চাকমা

চাকমা
𑄌𑄋𑄴𑄟𑄳𑄦
ঐতিহ্যবাহী পোশাকে চাকমা নারী
মোট জনসংখ্যা
≈ ৮০০,০০০ (২০১১–২০২২)
উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যার অঞ্চল
বাংলাদেশ,[] ভারত[] এবং মিয়ানমার
 বাংলাদেশ৫২৯,২৭১ (২০২২)[]
 ভারত২২৮,২৮১ (২০১১)[]
           মেজরাম৯২,৮৫০
           ত্রিপুরা৮৪,২৬৯
           অরুণাচল প্রদেশ৪৭,০৭৩
           আসাম৩,১৬৬
           পশ্চিমবঙ্গ১৭৫
           মেঘালয়১৫৯
           নাগাল্যান্ড১৫৬
 মিয়ানমার৪৩,১০০[]
ভাষা
চাকমা
ধর্ম
থেরবাদ বৌদ্ধধর্ম
সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী
ডাইংনেট, তঞ্চঙ্গ্যা, রাখাইন, বর্মা
উপজেলা অনুসারে চাকমা জনসংখ্যার শতাংশ দেখানো মানচিত্র
ভারত ও মায়ানমারের পূর্বতম সীমান্তে পার্বত্য চট্টগ্রাম ( খাগড়াছড়ি , রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান জেলা ) সহ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের জেলাগুলির রঙ-কোডেড মানচিত্র ।

চাকমা বা চাঙমা ( চাকমা :𑄌𑄋𑄴𑄟𑄳𑄦) হল ভারতীয় উপমহাদেশ এবং পশ্চিম মায়ানমারের পূর্ব-অধিকাংশ অঞ্চলের একটি জাতিগোষ্ঠী । তারা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের বৃহত্তম উপজাতিগোষ্ঠী এবং ভারতের মিজোরামের চাকমা স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদের বৃহত্তম । উল্লেখযোগ্য চাকমা জনসংখ্যা উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য অরুণাচল প্রদেশ, ত্রিপুরা এবং আসামে পাওয়া যায় ।

চাকমারা উত্তর-পূর্ব ভারতের তিব্বতি-বর্মী গোষ্ঠীগুলির সাথে দৃঢ় জাতিগত সম্পর্ক বজায় রেখেছে। অতীতে ক্ষমতা সংহত করার লক্ষ্যে তারা একটি ভাষা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে এবং চাকমা নামক একটি ইন্দো-আর্য ভাষা গ্রহণ করেছে, যা তাদের বসবাসরত অঞ্চলের প্রধান ভাষা চাটগাঁইয়া ভাষা সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।[] অধিকাংশ আধুনিক চাকমা জনগণ ১৯শ শতকের সংস্কার এবং রানী কালিন্দীর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ফলে থেরবাদ বৌদ্ধ ধর্ম পালন করে। মিয়ানমারে চাকমা জনগণকে ডাইংনেট নামে পরিচিত এবং সেখানে তারা ১৩৫টি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত জাতিগত গোষ্ঠীর একটি।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]

চাকমারা ৩১টি বংশ বা গোত্রে বিভক্ত।[] এই সম্প্রদায়ের প্রধান হচ্ছেন চাকমা রাজা, যার উপজাতি প্রধান হিসেবে মর্যাদা ঐতিহাসিকভাবে ব্রিটিশ ভারতের সরকার এবং বাংলাদেশের সরকার কর্তৃক স্বীকৃত।

চাকমাদের সাথে তাদের প্রতিবেশীদের সম্পর্ক জটিল। একদিকে, অনেক চাকমা মূলধারার মধ্যবিত্ত বাংলাদেশি ও ভারতীয় সমাজে ভালোভাবে একীভূত হয়েছে এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের সামরিক ও কূটনৈতিক বাহিনীতে কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রদূত হিসেবে তাদের সেবা উল্লেখযোগ্য। চাকমা রাজনীতিবিদরা বাংলাদেশে জাতীয় মন্ত্রিসভা এবং ত্রিপুরার রাজ্য মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে, চাকমারা যেসব উপজাতিদের মধ্যে প্রধান জাতিগোষ্ঠী, সেই পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিদের ওপর চাকমাদের নির্যাতনকে গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তবে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পর থেকে ওই অঞ্চলে সহিংসতা অনেকটাই কমে গেছে।[][]

শব্দগত উৎপত্তি

[সম্পাদনা]

চাকমা শব্দটি সংস্কৃত শব্দ শক্তিমান থেকে আগত।[] বর্মী রাজত্বের শুরুর দিককার সময়ে বর্মী রাজারা এই চাকমা নামকরণের প্রচলন করেন। তখনকার সময়ে বর্মী রাজারা, চাকমাদের রাজার পরামর্শক, মন্ত্রী এবং পালি ভাষার বৌদ্ধধর্মের পাঠ অনুবাদকের কাজে নিয়োগ প্রদান করতেন। রাজা কর্তৃক সরাসরি নিয়োগকৃত হওয়াতে বর্মী রাজ দরবারে চাকমারা বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। বার্মায় প্রচলিত চাকমাদের নাম সংক্ষেপ "সাক" শব্দটি সংস্কৃত শব্দ শক্তিমানের বিকৃত রুপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এরই এক পর্যায়ে, জনগোষ্ঠীটির নাম "সাকমা" এবং পরবর্তীতে বর্তমান "চাকমা" নামটি গ্রহণযোগ্যতা পায়।[১০]

চাকমারা উত্তর-পূর্ব ভারতের তিব্বতী-বর্মণ গোষ্ঠীগুলির সাথে জিনগত প্রগাঢ়তার মিল রয়েছে। এদের মূল ভূখণ্ডের ভারতীয়দের সাথে জিনগত উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সি বা মিলও রয়েছে।[১১]

মধ্যযুগে চাকমা জনগোষ্ঠী

[সম্পাদনা]

১৫৪৬ সালে আরাকান রাজা মেং বেং বার্মার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে পরেন। যুদ্ধাবস্থায় "সাক" রাজা উত্তর দিক থেকে তৎকালীন আরাকান, অর্থাৎ আজকের কক্সবাজারের রামু আক্রমণ করে দখল করে নেন।[১২]

ডিয়েগো ডি এস্টোর, একজন পর্তুগীজ, প্রাচীন বঙ্গ অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করেন। যা Descripção do Reino de Bengalla হিসেবে Quarta decada da Asia (Fourth decade of Asia) নামক বইয়ে João de Barros ১৬১৫ সালে প্রকাশ করেন।[১৩] ঐ মানচিত্রে কর্ণফুলি নদীর পূর্বতীরে "চাকোমাস" নামে একটি অঞ্চলের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ধারণা করা হয়, ঐ নির্দেশিত অঞ্চলটিই ছিল তখনকার চাকমা দের আবাসভূমি।

পরবর্তীকালে আরাকান রাজা মেং রাজাগ্রী (১৫৯৩-১৬১২) পর্তুগীজ মানচিত্রে উল্লেখ করা চাকোমাস অঞ্চলটি অধিকারে নেন। পর্তুগীজ বণিক Philip de Brito Nicote ১৬০৭ সালের এক চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, মেং রাজাগ্রী নিজেকে আরাকান, চাকোমাস এবং বেংগল এর সবচেয়ে শক্তিশালী রাজা হিসেবে পরিচয় দেন।[১৪]

আরাকানীদের কাছে পরাজিত হয়ে চাকমা জনগোষ্ঠী বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চলে আসেন এবং আলেক্যাদংয়ে (বর্তমান আলী কদম) তাদের রাজধানী স্থাপন করেন। পরবর্তীতে আলেক্যাদং থেকে আরো উত্তরে সরে এসে বর্তমান চট্টগ্রাম বিভাগের রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, ফটিকছড়ি উপজেলায় বসতি স্থাপন করেন।

১৬৬৬ সালে মুঘল সুবেদার শায়েস্তা খান, আরাকানীদের পরাজিত করে চট্টগ্রাম দখলে নেন এবং চট্টগ্রামের নাম ইসলামাবাদ রাখেন।[১৫] যাই হোক, ঐ সময় ও মুঘল সাম্রাজ্য চট্টগ্রামের সমতল অংশগুলোই নিয়ন্ত্রণ করতো, এবং চাকমারা তখনো পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত ছিলেন না।

তার কিছু সময় পর, মুঘলরা চাকমাদের কাছ থেকে চট্টগ্রামে ব্যবসা করার বিপরীতে খাজনা দাবি করতে থাকেন। এর ফলে মুঘলদের সাথে চাকমাদের বিরোধ শুরু হয়। চাকমা আর মুঘলদের সাথে যুদ্ধ হয়। এতে মুঘলরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুঘলদের কাছ থেকে চাকমা রাজা দুইটি কামান জব্দ করেন। যার একটি কাপ্তাই হৃদে নিমজ্জিত অবস্থায় আছে এবং আরেকটি চাকমা রাজবাড়ির কাছে আছে।[১৬]

পরবর্তীতে ১৭১৩ সালে চাকমা এবং মুগলদের মাঝে শান্তি স্থাপিত হয় এবং একটি দৃঢ় সম্পর্কের ও সূত্রপাত ঘটায় এই শান্তি স্থাপন। তারপর থেকে মুঘল সাম্রাজ্য আর কখনোই চাকমাদের কে তাদের বশ্যতা স্বীকারে বাধ্য করে নি। মুঘলরা একইসাথে চাকমা রাজা সুখদেব রায় কে পুরষ্কৃত করেন। সুখদেব রায় নিজের নামে রাজধানী স্থাপন করেন, যা আজো সুখবিলাস নামে পরিচিত। সেখানে আজো পুরনো রাজবাড়ির ধ্বংসাবশেষ এবং অন্যান্য প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। পরবর্তীতে রাজানগরে রাজধানী স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে যা চট্টগ্রাম জেলায় রাঙ্গুনিয়া উপজেলার, রানীরহাটের রাজানগর হিসেবে পরিচিত।

ব্রিটিশ শাসনে চাকমা জনগোষ্ঠী

[সম্পাদনা]

পলাশীর যুদ্ধের তিন বছর পরে, মুর্শিদাবাদের নতুন নবাব মীর কাশিম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীকে চট্টগ্রাম, বর্ধমান এবং মেদিনীপুর উপহার হিসেবে দিয়ে দেন। ৫ জানুয়ারি ১৭৬১ সালে, কোম্পানীর প্রতিনিধি হ্যারি ভেরেলস্ট চট্টগ্রামের শাসনভার সুবেদার মোহাম্মদ রেজা খানের কাছ থেকে গ্রহণ করেন।

তবে তখনো চাকমা রাজা শের দৌলত খান স্বাধীনভাবে তার রাজ্য পরিচালনা এবং মুঘলদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। এবং কোম্পানীর শাসন মেনে না নিয়ে কোম্পানী কর্তৃক ধার্য নির্ধারিত খাজনা প্রদানে বিরত ছিলেন। ফলে কোম্পানির সাথে একটি দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের সূত্রপাত হয়, যা ১৭৮৭ সালপর্যন্ত চলেছিল।[১৭] কোম্পানী চাকমা রাজের বিরুদ্ধে চারটি যুদ্ধ পরিচালনা করেছিল। সেগুলো হল - ১৭৭০, ১৭৮০, ১৭৮২ এবং ১৭৮৫ সালের যুদ্ধ। যুদ্ধে কোম্পানী বিশেষ সুবিধে করতে না পারায় এবং চাকমা রাজ্যে বাণিজ্য অবরোধের ফলে সৃষ্ট সমস্যায় - দুই পক্ষই ১৭৮৫ সালে একটি শান্তি আলোচনা চালায়। চাকমা রাজের পক্ষে রাজা জানবক্স খান, শের দৌলত খানের পুত্র অংশ নেন। পরবর্তীতে ১৭৮৭ সালে কলকাতায় চাকমা রাজের সাথে কোম্পানীর একটি শান্তি চুক্তি সম্পন্ন হয়। চুক্তি অনুযায়ী চাকমা রাজা কোম্পানীর আধিপত্য মেনে নেওয়ার পাশাপাশি বছরে ৫০০ মণ তুলা দেওয়ার প্রতিশ্রতি দেন, বিনিময়ে কোম্পানী চাকমা রাজার আঞ্চলিক আধিপত্য মেনে নিয়ে বাণিজ্য অবরোধ তুলে নেয়।[১৮]

লর্ড কর্নওয়ালিস ও চাকমা রাজার মধ্যে সাক্ষরিত চুক্তির প্রধান অংশগুলো ছিল নিম্নরুপ[১৯] -

  • কোম্পানী জানবক্স খান কে চাকমাদের রাজা হিসেবে স্বীকৃতি দেবে। এবং নিজ এলাকায় চাকমা রাজা রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব পালন করবেন।
  • ব্রিটিশ রাজ, চাকমা রাজ্যের স্বতন্ত্র সার্বভৌমত্বকে মেনে নেবেন এবং একই সাথে সমতল থেকে অভিবাসনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।
  • চুক্তি অনুযায়ী চাকমা রাজা জানবক্স খান নিজ এলাকায় শান্তি-শৃংখলা রক্ষার্থে মূল দায়িত্ব পালন করবেন।
  • ব্রিটিশ রাজের সৈন্য চাকমা রাজ্যে নিয়োজিত থাকবে চাকমা রাজের রাজ্য অন্য পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠীরর আক্রমণ থেকে রক্ষার্থে।[২০]

১৮২৯ সালে তখনকার চট্টগ্রামে কোম্পানির কমিশনার হ্যালহেড উল্লেখ করেন যে :

The hill tribes were not British subjects but merely tributaries and we recognized no right on our part to interfere with their internal arrangements. The near neighbourhood of a powerful and stable government naturally brought the Chief by degree under control and every leading chief paid to the Chittagong collector a certain tribute or yearly gifts. These sums were at first fluctuating in amount but gradually were brought to a specific and fixed limit, eventually taking the shape not as tribute but as revenue to the state.[২১]

জানবক্স খান তার রাজ্যের রাজধানী রাজানগরে সরিয়ে নেন, যা বর্তমান রাঙগুনিয়ার রানীরহাটে অবস্থিত। ১৮০০ সালে জানবক্স খানের মৃত্যুর পর তার পুত্র তব্বর খান রাজা হন, কিন্তু কিছু সময়ের ব্যবধানে তিনিও মারা গেলে, তার ছোট ভাই জব্বর খান রাজা হন। জব্বর খান ১০ বছর পর্যন্ত শাসন করেন। তার মৃত্যুর পর তারই সন্তান ধরম বক্স খান ১৮১২ সালে রাজা হন। ধরম বক্স খান ১৮৩২ সাল পর্যন্ত রাজত্ব করেন। ১৮৩২ সালে তার মৃত্যুর পর পুরুষ উত্তরাধিকারের অভাবে রাজ্য শাসনে অরাজকতা দেখা দেয়। ফলে কোম্পানীর হস্তক্ষেপে সুখলাল দেওয়ান কে অন্তর্বতীকালীন ম্যানেজার নিয়োগ দেয়া হয়। এই সময়কালে ধরম বক্স খানের বিধবা স্ত্রী রানী কালিন্দী কোম্পানীর কাছে রাজ্য পরিচালন ভার দেওয়ার আবেদন করেন। কোম্পানীর সরকার রানীর আবেদন গ্রহণ করে ১৮৪৪ সালে একটি আদেশ জারি করে।[২২] ১৮৬৪ সালে নতুন খাজনা ধার্য করা হয়, যার পরিমাণ দাঁড়ায় বছরে ১১, ৮০৩ টাকা।

সিপাহী বিদ্রোহের পরে ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশ সরকার কোম্পানীর কাছ থেকে ভারত শাসন ভার নিয়ে নেয়, এর মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের শাসনভার ও অন্তর্গত ছিল, যা তখনো পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে চট্টগ্রাম থেকে আলাদা করা হয় নি। তবে, ব্রিটিশ সরকার নতুন দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমানা নির্দেশ করে একটি প্রত্যাদেশ বাংলা ৬ শ্রাবণ ১১৭০ সনে জারি করেন। প্রত্যাদেশ অনুযায়ী ফেনী নদী হতে শঙ্খ নদীর মধ্যবর্তী সকল পাহাড় এবং চট্টগ্রামের নিজামপুর রোড হতে কুকি হিলস পর্যন্ত অঞ্চলকে চাকমা রাজের সীমানাভুক্ত করা হয়।[২৩]

১৮৭৩ সালে রানী কালিন্দীর মৃত্যুর পর, তার প্রপৌত্র হরিশ চন্দ্র কারবারি চাকমা রাজা হিসেবে স্থলাভিষিক্ত হন এবং রায় বাহাদুর উপাধী প্রদান করা হয়। ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে চাকমা সামরিক বাহিনী ক্রমে দুর্বল হয়ে পরে।

কুকি জনগোষ্ঠী, যারা আরো উত্তরের অঞ্চলে স্বাধীন ভাবে বসবাস করত, তারা ১৮৪৭, ১৮৪৮, ১৮৫৯ ও ১৮৬০ সালের দিকে ত্রিপুরা, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও রানী কালিন্দী শাসিত চাকমা অঞ্চলে একাধিকার আক্রমণ চালায়। এর ফলশ্রুতিতে, আক্রান্ত এলাকা রক্ষা এবং চাকমা ভূখণ্ড দখলে নেয়ার মানসিকতা থেকে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর, হিল ট্রাক্ট রেগুলেশন থেকে চাকমা শাসিত অংশটির অপসারন এবং একজন সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়োগের সুপারিশ করেন। এই সুপারিশগুলো ১৮৬০ সালের XXII নং আইনে পাশ করানো হয়, এবং তা একই বছরের ১৮ অগাস্ট থেকে আইন হিসেবে প্রয়োগ করা হয়। রানী কালিন্দী শাসিত চাকমা অঞ্চল কে প্রশাসনিক ভাবে চট্টগ্রাম থেকে আলাদা করে ফেলা হয়। এবং এই অঞ্চলের প্রশাসনিক প্রধান হিসেবে একজন সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়োগ করা হয় যার সদর দপ্তর ছিল বর্তমান রাঙামাটি জেলার চন্দ্রঘোনায়। এই সুপারিন্টেনডেন্ট এর অধিভুক্ত এলাকাকে, তখন থেকেই প্রথম বারের মত চিটাগাং হিল ট্র‍্যাক্টস হিসেবে নির্দেশ করা হয়। সুপারিন্টেনডেন্ট নিয়োগের পরবর্তী কয়েক বছর শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখাটাই হয়ে দাড়ায় মূল কাজ।

১৮৬৯ সালে সুপারিন্টেনডেন্ট এর সদর দপ্তর চন্দ্রঘোনা থেকে রাঙামাটিতে স্থানান্তর করা হয়। স্থানান্তর করার আগেই সুপারিন্টেনডেন্ট পদটিকে ডেপুটি কমিশনারে রুপ দেয়া হয়। এবং তাকে এই অঞ্চলের রাজস্ব আদায় থেকে স্থানীয় শাসন ও বিচার ব্যবস্থার সর্বময় ক্ষমতা প্রধান করা হয়।

পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠী গুলোর ক্রমাগত আক্রমণ এবং ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের চাপের মুখে চাকমাদের রাজধানী ১৮৭৪ সালে রাজানগর থেকে রাঙামাটি তে স্থানান্তরিত হয়। সেই সময় গুলোয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রচুর পরিমানে তুলা উৎপাদিত হত, যা ব্রিটিশদের কাছে তাদের দেশের সুতার কলকারখানার কাঁচামাল বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্ববহন করতো।

১৮৮১ সালের দিকে ব্রিটিশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম কে তিনটি সার্কেলে ভাগ করার সিদ্ধান্ত নেন। এবং এই সার্কেলের নামমাত্র শাসকদের "সার্কেল চীফ" হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই সার্কেল গুলো হল - চাকমা সার্কেল, বোমাং সার্কেল এবং মং সার্কেল। চাকমা সার্কেল চাকমাদের নিয়ে, আরাকানী বংশোদ্ভূত বোমাং প্রধানের দায়িত্বে বোমাং সার্কেল এবং আরাকানী ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী ও ত্রিপুরা অঞ্চলের অভিবাসীদের নিয়ে গঠিত হয় মং সার্কেল।

পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভাগ করার পিছনে মূল কারণ ছিল এই যে, ব্রিটিশ সরকার, এই অঞ্চলের অন্যান্য পাহাড়ি জনগোষ্ঠী দের কাছে চাকমা রাজার গ্রহণযোগ্যতাকে ভালো ভাবে নিতে পারছিলো না। উপরন্তু, ব্রিটিশ সরকার, এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় ক্রমানয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছিলো। যার ফলে, ব্রিটিশ সরকার এই অঞ্চলে পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থার ভিত্তি আরোপ করে। যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল:

  • চাকমা রাজের শাসন ক্ষমতার তদারকি এবং কতিপয় ক্ষমতার কাটছাঁট করা।
  • কুকী আক্রমণের হাত থেকে ব্রিটিশ কর্মকর্তা এবং ব্রিটিশ সম্পদ রক্ষা করা।
  • পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে শান্ত অবস্থা বজায় রাখা যাতে—এই অঞ্চলে তুলার উৎপাদন আরো বৃদ্ধি করানো যায়।

তিনটি আলাদা সার্কেল গঠন করার পরও পার্বত্য চট্টগ্রামে কুকী আক্রমণ চলতে থাকে। এর মধ্যেই শেন্দু জনগোষ্ঠী ১৮৬৫ থেকে ১৮৮৮ সালের মাঝে পার্বত্য চট্টগ্রামে আক্রমণ শানাতে থাকে। এর মধ্যে ১৮৭২ সালে লেফটেন্যান্ট স্টুয়ার্ড ও তার জরিপ দলের উপর হামলা অন্যতম। এই ক্রমাগত হামলার মুখে, ১৮৯০ সালে বাংলা ও আসাম এর ব্রিটিশ প্রশাসনের সহায়তায় লুসাই পাহাড় থেকে চট্টগ্রাম ও বার্মা পর্যন্ত সেনা অভিযান চালানো হয়। ফলশ্রুতিতে, স্বাধীন কুকীদের আবাস ভুমি ব্রিটিশ শাসনের অধীনে চলে আসে।

১ এপ্রিল ১৯০০ সালে, দক্ষিণ ও উত্তর লুসাই পাহাড় যা আগে পার্বত্য চট্টগ্রামের অংশ ছিল, তা আসাম প্রদেশের সাথে সংযুক্ত করা হয়। বর্তমানে লুসাই হিল ভারতের মিজোরাম রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত।

পার্বত্য চট্টগ্রামে ভাঙন নিশ্চিত ও চাকমা আধিপত্য খর্ব করার পর পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি ১৯০০ প্রনয়নের মাধ্যমে, ব্রিটিশদের পক্ষে ডেপুটি কমিশনার এই চাকমা শাসিত অঞ্চলের পরিপূর্ণ শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে পার্বত্য চট্টগ্রাম কে ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অন্তর্ভুক্ত না দেখিয়ে, স্বতন্ত্র এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

চাকমা জনগোষ্ঠীর বর্তমান অবস্থান

[সম্পাদনা]

পার্শ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম ও ত্রিপুরা অঞ্চলের চাকমাদের মতই আজকের দিনের বাংলাদেশী চাকমা জনগোষ্ঠী, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের বহু আগে থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছে। তবে বাংলাদেশ অংশে ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে চাকমাদের ঐতিহ্যবাহী বাসভূমিতে সমতলের বাঙালিদেরকে সরকারি ব্যবস্থায় অভিবাসন - একটি আন্ত:সাম্প্রদায়িক সমস্যার সূত্রপাত ঘটায়। এমন অভিবাসনের বিরুদ্ধে চাকমাসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের অন্যান্য জুম্ম জাতিগোষ্ঠীর প্রতিবাদী অবস্থানের বিপরীতে বাংলাদেশের সরকারগুলো রাজনৈতিক পন্থা অবলম্বন না করে দমন নীতি গ্রহণ করে। তবে ১৯৯৭ সালের ২ জানুয়ারিতে সাক্ষরিত পার্বত্য চুক্তি পূর্বেকার অবস্থার পরিবর্তন সাধনে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়।

চাকমা জনগোষ্ঠীর সাথে জবরদস্তি মূলক আচরনের সূত্রপাত ঘটে পূর্ব পাকিস্তান আমলে বহু চাকমা গ্রাম ও তাদের আবাদী ভূমি ডুবিয়ে দিয়ে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ব্যারেজ নির্মাণের মাধ্যমে। এর ফলে ১৯৬৪- ১৯৬৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে, চাকমা জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ - বসতভিটা ও আবাদের জমি হারিয়ে ভারতের অরুনাচল রাজ্যের দিয়ূন অঞ্চলে শরণার্থী হিসেবে অভিবাসন গ্রহণ করতে বাধ্য হন।

১৯৭২ এর ফেব্রুয়ারিতে, ভারত ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী একটি যৌথ বিবৃতি প্রদান করেন। এই যৌথ বিবৃতির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল - ১৯৫৫ সালের ভারতের নাগরিকত্ব আইনের ৫(১)(ক) ধারানুযায়ী, ভারত সরকার কর্তৃক অরুনাচল রাজ্যে অভিবাসিত চাকমাদের নাগরিকত্ব দেয়া। তবে এই সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তৎকালীন অরুনাচল রাজ্য সরকার মতামত দেয়া থেকে বিরত থাকে। তবে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অরুনাচল রাজ্যে তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে পুনর্বাসিত করা হয়। ভারতের নির্বাচন কমিশন পুনর্বাসিত চাকমাদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে এবং ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য অরুনাচল রাজ্য কনস্টিটিউয়েন্সিতে নতুন নীতিমালা প্রনয়ন করেন।

২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের সুপ্রিমকোর্ট একটি রায় প্রদান করেন। তাতে, অরুনাচলের সকল চাকমাদের নাগরিকত্ব দান ও পক্ষপাতবিহীনভাবে নাগরিক অধিকার চর্চা নিশ্চিত করার জন্য ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও অরুনাচল রাজ্য সরকারের প্রতি নির্দেশ প্রদান করেন। [২৪]

বর্তমানে মিজোরাম রাজ্যের জেনারেল এসেম্বলি, ত্রিপুরা রাজ্যের লেজিসলেটিভ এসেম্বলি এবং Tripura Tribal Area Autonomous District Council এ চাকমাদের প্রতিনিধিত্ব রয়েছে। চাকমাদের রাজনৈতিক অধিকার চর্চার একমাত্র ক্ষেত্র হিসেবে আছে ভারতের Chakma Autonomous District Council, তবে এই কাউন্সিল মিজোরাম অঞ্চলের চাকমাদের মাত্র ৩৫% এর প্রতিনিধিত্ব করে। বর্তমানে বার্মার রাখাইন রাজ্যে আরো প্রায় ৮০, ০০০ এর মত চাকমা বসবাস করছেন। বার্মায় চাকমারা মূলত ডাইংনেট জনগোষ্ঠী নামে পরিচিত।

আদিবাসী-উপজাতি বিতর্ক

[সম্পাদনা]

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৩(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বলা হয় যে, বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই; বরং মূল বাঙালি জনগোষ্ঠীর বিপরীতে এই অ-বাঙালি জনসমষ্টিকে - উপজাতি; ক্ষুদ্র জাতিসত্তা; নৃগোষ্ঠী নামে অভিহিত করা হয়েছে। তবে, এই চাকমারা জাতিসংঘ আদিবাসী অধিকার ঘোষণা ২০০৭ এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১০৭ ও ১৬৯ নং কনভেনশনের ঘোষণা অনুযায়ী নিজেদের আদিবাসী দাবি করে এবং উপজাতি নামটি মনেপ্রাণে অপমানকর মনে করে। তবে আরাকান থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে আসায় বাংলাদেশ তাদেরকে আদিবাসী স্বীকৃতি দেয়নি। তবে বর্তমানে পাঠ্যবইয়ে উপজাতি শব্দের বদলে ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী লেখা হয়।

চাকমা শব্দের উৎস

[সম্পাদনা]

কিছু দাবি মতে চাকমারা শব্দটি এসেছেও সংস্কৃত শব্দ শক্তিমান থেকে।[২৫] বর্মী রাজত্বের শুরুর দিককার সময়ে বর্মী রাজারা এই চাকমা নামকরনের প্রচলন করেন। তখনকার সময়ে বর্মী রাজারা, চাকমাদের রাজার পরামর্শক, মন্ত্রী এবং পালি ভাষার বৌদ্ধধর্মের পাঠ অনুবাদকের কাজে নিয়োগ প্রধান করতেন। রাজা কর্তৃক সরাসরি নিয়োগকৃত হওয়াতে বর্মী রাজ দরবারে চাকমারা বেশ প্রভাবশালী ছিলেন। বার্মায় প্রচলিত চাকমাদের নাম সংক্ষেপ "সাক" শব্দটিকে কেউ কেউ সংস্কৃত শব্দ শক্তিমানের বিকৃত রূপ হিসেবে বিবেচনা করে। এরই এক পর্যায়ে, জনগোষ্ঠীটির নাম "সাকমা" এবং পরবর্তীতে বর্তমান "চাকমা" নামটি গ্রহণযোগ্যতা পায়।[১০]

বেশির ভাগ চাকমা শত শত বছরের পুরাতন থেরবাদী বৌদ্ধ ধর্ম অনুসরণ করে। তাদের বৌদ্ধ ধর্ম পালনের মধ্যে হিন্দুধর্ম ও অন্যান্য প্রাচীন ধর্মের মিল পাওয়া যায়।

প্রায় প্রত্যেক চাকমা গ্রামে বৌদ্ধ মন্দির বা হিয়োং আছে। বৌদ্ধ সন্যাসীদের বৌদ্ধ ভিক্ষু বা ভান্তে বলা হয়। তাঁরা ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধান করে। গ্রামবাসী/অনুসারীরা ভিক্ষুদের খাদ্য (সিয়োং), বস্ত্র (চীবর), বাসস্থান (হিয়োং/কুটির), ওষুধসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দিয়ে জীবনধারণে সাহায্য করে। বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের জীবন সম্পূর্ণ সাধারণ মানুষের উপর নির্ভরশীল। তাঁদের কোনো চাকরি বা ব্যবসা বা চাষাবাদ করার সুযোগ নেই বুদ্ধের প্রকৃত বিধান অনুসারে। তাঁদের মূল কাজ বুদ্ধ প্রজ্ঞাপিত নিয়ম মেনে নিজের আধ্যাত্মিক উন্নতি বা দুঃখমুক্তির কাজ করে যাওয়া।

আগে চাকমারা হিন্দু দেব-দেবীর পূজাও করত। উদাহরণস্বরূপ, লক্ষীদেবীকে চাষাবাদের ফলন বেশি পাওয়ার জন্য পূজা করা হতো। চাকমারা ভূত-প্রেত বিশ্বাস করে এবং তাদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য ছাগল, মুরগী, হাঁস ইত্যাদি বলি দেয়া প্রচলন ছিল। যদিও বৌদ্ধ বিশ্বাসমতে পশুবলি সর্ম্পূণ নিষিদ্ধ। পার্বত্য অঞ্চলে বৌদ্ধধর্মের নবজাগরণকারী বৌদ্ধভিক্ষু পরম পূজ্য সাধনানন্দ মহাস্থবির বনভন্তের অক্লান্ত পরিশ্রমে এসব কুসংস্কার বর্তমানে প্রায় নেই বললেই চলে। চাকমারা নিজেদের গৌতম বুদ্ধের জন্মকুল সাক্যবংশের মানুষ মনে করে।

মুল নিবন্ধ চাকমা ভাষা

চাকমা মূল কথ্য ভাষা আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। কিছু চাকমার কথার মধ্যে প্রতিবেশী চাঁটগাঁইয়া উপভাষার সাথে সামঞ্জস্য লক্ষ্য করা যায়, যেটি মূলত পূর্ব ইন্দো-আর্যীয় ভাষা বংশের একটি উপভাষা এবং এটি আসামী ভাষার সাথে সম্পর্কযুক্ত। অনেক ভাষাবিদ মনে করেন, আধুনিক চাকমা ভাষা (চাংমা ভাজ অথবা চাংমা হধা নামে পরিচিত) পূর্ব ইন্দো-আরিয়ান ভাষার অংশ। চাকমা ভাষার লিখিত হয় এর নিজস্ব লিপি চাকমা লিপিতে।

সংস্কৃতি

[সম্পাদনা]

চাকমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, লোক সাহিত্য, সাহিত্য ও ঐতিহ্য আছে। চাকমা মেয়েরা কোমর জড়ানো গোড়ালি পর্যন্ত পোশাক পরে যাকে পিনোন বলা হয়। কোমরের উপর অংশকে বলা হয় হাদি। হাদি আর পিনোন সাধারণত রঙবেরঙের বিভিন্ন নকশার হয়। পুরুষরা "সিলুম" নামক গায়ের জামা এবং "টেন্নে হানি" নামক জামা পরিধান করে। এই নকশা প্রথমে আলাম নামে পরিচিত এক টুকরা কাপড়ের উপর সেলাই করা হয়।

চাকমাদের সবচেয়ে বড় জাতিগত উৎসব বিজু। বাংলা বছরের শেষ দুদিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন এ উৎসব পালন করা হয়। বাংলা বছরের শেষ দিনের আগের দিনকে বলা হয় ফুল বিজু এবং শেষ দিনকে বলা হয় চৈত্র সংক্রান্তি বা মূল বিঝু। মূল বিঝুর দিন সকাল বেলা চাকমারা ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করে ফুল দিয়ে সাজায়, বুড়ো-বুড়িদের গোসল করায় এবং তাদেরকে নতুন কাপড় দেয়। রাতে বসে পরের দিনের পাচন তরকারি রান্নার জন্য সবজি কাটতে বসে যা কমপক্ষে ৫টি এবং বেশি হলে ৩২ রকম সবজি মিশেলে রান্না করা হয়। পরের দিন মূল বিঝু, এদিন চাকমা তরুণ-তরুণীরা খুব ভোরে উঠে কলা পাতায় করে কিছু ফুল গঙ্গার উদ্দেশ্যে নদীর পাড়ে দেয়া হয়। তারপর সবাই বিশেষ করে ছোটোরা নতুন জামা-কাপড় পরে বাড়ি বাড়ি ঘুরতে থাকে। তবে গ্রাম গুলোতে প্রাচীনকালের মতোন করে"ঘিলে হারা"(খেলা) হয়। পরের দিন নতুন বছর বা গয্যে পয্যে, নতুন বছরের দিন সবাই বৌদ্ধ মন্দিরে যায়, খাবার দান করে, ভালো কাজ করে, বৃদ্ধদের কাছ থেকে আশীর্বাদ নেয়। বুদ্ধ পূর্ণিমা উল্লেখ্য চাকমা লোকসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধশালী। তাদের লোক কাহিনীকে বলা হয়উবগীদ। চাকমাদের তাল্লিক শাস্ত্র বা চিকিৎসা শাস্ত্র অনেক সমৃদ্ধ। আর বয়ন শিল্পে চাকমা রমণীদের সুখ্যাতি জগৎ জুড়ে।

ইদানীং বিঝুতে রেলি করা হয় । দেশ-বিদেশের অনেক লোক বিঝু রেলি যোগ দেওয়ার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে আসে ।

বিখ্যাত ব্যক্তি

[সম্পাদনা]

খাদ্য

[সম্পাদনা]

বাঁশের অঙ্কুর হল চাকমাদের ঐতিহ্যগত খাদ্য। তারা এটাকে “বাচ্ছুরি” নামে ডাকে এবং শ্রিম্প পেস্ট তাদের রান্নার ঐতিহ্যবাহী উপাদান। তারা এটাকে “সিদোল” বলে ডাকে। চাকমাদের প্রধান খাদ্য ভাত, ভুট্টা দ্বারা তৈরী খাদ্য, শাক-সবজি ও সরিষা। সবজির মধ্য রয়েছে রাঙা আলু, কুমড়া, তরমুজ, মাম্মারা (শশা)। চাকমারা শুকরের মাংস খেতে পছন্দ করে।

তথ্যসূত্র

[সম্পাদনা]
  1. Library of Congress Subject HeadingsI (13th সংস্করণ)। Cataloging Distribution Service, Library of Congress। ১৯৯০। পৃষ্ঠা 709। ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৩ ডিসেম্বর ২০১৬ 
  2. "Table 1.4 Ethnic Population by Group and Sex" (পিডিএফ)। Bangladesh Bureau of Statistics। ২০২১। পৃষ্ঠা 33। ১৫ মার্চ ২০২৩ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ নভেম্বর ২০২২ 
  3. "Table C-16 Population by Mother Tongue: India"www.censusindia.gov.inRegistrar General and Census Commissioner of India। ৪ জুন ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ আগস্ট ২০২২  See 'Chakma'. Since Chakma are not recorded as an ethnicity in all states where they live (such as Arunachal Pradesh) language is the best method to estimate their population in India.
  4. https://portal.moea.gov.mm/ethnicity/C-0004/7
  5. ABM Razaul Karim Faquire (৪ জানুয়ারি ২০১৯)। "The mystery behind creation of Chakma speech variety"The Financial Express (ইংরেজি ভাষায়)। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ 
  6. ABM Razaul Karim Faquire (৪ জানুয়ারি ২০১৯)। "The mystery behind creation of Chakma speech variety"The Financial Express (ইংরেজি ভাষায়)। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ 
  7. Sharon O'Brien (২০০৪)। "The Chittagong Hill Tracts"। Shelton, Dinah। Encyclopedia of Genocide and Crimes against Humanity। Macmillan Library Reference। পৃষ্ঠা 176–177। 
  8. "Hidden Bangladesh: Violence and Brutality in the Chittagong Hill Tracts."Amnesty International UK। ২১ আগস্ট ২০১৫। ১৮ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ 
  9. Gutman, Pamela-Ancient Arakan, 1976, Australian National University Press. P. 14
  10. Buchanan, Francis (১৯৯২)। Francis Buchanan in Southeast Bengal। Dhaka University Press। পৃষ্ঠা 104। আইএসবিএন 984-05-1192-0 
  11. Gazi, Nurun Nahar; Tamang, Rakesh; Singh, Vipin Kumar; Ferdous, Ahmed; Pathak, Ajai Kumar; Singh, Mugdha; Anugula, Sharath; Veeraiah, Pandichelvam; Kadarkaraisamy, Subburaj (২০১৩-১০-০৯)। O'Rourke, Dennis, সম্পাদক। "Genetic Structure of Tibeto-Burman Populations of Bangladesh: Evaluating the Gene Flow along the Sides of Bay-of-Bengal"PLoS ONE (ইংরেজি ভাষায়)। 8 (10): e75064। আইএসএসএন 1932-6203ডিওআই:10.1371/journal.pone.0075064পিএমআইডি 24130682পিএমসি 3794028অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  12. Sir Arthur P. Phayre, Chief Comissioner of Burma, History of Burma, P. 79
  13. "Biblioteca Nacional de Portugal"catalogo.bnportugal.pt। সংগ্রহের তারিখ ২০২০-০৯-০৯ 
  14. চাকমা, সুগত (১৯৯৩)। পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতি ও সংস্কৃতি। Dhīrā Khīsā Cākamā। পৃষ্ঠা ১৯–২০। 
  15. Majumdar R.c. (১৯৭৪)। The Mughul Empire 
  16. Saradindu Shekhar Chakam, Ethnic Cleansing in Chittagong Hill Tracts, P. 23
  17. Minahan, James (২০০২-০৫-৩০)। Encyclopedia of the Stateless Nations: Ethnic and National Groups Around the World A-Z [4 Volumes] (ইংরেজি ভাষায়)। ABC-CLIO। আইএসবিএন 9780313076961 
  18. Government of Bangladesh - District Gazetteer of Chittagong Hill Tracts P. 35
  19. Suniti Bhushan Qanungo (১৯৯৮)। Chakma Resistance to British Domination 1772–1798। Chittagong: Suniti Bhushan Qanungo। পৃষ্ঠা 52। ওসিএলসি 54822598 
  20. Dr. Suniti Vushan Kanongo, Professor of History, University of Chittagong, Chakma Resistence to British Domination :1972-1978. P. 52
  21.  
  22. বিরাজ মোহন দেওয়ান, চাকমা জাতির ইতিবৃত্ত, প. ১৯৫
  23. S. P. Talukdar, Chakmas : Life & Struggle, P. 35
  24. Supreme Court of India orders to grant indian citizenship rights to Chakmas & Hajongs in 3 months, 1, Law Street, 17 September2015
  25. Gutman, Pamela (১৯৭৬)। Ancient Arakan। Australian National University Press। পৃষ্ঠা 14।