস্টাব্দ) তিব্বত যাত্রার পূর্বে (১০৩০ খ্রিস্টাব্দ) লুইপাদের অভিসময়বিহঙ্গ রচনায় সাহায্য করেছিলেন। একথা যদি সত্য হয় তবে লুইপাদের দশম শতাব্দীর শেষভাগেও বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকার কথা। অপরদিকে তিব্বতি কিংবদন্তি অনুসারে তিনিই সিদ্ধাচার্যদের আদিগুরু। অর্থাৎ, চর্যার সময়কালও দশম শতাব্দীর পূর্বে হতে পারে না।[৮]
অন্যদিকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে হেবজ্রপঞ্জিকাযোগরত্নমালা নামে এক বৌদ্ধতান্ত্রিক পুঁথির সন্ধান মেলে, যেটির রচনাকাল শেষ পালরাজা গোবিন্দপালের (১১৫৫ খ্রিস্টাব্দ) শাসনকাল। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পুঁথির রচয়িতা শ্রীকৃষ্ণাচার্যই প্রকৃতপক্ষে চর্যার কাহ্নপাদ বা চর্যা-টীকার কৃষ্ণাচার্য। নাথ সাহিত্য অনুযায়ী কাহ্নপাদের গুরু জালন্ধরিপাদ বা হাড়িপা, যিনি গোরক্ষনাথের শিষ্য ছিলেন। আবার মারাঠি গ্রন্থ জ্ঞানেশ্বরী (রচনাকাল আনুমানিক ১২৯০ খ্রিস্টাব্দ) থেকে জানা যায় উক্ত গ্রন্থের রচয়িতা জ্ঞানদেব দীক্ষালাভ করেন নিবৃত্তিনাথের কাছ থেকে, যিনি গোরক্ষনাথের শিষ্য গেইনীনাথ বা গোয়নীনাথের থেকে দীক্ষাপ্রাপ্ত। সেই হিসাবেও কাহ্নপাদকে দ্বাদশ শতাব্দীর মানুষ বলে মনে করা হয়।[৮]
এইসব তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে চর্যার পদগুলি খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে রচিত বলেই অনুমিত হয়। তবে তার পরেও দু-তিনশো বছর ধরে গোপনে চর্যাগীতি রচিত হয়েছিল। শশিভূষণ দাশগুপ্ত নেপাল ও তরাই অঞ্চল থেকে এই ধরনের শতাধিক পদ উদ্ধার করেছেন ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে। এগুলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ১৯৮৯ সালে নব চর্যাপদ নামে সংকলিত ও প্রকাশিত হয়।[৯]
চর্যার কবিগণ সিদ্ধাচার্য নামে পরিচিত; সাধারণত বজ্রযানী ও সহজযানী আচার্যগণই এই নামে অভিহিত হতেন। তিব্বতি ও ভারতীয় কিংবদন্তিতে এরাই 'চৌরাশি সিদ্ধা' নামে পরিচিত। তবে এই ৮৪ জন সিদ্ধাচার্য আসলে কারা ছিলেন তা সঠিক জানা যায় নি।[১০]
চর্যার কবিরা ছিলেন পূর্ব ভারত ও নেপাল রাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসী। কেউ পূর্ববঙ্গ, কেউ উত্তরবঙ্গ, কেউ বা রাঢ়ের অধিবাসী ছিলেন। কেউ কেউ বিহার, কেউ ওড়িশা, কেউ বা আবার অসম বা কামরূপের বাসিন্দাও ছিলেন।[১১]
আবিষ্কৃত পুঁথিটিতে ৫০টি চর্যায় মোট ২৪ জন সিদ্ধাচার্যের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন: লুই, কুক্কুরী, বিরুআ, গুণ্ডরী, চাটিল, ভুসুকু, কাহ্ন, কাম্বলাম্বর, ডোম্বী, শান্তি, মহিত্তা, বীণা, সরহ, শবর, আজদেব, ঢেণ্ঢণ, দারিক, ভাদে, তাড়ক, কঙ্কণ, জয়নন্দী, ধাম, তান্তী পা, লাড়ীডোম্বী। এদের মধ্যে লাড়ীডোম্বীর পদটি পাওয়া যায়নি। ২৪, ২৫ ও ৪৮ সংখ্যক পদগুলি হরপ্রসাদ শাস্ত্রী আবিষ্কৃত পুঁথিতে না থাকলেও ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী আবিষ্কৃত তিব্বতি অনুবাদে এগুলির রচয়িতার নাম উল্লিখিত হয়েছে যথাক্রমে কাহ্ন, তান্তী পা ও কুক্কুরী।[১২] এই নামগুলির অধিকাংশই তাদের ছদ্মনাম এবং ভনিতার শেষে তারা নামের সঙ্গে 'পা' (<পদ) শব্দটি সম্ভ্রমবাচক অর্থে ব্যবহার করতেন।
সাধারণভাবে লুইপাদকেই আদি সিদ্ধাচার্য মনে করা হয়। তাঞ্জর বর্ণনা অনুযায়ী তিনি ছিলেন বাঙালি। তিনি মগধের বাসিন্দা ছিলেন ও রাঢ় ও ময়ূরভঞ্জে আজও তার নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। চর্যার টীকায় তার অন্য নাম লূয়ীপাদ বা লূয়ীচরণ। ১ ও ২৯ সংখ্যক পদদুটি তার রচিত।[১৩]
চর্যার পুঁথিতে সর্বাধিক সংখ্যক পদের রচয়িতা কাহ্ন বা কাহ্নপাদ। তিনি কৃষ্ণাচার্য, কৃষ্ণপাদ ও কৃষ্ণবজ্র নামেও পরিচিত। তার রচিত পদের সংখ্যা ১৩টি। পুঁথিতে তাঁর মোট ১২টি পদ (পদ – ৭, ৯, ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৮, ১৯, ৩৬, ৪০, ৪২ ও ৪৫) পাওয়া যায়।[১৩] তার রচিত ২৪ নম্বর পদটি পাওয়া যায়নি। ইনি ওড়িশার এক ব্রাহ্মণ বংশে জন্মগ্রহণ করেন বলে জানা যায়। শৌরসেনী অপভ্রংশ ও মাগধী অপভ্রংশজাত বাংলায় তিনি পদ রচনা করতেন।[১৪]
ভুসুকুপাদ বাঙালি ছিলেন বলে অনেকের অনুমান। কেউ কেউ তাকে চর্যাগানের শান্তিপাদের সঙ্গে অভিন্ন মনে করেন।[১৫] চর্যার পুঁথিতে তাঁর আটটি পদ (পদ – ৬, ২১, ২৩, ২৭, ৩০, ৪১, ৪৩, ৪৯) আছে।[১৩]
এছাড়া সরহপাদ চারটি (পদ – ২২, ৩২, ৩৮, ৩৯), কুক্কুরীপাদ তিনটি (পদ – ২, ২০, ৪৮) এবং শান্তিপাদ (পদ – ১৫ ও ২৬) ও শবরপাদ দুইটি পদ (পদ – ২৮ ও ৫০) রচনা করেন। একটি করে পদ রচনা করেন বিরুআ (পদ ৩), গুণ্ডরী (পদ ৪), চাটিল (পদ ৫), কম্বলাম্বরপাদ (পদ ৮), ডোম্বীপাদ (পদ ১৪), মহিণ্ডা (পদ ১৬), বীণাপাদ (পদ ১৭), আজদেব (পদ ৩১), ঢেণ্ঢণ (পদ ৩৩), দারিক (পদ ৩৪), ভদ্রপাদ (পদ ৩৫), তাড়ক (পদ ৩৭), কঙ্কণ (পদ ৪৪), জয়নন্দী (পদ ৪৬), ধাম (পদ ৪৭) ও তান্তী পা (পদ ২৫, মূল বিলুপ্ত)। নাড়ীডোম্বীপাদের পদটি পাওয়া যায় না।[১৬]
চর্যাপদের ভাষা বরং প্রতীকী প্রকৃতির। তাই অনেক ক্ষেত্রে কোনো শব্দের আভিধানিক অর্থের কোনো মানে হয় না। ফলস্বরূপ, প্রতিটি কবিতার একটি বর্ণনামূলক বা বর্ণনামূলক পৃষ্ঠের অর্থ রয়েছে তবে তান্ত্রিক বৌদ্ধ শিক্ষাকেও সংকেতায়িত করে। কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে, এটি ছিল অপ্রশিক্ষিতদের কাছ থেকে পবিত্র জ্ঞান গোপন করার জন্য, অন্যরা মনে করে যে এটি ধর্মীয় নিপীড়ন এড়াতে করা হয়েছে। চর্যাপদের গোপন তান্ত্রিক অর্থের পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়েছে।[১৭][১৮]
চর্যাপদের ভাষা বাংলা কি-না সে বিষয়ে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল পরবর্তীকালে যার অবসান হয়েছে। এটি সৃজ্যমান বাংলা ভাষার একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। চর্যাপদের রচয়িতা বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যগণ সংস্কৃতে পারদর্শী হলেও তাঁরা তৎকালীন অপরিণত বাংলাতেই পদগুলি রচনা করেছিলেন। চর্যাপদের ভাষা বাংলা ভাষার অদ্যাবধি আবিষ্কৃত আদিতম রূপ। এই ভাষা সম্প্রদায় বিশেষের সাধন-সঙ্গীতের ভাষা বিধায় অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য; যদিও এতে উল্লিখিত ছন্দ ও রাগ-রাগিনী পরবর্তীকালের বাঙালি কবিদের পথনির্দেশিকারূপে কাজ করে। তবে প্রাচীন কবিদের মতে এটিতে সন্ধ্যা বা আলোআঁধারি ভাষা ব্যবহার করা হয় সেইসাথে গদ্য ছন্দ ব্যবহৃত করা হয় ।
চর্যা পদসংগ্রহ প্রকাশিত হবার পর চর্যার ভাষা নিয়ে যেমন প্রচুর গবেষণা হয়েছে, তেমনি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের বিদ্বজ্জনেরা এই ভাষার উপর নিজ নিজ মাতৃভাষার অধিকার দাবি করে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। চর্যার পদগুলো বিভিন্ন অঞ্চলের কবিদের দ্বারা লিখিত, এবং এটা স্বাভাবিক যে তাদের লেখায় তাদের নিজেদের অঞ্চলের ভাষারূপ বা উপভাষার প্রভাবই পাওয়া যাবে। বিভিন্ন পণ্ডিত চর্যাপদের ভাষার সাথে অসমীয়া, ওড়িয়া, বাংলা ও মৈথিলী ভাষার সাদৃশ্য লক্ষ্য করেছেন।[১৯] সমসাময়িক ঝাড়খণ্ডী ভাষা গবেষকগণ মনে করেন, চর্যাপদের নিকটতম ভাষা হলো কুুড়মালি ভাষা।[২০][২১]
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তার সম্পাদিত হাজার বছরের পুরাণ বাঙ্গালা বৌদ্ধ গান ও দোহা গ্রন্থের ভূমিকায় চর্যাচর্যবিনিশ্চয়, সরহপাদ ও কৃষ্ণাচার্যের দোহা এবং ডাকার্ণব-কে সম্পূর্ণ প্রাচীন বাংলার নিদর্শন বলে দাবি করেছেন। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্যের আবিষ্কর্তা ও সম্পাদক বসন্তরঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভও তার দাবিকে সমর্থন করেন। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে বিজয়চন্দ্র মজুমদার তাদের দাবি অস্বীকার করে চর্যা ও অন্যান্য কবিতাগুলির সঙ্গে বাংলা ভাষার সম্বন্ধের দাবি নস্যাৎ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তার The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে চর্যাগান ও দোহাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব, ব্যাকরণ ও ছন্দ বিশ্লেষণ করে শুধুমাত্র এইগুলিকেই প্রাচীন বাংলার নিদর্শন হিসাবে গ্রহণ করেন। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্যারিস থেকে প্রকাশিত Les Chants Mystique de Saraha et de Kanha গ্রন্থে সুনীতিকুমারের মত গ্রহণ করেন।[২২] জয়দেবের গীতগোবিন্দের কিছু লেখায় "অর্ধ-মাগধী পদাশ্রিত গীতি" রয়েছে যেগুলো চর্যাগীতি দ্বারা প্রভাবিত।[২৩] কবি জয়দেবের জন্ম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বীরভূমের কেন্দুবিল্ব বা কেঁদুলি গ্রামে। তার নামে সেখানে প্রতি বছর মেলা অনুষ্ঠিত হয়।
সিদ্ধাচার্যদের অনেকেই ছিলেন বাংলার অধিবাসী। শবরপা, কুক্কুরিপা ও ভুসুকুপা বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। যে সকল ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য চর্যার সঙ্গে বাংলার সম্পর্ককে প্রমাণ করে সেগুলি হল:[২৪]
রাহুল সাংকৃত্যায়ন বা অন্যান্য ভাষার বিদ্বজ্জনেরা যাঁরা চর্যাকে নিজ নিজ ভাষার প্রাচীন নিদর্শন বলে দাবি করেছিলেন, তাঁরা এই রকম সুস্পষ্ট ও সুসংহত বৈজ্ঞানিক প্রমাণের দ্বারা নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন নি।
লুইপা কামরূপের বাসিন্দা ছিলেন এবং তিনি দুটি চর্যা রচনা করেছিলেন। আরেকজন কবি সরহপা বর্তমান গুয়াহাটির কাছাকাছি রাণী নামে একটি জায়গার অধিবাসী ছিলেন বলে শোনা যায়। অসমীয়াদের সাথে কিছু ঘনিষ্ঠতা হল[২৬]:
না বোধক শব্দ - অসমীয়াতে না বোধক শব্দ ক্রিয়াপদের আগে চলে আসে: না যাই (২, ৫, ২০, ২৯ নং); না জীবামী (৪ নং); না ছদা, না জানি, না ডিসা (৬ নং)। ১৫ নং চর্যায় এরকম ৯টি রূপ রয়েছে।
বর্তমান কৃদন্ত (প্রেসেন্ট পারটিসিপল) - বৈষ্ণব যুগে অসমীয় ভাষায় -ante প্রত্যয় ব্যবহৃত হত যেমন - jvante (বেঁচে থাকার সময়, ২২ নং); sunante (শোনার সময়, ৩০ নং) ইত্যাদি।
অসমাপিকা ক্রিয়া – -i এবং -iya প্রত্যয় যথাক্রমে আধুনিক ও পুরাতন অসমীয়াতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়, চর্যাপদেও তা লক্ষ্য করা যায়: kari (৩, ৩৮ নং); cumbi (৪ নং); maria (১১ নং); laia (২৮ নং) ইত্যাদি।
সাধারণ বর্তমান ক্রিয়া রূপ - অসমীয়া ভাষায় প্রত্যয় -ai দেখা যায়, তা চর্যাপদেও পাওয়া যায় - bhanai (১); tarai (৫); pivai (৬)।
ভবিষ্যত - প্রত্যয় -iva অসমীয় ভাষার মত চর্যাপদেও দেখা যায়: haiba (৫); kariba (৭)।
নাম বিভক্তি - অসমীয়া ভাষার নাম বিভক্তি -e (এ) কেস শেষ হবে ই : কুম্ভিরে খা, কোর নীলা (২)।
তৃতীয়া বিভক্তি - অসমীয় ভাষার বিভক্তি -e এবং -era চর্যাপদেও দেখা যায়: uju bate gela (১৫); kuthare chijaa (৪৫)।
চর্যাপদগুলির শব্দভাণ্ডারে কিছু অ-তৎসম শব্দ পাওয়া যায় যেগুলো এখন অসমীয় শব্দভাণ্ডারের অন্তর্গত, যেমন dala (১), thira kari (৩, ৩৮), tai (৪), uju (১৫), caka (১৪) ইত্যাদি।
ওড়িয়া কবিতার শুরু চর্যা সাহিত্যের বিকাশের সাথে মিলে যায়, এই সাহিত্যচর্চার শুরু হয় মহাযান বৌদ্ধ কবিদের দ্বারা।[২৭] এই সাহিত্য "সন্ধ্যা ভাষা" নামে একটি নির্দিষ্ট আকারে লেখা হয় এবং কাহ্নপার মত কবিরা উড়িষ্যা অঞ্চলের বাসিন্দা। চর্যার ভাষাকে প্রাকৃত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। করুণাকর কর তাঁর গ্রন্থে (Ascharya Charyachaya) উল্লেখ করেছেন যে, উড়িষ্যাই চর্যাপদের উৎপত্তিস্থল কারণ বৌদ্ধধর্মের বজ্রযান সম্প্রদায় সেখানে বিকশিত হয় এবং সেখানেই বৌদ্ধধর্মে নারী পূজা শুরু হয়। মাতৃ ডাকিনির পূজা এবং "কায়া সাধনা" চর্চা এই ধরনের নতুন সংস্কৃতির ফলাফল। একটি তত্ত্ব অনুসারে লক্ষ্মীঙ্করা ও পদ্মসম্ভবের মত বৌদ্ধ পণ্ডিতগণ উড়িষ্যায় জন্মগ্রহণ করেন (এই তত্ত্ব অনুসারে এদের জন্মস্থান ওড্ডিয়ান হল আসলে উড়িষ্যা)।[২৮] চর্যাপদে আদি সিদ্ধদের তৈরি কায়া সাধনা এবং শাকি উপাসনার (নারী নীতির উপাসনা) ধারণা ও অভিজ্ঞতার কাব্যিক অভিব্যক্তি পাওয়া যায়। এগুলো হচ্ছে পূর্ব ভারতীয় বংশোদ্ভূত ভাষার আদিম রূপ প্রাকৃত ও অপভ্রংশ ভাষায় রচিত প্রথম সাহিত্যিক দলিল। অনেকে দাবী করে যে, চর্যাপদের কবিরা প্রধাণত এই অঞ্চলের এবং তাদের চিন্তা ও লেখার শৈলী প্রাচীন ওড়িয়া সাহিত্যের কবিতাকে প্রভাবিত করেছে যা প্রধানত পঞ্চশাখা যুগে রচিত ষোড়শ শতাব্দীর ওড়িয়া কবিতায় উল্লেখযোগ্য।[২৯] চর্যাপদে ব্যবহৃত রাগ, বিশেষ করে মহাসিদ্ধদের লেখা গানের রাগগুলোর উৎপত্তিও উড়িষ্যার বলে বর্ণনা করা হয় (ঐতিহ্যবাহী জীবনীগুলো অনুসারে), এদের সাথে ওডিসি সঙ্গীতের (উড়িষ্যার সংগীত) ঐতিহ্যবাহী ব্যবহৃত রাগের সঙ্গে অনেক মিল রয়েছে, যা দ্বাদশ শতকের গীত গোবিন্দ থেকে ১৪শ থেকে ১৯শ শতকের ধ্রুপদী ওড়িয়া সাহিত্য পর্যন্ত বিস্তৃত।
কাহ্নপার কবিতার ভাষার সাথে ওড়িয়ার ভাষার খুব ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্য রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ,
Ekasa paduma chowshathi pakhudi Tahin chadhi nachaa dombi bapudi
Paduma (পদ্ম), Chausathi (চৌষট্টি), Pakhudi (পাপড়ি) Tahin (সেখানে), Chadhi (চড়ে), nachaa (নাচা), Dombi (তফসিলি সম্প্রদায়ের নারী, বাংলা ও উড়িষ্যা উভয় অঞ্চলেই এই শব্দটির ব্যবহার আছে), Bapudi (কথ্য ওড়িয়া ভাষায় "দরিদ্র ব্যক্তি" অর্থে ব্যবহৃত হয়)।
এছাড়া একটি মত অনুসারে জয়দেব ভারতের উড়িষ্যা প্রদেশের পুরীর নিকটবর্তী কেন্দ্রবিল্ব শাসনের ব্রাহ্মণ পরিবারের মানুষ ছিলেন। স্বয়ং জয়দেব লিখেছিলেন "কেন্দবিল্ব সমুদ্র সম্ভব"৷ উড়িষ্যা ও দাক্ষিণাত্যর সংস্কৃৃতিতে জয়দেবের প্রভাব অনস্বীকার্য। জয়দেবের গীতগোবিন্দের কিছু লেখায় "অর্ধ-মাগধী পদাশ্রিত গীতি" রয়েছে যেগুলো চর্যাগীতি দ্বারা প্রভাবিত। যদি তাই হয় তাহলে জয়দেবের গীতগোবিন্দের কিছু লেখায় "অর্ধ-মাগধী পদাশ্রিত গীতিতে" চর্যাগীতির প্রভাব চর্যাভাষার সাথে ওড়িয়া সম্পর্ককেই নির্দেশ করবে।
হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাচার্য-বিনিশ্চয় গ্রন্থের ভূমিকায় মুনিদত্তের সংস্কৃত ধারাভাষ্যের উপর ভিত্তি করে চর্যাপদের শ্লোকের রহস্যময় ভাষাকে সান্ধ্যভাষা বা আলো-আঁধারি ভাষা (অর্ধ-প্রকাশিত এবং অর্ধ-লুকানো) হিসেবে উল্লেখ করেন। বিধুশেখর শাস্ত্রী বেশ কিছু বৌদ্ধ গ্রন্থ থেকে প্রমাণের ভিত্তিতে পরে এই ভাষাকে 'ইচ্ছাকৃত ভাষা' (সংস্কৃত: সন্ধ্যা-ভাষা) হিসেবে উল্লেখ করেন।[৩০] চর্যাপদের ভাষা অস্পষ্ট ও দুর্বোধ্য। সেই কারণে চর্যায় ব্যবহৃত ভাষাকে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন সন্ধ্যাভাষা। তাঁর মতে,
“ | সহজিয়া ধর্মের সকল বই-ই সন্ধ্যা ভাষায় লেখা। সন্ধ্যা ভাষার মানে আলো-আঁধারি ভাষা, কতক আলো, কতক অন্ধকার, খানিক বুঝা যায়, খানিকটা বুঝা যায় না। অর্থাৎ, এই সকল উঁচু অঙ্গের ধর্মকথার ভিতরে একটা অন্য ভাবের কথাও আছে। সেটা খুলিয়া ব্যাখ্যা করিবার নয়। যাঁহারা সাধনভজন করেন তাঁহারাই সে কথা বুঝিবেন, আমাদের বুঝিয়া কাজ নাই। | ” |
বজ্রযানী ও সহজযানী গ্রন্থকারগণ প্রায়শ ‘সন্ধ্যাভাষয়া বোদ্ধব্যম্’ বলে এক রহস্যের ইঙ্গিত দিতেন। বজ্রযানী গ্রন্থগুলিতে ‘সন্ধ্যাভাষা’ শব্দটি বহুল-ব্যবহৃত। তিব্বতি ভাষায় ‘সন্ধ্যাভাষা’র অর্থ ‘প্রহেলিকাচ্ছলে উক্ত দুরুহ তত্ত্বের ব্যাখ্যা’। যদিও মহামহোপাধ্যায় বিধুশেখর শাস্ত্রী ও ডক্টর প্রবোধচন্দ্র বাগচী ‘সন্ধ্যা’র বদলে সন্-ধা ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ‘সন্ধা’ শব্দটি ব্যবহারের পক্ষপাতী। তাঁদের মতে, ‘সন্ধ্যা’ লিপিকরদের প্রমাদ। "সন্ধা" শব্দের অর্থ ‘অভিপ্রেত, উদ্দিষ্ট, আভিপ্রায়িক বচন’। ম্যাক্সমুলার ‘সন্ধা’র অর্থ করেছেন "প্রচ্ছন্ন উক্তি" ("hidden saying")। চর্যার ধর্মীয় প্রসঙ্গের সঙ্গে ‘সন্ধা’ এ-দিক দিয়ে যুক্তিগ্রাহ্য হলেও, যেহেতু অধিকাংশ পুঁথিতেই ‘সন্ধ্যা’ শব্দটি রয়েছে সেই কারণে হরপ্রসাদের অর্থেই আধুনিক গবেষকগণ এই শব্দটি গ্রহণ করেছেন।[৩২]
চর্যাপদের গুপ্ত ভাষার বৌদ্ধ – তান্ত্রিক ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়েছে।[৩৩]
প্রাচীন বাংলার ভাষাতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলির সন্ধানে প্রাকৃত বাংলায় রচিত চর্যাপদ একটি মূল্যবান উপাদান। ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় প্রথম এই বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা করেন তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language গ্রন্থে। এরপর ডক্টর সুকুমার সেন, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, তারাপদ মুখোপাধ্যায়, পরেশচন্দ্র মজুমদার ও ডক্টর রামেশ্বর শ' চর্যার ভাষাতত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করেন। ফলে আজ চর্যার ভাষার স্বরূপটি অনেক বেশি সুস্পষ্ট হয়ে গেছে।[৩৪]
চর্যার পদগুলি প্রধানত পয়ার ও ত্রিপদী পদে রচিত। এতে মাত্রাছন্দের প্রভাবও দেখা যায়। ১৬ মাত্রার পাদাকুলক ছন্দের ব্যবহারই এখানে বেশি। তবে সর্বত্র নির্দিষ্ট মাত্রারীতি দেখা যায়নি। ছন্দপংক্তির পর্বসংখ্যাগত বৈচিত্র্যও এই পদগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ডক্টর অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন, “তত্ত্বকথার ব্যাখ্যা এবং তাকে ব্রাহ্মণ সমাজের শ্যেনদৃষ্টি থেকে গোপন করা – এই দিকে পদকর্তারা এবং সিদ্ধাচার্যরা অত্যন্ত সচেতন ছিলেন বলে কবিতার আঙ্গিকের দিকে দৃষ্টি দেবার অবকাশ পাননি। তবে একটা কথা সত্য, চর্যাগানেই সর্বপ্রথম পয়ার-ত্রিপদীর আদিসুর ধ্বনিত হয়েছে। সংস্কৃতে রচিত গীতগোবিন্দও এর প্রভাব অস্বীকার করতে পারেনি।”[৩৫]
চর্যায় অনুপ্রাসের প্রয়োগ ব্যাপক। প্রায় প্রতিটি পদই অন্ত্যমিলযুক্ত। অন্তানুপ্রাসও প্রচুর। যেমন: “বাহ তু ডোম্বী বাহ লো ডোম্বী বাটত ভইলা উদারা”। চর্যায় উল্লিখিত ছন্দ ও অলংকারগুলি পরবর্তীকালের কবিদের পথপ্রদর্শকস্বরূপ হয়েছিল।[৩৫]
চর্যাপদ একাধিক চরণবিশিষ্ট, অন্ত্যমিলযুক্ত ও গীতিধর্মী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সংস্কৃত সাহিত্যের চিত্রধর্মী শ্লোক বাংলা সাহিত্যের উপর কোনও স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বরং চর্যার গীতিকবিতাগুলিই পরবর্তী বাংলা কাব্যসঙ্গীতের আঙ্গিকের ক্ষেত্রে আদর্শ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে চর্যার কবিরা যে তাঁদের ধর্মদর্শন ও সাধনপদ্ধতি রূপকের আড়ালে ব্যক্ত করে গান বেঁধেছিলেন, পরবর্তীকালের হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের সাধককবিরা সেই আদর্শেই তাঁদের স্ব স্ব ধর্মীয় সাধনসঙ্গীত রচনায় প্রবৃত্ত হন। বৈষ্ণব পদাবলি, বাউল গান, সুফি মুর্শিদি গান, নাথপন্থী দেহযোগী গান বা শাক্তপদাবলি– সবই চর্যাসংগীতের উত্তরসূরী।[৩৬]
চর্যার পদগুলিতে পদকর্তাদের নামের সঙ্গে বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর নামও পাওয়া যায়। এথেকে সহজেই অনুমিত হয় যে, এই পদগুলি সুরসহযোগে গাওয়া হতো। পটমঞ্জরী রাগে চর্যার ১১টি পদ (পদ –১, ৬, ৭, ৯, ১১, ১৭, ২০, ২৯, ৩১, ৩৩ ও ৩৬) নিবদ্ধ। এই রাগে গাওয়া পদের সংখ্যাই সর্বাধিক। এরপরেই মল্লারী রাগে ৫টি পদ (পদ – ৩০, ৩৫, ৪৪, ৪৫ ও ৪৯) নিবদ্ধ রয়েছে। ৪টি করে পদ ভৈরবী (পদ-১২, ১৬, ১৯ ও ৩৮), কামোদ (পদ – ১৩, ২৭, ৩৭ ও ৪২), বরাড়ী (চর্যায় অপর নাম বলাড্ডি, পদ- ২১, ২৩, ২৮ ও ৩৪) এবং গুঞ্জরী (চর্যায় অপর নাম গুঁজরী বা কহূ গুংজরী, পদ – ৫, ২২, ৪১ ও ৪৭) রাগে নিবদ্ধ। গৌড় (চর্যায় নাম গবড়া বা গউড়া, পদ – ২, ৩, ১৮) রাগে ৩টি পদ নিবদ্ধ। দেশাখ (চর্যায় অপর নাম দ্বেশাখ, পদ – ১০ ও ৩২), রামকেলি (চর্যায় অপর নাম রামক্রী, পদ – ১৫ ও ৫০), আশাবরী (চর্যায় অপর নাম শিবরী বা শবরী, পদ – ২৬ ও ৪৬) ও মালসী (চর্যায় অপর নাম মালসী গবুড়া, পদ- ৩৯ ও ৪০) রাগে ২টি করে এবং অরু (পদ ৪), দেবগিরি (চর্যায় অপর নাম দেবক্রী, পদ ৮), ধানশী (চর্যায় অপর নাম ধনসী,পদ ১৪) ও বঙ্গাল (পদ ৩৩) রাগে একটি করে পদ নিবদ্ধ। ২৫তম পদটি খণ্ডিত ও এর রাগনির্দেশ জানা যায় না।[৩৭]
চর্যাগীতিতে প্রতি পদের প্রত্যেক দুই লাইনের শেষে ধ্রু এই শব্দটি পাওয়া যায়, যা ধুঁয়া বা ধ্রুবপদের সংকেত বলে ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় মনে করেছেন। চর্যাপদের সংস্কৃত টীকাতে ধ্রুবপদেন দৃঢ়ীকুর্বন, ধ্রুবপদেন চতুর্থানন্দমুদ্দীপয়ন্নাহ ইত্যাদি ব্যাখ্যা থেকে এই প্রমাণ পাওয়া যায়। তিব্বতীতে এই পদকে ধু পদ বলা হয়েছে। প্রত্যেক পদ গাইবার পর শ্রোতাকে আকৃষ্ট করার জন্য বারবার ধ্রুবপদ গাইবার রীতি ছিল।[৩৮]
বাংলা ভাষা ও সঙ্গীতের প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদ। ১৯০৭ সালে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপালের রাজগ্রন্থাগার থেকে এর পুথি আবিষ্কার করেন। আবিষ্কৃত পুথিটির নাম চর্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়। এটি মূলত প্রাপ্ত ৪৭টি গানের সংকলন। খ্রিস্টীয় নবম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে গানগুলি রচিত।[৩৯]
বর্তমান কালের বাংলা গানের স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারী ও আভোগ এই চার কলির পরিবর্তে সেকালে ছিল উদ্গ্রাহ, মেলাপক, ধ্রুব ও আভোগ। এগুলিকে বলা হতো ধাতু। এই চারটি ধাতুর মধ্যে উদ্গ্রাহ ও ধ্রুব সব গানেই থাকত, অন্য দুটি বাধ্যতামূলক ছিল না। তাই একটি ধাতু বর্জিত হলে সেই গানকে বলা হতো ত্রিধাতুক, আর দুটি বর্জিত হলে দ্বিধাতুক। সাধারণভাবে সঙ্গীতকে তখন প্রবন্ধগীত বলা হতো। মেলাপকবর্জিত বলে চর্যাগুলি ত্রিধাতুক প্রবন্ধগীত।[৩৯]
চার্যার কবিরা ছিলেন বৌদ্ধ, তবে চার্যায়- ১) প্রথম, দ্বিতীয় ও ষষ্ঠ পদে আমরা বেদ ব্রাহ্মণ ও আর্য যোগীদের পরিচয় পাই। ২) পঞ্চম পদে বৌদ্ধদের কথার উল্লেখ পাই। ৩) তৃতীয় ও চতুর্থ পদে রয়েছে জৈন সাধুরা।
সিদ্ধাচার্যগণ অসামান্য কবিত্বশক্তির অধিকারী হলেও তারা মূলত ছিলেন সাধক। বৌদ্ধ সহজযানী চিন্তা, দর্শন ও সাধনপদ্ধতিই তাই চর্যাপদের উপজীব্য হয়ে ওঠে। এই সহজযানী দর্শন একান্তই ভাববাদী। সিদ্ধাচার্যগণ সহজমার্গের পথিক ছিলেন। শুষ্ক তত্ত্বকথা নিয়ে তারা সন্তুষ্ট থাকতেন না। সেজন্য প্রথাগত সংস্কারের ধারও তারা ধরতেন না।
মায়াপ্রপঞ্চ ও দ্বৈতবোধের ঊর্ধ্বে স্থিত যে ‘বোধিচিত্ত’, সকল প্রকার দ্বৈতবোধ পরিহার করে সাধনযোগে অবধূতিকামার্গের পথে সেই ‘বোধিচিত্ত’কে ‘মহাসুখকমল’-এ স্থিত করাই সিদ্ধাচার্যদের সাধনার লক্ষ্য ছিল।[৪০] এই ‘মহাসুখ’ সহজযান মতে একটি বিশেষ তত্ত্ব। সাধক ‘মহাসুখ’ লাভ করলে মায়াময় পৃথিবী সম্পর্কে জ্ঞানরহিত হন। এখানে হিন্দুদর্শনের সমাধিতত্ত্বের সঙ্গে ‘মহাসুখ’ দর্শনের সাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। চর্যাকারগণ গুরুবাদকে স্বীকার করেছেন। কুক্কুরীপাদের মতে, এক কোটি লোকের মধ্যে একজন চর্যার গূহ্যার্থ অনুধাবনে সক্ষম। সেক্ষেত্রে গুরুভিন্ন গতি নেই।[৪১] বাস্তবিকই চর্যার কথা লৌকিক অর্থের বদলে সংকেতে আবৃত হওয়ায় তা সর্বসাধারণের বুদ্ধিতে ঠিক ধরে না। এই দ্বৈতার্থের কয়েকটি নিদর্শন হলো: নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস অর্থে 'চন্দ্র', চিত্ত অর্থে 'হরিণ', জ্ঞানমুদ্রা অর্থে 'হরিণী', মহাসুখকায় অর্থে 'নৌকা', শবরী অর্থে 'দেবী নৈরাত্মা' ইত্যাদি।[৪২]
• ভূমিকা: সাহিত্য- কাব্যকলা কালোত্তীর্ণ হলেও তা সমকালীন সমাজ ও জীবনের প্রতিচ্ছবি। সেই দৃষ্টিতে চর্যাপদ বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম ঐতিহাসিক নিদর্শন।পাল ও সেন রাজাদের দীর্ঘ দুশো বছরের রাজনৈতিক উত্থান পতনের অস্থিরতায় বাংলার সমাজজীবনে যে ভাঙা-গড়া চলতে থাকে, চর্যাপদে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
• ধর্ম সমন্বয়: চর্যাযুগের বাংলাদেশে বিভিন্ন আদর্শের সমন্বয়ের আত্মব্যাপ্তি এবং আত্ম স্বাতন্ত্র রক্ষার প্রবল সচেতনা যুগপৎ প্রচলিত ছিল। ফলে চর্যার ধর্মমতের মধ্যে হিন্দু ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক দেহবাদের ধারা অনেকটা পরিমাণে প্রবেশ করেছিল।ডক্টর নীহাররঞ্জন রায়ের মতে এই মিলন পাল পর্বের শেষের দিকে আরম্ভ হয়েছিল। বৌদ্ধ সাধনার সঙ্গে বাংলার এই তান্ত্রিক সহজ সাধনার যোগবন্ধন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা।
• বাঙালির স্বাতন্ত্রপ্রিয়তা: ভিন্ন ধর্মের সাধন পদ্ধতির সমন্বয় ঘটলেও উন্নাসিকতাগর্বী আর্য ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি স্বাতন্ত্রপ্রিয় বাংলায় সাদর অভ্যর্থনা লাভ করেনি। চর্যাপদে সিদ্ধাচার্যগণ আচার-আচরণ সর্বস্ব বেদ-ধর্মের দুর্বলতার প্রতি কটাক্ষ করে বলেছেন-
"জাহের বান চিহ্ণ রূপ ণ জানী
সো কইসে আগম বে এ বখানী"।
কিন্তু বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনা খুব সহজেই স্বাতন্ত্র প্রিয় বাঙালির হৃদয় জয় করেছিল।
• যুগ সীমানার পরিবর্তন: চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ার পূর্বে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম যুগ সীমানা ছিল মনসামঙ্গল। কিন্তু চর্যাপদ আবিষ্কৃত হওয়ায় তা প্রায় আড়াইশো বছর অতীতে সম্প্রসারিত হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।
• পূর্ববঙ্গের বৌদ্ধধর্ম: তৎকালীন বঙ্গালদেশ বা পূর্ববঙ্গে ও বৌদ্ধ ধর্ম প্রচার লাভ করেছিল- এ ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষ্য বহন করে - "আদি ভুসুক বঙ্গালি ভইলী" পদটি।
• অস্পৃশ্যতা ও বর্ণভেদ: তখনকার উচ্চ- নীচ, স্পৃশ্য, অস্পৃশ্য, ভেদাভেদ বিদীর্ণ সমাজের কলঙ্কিত মুখচ্ছবি প্রকাশিত হয়েছে চর্চার কোনো কোনো পদে। অস্পৃশ্য বলে একঘরে করে রাখার প্রথাও প্রচলিত ছিল-
"টালতো ঘর মোর নাহি পড়বেষী"- পদটিতে তার প্রমাণ মেলে।
• তৎকালীন জীবনচিত্র: সমকালীন জীবনচিত্র ও ইতিহাসের একটি অংশ। চর্যাপদে সমকালীন জীবনচিত্রের স্পষ্ট পরিচয় সুমুদ্রিত। নদীমাতৃক বাংলার খেয়া ও সাঁকো পারাপারের দৃশ্য, নৌকার বিভিন্ন অংশের বর্ণনা, সাধারণ মানুষের আমোদ-প্রমোদ,পোশাক-পরিচ্ছদ, নৃত্যগীত নাটকাভিনয়, অভাব-অনটন এমনকি শুঁড়িখানার মদ্যপানের চিত্র ও অংকিত হয়েছে। এ সকল খণ্ড ক্ষুদ্র চিত্রের সমন্বয়ে তৎকালীন যুগ, সমাজ ও মানব জীবনের আলোকচিত্র আমাদের সামনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
• উপসংহার: চর্যার সাধনতত্ত্ব ও নির্বাণ লাভের উপায়গুলির রুপক চিত্রের মধ্যে ইতিহাসের উপকরণের ছড়াছড়ি। চর্যাপদ যদিও বৌদ্ধ সাধন সঙ্গীত তা সত্বেও তা সমকালীন ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।
• ভূমিকা: "প্রতীক রূপকের সাহায্যে চিত্র সৃষ্টি, আখ্যানের ইঙ্গিত, মানব চরিত্রের মধ্যে সুখ-দুঃখের বিরহ মিলনের দৈনন্দিন জীবন চিত্র চর্যার দর্শন ও তত্ত্বের নিষ্প্রাণতাকে কাব্যরসের স্পর্শে সজীব করিয়াছে"- অ .কু. ব
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ ইতিহাসকার ডঃ অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় এর এই মন্তব্যকে পাথেয় করে চর্যাপদের সাহিত্যমূল্য বিচারে অগ্রসর হওয়া যাক। আমরা জানি যে, চর্যাপদ বৌদ্ধ সহজিয়া সাধন সংগীত। ধর্মাচরণের গুহ্য সংকেত, নির্বাণতত্ত্ব ও দর্শনই চর্যার আলোচ্য বিষয় হলেও উক্ত বিষয়কে প্রকাশ করতে গিয়ে চর্যার সিদ্ধাচার্য কবিরা যে রূপক, প্রতীক ও চিত্রকল্পের ব্যবহার করেছেন তা তৎকালীন সমাজ, প্রকৃতি ও জীবনের রসসিক্ত খন্ডচিত্র- যা চর্যাপদকে সাহিত্যগুণ সমৃদ্ধ করে তুলেছে।
• প্রকৃতি বর্ণনা: চর্যাপদের পদগুলির মধ্যে গভীর গূঢ় অর্থ থাকলেও তার বাইরের সাধারণ অর্থে বহুপদে শ্যাম-তন্বী বঙ্গ প্রকৃতির নির্মল চিত্র ফুটে উঠেছে। তার নমুনা চর্যার ২৮ সংখ্যক পদটিতে মেলে-
"উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী
মোরঙ্গ পীচ্ছ পরহিন সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী"
পদটিতে শবরী বালিকার প্রেক্ষাপটে চারপাশের আকাশ-বাতাস, পাহাড়-পর্বত, শ্যামল বৃক্ষশোভা, বর্ণময় ফুল এমনকি সোনালী রোদের প্রতিফলন যেন পাহাড়ি বন্য প্রকৃতির অসাধারণ চিত্ররূপ- যা আধুনিক সাহিত্যের প্রকৃতি বর্ণনার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।
• রূপক, প্রতীক চিত্রকল্প: রূপক,প্রতীক ,চিত্রকল্প ব্যবহারেও চর্যাপদ সাহিত্য গুণান্বিত হয়ে উঠেছে।
"টালত ঘর মোর নাহি পড়বেষী" অথবা "আপনা মাংসে হরিণা বৈরী"- প্রভৃতি পদের পংক্তিতে পংক্তিতে রূপক, প্রতীক ও চিত্রকল্পের প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
• আখ্যানধর্মীতা: আখ্যানধর্মীতা চর্যাপদের সার্থক সাহিত্য হয়ে ওঠার আরেকটি কারণ। চর্যার কোনো কোনো পদে আখ্যান বা কাহিনির সন্ধান মেলে। ৫০ সংখ্যক পদে চাঁচের বেড়া দেওয়া ঘরে শবর বালিকার জীবনচিত্র কাহিনীর মতো উপস্থাপিত হয়েছে।
• বাস্তব জীবনচিত্র: "যথার্থ সাহিত্য জীবন সম্ভব"। চর্যার ১৯ সংখ্যক-
"কাহ্ণ ডোম্বী বিবাহে চলিআ" পদে বিবাহ এবং মর্তমানবের দেহাসক্ত প্রেমের চিত্র, "টালত ঘর মোর" পদে দরিদ্র মানবের বাস্তব চিত্র অংকিত হয়েছে। যে বাস্তব জীবনচিত্র বা বাস্তবতা আধুনিক সাহিত্যের প্রধান লক্ষণ, চর্যাপদে ও সেই মর্মগ্রাহী বাস্তব জীবনচিত্রের অভাব নেই।
• অলংকার: চর্যার কবিরা কথার সজ্জায়, আলংকারিক উজ্জ্বলতায় চর্যাপদ গুলিকে কবিতারস সমৃদ্ধ করে তুলেছিল। অনুপ্রাস, শ্লেষ, সমাসোক্তি প্রভৃতি অলংকারের সার্থক প্রয়োগ ঘটেছে চর্যাপদে।
• ছন্দ: শুধু অলংকারের কারুকার্যে নয়, ছান্দসিক সাবলীলতায় ও চর্যাপদ গুলি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। মাত্রা সমতার কিছু অসংগতি থাকলেও পয়ার, ত্রিপদী ছন্দের ব্যবহার চর্যাপদ গুলির নির্মিতিকে আরও সমৃদ্ধ করেছে।
• উপসংহার: উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করে বলা যায় যে বৌদ্ধ সাধন সংগীত হলেও চর্যাপদ আদর্শ সাহিত্য হয়ে উঠেছে। চর্যার ভাব ও রূপ সাহিত্য গুণের দিক থেকে উৎকৃষ্ট ছিল বলেই পরবর্তী সাহিত্যে তাঁর স্পষ্ট প্রভাব পড়েছিল। ডক্টর ভূদেব চৌধুরী যথার্থই মন্তব্য করেছেন- "অষ্টাদশ শতকের শাক্ত সঙ্গীত ও শ্যামাগীতি যে কারণে এবং যে অর্থে উৎকৃষ্ট গীতি সাহিত্য, সেই কারণে এবং সেই অর্থেই চর্চাপদাবলী ও সার্থক সাহিত্যসৃষ্ট"।
• ভূমিকা: সাহিত্য সমাজের দর্পণ। অ্যারিস্টটলের ভাষায়-"Art is imitation of life". কবিরা যেহেতু কোন সমাজেরই মানুষ তাই তাঁদের রচনায় কখনো সচেতনভাবে, কখনো বা তাদের অজান্তেই সমকালীন সমাজের সত্য ছবি ফুটে ওঠে। চর্যার সিদ্ধাচার্য কবিরা সহজিয়া সাধন পদ্ধতি ও ধর্মীয় তত্ত্ব কথাকে প্রকাশ করতে গিয়ে তৎকালীন সমাজ ও লৌকিক জীবনের নানা চিত্রের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। ফলে তাঁদের অজান্তেই চর্যাপদগুলিতে তৎকালীন পরিবেশ, প্রকৃতি ও সমাজের জীবন্ত খণ্ডচিত্র ফুটে উঠেছে।
• ভূপ্রকৃতি ও যোগাযোগ: "নৌবাহী নৌকা টান অ গুণে"- সরহপাদের এই পদটি সহ বিভিন্ন পদে তৎকালীন নদীমাতৃক বাংলার ভূ প্রকৃতি, জলপথে যাতায়াত বা যোগাযোগ ব্যবস্থার চিত্র ফুটে উঠেছে।
• সম্প্রদায় ও জীবিকা: এছাড়া চর্যার বিভিন্ন পদে তৎকালীন সমাজের অন্তজশ্রেণীর মাঝিমাল্লা, তাঁতি, শবর, মাহুত, শুঁড়ি,কাপালিক, নট প্রভৃতি সম্প্রদায় এবং নৌকা বাওয়া, দুগ্ধ দোহন,চাঙারি বোনা, পশু শিকার, তাঁতবোনা প্রভৃতি জীবিকার পরিচয় পাওয়া যায়।
• দারিদ্র লাঞ্ছিত জীবন চিত্র: "হাঁড়িত ভাত নাহি নিতি আবেশী "-পদটিতে তখনকার শ্রমজীবী নিম্ন শ্রেণীর মানুষের দারিদ্র্য লাঞ্ছিত জীবনের বাস্তবচিত্র উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
• দস্যু ভয়: সেই সমাজের অবস্থা ছিল অরাজক। চোর-ডাকাত, জলদস্যুর ভয় ছিল। তারও প্রমাণ চর্যাপদে দুষ্প্রাপ্য নয়।যেমন- "কানেট চৌরে নিল" অথবা "সোনা রূঅ মোর কিম্পি ণ থাকিউ"
• বিচারব্যবস্থা: তবে সমাজে যেমন চোর ডাকাত দস্যুর উৎপাত ছিল, তেমনি বিচার ব্যবস্থার অস্তিত্বের ও প্রমাণ মেলে। চোর ধরার জন্য "দুষাধী" অর্থাৎ দারোগা এবং শাস্তির জন্য "উআরি" অর্থাৎ থানার ব্যবস্থার কথা ও চর্যাপদ থেকে জানা যায়।
• খাদ্য: সেই সমাজে মানুষ ভাত, মাছ, হরিণের মাংস, দুধ, ফলমূল ইত্যাদি খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত। এছাড়া একশ্রেণীর মানুষের মাদকাসক্তি ও নেশাগ্রস্ত ব্যক্তির উন্মত্ত আচরণের ও স্পষ্ট ছবি চর্যাপদে মুদ্রিত আছে।
• সামাজিক ও ধর্মীয় উৎসব: চর্যার পদগুলিকে তৎকালীন ধর্মীয় ও সামাজিক নানা আচার-বিচার, উৎসব-অনুষ্ঠান,ক্রিয়াকর্মের ও পরিচয় পাওয়া যায়। "ডোম্বী বিবাহিআ অহারিউ জাম"- পদটিতে ধুমধাম করে বিবাহ অনুষ্ঠানের বর্ণনা পাওয়া যায়। উৎসব অনুষ্ঠানে ডমরু, মাদল, বাঁশী, বীণা প্রভৃতি বাদ্য বাজনা ও নৃত্যগীতের আয়োজন ও থাকতো। "নাচন্তী গাইল বাজন্তী দেবী" পঙ্কতিটি তারই সাক্ষ্যবাহী।
• যৌতুক প্রথা: বিবাহ উৎসবে যৌতুক প্রথা ও প্রচলিত ছিল। "জাউতুকে কি অ আনতু ধাম" - পঙ্কতি বিবাহে যৌতুক দেওয়া রীতির পরিচয় পাওয়া যায়।
• গৃহস্থ সংসার: শশুর, শাশুড়ি, ননদ পরিবৃত গৃহস্থবধূর সংসার, আঁতুরঘর,হাঁড়ি ঘড়া প্রভৃতি নিত্যব্যবহার্য বাসনপত্র, টাঙ্গি-কুঠার প্রভৃতি হাতিয়ারের ব্যবহার- এককথায় চর্যাপদে গৃহস্থ সংসারের স্পষ্ট ছবি বর্তমান।
• বর্ণভেদ ও অস্পৃশ্যতা: জাতপাতের বিভেদ ও অস্পৃশ্যতা বিদীর্ণ সমাজের কলঙ্কিত মুখচ্ছবি ও ফুটে উঠেছে চর্যাপদে। অস্পৃশ্য বলে একঘরে করে রাখার প্রথা প্রচলিত ছিল। "টালত ঘর মোর নাহি পড়বেশী"- পদটিতে সেই একাকীত্বের ছবি মর্মস্পর্শী ভাষায় অঙ্কিত হয়েছে।
• উপসংহার: চর্যাপদ যদিও বৌদ্ধ সাধন সংগীত তার সত্বেও তা সমকালীন সমাজের জীবন্ত দলিল এবং সম্ভবত এই সমাজ ব্যবস্থায় সমকালীন গৌড় বঙ্গের সমাজ জীবনেরই ছায়াপাত ঘটেছে।
চর্যাপদের যুগে নারীরা খুব স্বাধীন ছিলেন বলে জানা যায়। তারা স্বেচ্ছায় সঙ্গী ও পেশা নির্বাচনের অধিকার রাখতেন। কুক্করীপা গৃহবধূর ছল করা নিয়ে বলেছেন, "সে দিনের বেলায় কাকের ডাকে ভয় পায়, কিন্তু রাতে প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে যায়।" ডোম্বীপাদের ১৪ নম্বর পদে নারীদের নৌকা চালনা, লোক পারাপার, নৌকার জলসিঞ্চন ইত্যাদি কর্মে অংশগ্রহণের উল্লেখ পাওয়া যায়। এছাড়া সেসময় নারীরা গুরুর স্থানও অধিকার করেছিল।[৪৩]
চর্যার যুগে নারীরা ছিল স্বাধীন। তারা স্বেচ্ছায় পেশা ও সঙ্গী নির্বাচনের অধিকার রাখত। কুকুরীপা এর ২ নং পদে পাওয়া যায় গৃহবধূটি বেশ ছল জানে। সে দিনের বেলায় কাকের ডাকে ভয় পায়। কিন্তু রাতে প্রেমিকের সাথে দেখা করতে যায়। ১০ নং পদে জানা যায় এক ডােমনী নগরে তাঁত ও চেঙারি বিক্রি করে। কাহ্নপা এর ১৮ নং পদে ডােমনীর ছিনালী করার কথা আছে। ডােম্বীপাদের ১৪ নং পদে নারীদের নৌকা চালানাে, নৌকার জল সেচন, লােক পারাপার ইত্যাদি কর্মে নিযুক্ত থাকার কথা জানা যায়। তাছাড়া নারীরা গুরুপদও অধিকার করেছিল।
চর্যাপদে প্রবাদ বাক্য ৬টি।[৪৪] এগুলো হলো:
প্রবাদ | পদে অবস্থায় | কবির নাম | অর্থ |
---|---|---|---|
আপনা মাংসেঁ হরিণা বৈরী | ৬ নং পদ | ভুসুকুপা | হরিণের মাংসই তার জন্য শত্রু |
হাতের কাঙ্কন মা লোউ দাপন | ৩২ নং পদ | সরহপা | হাতের কাঁকন দেখার জন্য দর্পণের প্রয়োজন হয় না |
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী | ৩৩ নং পদ | ঢেগুণ পা | হাড়িতেঁ ভাত নেই, অথচ প্রতিদিন প্রেমিকেরা এসে ভীড় করে |
দুহিল দুধু কী বেন্টে সামায় | ৩৩ নং পদ | ঢেগুণ পা | দোহন করা দুধ কি বাটে প্রবেশ করানো যায়? |
বর সুন গোহালী কিমু দুঠ্য বলন্দেঁ | ৩৯ নং পদ | সরহপা | দুষ্ট গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো |
আন চাহন্তে আন বিনধা | ৪৪ নং পদ | কঙ্কন পা | অন্য চাহিতে, অন্য বিনষ্ট |
চর্যা পদসংকলন
|
সাহিত্যের ইতিহাস ও অন্যান্য আলোচনা
|
বাংলা সাহিত্য | |
---|---|
বাংলা সাহিত্য (বিষয়শ্রেণী তালিকা) বাংলা ভাষা | |
সাহিত্যের ইতিহাস | |
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস | |
বাঙালি সাহিত্যিকদের তালিকা | |
কালানুক্রমিক তালিকা - বর্ণানুক্রমিক তালিকা | |
বাঙালি সাহিত্যিক | |
লেখক - ঔপন্যাসিক - কবি | |
সাহিত্যধারা | |
প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় চর্যাপদ - মঙ্গলকাব্য - বৈষ্ণব পদাবলি ও সাহিত্য - নাথসাহিত্য - অনুবাদ সাহিত্য -ইসলামী সাহিত্য - শাক্তপদাবলি - বাউল গান আধুনিক সাহিত্য উপন্যাস - কবিতা - নাটক - ছোটোগল্প - প্রবন্ধ - শিশুসাহিত্য - কল্পবিজ্ঞান | |
প্রতিষ্ঠান ও পুরস্কার | |
ভাষা শিক্ষায়ন সাহিত্য পুরস্কার | |
সম্পর্কিত প্রবেশদ্বার সাহিত্য প্রবেশদ্বার বঙ্গ প্রবেশদ্বার | |
বৌদ্ধধর্ম |
---|
এর ধারাবাহিক নিবন্ধের অংশ |