চৌধুরী রহমত আলি | |
---|---|
জন্ম | ১৬ নভেম্বর ১৮৯৫ |
মৃত্যু | ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১ | (বয়স ৫৫)
অন্যান্য নাম | চৌধুরী রহমত আলি |
উল্লেখযোগ্য কর্ম | নাউ অর নেভার |
আন্দোলন | পাকিস্তান আন্দোলন, পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলন |
চৌধুরী রহমত আলি (উর্দু : چودھری رحمت علی) (১৬ নভেম্বর ১৮৯৫ – ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫১) ছিলেন একজন পাকিস্তানি[১][২][৩] মুসলিম জাতীয়তাবাদী। তিনি পাকিস্তান সৃষ্টির প্রবক্তাদের অন্যতম। দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের পৃথক আবাসভূমির জন্য “পাকিস্তান” শব্দটি তার সৃষ্টি। তাকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের স্থপতি হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। ১৯৩৩ সালে প্রকাশিত পুস্তিকা নাউ অর নেভার; আর উই টু লিভ অর পেরিশ ফরএভার? এর লেখক হিসেবে তিনি খ্যাত। এটি পাকিস্তান ঘোষণা বলেও পরিচিত। পুস্তিকাটি নিম্নোক্তভাবে শুরু হয়ঃ
“ভারতের ইতিহাসের এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, যখন ব্রিটিশ ও ভারতীয় মুখপাত্ররা এই ভূমির জন্য কেন্দ্রীয় সংবিধানের ভিত্তি গড়ে তুলছেন, আমরা আপনাদের কাছে এই আবেদন জানাচ্ছি, আমাদের সাধারণ ঐতিহ্যের নামে, আমাদের ত্রিশ মিলিয়ন মুসলিম ভাই যারা পাকস্তানে বাস করে তাদের পক্ষে – এর মাধ্যমে আমরা ভারতের পাঁচটি উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশকে বোঝাচ্ছি, যথাঃ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (আফগান প্রদেশ), কাশ্মীর, সিন্ধু ও বালুচিস্তান।“
চৌধুরী রহমত আলি তৎকালীন ভারতের পাঞ্জাবের হোশিয়ারপুর জেলার অন্তর্গত বালাচৌর শহরে একটি মুসলিম গুরজার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন (বর্তমান নাওয়ানশহর জেলা)।[৪] ১৯১৮ সালে তিনি লাহোরের ইসলামিয়া মাদ্রাসা থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে তিনি লাহোরের আইচসন কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। এরপর তিনি পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে অধ্যয়নের জন্য ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে তিনি ইংল্যান্ড চলে যান ও ১৯৩১ সালে ক্যামব্রিজে ইমানুয়েল কলেজে যোগ দেন। ১৯৩৩ সালে তিনি “নাউ অর নেভার” পুস্তিকাটি প্রকাশ করেন। এতে সর্বপ্রথম ‘’পাকিস্তান’’ শব্দটির উল্লেখ করা হয়। ১৯৩৩ সালে তিনি ইংল্যান্ডে পাকিস্তান জাতীয় আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৩ সালে পরবর্তীতে তিনি বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন ও ১৯৪০ সালে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৪৩ সালে তিনি লন্ডনের মিডল টেম্পলে যোগ দেন। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি তিনি বিভিন্ন পুস্তিকায় প্রকাশ করেন। ভারত বিভাগের ফলে ঘটিত গণহত্যা ও ব্যাপক দেশান্তর তাকে ব্যথিত করে তোলে। দুই দেশের মধ্যে বন্টনকৃত এলাকা নিয়ে তার অসন্তোষ ছিল। তিনি একে বিশৃঙ্খলার কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
চৌধুরী রহমত আলি বিশ্বাস করতেন যে ভারতের মুসলিমদের মজবুত, স্বাধীন সম্প্রদায় হিসেবে দাঁড়াতে হলে রাজনৈতিক দিক থেকে সংস্কার করতে হবে। তিনি ইসলামের ইতিহাস দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। বিশেষ করে ইসলামের প্রতিষ্ঠাকালের সময় নবী মুহাম্মদ এর আরবের গোত্রগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার ঘটনা তাকে বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত করে। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ক্রমান্বয়ে প্রতিকূল হয়ে উঠা ভারতে ভারতীয় মুসলিমদেরকেও একইভাবে ঐক্যভাবে হতে হবে।
মুহাম্মদ ইকবাল ও অন্যান্যদের মত তার লেখাগুলোও পাকিস্তান সৃষ্টির উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। তিনি বাংলার মুসলিমদের জন্য বাঙ্গিস্তান ও দক্ষিণাত্যের মুসলিমদের জন্য উসমানিস্তান নামের আবাসভূমির প্রস্তাব করেন। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের জন্য তিনি দক্ষিণ এশিয়ার “দিনিয়া’’ নামের প্রস্তাব করেন।[৫]
আলি পাকিস্তান ধারণার প্রতি উৎসর্গিত হিসেবে খ্যাত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর তিনি জাতিসংঘে কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানের পক্ষে ও ভারতের ভেতর বসবাসকারী মুসলিম সংখ্যালঘুদের অধিকারের পক্ষে বক্তব্য তুলে ধরেন।
১৯৩২ সালে আলি ৩ হাম্বারস্টোন রোডের একটি বাড়িতে উঠেন। এই বাড়ির একটি কক্ষে তিনি সর্বপ্রথম ‘পাকিস্তান’ শব্দটি লেখেন বলে উল্লেখ করা হয়। এই নামের উৎপত্তি বিষয়ে কয়েকটি মত রয়েছে। তার এক বন্ধু আবদুল করিম জব্বারের মতে ১৯৩২ সালে আলি তার বন্ধু পীর আহসানউদ্দিন ও খাজা আবদুল রহিমের সাথে টেমস নদীর তীর ধরে হাটার সময় নামটি তার মাথায় আসে। আলির সেক্রেটারি মিস ফ্রস্টের মতে লন্ডনের একটি বাসে চড়ার সময় তিনি ধারণাটি লাভ করেন।[৬]
১৯৩৩ সালের ২৮ জানুয়ারি আলি তার ধারণা নাউ অর নেভার; আর উই টু লিভ অর পেরিশ ফরএভার? পুস্তিকায় প্রকাশ করেন।[৭] পাকস্তান শব্দটি ভারতের উত্তরের পাঁচটি রাজ্যকে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (আফগান প্রদেশ), কাশ্মীর, সিন্ধু ও বেলুচিস্তানকে নির্দেশ করে।[৮][৯] ১৯৩৩ সালের শেষ নাগাদ ‘পাকিস্তান’ শব্দটি বেশ পরিচিত হয়ে উঠে এবং উচ্চারণের সুবিধার্থে ‘ই’ যোগ করা হয় (‘আফগানিস্তান’ এর মত)।[১০]
পরবর্তী একটি বইয়ে আলি এর উৎপত্তি ব্যাখ্যাসহ বিবৃত করেন:[১১]
তার জীবনীকার কে. কে. আজিজ লিখেছেন[১২] যে রহমত আলি একাই এই ঘোষণাটির খসড়া তৈরী করেন[১৩] (যেটিতে পাকিস্তান শব্দটি প্রথমবার ব্যবহৃত হয়), কিন্তু একে প্রতিনিধিত্বশীল করে তোলার জন্য তার সাথে এতে স্বাক্ষর করবে এমন লোকদের খুজতে থাকেন। এই খোঁজ সহজ ছিল না। ইংল্যান্ডে এর সপক্ষে তিনজন সমর্থক ও স্বাক্ষরকারী পেতে একমাসের বেশি সময় লেগেছিল।[১৪] পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা এই স্বাক্ষরকারীদের ও আলির অন্যান্য বন্ধুদের নাম ‘পাকিস্তান’ শব্দের স্রষ্টা হিসেবে ব্যবহার করে।
এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ আলি জিন্নাহর উদ্ধৃতি দেয়া যায়। ১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশনে তিনি বলেন:[১৫]
“আমার ধারণা আপনারা আমাকে সমর্থন করবেন যে যখন আমরা লাহোর প্রস্তাব পাস করি তখন আমরা ‘পাকিস্তান’ শব্দটি ব্যবহার করিনি। কে আমাদের এই শব্দটি দিয়েছে? (“হিন্দুদের” চিৎকার) আমি বলবে এটা তাদের ভুল। তারা এটিকে পাকিস্তান প্রস্তাব বলছে। তারা মুসলিমদের আন্দোলন সম্পর্কে আসলেই অনবহিত। এই শব্দটি তারা আমাদের উপর আরোপিত করেছে ..... আপনারা ভাল করে জানেন যে পাকিস্তান শব্দটি কিছু হিন্দু ও ব্রিটিশ পত্রিকা আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। এখন অনেকদিন ধরে আমাদের প্রস্তাব যা দীর্ঘদিন ধরে লাহোর প্রস্তাব হিসেবে পরিচিত ছিল তাকে পাকিস্তান বলা হচ্ছে। কিন্তু কতদিন আমরা এই দীর্ঘ বাক্যটি ব্যবহার করব? এখন আমি আমার হিন্দু ও ব্রিটিশ বন্ধুদেরকে বলবঃ আমাদেরকে একটি শব্দ প্রদানের জন্য আপনাদেরকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। (প্রশংসা ও উচ্চধ্বনি)। পাকিস্তান শব্দের উৎপত্তি কী? মুসলিম লীগ বা কায়েদে আজম এই শব্দটি তৈরী করেনি। লন্ডনের কিছু তরুণ সঙ্গী[১৬] যারা চাচ্ছেন যাতে ভারত থেকে উত্তর পশ্চিমের কিছু নির্দিষ্ট অংশ পৃথক করে নেয়া হয় তারা ১৯২৯-৩০ এ নামটি উদ্ভাবন করেন, এই ধারণার আরম্ভ করেন ও এই অঞ্চলকে পাকিস্তান নাম দেন। তারা পাঞ্জাব থেকে পি, আফগান থেকে এ, যেহেতু বর্তমানেও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশকে আফগান বলা হয়, কাশ্মীর থেকে কে, সিন্ধু থেকে এস. ও বালুচিস্তান থেকে তান নির্বাচিত করেন। এর মাধ্যমে নামটি সৃষ্টি হয়। শব্দের অর্থ যাই হোক না কেন এটি পরিষ্কার যে প্রত্যেক সভ্য দেশের ভাষাই নতুন শব্দ উদ্ভাবন করে। পাকিস্তান শব্দটি লাহোর প্রস্তাবের অর্থ নির্দেশ করে। আমরা একটি শব্দ চাইছিলাম ও এটি আমাদের কাছে এসে গেছে এবং আমরা একে লাহোর প্রস্তাব প্রতিশব্দ হিসেবে ব্যবহারের উপযোগী বলে মনে করছি।“
১৯৩০ সালের ২৯ ডিসেম্বর মোহাম্মদ ইকবাল তার স্মারক বক্তব্যে বলেনঃ[১৭]
"পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বালুচিস্তানকে একটি একক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে আমি পছন্দ করি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধীন স্বায়ত্তশাসিত বা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাইরে, উত্তর-পশ্চিমে ভারতীয় মুসলিমদের রাষ্ট্র আমার কাছে মুসলিমদের, অন্ততপক্ষে উত্তর-পশ্চিম ভারতের মুসলিমদের চূড়ান্ত নিয়তি বলে মনে হয়।"
কিছু বিশেষজ্ঞের মতে[১৮] ইকবাল একটি স্বশাসিত মুসলিম রাষ্ট্রের কথা বলেননি; বরং তিনি পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বালুচিস্তানকে নিয়ে ভারতের মধ্যে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে একীভূত একটি মুসলিম প্রদেশ চাইতেন।[১৯] তারা বলেন যে “ইকবাল কখনো দেশের বিভক্তিসূচক কিছু বলেননি। বরঞ্চ তিনি ভারতের জন্য ফেডারেল ব্যবস্থার পক্ষপাতি ছিলেন ..... এবং চাইতেন ভারতীয় ফেডারেশনের ভেতর মুসলিমদের একত্রিত থাকুক।[২০]
আরেকজন ভারতীয় ইতিহাসবিদ, তারা চাঁদ বলেন যে ইকবাল ভারতের বিভক্তির কথা ভাবেননি কিন্তু ভারতের ভেতর স্বাশাসিত রাজ্যের কথা ভাবতেন।[২১] ড. সফদর মেহমুদও কিছু ব্যাপারে গবেষণা করেন এবং বলেন যে এলাহাবাদে একটি বক্তব্যে ইকবাল ভারতীয় ফেডারেশনের অন্তর্গত একটি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের প্রস্তাব করেন এবং ভারতীয় ফেডারেশনের বাইরে স্বাধীন রাষ্ট্রের কথা তিনি বলেননি।[২২]
ব্রিটিশ ও ভারতীয় পত্রিকায় এই দুটি ভিন্ন প্রকল্প নিয়ে সমালোচনা করা হয়। “পাকিস্তান” নামক শব্দের উৎপত্তির ব্যাপারে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা হয়। এমনকি জওহরলাল নেহ্রু লিখেছেনঃ “ইকবাল পাকিস্তানের একজন প্রথমদিককার সমর্থক ছিলেন এবং এরপরও তিনি এর পরবর্তী ভয়ংকর ও অর্থহীনতা বুঝতে পেরেছিলেন এডওয়ার্ড থমসন লিখেছেন যে কথোপকথনের সময় ইকবাল তাকে বলেন যে তিনি পাকিস্তানের সমর্থন করেছেন কারণ মুসলিম লীগের অধিবেশনের সভাপতির পদে ছিলেন, কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে এটি সামগ্রিকভাবে ভারতের জন্য ক্ষতিকর হবে এবং বিশেষ করে মুসলিমদের জন্য।"[২৩]
১৯৩৪ সালে চৌধুরী রহমত আলি ও তার বন্ধুরা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং পাকিস্তান ধারণার জন্য তার সমর্থন কামনা করেন। তিনি উত্তর দেনঃ "আমার প্রিয় পুত্ররা, তাড়াহুড়া কর না, পানিকে প্রবাহিত হতে দাও এবং তারা তাদের নিজস্ব পথ খুজে নেবে।"[২৪]
চৌধুরী রহমত আলি পাকিস্তান ধারণার একজন নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিত্ব হলেও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তিনি অধিকাংশ সময়ই ইংল্যান্ডে কাটান। ১৯৪৮ সালের ৬ এপ্রিল লাহোরে আসার পর তিনি পাকিস্তানের সৃষ্টির ব্যাপারে নিজের অসন্তোষ প্রকাশ করেন। তার “নাউ অর নেভার” পুস্তিকায় তুলে ধরা পাকিস্তানের চেয়ে তুলনামূলক ক্ষুদ্র পাকিস্তানের ব্যাপারে তিনি ব্যথিত ছিলেন।[২৫]
পাকিস্তান সৃষ্টির পর ১৯৪৮ এর এপ্রিলে তিনি পাকিস্তানে ফিরে আসেন। এখানে থেকে যাওয়া তার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান তাকে দেশত্যাগের আদেশ দেন। তার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৯৪৮ এর অক্টোবরে তিনি খালি হাতে ইংল্যান্ড ফিরে যান।[২৬]
১৯৫১ সালের ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ২০ ফেব্রুয়ারি ক্যামব্রিজের Newmarket Road Cemeteryনিউমার্কেট রোড সিমেট্রিতে তাকে দাফন করা হয়।[২৭]
In the Gujjar tribe his clan was Gorci.
|coauthors=
উপেক্ষা করা হয়েছে (|author=
ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে) (সাহায্য);