চলচ্চিত্রে (অন্যান্য ভিজ্যুয়াল চিত্রের মতো) ইসলামের নবী মুহাম্মাদ (স:) কে চিত্রিত করা ইসলামের অভ্যন্তরে এবং বাইরে উভয় ক্ষেত্রেই একটি বিতর্কিত বিষয়। কুরআন সুস্পষ্টভাবে মুহাম্মদ (স:) এর ছবিকে নিষেধ করে না, তবে কয়েকটি হাদিস (পরিপূরক শিক্ষা) রয়েছে যা মুসলমানদের ব্যক্তির ভিজ্যুয়াল বা চাক্ষুষ প্রতিকৃতি তৈরি করতে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছে। ইসলামের দুটি প্রধান সম্প্রদায় সুন্নি ও শিয়া মুসলিমের মধ্যে এই বিষয়ে মতভেদ আছে।
বেশিরভাগ সুন্নি মুসলমান বিশ্বাস করেন যে ইসলামের সমস্ত নবীর ভিজ্যুয়াল প্রতিকৃতি তৈরি নিষিদ্ধ করা উচিত[১] এবং বিশেষত মুহাম্মদ (স:) এর চাক্ষুষ (ভিজ্যুয়াল) উপস্থাপনা থেকে বিরত রয়েছে।[২] ১৯২৬ সালে আতাতুর্কের তুর্কি সরকারের অর্থায়নে নির্মিতব্য একটি প্রস্তাবিত ছবিতে মুহাম্মদের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য নির্বাচিত হওয়ায় মিশরীয় অভিনেতা ইউসুফ ওয়াহবী বিতর্কিত হন। কায়রোতে সুন্নি ইসলামী আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়টি সম্পর্কে জানতে পারে, সেখানকার পন্ডিতগণ একটি ফতোয়া জারি করেন যেখানে বলা হয় যে, ইসলাম মুহাম্মদ (স:)-কে পর্দায় চিত্রিত করতে নিষেধ করে এবং এরপর
মিশরীয় সমসাময়িক বাদশাহ প্রথম ফুয়াদ অভিনেতাকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন, তাকে নির্বাসন দেওয়ার ও তার মিশরীয় জাতীয়তা ছিনিয়ে নেওয়ার হুমকি দেন। বিতর্কের ফলস্বরূপ চলচ্চিত্রটি পরিত্যক্ত হয়। [৩]
শিয়া মুসলিমদের পণ্ডিতরাও ঐতিহাসিকভাবে এ জাতীয় চিত্রের বিরুদ্ধে ছিলেন, তবে বছরের পর বছর ধরে আরও সহজ দৃষ্টিভঙ্গিতে নিয়েছেন এবং মুহাম্মদ (স:) এর চিত্র আজকাল প্রচলিত আছে।[২] ইরাকের শিয়ামারজাআলী আল-সিস্তানির দেওয়া একটি ফতোয়াতে বলা হয়েছে যে, শ্রদ্ধার সাথে করা হলে, এমনকি টেলিভিশন বা সিনেমাতেও মুহাম্মদ (স:)-কে চিত্রিত করা বৈধ।[৪]
মোহাম্মদ, ম্যাসেঞ্জার অফ গড হচ্ছে মুহাম্মাদ কে নিয়ে প্রথম কোন বড় চলচ্চিত্র, এটি দ্য ম্যাসেজ নামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মুক্তি পায়। ছবিটি ১৯৭৬ সালের ১ জানুয়ারি মুক্তি পায় এবং একই বছরের ২৯ শে জুলাই লন্ডনের সিনেমাহল "প্লাজা" -তে এটির প্রিমিয়ার শো হয়। মুভিটির দুটি সংস্করণ আছে, একটি ইংরেজি এবং অপরটি আরব সংস্করণ। ১৯৭৬ সালের ১৯ আগস্ট লন্ডনের একটি সিনেমা হল কার্জনে আরব সংস্করণটির প্রিমিয়ার হয়। উভয় সংস্করণ ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়। ফলে ইংরেজি সংস্করণটি নয় সপ্তাহ এবং আরব সংস্করণটি ছয় সপ্তাহের জন্য প্রদর্শিত হয়।
পরিচালক মুস্তফা আক্কাদ ছবিটিতে আমেরিকান এবং মিশরীয় অভিনেতাকে ব্যবহার করেছেন। ইংলিশ সংস্করণে হামজার ভূমিকায় অ্যান্থনি কুইন, মুহাম্মদের মূল প্রতিপক্ষ আবু সুফিয়ানের চরিত্রে মাইকেল আনসারা এবং আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ-এর ভূমিকায় ইরেন পাপাস অভিনয় করেছেন। আরব সংস্করণে এই ভূমিকাগুলিতে মিশরীয় অভিনেতারা অভিনয় করেছেন। তবে, সামগ্রিক শটগুলির বেশ কয়েকটিতে, যেখানে অনেক অভিনেতা অভিনয় করছে, যেমন বদরের যুদ্ধের মতো দৃশ্যে, এটি শোনা যায় যে দৃশ্যটি কেবল একবারই শ্যুট করা হয়েছিল, অভিনেতারা "আল্লাহু আকবর" বলে চিৎকার করার সময়, অন্য একই রকম দৃশ্যে পরিচালক "ইশ্বর মহান" বেছে নিয়েছেন।
যদিও সিনেমাটি মুহাম্মদ সম্পর্কে, তবে পরিচালক ছবিটির শুটিংয়ের মুহাম্মদ কে চিত্রিত না করার সিদ্ধান্ত নেন। মুহাম্মদ কে দর্শনে আনার সময় আক্কাদ ঘন ঘন ক্যামেরার অবস্থান পরিবর্তন করেন। মুহাম্মদ যখন কোনও দৃশ্যের জন্য অপরিহার্য ছিলেন, তখন ক্যামেরা তাঁর দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাগুলি প্রদর্শন করে।[৫]
দ্য ম্যাসেজ খুব জনপ্রিয়তা পায়, মুসলমানদের মধ্যেও কম নয় উদাহরণস্বরূপ আফ্রিকা এবং এশিয়ায়। তবুও, দ্য মেসেজ সম্পর্কে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় এবং লেবাননের শিয়া কাউন্সিল দুটি সুপরিচিত ফতোয়া জারি করে।
মুহাম্মদ: দ্য লাস্ট প্রফেট হচ্ছে "দ্য ম্যাসেজ" এর একই নীতি অনুসরণে বদর ইন্টারন্যাশনাল নির্মিত একটি অ্যানিমেশনকৃত চলচ্চিত্র। এর পরিচালক হলেন রিচার্ড রিচ। সিনেমাটি ২০০৪ সালে মুক্তি পায় এবং এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের সীমিত সংখ্যক সিনেমা-প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হয়। ছবিটি ইসলামের প্রাথমিক যুগের উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়।
২০১২ সালের অক্টোবরে ইরানি পরিচালক মজিদ মজিদি মুহাম্মদকে পর্দায় দেখানোর পরিকল্পনা নিয়ে মুহাম্মদ: দ্য মেসেঞ্জার অফ গড নামে একটি ছবির শুটিং শুরু করেছিলেন, যদিও শিয়া ঐতিহ্য অনুসারে তাঁর চেহারা প্রদর্শন করা নিষেধ। ছবিটির বিশ্ব প্রিমিয়ার ২৭ আগস্ট ২০১৫ তারিখে ছিল।[৬]
মুহম্মদ কে নিয়ে বর্তমানে কিছু নতুন চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, "তাদের ধরনের দ্বিতীয়" হিসাবে বিবেচিত (মুহাম্মদের প্রতিকৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে পশ্চিমা ধাচের চলচ্চিত্র)।[৭][৮]
২০০৮ সালের অক্টোবরে, মূল দ্য ম্যাসেজ ছবিতে কাজ করা প্রযোজক অস্কার জোঘবি বলেন যে তিনি পবিত্র শহর মক্কা এবং মদিনার আশেপাশে মেসেঞ্জার অফ পিস নামে একটি রিমেকের (পুননির্মাণ) শুটিং করবেন।[৮]
মুহাম্মদ কে নিয়ে একটি সম্ভাব্য ধারাবাহিকের উপদেষ্টা হিসাবে চলচ্চিত্র প্রযোজক ব্যারি এম. ওসবর্নকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কাতারি মিডিয়া সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত এবং মিশরীয় আলেম ইউসুফ আল-কারাদাভী তত্ত্বাবধান করবেন, এই চলচ্চিত্রগুলি সুন্নি রীতি অনুসারে পর্দায় মুহাম্মদ কে চিত্রিত করার সম্ভাবনা কম, যেখানে নবীদের যে কোন ধরনের উপস্থাপনাকে নিন্দনীয় বলা হয়।[৭][৯]