চান্দ্র দক্ষিণ মেরু হল চাঁদের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত অঞ্চল। এই অঞ্চলটিকে ঘিরে থাকা চির অন্ধকারময় অভিঘাত খাদগুলিতে জলীয় বরফের অস্তিত্বের সম্ভাবনা আছে বলেই চান্দ্র দক্ষিণ মেরু বিজ্ঞানীদের কাছে বিশেষ আগ্রহের বিষয়। এখানে এমন কিছু অভিঘাত খাদ আছে, যেগুলির অভ্যন্তরে প্রায়-স্থির সূর্যালোক প্রবেশই করতে পারে না। এই ধরনের খাদগুলি শীতল ফাঁদ নামে পরিচিত, যেখানে আদি সৌরজগতের সময় থেকে হাইড্রোজেন, জলীয় বরফ ও অন্যান্য উদ্বায়ী পদার্থ ফসিলের আকারে আবদ্ধ হয়ে রয়েছে।[১][২] অপরপক্ষে চান্দ্র উত্তর মেরু অঞ্চলে এই ধরনের অন্ধকারাচ্ছন্ন অভিঘাত খাদের সংখ্যা অনেক কম। [৩]
চান্দ্র দক্ষিণ মেরুর অবস্থান চাঁদের মেরু অঞ্চলের অ্যান্টার্কটিক চক্রের (৮০°দ থেকে ৯০°দ) কেন্দ্রভাগে।[২][৪] (অক্ষের আবর্তন গ্রহণরেখার তল থেকে ৮৮.৫ ডিগ্রি।) কয়েক কোটি বছর আগে চান্দ্র দক্ষিণ মেরু তার আদি অবস্থান থেকে ৫.৫ ডিগ্রি সরে যায়।[৫] এই পরিবর্তনের ফলে[৬] চাঁদের আবর্তন অক্ষটিরও পরিবর্তন হয়েছে। এর ফলে ইতিপূর্বে ছায়াচ্ছন্ন এলাকাগুলিতে সূর্যালোক প্রবেশ করতে পেরেছে। তবু চান্দ্র দক্ষিণ মেরুতে এখনও কয়েকটি সম্পূর্ণ ছায়াচ্ছন্ন অঞ্চল রয়ে গিয়েছে। অপরপক্ষে মেরু অঞ্চলে এমন কিছু এলাকাও রয়েছে যা স্থায়ীভাবে সূর্যালোকের অভিমুখী হয়ে পড়েছে। চান্দ্র দক্ষিণ মেরি অঞ্চলে অনেক অভিঘাত খাদ ও অববাহিকা (যেমন দক্ষিণ মেরু-এইটকেন অববাহিকা, যেটি চাঁদের সর্বাধিক মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলির একটি),[৭] এবং পর্বত (যেমন ৯.০৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় অবস্থিত এপসিলোন শৃঙ্গ, যা পৃথিবীর যে কোনও পর্বতের চেয়েও উঁচু) রয়েছে। চান্দ্র দক্ষিণ মেরু অঞ্চলের গড় তাপমাত্রা ২৬০ kelvin (−১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস; ৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট).[৭]
চাঁদের আবর্তন অক্ষ দ্বারা চিহ্নিত দক্ষিণ মেরু অঞ্চলটি শ্যাকলটন অভিঘাত খাদের মধ্যে পড়ে। চান্দ্র দক্ষিণ মেরুর নিকটবর্তী উল্লেখযোগ্য অভিঘাত খাদগুলি হল দে গারল্যাশ, স্ভেরদ্রুপ, শুমেকার, ফউসতিনি, হাওর্থ, নোবাইল ও ক্যাবেয়াস।
চান্দ্র দক্ষিণ মেরু এমনটি অঞ্চল যেখানে অভিঘাত খাদের প্রান্তভাগগুলি প্রায়-স্থায়ী সৌর বিচ্ছুরণের অভিমুখী অবস্থায় থাকে, এদিকে খাদগুলির অভ্যন্তরভাগ স্থায়ীভাবে সূর্যালোক থেকে বঞ্চিত। এই অঞ্চলের আলোক-বিচ্ছুরণ লুনার রিকনিসনস অরবিটরের প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে উচ্চ-রেজোলিউশনের ডিজিট্যাল মডেলের মাধ্যমে পর্যালোচিত হয়েছে।[৮] চান্দ্র পৃষ্ঠভাগ শক্তিশালী নিষ্ক্রিয় পরমাণু হিসেবে সৌর বায়ু প্রতিফলিত করতে পারে। গড়ে এই পরমাণুর ১৬ শতাংশ প্রোটন দ্বারা গঠিত। তবে এই পরিমাণ অঞ্চল ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়। চাঁদের পৃষ্ঠতলস্থ প্লাজমা যে পরিমাণে প্রতিফলিত হয়, তার ফলে এই পরমাণুগুলি ব্যাকস্ক্যাটারড হাইড্রোজেন পরমাণুর একটি সম্মিলিত স্রোত সৃষ্টি করে। এছাড়া এগুলি চাঁদের পৃষ্ঠতলে এই নিষ্ক্রিয় পরমাণু-সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলির মধ্যে রেখা সীমানা ও চৌম্বক গতিটিকেও প্রকাশ করে।[৯]
শীতল ফাঁদ হল চান্দ্র দক্ষিণ মেরুর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান, যেখানে জলীয় বরফ বা অন্যান্য সঞ্চিত উদ্বায়ী পদার্থ পাওয়া সম্ভব। শীতল ফাঁদগুলিতে যে জল ও বরফ সঞ্চিত থাকে, তার আদি উৎস ধূমকেতু, উল্কা ও সৌর বায়ু-জনিত লৌহহ্রাস। পরীক্ষানিরীক্ষা ও নমুনা পর্যালোচনা করে বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে আসতে সক্ষম হয়েছেন যে, শীতল ফাঁদগুলিতে বরফ থাকে। হাইড্রক্সিলও এই ধরনের ফাঁদগুলিতে পাওয়া যায়। এই দুই উপাদানের আবিষ্কারের ফলে চান্দ্র মেরুগুলিতে বিশ্বব্যাপী অবলোহিত অনুসন্ধানের মাধ্যমে অভিযান শুরু হয়। এই ধরনের ফাঁদগুলিতে বরফ আটকে থাকার কারণ চাঁদের তাপমাত্রা-সংক্রান্ত অবস্থাটি, যা ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সূর্যালোক, তাপ পুনর্বিচ্ছুরণ, অভ্যন্তরীণ তাপ এবং পৃথিবী থেকে প্রতিফলিত আলোক প্রভৃতি তাপভৌতিক বিষয়গুলির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।[১০]
চাঁদের পৃষ্ঠভাগে এমন কিছু জায়গা আছে যেখানে পৃষ্ঠতল চৌম্বকায়িত হয়ে রয়েছে। এগুলিকে চৌম্বকীয়ভাবে অস্বাভাবিক বলে মনে করা হয়। এই ধরণের চৌম্বকপৃষ্ঠ সৃষ্টির কারণ সেইসব সংঘাতের ফলে স্থাপিত ধাতব লোহা, যা দক্ষিণ মেরু—এইটকেন অববাহিকা (এসপিএ অববাহিকা) সৃষ্টির জন্য দায়ী। অবশ্য অববাহিকার মধ্যে লোহার যে কেন্দ্রীভবন হয়েছে বলে মনে করা হয়, তা ম্যাপিংগুলিতে পাওয়া যায় না। কারণ চাঁদের পৃষ্ঠতলের এত গভীরে এগুলির অবস্থান যে ম্যাপিং তা শনাক্ত করতে পারে না। আবার এই চৌম্বকীয় অস্বাভাবিকতা সৃষ্টির পিছনে অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে, যার সঙ্গে ধাতব চরিত্রের কোনও সম্পর্ক নেই। আবিষ্কারগুলিও অপর্যাপ্ত বলে প্রমাণিত হয়েছে। কারণ ব্যবহৃত মানচিত্রগুলির মধ্যে অসামঞ্জস্য রয়েছে, আর তাছাড়াও এগুলি চাঁদের পৃষ্ঠভাগে চৌম্বক অস্থিরতার বিস্তারটিকে শনাক্ত করতে পারেনি।[১১]
বিভিন্ন দেশের অরবিটর চান্দ্র দক্ষিণ মেরু অঞ্চলটি অনুসন্ধান করেছে। লুনার অরবিটর, ক্লিমেনটাইন, লুনার প্রসপেক্টর, লুনার রিকনিসনস অরবিটর, কাগুয়া ও চন্দ্রযান-১ এই অঞ্চলে বিশেষ পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে এবং চান্দ্র জলের উপস্থিতি আবিষ্কার করেছে, নাসার এলসিআরওএসএস মিশন ক্যাবেয়াস অভিঘাত খাদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পরিমাণে জল আবিষ্কার করেছে।[১২] এলসিআরওএসএস মিশনটি ইচ্ছাকৃতভাবে ক্যাবেয়াসের পৃষ্ঠভাগে ভেঙে পড়ে এবং সেখান থেকে প্রাপ্ত নমুনায় দেখা যায় প্রায় ৫ শতাংশ জল তাতে রয়েছে।[১৩]
২০০৯ সালের ১৮ জুন লুনার রিকনিসনস অরবিটর (এলআরও) নাসা কর্তৃক উৎক্ষেপিত হয় এবং এটি এখনও চান্দ্র দক্ষিণ অঞ্চলে ম্যাপিং করে চলেছে। এই মিশনটির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা দেখতে সক্ষম হবেন উক্ত অঞ্চলে কর্মীসহ একটি স্থায়ী স্টেশন স্থাপন করার উপযুক্ত যথেষ্ট রসদ আছে কিনা। এলআরও-র সঙ্গে ডিভাইনার লুনার রেডিওমিটার এক্সপেরিমেন্ট রয়েছে, যা দক্ষিণ মেরুর পৃষ্ঠদেশের বিকিরণ ও তাপ-ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যগুলি পর্যবেক্ষণ করবে। এটি প্রতিফলিত সৌর বিকিরণ ও অভ্যন্তরিণ অবলোহিত নিক্ষেপও শনাক্ত করতে পারে। পৃষ্ঠতলের কোথায় জলীয় বরফ বন্দী হয়ে আছে তাও শনাক্ত করতে সক্ষম এলআরও ডিভাইনার। [১০]
লুনার ক্রেটার অবজারভেশন অ্যান্ড সেন্সিং স্যাটেলাইট (এলসিআরওএসএস) ছিল নাসা-পরিচালিত একটি রোবোটিক মহাকাশযান। চাঁদের মেরু অঞ্চল দু’টিতে হাইড্রোজেনের প্রকৃতি শনাক্তকরণের একটি কম খরচার মিশন হিসেবে এটিকে চিহ্নিত করা হয়েছিল।[১৪] চন্দ্রযান-১ কর্তৃক চান্দ্র জল আবিষ্কারের অব্যবহিত পরেই এই মিশনটি উৎক্ষেপিত হয়।[১৫] প্রধান এলসিআরওএসএস মিশনের উদ্দেশ্য ছিল চান্দ্র মেরু অঞ্চলের কাছে একটি চির-ছায়াচ্ছন্ন অভিঘাত খাদে বরফের আকারে জলের অস্তিত্ব আছে কিনা তা নিয়ে আরও অনুসন্ধান চালানো।[১৬] লুনার রিকনিসনস অরবিটর (এলআরও) ও তার সেন্ট্যুর আপার স্তরের সঙ্গে এটি উৎক্ষেপিত হয়। চাঁদের দক্ষিণ মেরুর অভিঘাত খাদ ক্যাবিয়াসে জলের অস্তিত্ব নিশ্চিত করতে সফল হয় এই মিশন।[১৭]
ভারতের জাতীয় মহাকাশ সংস্থা ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গ্যানাইজেশন (ইসরো) মুন ইমপ্যাক্ট প্রোব (এমআইপি) প্রস্তুত করে। ২০০৮ সালের ২২ অক্টোবর উৎক্ষেপিত ইসরোর চন্দ্রযান-১ লুনার রিমোট সেন্সিং অরবিটর এই লুনার প্রোবটিকে ছেড়েছিল। ওই বছর ১৪ নভেম্বর ভারতীয় সময় রাত আটটা ছয় মিনিটে চন্দ্র-পরিক্রমাকারী চন্দ্রযান-১ থেকে এমআইপি বিচ্ছিন্ন হয় এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রায় পঁচিশ মিনিটে এটি শ্যাকলটন অভিঘাত খাদের প্রান্তভাগের কাছে অবতরণ করে। এই মিশনের মাধ্যমে ভারত প্রথম চান্দ্র দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করতে সক্ষম হয়।
২০২৩ সালের ১০ অগস্ট রাশিয়া তার লুনা ২৫ লুনার ল্যান্ডার উৎক্ষেপন করে।[১৮] চাঁদে পৌঁছাতে লুনা ২৫-এর পাঁচ দিন সময় লাগে, তারপর এটি আরও পাঁচ থেকে সাত দিন চাঁদকে প্রদক্ষিণ করে। পরিকল্পনা ছিল মহাকাশযানটি চান্দ্র দক্ষিণ মেরুতে বোগাললোস্কি অভিঘাত খাদের কাছে নামবে। লুনা ২৫ একটি "আপদকালীন পরিস্থিতি" সৃষ্টি করে, যেটি ঘটে প্রাক্-অবতরণ প্রদক্ষিণের সময় প্রোবটির লঘুকরণের সময়। ২টো ৫৭ মিনিটে (১১:৫৭ জিএমটি) লুনার ল্যান্ডারটির সঙ্গে যোগাযোগ হঠাৎ করে ছিন্ন হয়ে যায়। লুনা ২৫ ছিল শুধুমাত্র একটি ল্যান্ডার। এটির প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল অবতরণের প্রযুক্তিটি প্রমাণ করা। মিশনটি ৩০ কিলোগ্রাম (৬৬ পাউন্ড) বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বহন করে নিয়ে গিয়েছিল, যার মধ্যে ছিল মাটির নমুনা সংগ্রহের একটি রোবোটিক বাহু এবং মাটি খোঁড়ার যন্ত্রপাতি।[১৯] লুনা ২৫ উৎক্ষেপিত হয়েছিল ভোস্তোকনি কসমোড্রোম থেকে ফ্রেগাট উচ্চ স্তর সহ একটি সোয়াজ-২.১বি রকেটের মাধ্যমে।[২০][২১]
২০২৩ সালের ২৩ অগস্ট বৈশ্বিক সময় ১২টা ৩৪ মিনিটে ভারতের চন্দ্রযান-৩ প্রথম চন্দ্র অভিযান হিসেবে চান্দ্র দক্ষিণ মেরুর কাছে একটি সফট ল্যান্ডিং-এ সমর্থ হয়। এই মিশনে একটি ল্যান্ডার ও বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি বহনের জন্য একটি রোভার পাঠানো হয়েছিল।[২২]
আইএম-১ ওডিসিয়াস ল্যান্ডার ছয় দিনে পৃথিবী থেকে যাত্রা করে চাঁদে পৌঁছায়। চাঁদের কাছাকাছি আসার পর ল্যান্ডারটি পৃথিবীর এক দিনের প্রায় সমান সময় আরও নেয় চাঁদ প্রদক্ষিণের জন্য। তাই ২০২৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বৈশ্বিক সময় ১১টা ২৪ মিনিটে ল্যান্ডারটি চাঁদে অবতরণ করে।[২৩][২৪] মিশনটির প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল চান্দ্র দক্ষিণ মেরু থেকে প্রায় ৩০০ কিলোমিটার (১৯০ মাইল) দূরে মালাপার্ট-এ অভিঘাত খাদে অবতরণের।[২৫][২৬] এটি একুশ শতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম চন্দ্রাভিযান।
<ref>
ট্যাগ বৈধ নয়; set
নামের সূত্রটির জন্য কোন লেখা প্রদান করা হয়নি
Updated 12:49 AM EDT, August 24, 2023.