চিকুনগুনিয়া হচ্ছে চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (CHIKV) দ্বারা সৃষ্ট একটি সংক্রমণ।[২] এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশের দুই থেকে চার দিনের মধ্যে আকস্মিক জ্বর শুরু হয় এবং এর সাথে অস্থিসন্ধিতে ব্যথা থাকে যা কয়েক সপ্তাহ, মাস বা বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।[৩][৪][৫] এই রোগে মৃত্যু ঝুঁকি প্রতি দশ হাজারে এক জন বা এর চেয়েও কম তবে বয়স্কদের ক্ষেত্রে এই রোগের জটিলতা তুলনামূলক বেশি হয়।[৬]
এই ভাইরাসটি মশার কামড়ের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করে। এডিস গণের দুটি প্রজাতি এডিস ইজিপ্টি ও এডিস এলবোপিকটাস এই ভাইরাসের বাহক হিসেবে পরিচিত।[৭][৮] তারা মূলত দিনের আলোতে কাঁমড় দিয়ে থাকে। মানুষ ছাড়াও কয়েকটি প্রাণী বানর, পাখি, তীক্ষ্ণ দন্ত প্রাণী যেমন ইঁদুরে এই ভাইরাসের জীবনচক্র বিদ্যমান।[৯] রোগ সাধারণত রক্ত পরীক্ষা করে ভাইরাসের আরএনএ বা ভাইরাসের এন্টিবডির মাধ্যমে নির্ণয় করা হয়। এই রোগের উপসর্গকে অনেক সময় ডেঙ্গু জ্বর এবং জিকা জ্বরের সাথে ভুল করে তুলনা করা হয়। একক সংক্রমণের পর এটি বিশ্বাস করা হয় যে, বেশিরভাগ মানুষই অনাক্রম্য হয়ে পড়ে। এখানেই ডেঙ্গু ভাইরাসের সাথে এর পার্থক্য কারণ ডেঙ্গু ভাইরাস শুধু স্তন্যপায়ীদের আক্রান্ত করে।[১০]
এই রোগ প্রতিরোধের প্রধান উপায় হলো মশা নিয়ন্ত্রণ এবং যেসব এলাকায় এ রোগের ঘটনা সাধারণত ঘটেছে সেসব স্থান পরিত্যাগ করা।[১১] পানি আছে এমন স্থানে মশা কমানো এবং পোকামাকড় প্রতিরোধক ব্যবস্থা ও মশারি ব্যাবহারের মাধ্যমে এর প্রাদুর্ভাব কমানো যেতে পারে। ২০১৬ সাল নাগাদ, এই রোগের কোন প্রতিষেধক বা চিকিৎসা আবিষ্কার হয়নি।[২] সাধারণত, জ্বর এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা কমানোর জন্য বিশ্রাম, তরল খাবার গ্রহণ এবং সাধারণ জ্বরের ঔষধ সেবনের পরামর্শ দেওয়া হয়।[২]
যদিও চিকনগুনির প্রাদুর্ভাব সাধারণত এশিয়া ও আফ্রিকাতে বেশি দেখা যায় তবে প্রতিবেদন অনুসারে ২০০০-এর দশকে এটি ইউরোপ ও আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৪ সালে এক মিলিয়নের বেশি মানুষ আক্রন্ত হয়েছে।[২] ২০১৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী এটি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডাতে দেখা গেছে কিন্তু ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে স্থানীয়ভাবে এই রোগের প্রভাব দেখা যায়নি।[১২][১৩] তানজানিয়াতে ১৯৫২ সালে প্রথম রোগটি ধরা পরে।[২] চিকনগুনিয়া নামটি এসেছে তানজানিয়ার মাকুন্দি জনগোষ্ঠির ব্যবহৃত কিমাকুন্দি ভাষা থেকে যার অর্থ "কুঁচিত হওয়া" বা বাঁকা হয়ে যাওয়া।[২] ২০০৮ সালের দিকে বাংলাদেশের রাজশাহী এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রথম এ রোগের ভাইরাসটি ধরা পরে। পরবর্তীতে ২০১১ সালে ঢাকার দোহারে এটি লক্ষ্য করা গেলেও এরপর তেমনভাবে এ ভাইরাসের কথা শোনা যায়নি তবে ২০১৭ সালের প্রথমদিকে সারাদেশে ভাইরাসটি উল্লেখযোগ্য হারে লক্ষ করা যায়।[১৪]
এই ভাইরাসের সুপ্তিকাল এক থেকে বারো দিন তবে বেশিভাগ ক্ষেত্রে তা তিন থেকে সাত দিন পর্যন্ত থাকে।[১৫]
অনেক সময় এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলেও কোনো উপসর্গ প্রকাশ পায় না। সাধারণত ৭২-৯৭% ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা দেয়।[১৫] রোগটি সাধারণত আকস্মিক উচ্চমাত্রার জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা ও ফুসকুড়ি নিয়ে শুরু হয়। ফুসকুড়ি রোগের শুরুতেই দেখা দিতে পারে তবে অনেক সময় রোগ শুরু হওয়ার দুই থেকে তিন দিন পর জ্বর কমতে শুরু করলে ফুসকুড়ির আবির্ভাব হয়।[৩] এছাড়া অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, পেটব্যথা, ফটোফোবিয়া বা আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা, কনজাংটিভাইটিস।[১৬] বড়দের আর্থ্রাইটিস বা জয়েন্টে প্রদাহ হতে পারে।
সাম্প্রতিক এ ভাইরাস সংক্রান্ত মহামারি থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, চিকুনগুনি জ্বরের ফলে ক্রনিক পর্যায়ে ছাড়া তীব্র অসুস্থতাও হতে পারে। তীব্র অসুস্থতার পর্যায়কে দুটি ভাগে ভাগ করা হয়েছে: পাঁচ থেকে সাত দিনের মধ্যে এর প্রথম পর্যায়ে ভাইরাস রক্তের মধ্যে প্রবেশ করে[১৭], পরবর্তীতে শেষ ধাপে স্বাস্থ্য পুনরূদ্ধারকারী পর্যায়ে পৌঁছায় যে সময়টি দশ দিন স্থায়ী হয়। এ পর্যায়ে ভাইরাস রক্তে শনাক্ত করা যায় না।[১৫] সাধারণত এই রোগটি শুরু হয় হঠাৎ করেই শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে যা সাত থেকে দশ দিন পর্যন্তও স্থায়ী হয়। জ্বর সাধারণত ৩৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০২ ডিগ্রি ফারেনহাইট) বা মাঝে মাঝে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট) পর্যন্ত হয়ে থাকে—কয়েকদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয় এবং আস্তে আস্তে কমতে থাকে। রক্তে ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সাথে জ্বর আসে এবং রক্তে ভাইরাসটির মাত্রা যতই তীব্র পর্যায়ে পৌঁছায় লক্ষণগুলির তীব্রতাও সাথে সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে।[১৭] ভাইরাসটির রক্তে প্রবেশের পর যখন আইজিএম নামে একটি এন্টিবডি রক্তস্রোতের মধ্যে বাইরের থেকে প্রবিষ্ট রোগজীবাণু-প্রতিরোধক পদার্থ সৃষ্টি করে তখন এর প্রভাব কমতে শুরু করে। যাইহোক, মাথা ব্যথা, অনিদ্রা এবং তীব্র অবসাদ সাধারণত পাঁচ থেকে সাত দিন থেকে যায়।[১৮]
চিকুনগুনিয়া ভাইরাস টোগাভাইরিডি পরিবারের আলফাভাইরাস গণের অন্তর্ভুক্ত একটি RNA ভাইরাস।[২০]
এটি সেমলিকি ফরেস্ট ভাইরাস কমপ্লেক্স এর সদস্য এবং রস রিভার ভাইরাস, ও'নিয়ং'নিয়ং ভাইরাস ও সেমলিকি ফরেস্ট ভাইরাসের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। [২১] যেহেতু এটা আর্থ্রোপড যেমন মশার মাধ্যমে ছড়ায় তাই একে আর্বোভাইরাসও বলে।[২২]
এই রোগের বিরুদ্ধে কার্যকরী অনুমোদিত কোনো টিকা নেই। মশা নিয়ন্ত্রণ ও ঘুমানোর সময় মশারি টাঙিয়ে ঘুমানো, লম্বা হাতলযুক্ত জামা ও ট্রাউজার পরে থাকা, বাড়ির আশেপাশে পানি জমতে না দেয়া ইত্যাদি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। শুধু স্ত্রী মশা দিনের বেলা কামড়ায়। এরা একবারে একের অধিক ব্যক্তিকে কামড়াতে পছন্দ করে। একবার রক্ত খাওয়া শেষে ডিম পাড়ার পূর্বে তিন দিনের বিশ্রামের প্রয়োজন হয়।এদের ডিমগুলো পানিতে এক বছর পর্যন্ত বাঁচতে পারে।অল্প পরিমাণ জমে থাকা পানিও ডিম পরিস্ফুটনের জন্য যথেষ্ট।এডিস মশা স্থির পানিতে ডিম পাড়ে তাই বালতি, ফুলের টব, গাড়ির টায়ার প্রভৃতি স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।[২৫]
↑Staples JE, Fischer M (২০১৪)। "Chikungunya virus in the Americas--what a vectorborne pathogen can do"। N. Engl. J. Med. (ইংরেজি ভাষায়)। 371 (10): 887–9। ডিওআই:10.1056/NEJMp1407698। পিএমআইডি25184860।
↑Fischer M, Staples JE (৬ জুন ২০১৪)। "Notes from the Field: Chikungunya Virus Spreads in the Americas - Caribbean and South America, 2013-2014."। MMWR. Morbidity and mortality weekly report (ইংরেজি ভাষায়)। 63 (22): 500–501। পিএমআইডি24898168।
↑Chhabra M, Mittal V, Bhattacharya D, Rana U, Lal S (২০০৮)। "Chikungunya fever: a re-emerging viral infection"। Indian J Med Microbiol (ইংরেজি ভাষায়)। 26 (1): 5–12। ডিওআই:10.4103/0255-0857.38850। পিএমআইডি18227590।
↑Weaver, Scott C; Osorio, Jorge E; Livengood, Jill A; Chen, Rubing; Stinchcomb, Dan T (২০১২)। "Chikungunya virus and prospects for a vaccine"। Expert Review of Vaccines (ইংরেজি ভাষায়)। 11 (9): 1087–1101। আইএসএসএন1476-0584। ডিওআই:10.1586/erv.12.84।
↑"Chikungunya Virus Infections"। New England Journal of Medicine (ইংরেজি ভাষায়)। 373: 93–95। ডিওআই:10.1056/NEJMc1505501।
↑Caglioti C, Lalle E, Castilletti C, Carletti F, Capobianchi MR, Bordi L (জুলাই ২০১৩)। "Chikungunya virus infection: an overview."। The new microbiologica (ইংরেজি ভাষায়)। 36 (3): 211–27। পিএমআইডি23912863।
"Chikungunya" (ইংরেজি ভাষায়)। রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য ইউরোপীয় কেন্দ্র। ২৩ জানুয়ারি ২০০৮। ৫ আগস্ট ২০০৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২০ মে ২০১৩।