জন মিয়ারশাইমার একজন মার্কিন অধ্যাপক যিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে কর্মরত আছেন। তিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে একজন তাত্ত্বিক। তিনি তার লেখা বই দ্যা ট্র্যাজেডি অফ গ্রেট পাওয়ার পলিটিক্স-র জন্য বিশেষ ভাবে খ্যাত। সম্প্রতি আরেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী স্টিফেন ওয়াল্টের সাথে লেখা একটি নিবন্ধ দ্যা ইসরায়েল লবি অ্যান্ড ইউএস ফরেন পলিসি-র মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে আলোচিত হয়েছেন। শেষোক্ত নিবন্ধটি পরে বই আকৃতিতে প্রকাশ পাবার পর তা নিউ ইয়র্ক টাইমস বর্ণিত সর্বাধিক বিক্রিত বই হওয়ার সম্মান অর্জন করেছে।
জন মিয়ারশাইমার ১৯৪৭ সালে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন অঞ্চলে জন্ম গ্রহণ করেন। আট বছর বয়স পর্যন্ত মিয়ারশাইমার নিউ ইয়র্ক শহরেই লালিত পালিত হয়েছেন। পরে তার মা বাবা তাকে নিয়ে নিউ ইয়র্কেরই ওয়েস্টচেস্টার কাউন্টিতে ক্রটন-অন-হাডসন অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন।
১৭ বছর বয়সে মিয়ারশাইমার মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। যোগদানের এক বছর পর তিনি ওয়েস্ট পয়েন্টে ইউনাইটেড স্টেটস মিলিটারি অ্যাকাডেমিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত ওয়েস্ট পয়েন্টে অবস্থান করে তিনি স্নাতকে উত্তীর্ণ হন ও পরের পাঁচ বছর মার্কিন বিমান বাহিনীতে কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ম পালন করেন।
বিমান বাহিনীতে থাকা অবস্থায় ১৯৭৪ সালে তিনি সাউথ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে সম্মান ডিগ্রী অর্জন করেন। এর পরপরই তিনি সরকার ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে উচ্চতর গবেষণার উদ্দেশ্যে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন ও ১৯৮১ সালে সেখান থেক ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯৭৮-৭৯ সময়কালে তিনি ওয়াশিংটন ডিসির ব্রুকিংস ইন্সটিটিউশানের রিসার্চ ফেলো ছিলেন। ১৯৮০-৮২ সময়কালে তিনি ছিলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ইন্টার্ন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের পোস্ট ডক্টোরাল ফেলো। ১৯৯৮-৯৯ সময়কালে তিনি নিউ ইয়র্কের বৈদেশিক সম্পর্ক পরিষদের হুইটনি এইচ শেপার্ডসন ফেলোও ছিলেন।
মিয়ারশাইমার ১৯৮২ সাল থেকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুষদের একজন সদস্য। ১৯৮৪ সালে তিনি সহ-অধ্যাপক হন ও অধ্যাপক হন ১৯৮৭ সালে। ১৯৮৯ সাল থেকে তিন বছরের জন্য তিনি বিভাগটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।
মিয়ারশাইমার জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক তত্ত্বের উপর প্রচুর লেখালেখি করেছেন। তিনি বিশেষত রাজনৈতিক বস্তুতন্ত্রবাদের উপর গবেষণা করেছেন এবং মতামত দিয়ে থাকেন যে এক্ষেত্রে বস্তুতন্ত্রবাদ মূলত হচ্ছে কোন রাষ্ট্রের একটি বিশেষ প্রবণতা যার দ্বারা রাষ্ট্রটি আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে আপেক্ষিক ভাবে যত বেশি সম্ভব ক্ষমতা অর্জন করতে উদ্যত হয়।
মিয়ারশাইমার রচিত বইগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৮৩ সালে লেখা কনভেনশনাল ডিটারেন্স (এডগার এস ফার্নিস জুনিয়ার পুরস্কার প্রাপ্ত), ১৯৮৫ সালে লেখা নিউক্লিয়ার ডিটারেন্স – এথিক্স অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজি, ২০০১ সালে লেখা দ্যা ট্র্যাজেডি অফ গ্রেট পাওয়ার পলিটিক্স (জোসেফ লেপগোল্ড পুরস্কার প্রাপ্ত) এবং ২০০৭ সালে লেখা দ্যা ইসরায়েল লবি অ্যান্ড ইউএস ফরেন পলিসি। তার লেখা প্রচুর প্রবন্ধ ইন্টার্ন্যাশনাল সিকিউরিটি সহ বিভিন্ন জার্নাল ও অন্যান্য পত্রিকা যেমন লন্ডন রিভিউ অফ বুক্স-এ প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া তিনি নিউ ইয়র্ক টাইম্স, লস এঞ্জেল্স টাইম্স ও শিকাগো ট্রিবিউন পত্রিকার উপসম্পাদকীয় লিখে থাকেন।
লেখালেখির পাশাপাশি শিক্ষকতার জন্য মিয়ারশাইমার একাধিকবার পুরষ্কৃত হয়েছেন। কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় ১৯৭৭ সালে তিনি শিক্ষকতার জন্য ক্লার্ক অ্যাওয়ার্ড ফর ডিস্টিংগুইশ্ড টিচিং লাভ করেন। ১৯৮৫ সালে ়শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা অবস্থায় জিতে নেন কোয়ান্ট্রেল অ্যাওয়ার্ড ফর এক্সিলেন্স ইন আন্ডারগ্র্যাজুয়েট টিচিং।
শিক্ষকতা ও বক্তব্যদানের ক্ষেত্রে মিয়ারশাইমার শব্দের বৈচিত্র্যময় ব্যবহার এবং ক্ষেত্রবিশেষে বিভিন্ন প্রবাদ ও উপমা ব্যবহারের মাধ্যমে আকর্ষণীয় ভাবে বক্তৃতা করার জন্য বিখ্যাত। উপমা দেয়ার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হচ্ছে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংক্ষিপ্ত নাম ইউএসকে ভেঙ্গে বলবার ক্ষেত্রে আঙ্কেল শুগার আখ্যা দিয়ে থাকেন এবং রাশিয়া উল্লেখ করার বদলে বলে থাকেন দ্যা বিয়ার বা ভাল্লুক।
২০০৬ সালের মার্চে মিয়ারশাইমার হার্ভার্ড কেনেডি স্কুল অফ গভর্নমেন্টের অধ্যাপক স্টিফেন ওয়াল্টের সাথে যৌথ ভাবে একটি গবেষণাপত্র[১] এবং একটি নিবন্ধ[২] প্রকাশ করেন যেগুলোতে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণে সেখানকার ইহুদি লবির শক্তিশালী ভূমিকা অর্থাৎ প্রভাবের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। উক্ত নিবন্ধটি লন্ডন রিভিউ অফ বুক্স পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং মূল গবেষণাপত্রটি পরে বই আকারে প্রকাশিত হয়। রচনা গুলোতে তারা ইহুদি বা ইসরায়েল লবিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করেন, এটি হচ্ছে মূলত কিছু ব্যক্তি এবং বেশ কয়েকটি সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত একটি অনানুষ্ঠানিক বা অঘোষিত ঐক্য যা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রশাসনিক কাঠামো ও বৈদেশিক নীতিকে ক্রমান্বয়ে ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বনের উদ্দেশ্যে নানান উপায়ে প্রভাবিত করে থাকে। তারা এই লবিকে বিশেষত ‘ইসরায়েল লবি’ হিসেবে চিহ্নিত করে নামের ব্যাখ্যাটি স্পষ্ট করতে চেয়েছেন। এর প্রধান কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এই নিশ্চয়তা দেয়া যায় না যে ইহুদি সম্প্রদায়ের সব মানুষই একচ্ছত্র ভাবে ইসরায়েলের পক্ষাবলম্বনে আগ্রহী, যদিও উক্ত লবিটি মূলত ইসরায়েলের কল্যাণার্থে মার্কিন নীতিমালা গঠনের জন্য প্রভাব সৃষ্টি করেন। লবিটিকে ইহুদি লবি না বলে ইসরায়েল লবি বলার আরেকটি কারণ হচ্ছে, এই লবির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ব্যক্তিবর্গের সকলেই যে ইহুদি তা নয়। এখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন ব্যক্তি বা সংস্থার জড়িত থাকবার কথা নিশ্চিত করা হয়েছে যেসকল ব্যক্তিবর্গ বা সংস্থা আদর্শগত ভাবে অন্য মতাবলম্বী যেমন খ্রিস্টান জিওনিস্ট। রচনাটিতে আরেকটি ব্যাপার স্পষ্ট করা হয় যে ইসরায়েল লবি কোন সুনির্দিষ্ট ষড়যন্ত্র নয় বরং এটি একটি সমন্বিত গোষ্ঠী যা ইসরায়েলের স্বার্থ সংরক্ষণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। উল্লেখ্য যে স্টিফেন ওয়াল্টের সাথে লেখা জন মিয়ারশাইমারের এই রচনাটি মিডিয়ায় অসামান্য আলোড়ন সৃষ্টি করে।
দুই রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর এই গবেষণা দ্যা ইসরায়েল লবি অ্যান্ড ইউএস ফরেন পলিসি নামক বই হিসেবে ২০০৭ সালের আগস্টে প্রকাশিত হয়। বইটি ১৭ টি ভাষায় প্রকাশ করা হয় এবং ২১ টি দেশে বিক্রয় করা হয়। বইটি অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইতিবাচক সাড়া পেলেও যুক্তরাষ্ট্রের মূলধারার প্রচারমাধ্যম বইটিকে ভালো ভাবে গ্রহণ করেনি। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি ইসরায়েলে এই বইটি আশাতীত ভাবে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছে।[৩] জন মিয়ারশাইমার ও স্টিফেন ওয়াল্ট দুজনেই এই বইটির উপর বক্তৃতা করার জন্য কানাডাসহ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে আমন্ত্রিত হয়েছেন। একটি সাক্ষাৎকারে মিয়ারশাইমার জানান যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিগত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের একজন অত্যন্ত জনপ্রিয় প্রার্থীর সম্মানে আয়োজিত একটি নৈশভোজে স্টিফেন ওয়াল্টকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু নৈশভোজের কিছু সময় আগে হঠাৎ করে তার আমন্ত্রণ বাতিল করা হয় এবং সেই প্রার্থীর এক আজ্ঞাবহর পক্ষ থেকে জানানো হয় যে যুক্তরাষ্ট্রে ইহুদিদের কয়েকটি সংস্থার প্রবল আপত্তির মুখে উক্ত প্রার্থী ওয়াল্টের আমন্ত্রণ বাতিল করতে বাধ্য হচ্ছেন। মিয়ারশাইমার এও জানিয়েছেন যে শুধুমাত্র এই বইটি লেখার ও সংশ্লিষ্ট তৎপরতার ফলে তিনি বা ওয়াল্ট হয়তোবা আর কখনওই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের দায়িত্মশীল ও নীতিনির্ধারণী কোন পদে আসীন হতে পারবেন না। সাক্ষাৎকারে মিয়ারশাইমার স্পষ্ট করেছেন যে পরিণতির কথা না জেনে তারা বইটি লিখেননি।
মিয়ারশাইমার ২০০৬ সালের গ্রীষ্মে ঘটে যাওয়া হিযবুল্লাহ্ তথা লেবাবনের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আগ্রাসনের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন। তিনি মন্তব্য করেন যে ইসরায়েলি রণকৌশল সম্পূর্ণ রূপে ব্যার্থ হতে পারে কেননা তারা হিযবুল্লাহ্র বিরুদ্ধে আকাশপথে তীব্র আঘাত হেনে জয়ী হবার যে পরিকল্পনা করেছে তা কখনওই কোন গেরিলা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে কার্যকর হবে না। তিনি মতপ্রকাশ করেন যে এই আক্রমণ সাধারণ লেবানিজ জনগণের জন্য দূর্ভোগ তো বয়ে এনেছেই, এটি ইসরায়েল বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও কোন উপকারে আসেনি। এই ঘটনাটিতে ইসরায়েলি লবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল কারণ এদের প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্র ঘটনাটিতে নিরপেক্ষ ভাবে প্রভাব বিস্তার করা থেকে সম্পূর্ণ ভাবে বিরত ছিল।
মিয়ারশাইমার ২০০৮ সালের শেষদিকে শুরু হওয়া গাজায় ইসরায়েলের নিষ্ঠুর আগ্রাসনেরও প্রচন্ড সমালোচনা করেন। তিনি তুলে ধরেন যে এই আক্রমণটির ফলে কোন পক্ষেরই উল্লেখযোগ্য কোন অর্জন হওয়া সম্ভব নয়। বরং এই আক্রমণের ফলে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে চলমান সংকট নিরসনের সব সম্ভাবনাকে নাকচ করা হয়েছে কেননা এই আগ্রাসন আগামী বছরগুলোতে তাদের সম্পর্কে বৈরিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে অবদান রেখে যাবে।
মিয়ারশাইমার আরও উল্লেখ করেন যে চলমান এই সংকটের একমাত্র সমাধান হল ফিলিস্তিনীদের স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাব মেনে নেয়া। এতে উভয় পক্ষ হতেই শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব। এর ব্যাতিরেকে ইসরায়েল চিরকাল একটি বর্ণবাদী রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিত থাকবে এবং এটি ইসরায়েল, যুক্তরাষ্ট্র ও বিশেষ করে ফিলিস্তিনিদের উপর প্রচন্ড বিরূপ প্রভাব ফেলে যাবে।[৪]
জন মিয়ারশাইমার রাজনৈতিক বস্তুতন্ত্র তত্ত্বের বিশেষ শাখা আগ্রাসী বস্তুতন্ত্রবাদ বা অফেনসিভ রিয়েলিজ্মের একজন গবেষক ও ব্যাখ্যাদানকারী। এই তত্ত্বকে হ্যান্স মর্গানথর ক্লাসিকাল রিয়েলিজ্ম থেকে একটু আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে এবং বলা হয় যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে উদ্ভূত বিভিন্ন সংঘাতময় পরিস্থিতির জন্য মানব সম্প্রদায়ের স্বাভাবিক আচরণ দায়ী নয় বরং দায়ী হচ্ছে মূলত শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর নিরাপত্তাজনিত প্রতিযোগিতা। বস্তুতন্ত্রবাদের আরেকটি শাখা ডিফেন্সিভ রিয়েলিজ্ম, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞ কেনেথ ওয়াল্টজ যেটির ব্যাখ্যা দেন, অফেনসিভ রিয়েলিজ্ম তা থেকেও কিছুটা ভিন্নতা অবলম্বন করে ব্যাখ্যা দেয় যে কোন রাষ্ট্রই তার বর্তমান শক্তির সম্পর্কে সন্তুষ্ট থাকেনা বরং প্রতিনিয়ত নিরাপত্তা ব্যাবস্থায় নেতৃত্ব অর্জনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যায়।
মিয়ারশাইমার আগ্রাসী বস্তুতন্ত্রবাদ প্রসঙ্গে তার দৃষ্টিভঙ্গিকে দ্যা ট্র্যাজেডি অফ গ্রেট পাওয়ার পলিটিক্স বইয়ে এভাবে তুলে ধরেছেন।
বর্তমান ও ভবিষ্যতের নিশ্চয়তার জন্য কতটুকু ক্ষমতাবান হওয়া যথেষ্ট এটি নিরূপণ করা যেহেতু সহজ নয়, সেহেতু শক্তিধর রাষ্ট্র বা সুপার পাওয়ারগুলো প্রতিনিয়ত ক্ষমতার বিস্তারের জন্য ও প্রতি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য সদা সচেষ্ট থাকে যেন তারা অন্যান্য প্রতিপক্ষ হতে আগত সম্ভাব্য হুমকির মোকাবেলা করার জন্য সবসময়ে প্রস্তুত থাকতে পারে। যদি কোন রাষ্ট্র এই ধারণা লাভ করে যে তারা ইতোমধ্যেই যথেষ্ট পরিমাণ ক্ষমতার্জন করতে পেরেছে, এর অর্থ হচ্ছে উক্ত রাষ্ট্রটি প্রকৃতপক্ষে ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে এবং তারা ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য তাদের প্রাপ্ত সুযোগ গুলোর সদ্ব্যবহার করতে ব্যার্থ হবে।
মিয়ারশাইমারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী ক্ষমতার কোন স্ট্যাটাস কো শ্রেণীভুক্ততা নেই কেননা কোন শক্তিধর রাষ্ট্র যদি বাস্তবে তার প্রতিপক্ষের চেয়ে অধিক ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয় তবে রাষ্ট্রটি স্বাভাবিক নিয়মেই অপেক্ষাকৃত দূর্বল প্রতিপক্ষের প্রতি আগ্রাসন প্রদর্শন করবে বা প্রবণতা ব্যাক্ত করবে। এই ব্যাখ্যা দেয়ার মাধ্যমে মিয়ারশাইমার গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্বের যথার্থতাকেও নাকচ করেছেন। গণতান্ত্রিক শান্তি তত্ত্ব মূলত ব্যাখ্যা করে যে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো কখনওই বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে যুদ্ধে লিপ্ত হয়না বা শান্তিভঙ্গের কারণ সৃষ্টি করেনা; এবং আগ্রাসী বস্ততন্ত্রবাদ এই ব্যাখ্যাকে যৌক্তিক মনে করে না।
মিয়ারশাইমারের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কোন রাষ্ট্র বা একক শক্তির পক্ষে এককভাবে বিশ্ব রাজনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। তবে তিনি মনে করেন একটি রাষ্ট্র তার নিজস্ব বিস্তীর্ণ অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হতে পারে, নিদেনপক্ষে অপর কোন রাষ্ট্র যেন চালকের আসনে আসীন না হয় সেটি নিশ্চিত করার জন্য উদ্যত হতে পারে। এই তৎপরতা চালাতে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই কোন রাষ্ট্রকে অপর একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হতে পারে, তারা সমশক্তিধর হোক বা নাই হোক। কিছু রাষ্ট্র যারা ইতমধ্যে আঞ্চলিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়ান ফেডারেশান, তারা দূরে অবস্থান করে অন্যান্য পরস্পর প্রতিযোগী রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার জন্য উদ্যোগী হবে, এবং অন্যান্য অঞ্চলের রাজনীতিতে তখনই হস্তক্ষেপ করবে যখন সেই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণকারী বড় বা শক্তিধর রাষ্ট্রটি সেই কাজে ইতোমধ্যে ব্যার্থ হয়।
মিয়ারশাইমার বিভিন্ন সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চীন বিষয়ক নীতিমালার সমালোচনা করেছেন। যদিও এই যুগে চীনের কোন সামরিক উচ্চাকাংখার কথা জানা যায়না, তবুও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ক্রমান্বয়ের চীনের সাথে বাণিজ্যিক নৈকট্য বৃদ্ধির মাধ্যমে চীনকে এমন একটি অবস্থান গ্রহণের সুযোগ দিচ্ছে যার ফলে নির্দিষ্ট সময় পর নিজের দোষেই যুক্তরাষ্ট্রর নিরাপত্তার পক্ষে একটি হুমকি সৃষ্টি হবে। মিয়ারশাইমার মত দিয়েছেন যে ইতমধ্যেই চীনের উল্লেখযোগ্য প্রতিবেশীরা চীনের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও প্রভাবের কারণে নানান আশঙ্কা প্রকাশ করছে। এই আশঙ্কার বশবর্তী হয়ে তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে উদ্যত হচ্ছে যাতে করে চীনের সাথে বৈরীতা চলাকালীন সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দূরে অবস্থান করে ভারসাম্য সৃষ্টিকারী হিসেবে অবদান রাখতে পারে।