চীনের মহাদুর্ভিক্ষ 三年大饑荒 | |
---|---|
দেশ | গণপ্রজাতন্ত্রী চীন |
অবস্থান | মেইনল্যান্ড চীন |
সময়কাল | ১৯৫৯–১৯৬১ |
মোট মৃত্যু | ১.৫ কোটি (সরকারি পরিসংখ্যান) ১.৫ থেকে ৩ কোটি (গবেষকদের হিসাবমতে)[১] কমপক্ষে ৪.৫ কোটি (ডিকটার) |
পর্যবেক্ষণ | ফ্রাঙ্ক ডিকটারের মতে চীনের সবথেকে ধ্বংসাত্মক দুর্যোগ। সম্মুখগামী মহালম্ফ আন্দোলনের একটি অংশ। |
পরিণতি | সম্মুখগামী মহালম্ফ আন্দোলনে শেষ হয় |
চীনের তিন বছরের মহাদুর্ভিক্ষ (সরলীকৃত চীনা: 三年 大 饥荒; প্রথাগত চীনা: 三年 大 饑荒; ফিনিন: Sānnián dà jīhuāng সান্নিয়েন তা চিহুয়াং), চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মতে তিন বছরের প্রাকৃতিক দুর্যোগ (সরলীকৃত চীনা:三年 自然 灾害; প্রথাগত চীনা: 三年 自然 災害; ফিনিন: Sānnián zìrán zāihài সান্নিয়েন চিরান চাইহাই) তিন বছরের দুর্বিপাক (সরলীকৃত চীনা: 三年 困难 时期; প্রথাগত চীনা: 三年 困難 時期; ফিনিন: Sānnián kùnnán shíqī সান্নিয়েন খুন্নান শিছি) বা সম্মুখগামী মহালম্ফ দুর্ভিক্ষ হল ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে গণপ্রজাতন্ত্রী চীনে সংঘটিত ব্যাপক দুর্ভিক্ষের সময়। খরা, প্রতিকূল আবহাওয়া এবং চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নীতি এই দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী হলেও এর ফলশ্রুতিতেই "সম্মুখগামী মহালম্ফের" জন্ম হয়।
সরকারী পরিসংখ্যানমতে এই সময়ের মধ্যে ১ কোটি ৫০ লক্ষ বাড়তি মৃত্যু ঘটে। তবে এই সময়ে চীনা সরকার দৃঢ়ভাবে "সম্মুখগামী মহালম্ফের" বিরুদ্ধে থাকা বাজার সংস্কারক দ্বারা অধিগৃহীত হয়।[২] অপ্রাতিষ্ঠানিক অনুমানে নানা তারতম্য থাকা সত্ত্বেও পণ্ডিতরা অনুমান করেন যে দুর্ভিক্ষে পীড়িতদের সংখ্যা ২ কোটি থেকে ৪ কোটি ৩০ লক্ষের মধ্যে।[৩] ইতিহাসবিদ ফ্রাঙ্ক ডিকোটার, চীনা মহাফেজখানা বা আর্কাইভের বিভিন্ন উপকরণ পরীক্ষা করার বিশেষ অনুমতিপ্রাপ্ত হয়ে অনুমান করেন যে ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে চীনে অন্তত ৪ কোটি ৫০ লক্ষ লোকের অকাল মৃত্যু ঘটেছিল, যার বেশিরভাগই ঘটে অনাহারের ফলস্বরূপ।[৪][৫]
চীনা সাংবাদিক ইয়াং চিশেঙের মতে, এই দুর্ভিক্ষে অনাহারের কারণে একদিকে ৩ কোটি ৬০ লক্ষ লোক মারা যায়, অপরদিকে ৪ কোটি জন্মগ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়, ফলে "মহাদুর্ভিক্ষের সময় চীনের মোট জনসংখ্যার হ্রাস ঘটে ৭ কোটি ৬০ লক্ষ"।[৬] "তিনটি তিক্ত বছর" শব্দটি প্রায়ই চীনা কৃষকদের দ্বারা ব্যবহৃত হয় এই দুর্ভিক্ষের সময়কে বোঝাতে।[৭]
চীনের মহাদুর্ভিক্ষ ছিল প্রতিকূল আবহাওয়া, সামাজিক চাপ, অর্থনৈতিক অব্যবস্থা এবং সরকারী বিধান দ্বারা আরোপিত কৃষির আমূল পরিবর্তনের সংমিশ্রণ দ্বারা সৃষ্ট।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও সে তুং, চাষের ক্ষেত্রে খামারে ব্যক্তি মালিকানা বন্ধ করে বিরাট পরিবর্তন করেন। এই নীতি মেনে চলতে ব্যর্থ হলে নিপীড়নের শিকার হতে হত। নাগরিকদের ওপর আরোপিত সরকার নিয়ন্ত্রিত এই চাষ ও ব্যবসার পরিপ্রেক্ষিতে সামাজিক চাপ রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করে।সরকার পরিসংখ্যান অনুযায়ী এই সময়ের আইন এবং সম্মুখগামী মহালম্ফের (১৯৫৮-১৯৬২) দরুন প্রায় ৩ কোটি ৬০ লক্ষ মানুষ এই সময়ের মধ্যে মারা যায়।[৮]
১৯৮০ সাল পর্যন্ত চীনা সরকারের অবস্থান এই ব্যাপারে, যা "প্রাকৃতিক দুর্যোগের তিন বছর" নাম দ্বারা প্রতিফলিত, ছিল যে এই দুর্ভিক্ষ মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগের একাধারে আগমন এবং বিভিন্ন পরিকল্পনা ত্রুটির কারণেই শুরু হয়েছিল।কিন্তু চীন বাইরে গবেষকরা যুক্তি দেখান যে, সম্মুখগামী মহালম্ফের ফলে যে ব্যাপক প্রাতিষ্ঠানিক ও নীতি পরিবর্তন হয় তা ছিল দুর্ভিক্ষের মূল কারণ বা প্রাকৃতিক এই দুর্যোগের অবস্থার অবনতির জন্য দায়ী।[৯][১০] ১৯৮০ সাল থেকে চীনে এই দুর্যোগের জন্য নীতিগত ভুলকে স্বীকৃতিদান করে বলা হয়েছে যে, দুর্যোগের প্রাকৃতিক কারণ ছিল ৩০% এবং অব্যবস্থাজনিত কারণ ছিল ৭০%।[১১]
সম্মুখগামী মহালম্ফের সময় সমবায় চাষ চালু করা হয় এবং ব্যক্তিগত খামার চাষ নিষিদ্ধ করা হয়। লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদনকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল।লক্ষ লক্ষ কৃষকদের লৌহ ও ইস্পাত উৎপাদনে যোগদানের জন্য কৃষি কাজ থেকে দূরে যাবার আদেশ করা হয়েছিল।
ইয়াং চিশেং ২০০৮ সালে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রার প্রভাব সংক্ষেপে তুলে ধরেন:
জিনজিয়াং এ মানুষ শস্যগুদামের দরজার সামনে না খেতে পেরে মারা যেত।মারা যাবার সময় তারা চিৎকার করে বলৎ, "কমিউনিস্ট পার্টির চেয়ারম্যান মাও, বাঁচান।" হনান এবং হপেই-এর শস্যগুদাম তখন যদি খোলা হত, কেউ তাহলে মারা যেত না। চারপাশে এত মানুষ মারা যাচ্ছিল যে কর্মকর্তারা তাদের উদ্ধার করার জন্য কোন তাগাদা অনুভব করতেন না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল শস্য বিতরণ কীভাবে করা যায়।[১২]
যৌথচাষ ছাড়াও কেন্দ্রীয় সরকার সোভিয়েত সিওডোসায়েন্টিস্ট ট্রোফিম লাইসেঙ্কোর ধারণার উপর ভিত্তি করে কৃষিবিদ্যায় একাধিক পরিবর্তন সাধন করে।[১৩] এইসব ধারণার মাঝে একটি ছিল, বন্ধ আবাদ যার মাধ্যমে চারার ঘনত্ব প্রথমে তিনগুণ এবং তারপর আবার দ্বিগুন করা হত। তত্ব ছিল যে একই প্রজাতির উদ্ভিদ একে অপরের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে না। কিন্তু বাস্তবে তারা করে, যার ফলে বৃদ্ধি রোধ হয় এবং ফলন কমে যায়।
আরেকটি নীতি (যা "গভীর চাষ" নামে পরিচিত) ছিল লাইসেঙ্কোর সহকর্মী তেরেন্তি মাৎসেভের যার উপর ভিত্তি করে ১৫-২০ সেন্টিমিটার স্বাভাবিক চাষ গভীরত্ব পরিহার করে তার পরিবর্তে মাটির অত্যন্ত গভীরে (১ থেকে ২ মিটার) চাষ করতে চীন জুড়ে কৃষকদের উৎসাহিত করা হয়। গভীর চাষ তত্ত্বে বিবৃত হয় যে সবচেয়ে উর্বর মাটি পৃথিবীর গভীরে থাকে এবং অসাধারণভাবে গভীরে চাষ সম্ভব হলে অতিরিক্ত শক্তিশালী শিকড় বৃদ্ধি সম্ভব হবে।[১৪] যাইহোক, এই পদ্ধতিতে বেহুদা পাথর, মাটি, বালি উপরে আনা হয়, উর্বর পৃষ্ঠমৃত্তিকা দাফন করে এবং এর ফলে গুরুতরভাবে চারার বৃদ্ধি রোধ পায়।
একইভাবে মহা চড়ুই প্রচারনায় নাগরিকদের চড়ুই এবং অন্যান্য পাখি ধবংসের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয় শস্যক্ষেত্র রক্ষার জন্য। তাই কীটপতঙ্গখেকো পাখিদের হয় গুলি করে মারা হয় বা তাদের মাটিতে নামা থেকে বিরত করা হয়। এর ফলে পোকাদের (বিশেষত ফসল-খাদক পোকামাকড়) জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটে, যার কারণ ছিল তাদের শিকারী সংখ্যা হ্রাস।
চাষ সংগঠনে এই আমূল ক্ষতিকর পরিবর্তনের সাথে যুক্ত হয় খরা ও বন্যার মতো প্রতিকূল আবহাওয়ার সব নিদর্শন। ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসে হলুদ নদীর বন্যা পূর্ব চীন প্লাবিত করে। দুর্যোগ কেন্দ্রের মতে, এ বন্যায় সরাসরি ডুবে এবং ফসল ডুবার জন্য অনাহারে আনুমানিক ২০ লক্ষ মানুষ মারা যায় এবং তা অন্যান্য এলাকাকেও নানাভাবে প্রভাবিত করছিল। ফ্রাঙ্ক ডিকত্তের যুক্তি দেন যে অধিকাংশ বন্যা অস্বাভাবিক আবহাওয়ার কারণে ছিল না, বরং তাড়া ছিল সম্মুখগামী মহালম্ফের দুর্বল পরিকল্পিত এবং দুর্বল সেচ কাজের অংশ।
১৯৬০ সালে উত্তর চীনের কৃষি জমির আনুমানিক ৬০% সব সময়ে কোন না কোন বৃষ্টি পেয়েছিল।[১৫] ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সালের এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার বছরবইয়ে চীনা সরকার সূত্রের উপর ভিত্তি করে এছাড়াও অস্বাভাবিক আবহাওয়া রিপোর্ট, খরা ও বন্যার কথা লেখা হয়। ১৯৫৯ সালের জুনে পাঁচদিন জুড়ে হংকং বৃষ্টিস্নাত হয় যার পরিমাণ ছিল ৭৬০ মিলিমিটার এবং এর একটি অংশ দক্ষিণ চীনকেও আঘাত করে।[১৬]
এই কারণগুলির ফলে, চীনে বছরের পর বছর শস্য উৎপাদন কমতে থাকে। যেখানে ১৯৫৯ সালে ফসলের ফলন হ্রাস পায় ১৫% যা ১৯৬২ সালে হ্রাস পেয়ে দাড়ায় ১৯৫৮ সালের ৭০% এ। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত কোন পুনরুদ্ধার হয়নি এই অবস্থার,যা ছিল সম্মুখগামী মহালম্ফের শেষ।[১৭]
নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ এবং দুর্ভিক্ষের উপর বিশেষজ্ঞ অমর্ত্য সেনের মতে, বেশিরভাগ দুর্ভিক্ষই শুধু কম খাদ্য উৎপাদন থেকে তৈরি হয় না, বরং খাদ্যের একটি অনুপযুক্ত বা অদক্ষ বিতরণের জন্য তৈরি হয়, যা প্রায়ই তথ্যের অভাব এবং প্রকৃতপক্ষে ভুল তথ্যের জন্য সৃষ্ট হয়ে থাকে।[১৮] এই চীনা দুর্ভিক্ষের ক্ষেত্রে, শহুরে জনসংখ্যার জন্য (মাওবাদের নির্দেশনা অনুযায়ী), শস্য খরচের নির্দিষ্ট পরিমাণ আইনি অধিকার রক্ষা করা ছিল, কিন্তু গ্রামীণ কৃষক জনতার এমন কোন অধিকার দেওয়া হয়নি এবং অবিবেচনীয় উৎপাদন কোটার আওতায় ছিল, যার উদ্বৃত্তের উপর তারা বেঁচে ছিল।
গ্রামাঞ্চলের স্থানীয় কর্মকর্তাদের অতিমাত্রায় রিপোর্টে উৎপাদনের মাত্রা বেশি দেখানো হত তাদের অঞ্চলে যাতে তারা নতুন অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিক্রিয়ায় অর্জন করার জন্য প্রতিযোগিতা করত। ফলে স্থানীয় কৃষকদের সেই কোটা পুরনের জন্য তাদের উদ্বৃত্তের পরিমাণ কমানো লাগত এবং একসময় উদ্বৃত্ত কমতে কমতে নাই এর পর্যায়ে চলে যায়।যখন তারা অবশেষে শহরের ভোজনের জন্য কোটা পূরণ করতে ব্যর্থ হল, তখন চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তারা কৃষকদের অন্যায়ভাবে ব্যাপক স্ফীত উৎপাদন দ্বারা মজুদ, মুনাফাখোরি ও অন্যান্য বিপ্লবী ক্রিয়াকলাপের জন্য অভিযুক্ত করতে থাকল এবং প্রমাণ হিসেবে স্থানীয় নেতাদের বাড়ানো সব দলিলকে পেশ করল।
দুর্ভিক্ষের অবস্থা আরও খারাপের দিকে যেতে থাকলে, এই অভিযোগকে কেন্দ্র করে ব্যাপক নৃশংসতা চালনা করে (বৃহদায়তন শস্য বাজেয়াপ্ত সহ, ক্ষুধায় মারা যায় লক্ষ লক্ষ কৃষক) মাওবাদী দলের কর্মকর্তারা, যারা কৃষি নীতি এবং শস্য উৎপাদনের ব্যাপক ভুল হিসাবের দায়কে অন্যের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।সেই সময়ে, দুর্ভিক্ষের সব দায় একচেটিয়াভাবে "মানুষের শত্রু" এবং কৃষকদের মধ্যে "অসংশোধিত কুলাক পদার্থ" এর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় পদার যেখানে কৃষকদের মধ্যে চীনের শহরের মানুষদের তুলনায় তিনগুন হারে অনাহারের অবস্থা দেখা যায়।
স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ তাদের তাদের নিজস্ব জীবন ও অবস্থানের রক্ষা করার জন্য তাদের বিভিন্ন ভুলের দায় এড়াতে ষড়যন্ত্রের উপর দায় দেয়। বিখ্যাত উদাহরণস্বরূপ, মাও সেতুং এর দুর্ভিক্ষের সময় শানজী প্রদেশের একটি স্থানীয় কৃষি কমিউনে সফর নির্ধারিত ছিল অবস্থার মূল্যায়ন করার জন্য ; তার সফরের জন্য প্রস্তুতিহিসেবে স্থানীয় পার্টি কর্মকর্তারা অনাহারী কৃষকদের সাবধানে শত শত কাছাকাছি খামার থেকে হাত দ্বারা ট্রান্সপ্লান্ট করে ফসল এনে সাজিয়ে দেখানো হয়েছিল "মডেল ক্ষেত্রে", যা পরে প্রমাণ হিসেবে মাওকে দেখানো হয়েছিল যে ফসলের ফলন ব্যর্থ হয়নি।
ঠিক একইভাবে ১৯৩৩ সালে সোভিয়েতের বিশাল দুর্ভিক্ষে অভ্যন্তরীণ কারণের জন্য এবং সুবর্ণ অবরোধ (হলোডমোর ) এর কারণে ডাক্তারদের মৃত্যুর সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে 'অনাহার "তালিকাবদ্ধ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়। প্রতারণার এই ধরনের উদাহরণ বিরল ছিল না; দুর্ভিক্ষের একটি বিখ্যাত প্রচারণার ছবিতে দেখানো হয় যে, শানতুং প্রদেশের চীনা শিশুরা গম ক্ষেতের উপরে দাঁড়িয়ে আছে যাতে ফসল এত ঘন যে এটা দৃশ্যত তাদের ওজনকে বহন করতে পারছ। বাস্তবে, তারা একটি বেঞ্চের উপর দাঁড়িয়ে ছিল যা গাছপালার তলদেশে গোপনে রাখা ছিল এবং "ক্ষেত্র" টিও আবার সম্পূর্ণরূপে পৃথকভাবে রোপা ফসল দিয়ে গঠিত।
অমর্ত্য সেন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বলেন গণতন্ত্রের অভাব এর প্রধান দায়ী: " এ ধরনের সারগর্ভ দুর্ভিক্ষ কোন গণতান্ত্রিক দেশে ঘটেছে কিনা সন্দেহ, তা সে যতই গরীব হোক না কেন।" তিনি আরো বলেন যে "এটি কল্পনা করাও কঠিন যে এইধরনের একটা দেশে যেখানে নিয়মিত নির্বাচন হয় এবং যার একটি স্বাধীন প্রেস রয়েছে সেখানে এমন কোন কিছু ঘটতে পারে।[১৯] এই খারাপ সময়ে চলাকালীন সংবাদপত্র থেকে সরকার কোন চাপ পায়নি, কারণ তারা নিয়ন্ত্রিত হত সরকার দ্বারা এবং বিরোধী দলও ছিল অনুপস্থিত।" একটি পরস্পরবিরোধী নোটে সেন দেখিয়েছেন কীভাবে ভারতে " বাড়তি মৃত্যুহার " সংখ্যা নিয়মিতভাবে ১৯৫৮-১৯৬১ এর সময় চীনকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।[২০]
চীনা পরিসংখ্যানগত বছরবই অনুসারে (১৯৮৪), ফসল উৎপাদন ২০ কোটি টন (১৯৫৮) থেকে ১৪ কোটি ৩৫ লাখ টনে (১৯৬০) নেমে আসে। খাদ্য ও সময়মত বিবাহের অভাবে জনসংখ্যা ১৯৬১ সালে হয় প্রায় ৬৫৮,৫৯০,০০০ যা ১৯৫৯ সালের তুলনায় ১৩,৪৮০,০০০ কম। জন্মহার ২.৯২২% (১৯৫৮) থেকে কমে হয় ২.০৮৬% (১৯৬০) এবং মৃত্যুর হার ১.১৯৮%(১৯৫৮) থেকে বেড়ে হয় ২.৫৪৩%(১৯৬০) যেখানে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ তে গড় ছিল ৪% এবং ১% যথাক্রমে।
আনুষ্ঠানিক মৃত্যু রিপোর্টে মৃত্যুর হার প্রদেশে এবং কাউন্টিতে অনেক বেশি নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ, সিচুয়ান প্রদেশে যা চীনের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ, সরকার ১ কোটি ১০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু দেখায় যেখানে মোট জনসংখ্যা ছিল ৭০ কোটি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬১ সালের মাঝে। যার অর্থ প্রত্যেক সাতশো মানুষের মধ্যে এগার জনের মৃত্যু ঘটে। হেনান প্রদেশের হুয়াইবিন কাউন্টিতে, সরকার ৩ লাখ ৭৮ হাজার জনসংখ্যার মধ্যে ১ লাখ ২ হাজার মৃত্যু দেখায় ১৯৬০ সালের জাতীয় পর্যায়ে রিপোর্টে। সরকারী পরিসংখ্যানে প্রায় ১ কোটি ৫০ লাখ তথাকথিত "বাড়তি মৃত্যু" "অস্বাভাবিক মৃত্যু" দেখানো হয় যার সবচেয়ে বড় কারণ অনাহার।
১৯৫৯ থেকে ১৯৬০ সালে জিন জিয়াং এর একটি সরকারী দলের সচিব ইয়ু দিহং বলেন ,
আমি এক গ্রামে গিয়ে ১০০ লাশ দেখি, তারপর অন্য গ্রামে অন্য ১০০ লাশ দেখেছি। কেউ তাদের দিকে মনোযোগ দেয়নি। লোকেরা বলে যে কুকুর লাশ খাচ্ছিল। কিন্তু তা সত্য না। কারণ তার আগেই মানুষ কুকুর খেয়ে ফেলেছিল।
এটা বিশ্বাস করা হয় যে সরকার মৃত্যুর সংখ্যা অনেক কম রিপোর্ট করত: লু বাউগু, জিনজিয়াং এর একজন জিনহুয়া রিপোর্টার, ইয়াং চিশেং কে বলেন যে কেন তিনি এইসব রিপোর্ট তুলে ধরেননি:
১৯৫৯ সালের দ্বিতীয়ার্ধে, আমি জিনজিয়াং থেকে লুশান এবং গুশিতে একটি বাসে যাত্রা করেছিলাম। জানালা দিয়ে আমি একটা লাশের উপর আরেকটা লাশ ফেলাতে দেখেছি। বাসে কেউ মৃত মানুষের কথা ভুলেও বলেনি। গুয়াংশান নামের এক কাউন্টিতে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গিয়েছিল। যদিও সেখানে মৃতদেহ সর্বত্র ছিল তবুও স্থানীয় নেতারা ভাল খাবার এবং মদ উপভোগ করছিল .... আমি এমন মানুষকে দেখেছি যারা সত্য বলে ধ্বংস হয়েছে। আমি এগুলো লিখব কোন সাহসে?
প্যাট্রিসিয়া বাকলি ইব্রের মতো কিছু পশ্চিমা বিশ্লেষকদের মতে, প্রায় ২-৪ কোটি মানুষ খারাপ সরকারী নীতি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ দ্বারা সৃষ্ট অনাহার মারা গেছেন। জে বানিস্টারের মতে এই সংখ্যা প্রায় ২ কোটি ৩০ লাখ। লি চেংরুই, চীন এর জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাবেক মন্ত্রীর মতে তা আনুমানিক ২ কোটি ২০ লাখ (১৯৯৮)। তার অনুমানের ভিত্তি ছিল এন্সলি জে কোয়ালে এবং জিয়াং ঝেঞ্জুয়ার ২কোটি ৭০ লাখের অনুমান, কাও সুজি অনুমান করেন ৩ কোটি ২৫ লাখ। ইয়াং চিশেং (২০০৮) এর মতে মৃতের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ।[২১]
হংকং ভিত্তিক ইতিহাসবিদ ফ্রাঙ্ক ডিকত্তের (২০১০) অনুমান করে যে, কমপক্ষে, ৪ কোটি ৫০ লাখ মানুষ সম্মুখগামী মহালম্ফের সময় অনাহার, অতিরিক্ত পরিশ্রম ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার কারণে মারা যান। তিনি দাবি করেন এই তথ্য সম্প্রতি খোলা স্থানীয় ও প্রাদেশিক পার্টি আর্কাইভের উপর ভিত্তি করে দেওয়া। যদিও প্রথম লেখক হিসেবে তার দাবীকে অন্য পণ্ডিতরা প্রশ্নবিদ্ধ করেন।ডিকত্তের দাবী করেন যে কমপক্ষে ২০ লাখ ৫০ হাজার মানুষকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি এক সদস্য কিছু খাবার চুরি করে ধরা পরার পর তার পরিবারে কি ঘটেছে তার একটি গ্রাফিক উদাহরণ দেন:
লিউ দিশেং, একটি মিষ্টি আলু চুরিতে দোষী, প্রস্রাবে আবৃত ছিল ... তিনি, তার স্ত্রী ও তার পুত্রকে এক গাদা মলের মধ্যে থাকতে বাধ্য করা হয়। তারপর চিমটা দিয়ে তার মুখ খোলা হয় যখন তিনি মল গেলতে অস্বীকার করেন। তিনি তিন সপ্তাহ পরে মারা যান।[২২]
ব্যাপক মৌখিক রিপোর্ট আছে, এবং কিছু ডকুমেন্টেশন রয়েছে দুর্ভিক্ষের ফলে নরমাংসভক্ষণপ্রথা নিয়ে যা তখন বিভিন্নভাবে চর্চা করা হত।[২৩][২৪][২৫] দুর্ভিক্ষের কারণে স্বজাতিভক্ষণ দুর্ভিক্ষের স্কেলে "বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে অভূতপূর্ব পর্যায়" হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সফলতার পর সম্মুখগামী মহালম্ফের চালু করা হয়েছিল ১৯৫৮সালে। সম্মুখগামী মহালম্ফের একটি অংশ গ্রামাঞ্চলের কমিউনে দাঁড়ানোর কথা ছিল। তবে পার্টির প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের উৎপাদনশীলতায় সময়ের চেয়ে বেশি আশাবাদী অনুমান করা হয়েছিল।বাস্তবে, চাষ কার্যকলাপ পুরোপুরিভাবে নিচে চলে গিয়েছিল।
কিছু কর্মী সম্মুখগামী মহালম্ফের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গিয়েছিল, কিন্তু তাদের মাও বিরোধী হিসেবে দেখা হয় এবং "এন্টি-ডান আন্দোলনের" মাধ্যমের তাদের স্তব্ধ করা হয়।
দুর্ভিক্ষের পর চীন গণপ্রজাতন্ত্রের তৎকালীন চেয়ারম্যান লিউ শাওকি সিদ্ধান্তে আসেন যে, দুর্ভিক্ষের কারণ ছিল "৩০% প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ৭০% নীতি"। পরের সাংস্কৃতিক বিপ্লবে, লিউকে বিশ্বাসঘাতক এবং তিন লাল ব্যানারের বিরুদ্ধে শত্রু এজেন্ট বলে ঘোষণা করা হয়।