জয় বাংলা একটি স্লোগান যা বাংলাদেশে ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম রাজ্যে ব্যবহৃত হয়। এটি বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান।[১] ১৯২২ সালে কাজী নজরুল ইসলাম তার ভাঙার গান কাব্যে ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কবিতায় সর্বপ্রথম "জয় বাঙলা" শব্দ যুগল ব্যবহার করেন। নজরুলের কাব্যে উৎপত্তির পর কালক্রমে এটি স্লোগানে পরিণত হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্লোগান জনগণকে তাদের মুক্তিসংগ্রামে প্রবলভাবে প্রেরণা যুগিয়েছিল। ভারতের বাঙালি অধ্যুষিত পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বরাক উপত্যকার লোকেরাও বাঙালির ঐক্য বোঝাতে এর ব্যবহার করে থাকে। এর আগে বাঙালি কখনো এত তীব্র, সংহত ও তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান দেয় নি, যাতে একটি পদেই প্রকাশ পেয়েছে রাজনীতি, সংস্কৃতি, দেশ, ভাষার সৌন্দর্য ও জাতীয় আবেগ।[২] জয় বাংলা স্লোগান ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাঙালির প্রেরণার উৎস। সফল অপারেশন শেষে বা যুদ্ধ জয়ের পর অবধারিত ভাবে মুক্তিযোদ্ধারা চিৎকার করে "জয় বাংলা" স্লোগান দিয়ে জয় উদ্যাপন করত।[৩]
জয় বাংলার উৎপত্তি সম্বন্ধে জানা যায় যে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা ছিলেন মাদারীপুরের স্কুল শিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাস। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন এর জন্য জেল-জুলুম-নির্যাতনের শিকার হন তিনি। তার আত্মত্যাগ, তার স্বজাত্যবোধে মুগ্ধ হয়ে পূর্ণচন্দ্র দাস মহাশয়ের কারামুক্তি উপলক্ষে কালিপদ রায়চৌধুরীর অনুরোধে কবি নজরুল রচনা করেন ভাঙার গান কাব্যগ্রন্থের ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ (১৯২২) কবিতাটি।[৪][৫] এই কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম প্রথম ‘জয় বাংলা’ শব্দটি ব্যবহার করেন।[৬][৭][৮] তার রচিত ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রবন্ধেও জয় বাংলা পাওয়া যায়। নিচে ‘পূর্ণ-অভিনন্দন’ কাব্য থেকে উদ্ধৃত হল:[৯]
“ | জয় বাংলার পূর্ণচন্দ্র, জয় জয় আদি অন্তরীণ, |
” |
একসূত্রে বলা হয়েছে যে ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে শিক্ষা দিবস (১৭ মার্চ) যৌথভাবে পালনের জন্য কর্মসূচি প্রণয়নের সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর আহুত সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আফতাব আহমেদ ও চিশতী হেলালুর রহমান "জয় বাংলা" স্লোগানটি সর্বপ্রথম উচ্চারণ করেন।[১০] তবে ১৯ জানুয়ারি ১৯৭০-এ ঢাকা শহরের পল্টনের এক জনসভায় ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান তার ভাষণে সর্বপ্রথম "জয় বাংলা" স্লোগানটি উচ্চারণ করেছিলেন বলে প্রচলিত আছে।[১১] বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজে প্রথম "জয় বাংলা" স্লোগানটি উচ্চারণ করেন ৭ মার্চ ১৯৭১-এ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভার ভাষণে।[১২]
এই স্লোগান-এর উৎপত্তি সম্পর্কে আর একটি তথ্য পাওয়া যায় তা হল, কাজী নজরুল ইসলামের সম্পাদনায় প্রকাশিত নবপর্যায় (১৯৪০) নবযুগ পত্রিকার ৩রা বৈশাখ ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ (১৯৪২) সংখ্যায় ‘বাঙালির বাঙলা’ নামে প্রকাশিত প্রবন্ধে তিনি (কাজী নজরুল ইসলাম) বলেন:[১৩]
“ |
‘বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও; |
” |
— বাঙালির বাঙলা, কাজী নজরুল ইসলাম |
১৯৪২ সালে বঙ্গবন্ধু কলকাতায় ছিলেন, নবযুগ পত্রিকার সেই উদ্দীপ্ত প্রবন্ধ তাকে তখন বা পরে উজ্জীবিত করে থাকতে পারে।[১৫]
আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ ১৯৭১ তারিখে প্রদত্ত তার বিখ্যাত সাতই মার্চের ভাষণ সমাপ্ত করেছিলেন "জয় বাংলা" উচ্চারণ করে। এই ভাষণের পর থেকে এটি সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করে। এর কাছাকাছি শব্দ ছিল ফার্সি "জিন্দাবাদ"। তৎকালীন বর্ষীয়ান জননেতা মাওলানা ভাসানী ১৯৭১-এর শুরু থেকে "স্বাধীন বাংলা জিন্দাবাদ", "আযাদ বাংলা জিন্দাবাদ" প্রভৃতি স্লোগান ব্যবহার করতেন। ১৯৭১-এর মার্চ থেকে জনসভা, মিছিলে এবং প্রচারণায় "জয় বাংলা" স্লোগানটি ব্যবহৃত হতে থাকে। ২৭ মার্চ ১৯৭১ সালে মেজর জিয়াউর রহমান অস্থায়ী কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে যে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেছিলেন তার শেষেও তিনি "জয় বাংলা" উচ্চারণ করেন।[১৬] মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময় "জয় বাংলা" ব্যবহার করা হতো। এই বেতার কেন্দ্রের স্বাক্ষরসঙ্গীত ছিল জয় বাংলা, বাংলার জয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ১১ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে প্রচারিত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহ্মদের প্রথম বেতার ভাষণটি শেষ হয়েছিল "জয় বাংলা, জয় স্বাধীন বাংলাদেশ" স্লোগান দিয়ে। আজও স্লোগানটি সমান ভাবে রাজনৈতিক স্লোগান হিসাবে ব্যবহার হয় ৷[১৭]
২০১১ ও ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানান যে, কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা থেকেই বঙ্গবন্ধু এই "জয় বাংলা" স্লোগানটি নিয়েছিলেন।[৭][৮]
২০২০ সালের ১০ মার্চ জয় বাংলা স্লোগানকে বাংলাদেশের জাতীয় স্লোগান হিসেবে গ্রহণের জন্য হাইকোর্ট রায় প্রদান করেন। বাংলাদেশ হাইকোর্টের বিচারপতি নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রায় দেন।[১৮]
জয় বাংলা কে জাতীয় স্লোগান ঘোষণার পর জাতীয় দিবসগুলোতে উপযুক্ত ক্ষেত্রে সাংবিধানিক পদাধিকারী ও রাষ্ট্রীয় সকল কর্মকর্তা সরকারি অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান যাতে উচ্চারণ এবং সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রাত্যহিক সমাবেশ শেষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীগণ যাতে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করেন সেই আদেশ প্রদান এবং তা আগামী তিন মাসের মধ্যে কার্যকর করার নির্দেশ দেওয়া হয়।[১৯]
উল্লেখ্য, জয় বাংলা কে জাতীয় স্লোগান হিসেবে ঘোষণা প্রদান চেয়ে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ড. বশির আহমেদ হাইকোর্টে রিট করেন।[১৮] ২০২২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।[২০] ২ মার্চ ২০২২ জয় বাংলাকে জাতীয় স্লোগান ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ প্রজ্ঞাপন জারি করে।[২১] এতে বলা হয়:[২২]
"জয় বাংলা" হল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক স্লোগান। কোন বক্তৃতা ও বার্তা শেষে দলটির সদস্যরা বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি প্রেম দেখাতে "জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু" শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন।
পশ্চিমবঙ্গে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের জন্য ভারতে বাঙালির জাতীয় সংগঠন "বাংলা পক্ষ" জয় বাংলা স্লোগান দেয়।
২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে, বিজেপির স্লোগান জয় শ্রীরাম স্লোগানের বিকল্প হিসাবে তৃণমূল কংগ্রেস জয় বাংলা স্লোগানটি ব্যবহার শুরু করে।[২৪] নির্বাচনে বিজয়ের পর তিনি এই স্লোগান জয়ে সাহায্য করেছে বলে কৃতিত্বও দেন।[২৫]
১৯৭০ সালে জয় বাংলা নামে একটি চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়। এর পরিচালক ছিলেন ফখরুল আলম, কাহিনি ও সংলাপ রচয়িতা মাহবুব তালুকদার, সংগীত পরিচালক আনোয়ার পারভেজ, প্রযোজক মোহাম্মদ আবুল খায়ের। পরিবেশক ছিলেন চিত্রকল্প প্রোডাকশনের ব্যানারে সালাউদ্দীন। চলচ্চিত্রটি ১৯৭০ সালের শেষ ভাগে পাকিস্তান সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই চলচ্চিত্রের জয় বাংলা, বাংলার জয় গানটি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়। [২৬]
এই পত্রিকায় নজরুলের প্রবন্ধ ‘বাঙালির বাঙলা’ প্রকাশ পায় ৩রা বৈশাখ, ১৩৪৯ বঙ্গাব্দ সংখ্যায়। লেখার শিরোনামটিই অনন্য এবং ১৯৪২ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে খুবই আগ্রহব্যঞ্জক, বিশেষ করে বাঙালিদের জন্য। নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধু সেটি পাঠ করেছেন এবং শুধু তিনি নন, বাঙালি ছাত্রনেতাদের অনেকেই সেটি পড়ে থাকবেন। এই প্রবন্ধের প্রভাবেই বঙ্গবন্ধুর মনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের ভ্রুণ স্থাপিত হয়েছিল যা পরে তিনি বাঙালির মুক্তির স্লোগান হিসেবে ছড়িয়ে দেন।