জসিম বিন মোহাম্মাদ আলে সানি جاسم بن محمد آل ثاني | |
---|---|
রাজত্ব | ১৮ ডিসেম্বর, ১৮৭৮–১৭ জুলাই, ১৯১৩ |
পূর্বসূরি | মোহাম্মদ বিন সানি |
উত্তরসূরি | |
জন্ম | ১৮২৫ মুহাররাক, বাহরাইন |
মৃত্যু | ১৭ জুলাই ১৯১৪ লুসাইল, কাতার | (বয়স ৮৮–৮৯)
পিতা | মোহাম্মদ বিন সানি |
ধর্ম | ইসলাম |
কাতারের আমির এর রীতি | |
---|---|
উদ্ধৃতিকরণের রীতি | মাননীয় |
কথ্যরীতি | আপনার মর্যাদা সুউচ্চ হোক |
বিকল্প রীতি | শেখ |
জসিম বিন মোহাম্মদ আলে সানি (আরবি: جاسم بن محمد آل ثاني; ১৮২৫ – ১৯১৩) আধুনিক কাতারের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দ্য ফাউন্ডার নামেও পরিচিত। তিনি ১৯ শতকের শেষের দিকে উসমানি সেনাবাহিনী থেকে কাতার অধিগ্রহণ করেন। তার মোট ৫৬ জন সন্তান ছিলেন; ১৯ জন ছেলে ও ৩৭ জন মেয়ে।[১][২][৩]
যদিও শেখ জসিম বিন মুহাম্মদ আল থানির জন্মের সঠিক তারিখ অজানা, তবে অনুমান করা হয় যে, তিনি ১৮২৫ সালের দিকে জন্মগ্রহণ করেন।[২] শেখ জসিম কাতারের ফুওয়াইরিতে বেড়ে ওঠেন।[১] তিনি নিজেকে তামিম গোত্রের বংশধর বলে দাবি করেন। কারণ তিনি ছিলেন মুহাম্মদ বিন থানির জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি যৌবনেই দেশ পরিচালনা বিষয়ে পূর্ণ দক্ষতা অর্জন করেন এবং এমন এক সময়কালে তিনি দেশ পরিচালনা করেন, যা বড় বড় ঘটনা ও পরিবর্তনের সাক্ষী ছিল। তার বাবার ডেপুটি হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় রাজনীতিতে জড়িত থাকার ফলে জসিম রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন।
কিছুদিন পর তিনি বাবার সাথে বিদ্দায় চলে আসেন। তখন তিনি ২১ বছর বয়সী ছিলেন এবং সেখানে তিনি নিজের সঙ্গীদের মধ্যে একজন তরুণ নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন, যা পরবর্তীতে কাতার আক্রমণকারীদের প্রতিহত করার মাধ্যমে তিনি প্রমাণিত করেন।[১][২] তিনি স্থানীয় পর্যায়ে কাতারকে একটি একক ঐক্যবদ্ধ ও স্বাধীন সত্তায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে কাতার শুরুতেই একটি সুসংগত ও স্থিতিশীল দেশ হিসাবে আবির্ভূত হয়। স্থানীয় উপজাতিদের তিনি নিজের ভবিষ্যত শুরু করার জন্য একত্র করেন এবং কাতারের অস্তিত্ব ও সীমানাকে সুসংহত করেন।
তিনি পারস্য উপসাগর ও এর অঞ্চলসমূহে আধিপত্য বিস্তারে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী দুটি প্রধান বড় শক্তি ব্রিটিশ সাম্রাজ্য এবং উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাথে মোকাবেলা করার নীতি গ্রহণ করেন। ১৬ শতকের পর পর্তুগিজরা উক্ত অঞ্চল ছেড়ে গেলে উভয় পরাশক্তি তা নিজেদের কব্জায় রাখার জন্যে জোড় চেষ্টা চালায়।[১]
১৮৬৭ সালে শেখ জসিম বাহরাইনের শাসক মুহাম্মদ বিন খলিফা কর্তৃক বন্দী হন। তিনি একজন অভিযুক্ত কাতারি বেদুইনকে গ্রেফতার করার বিষয়ে আলোচনা করতে বাহরাইন ভ্রমণ করেছিলেন। বেদুইনকে ফেরত পাঠানো বিষয়ে তার দাবি বাহরাইনকে উস্কে দেয়। ফলে আবুধাবির সমর্থনে তারা কাতারের প্রধান প্রধান শহরগুলিতে আক্রমণ চালায় এবং এতে উল্লেখযোগ্য ক্ষতিসাধন করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে ১৮৬৪ সালে কাতার বাহরাইন আক্রমণ করে। এতে প্রায় ১ হাজার লোক মারা যায় এবং ষাটটি জাহাজ ডুবে যায়। বন্দী শেখ জসিম পরে বাহরাইনের বন্দীর বিনিময়ে মুক্তি পান।
১৮৭১ সালের এপ্রিলে বাগদাদের উসমানীয় গভর্নর মিদাত পাশা কর্তৃক পূর্ব আরবে প্রেরিত একটি সৈন্য দল কাতার উপকূলে এসে পৌঁছয়।[১][৩] সৈন্যদের অবতরণ নিশ্চিত করার প্রয়াসে উসমানীয়রা শেখ জসিমের কাছে উসমানীয় পতাকা বহনকারী একজন দূত পাঠায়। তিনি পতাকাটি গ্রহণ করেন এবং উড্ডয়ন করেন। সেই বছরের ডিসেম্বরেই তিনি উসমানীয়দের আলবিদ্দায় সামরিক সরঞ্জাম ও ১০০ সৈন্য পাঠানোর অনুমতি দেন। ১৮৭২ সালের জানুয়ারি মাসে কাতার আনুষ্ঠানিকভাবে উসমানীয় সাম্রাজ্যের সাথে নজদের একটি প্রদেশ হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয় এবং শেখ জসিম এর কায়কাম (সাব-গভর্নর) নিযুক্ত হন।[৪]
১৮৭৮ সালের ১৮ ডিসেম্বরে শেখ জসিমের ক্ষমতা গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ সময় ছিল। এ সময় আধুনিক কাতার রাষ্ট্রের সূচনা ছিল, যা জসিম বিন মুহাম্মাদের অধ্যবসায়ী প্রচেষ্টার ফলে অর্জিত হয়। তখন কাতার রাজ্যের স্বাধীনতা উভয় শক্তি দ্বারা পূর্ণ স্বীকৃতি লাভ করে।[১][২] স্থানীয় উপজাতিদের অসম্মতি সত্ত্বেও তিনি উসমানি শাসনকে সমর্থন করতে থাকেন। তবে শ্রীঘ্রই কাতারি-উসমানীয় সম্পর্ক শীঘ্রই স্থবির হয়ে পড়ে এবং ১৮৮২ সালে যখন উসমানীয়রা তাকে আবুধাবি - অধিকৃত আল খোর অভিযানে সহায়তা করতে অস্বীকার করে তখন তারা আরো বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়।[৫] ১৮৮৫ থেকে ১৮৮৬ সাল উসমানীয়দের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ার পর শেখ জসিম উসমানীয়দের পক্ষ থেকে সরে আসেন।[৬]
এরপর শেখ জসিম অতি শীঘ্রই উসমানীয় সাম্রাজ্যের জুবারাহ, দোহা, আল ওয়াকরাহ ও খোর আল উদায়ে প্রশাসনিক কর্মী নিয়োগ ও শুল্ক অফিস প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে কাতারে তার প্রভাব বাড়ানোর ফলে স্থানীয় বিরোধীদের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। ১৮৯২ সালের প্রথম দিকে তিনি কাতারের কায়কাম পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং সেই বছরের আগস্টে উসমানীয় সাম্রাজ্যকে কর প্রদান বন্ধ করেন।[৭]
উসমানীয়দের বিরোধিতা করার সাথে সাথে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সাম্রাজ্যবাদের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধেও বিরোধিতা শুরু করেন। ১৮৮২ সালে কাতারে তাদের মালিকাধীন দোকান বন্ধ করে দেয়ার পাশাপাশি তিনি ব্রিটিশ ভারতীয় মুক্তা সকল ব্যবসায়ীকে দোহা থেকে বহিষ্কার করেন।[৮]
১৮৯২ সালের অক্টোবর মাসে বসরার গভর্নর মাহমুদ হাফিজ পাশার নেতৃত্বে প্রায় ২০০ জনবল নিয়ে গঠিত উসমানীয় সেনাবাহিনীর একটি দলকে শেখ জসিমের সীমালঙ্ঘনের জবাবে কাতারে পাঠানো হয়।[৯] তারা ১৮৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে কুয়েত থেকে অতিরিক্ত শক্তিবৃদ্ধি নিয়ে কাতার পৌঁছায়। শেখ জসিম তখন মৃত্যু বা কারাবাসের আশঙ্কায় প্রথমে আলদায়েন এবং পরবর্তীতে দোহা থেকে দশ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত আল ওয়াজবাহ দুর্গে পালিয়ে যান। তখন তার সাথে সেখানে বেশ কয়েকটি কাতারি উপজাতির লোকও ছিল।[১০][১১]
মাহমুদ পাশা শেখ জসিমকে একটি চিঠি পাঠান, যাতে তিনি তার সৈন্য ত্যাগ করেন এবং উসমানীয়দের প্রতি আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দেন। শেখ জসিম উসমানীয় কর্তৃপক্ষের কথা মেনে চলতে অস্বীকার করার বিষয়ে অনড় থাকেন এবং অসুস্থতার কারণে মাহমুদের সাথে দেখা করতে অস্বীকার করেন। এর পরিবর্তে তিনি তার ভাই আহমদ বিন মুহাম্মদ আল থানিকে নিজের দূত নিযুক্ত করে আলোচনা জারি রাখেন। দীর্ঘ এক মাস আলোচনার পর মার্চ মাসে মাহমুদ পাশা ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন এবং শেখ জসিমের ভাই ও ১৩ থেকে ১৬ জন বিশিষ্ট কাতারি উপজাতি নেতাকে উসমানীয় কর্ভেট মেরিখে বন্দী করে রাখেন।[১০]
ফলস্বরূপ ১৮৯৩ সালের মার্চ একটি সামরিক সংঘর্ষ শুরু হয় এবং শেখ জসিমের নেতৃত্বে কাতারি বাহিনী ও উসমানীয় সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ শুরু হয়। তিনি এবং বেশ কয়েকটি কাতারি উপজাতি বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী একটি বড় যুদ্ধে লড়াই করে এবং তারা উসমানীয় সৈন্যদের পরাজিত করে বিজয় অর্জন করে। বিজয়টি সিদ্ধান্তমূলক ছিল এবং তুর্কি বাহিনীর কাছে শেখ জসিমের ভাইয়ের বিনিময়ে বন্দীদের মুক্ত করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না।[১][২][৩]
যুদ্ধটি কাতারের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। এটিকে কাতারের স্বাধীনতা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রধান যুদ্ধগুলির মধ্যে একটি মনে করা হয়। আল ওয়াজবাহের প্রধান যুদ্ধে শেখ জসিম যে দুর্গ উসমানীয় সৈন্যদের প্রতিহত করতে ব্যবহার করেছিলেন সেটির নাম ছিল, আল ওয়াজবাহ দুর্গ এবং সেই দুর্গের নামেই এই যুদ্ধকে আল ওয়াজবাহের যুদ্ধ বাল হয়। এটি আল রাইয়ান পৌরসভায় অবস্থিত।[২][৩]
ব্রিটিশরা তুর্কি সৈন্য ও কাতারি উপজাতিদের মধ্যে বিবাদে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করে। কিন্তু কাতারকে ব্রিটিশ সুরক্ষার অধীনে রাখার বিষয়ে জসিমের প্রস্তাব গ্রহণ করতে তারা ব্যর্থ হয়। এদিকে তুর্কি বাহিনী শেখ জসিমের সাথে শান্তি স্থাপন করে। যদিও তখন দেশ পরিচালনার দায়িত্ব তিনি ছোট ভাই শেখ আহমদ বিন মুহাম্মদ আল থানির হাতে অর্পণ করে লুসাইল অঞ্চল শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করছিলেন। ১৮৮৪ সালের মে মাসের প্রথম দিকে শেখ জসিম ব্রিটিশ সরকারকে চিঠি দেন যে, তিনি সরকার থেকে পদত্যাগ করেছেন এবং এর দায়িত্ব তার ভাই আহমদ নিয়েছেন।[১২]
সে সময় বাহরাইনের ব্রিটিশ পলিটিকাল এজেন্ট শেখ আহমদকে একজন চতুর ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি ১৯০৫ সালের নভেম্বরে আল-বিদ্দায় তাঁর বাড়িতে শেখের সাথে দেখা করেন। শেখ আহমদের সাথে দেখা করার আগে এজেন্ট লুসাইলে তার বড় ভাই শেখ জসিমের সাথে দেখা করেন। শেখ জসিম তখন আশির দশকে ছিলেন এবং তার জামাতা নাসির বিন মুবারক আল-খলিফার সাথে থাকার সময় তিনি গুরুতর চক্ষু রোগে ভুগছিলেন। পলিটিক্যাল এজেন্টটি শেখ জসিমের সাথে দেখা করার কয়েক দিন পরে শেখ আহমদের বাড়িতে তার সফর সম্পর্কে লিখেন এবং এটিকে একটি অতিথিপরায়ণ সফর হিসাবে বর্ণনা করে লেখেন যে, শেখ আহমেদ আমাকে অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ স্টাইলে গ্রহণ করেন এবং আমাকে তার অতিথি কক্ষে রাখেন।
১৯০৫ সালের ডিসেম্বরে দোহায় তিনি তার চাকরের হাতে নিহত হন এবং তার হত্যাকারীর নাম ছিল বিন মুয়াম্মাম। যদিও গুজব ওঠে যে, খুনি এবং তার দুই সহযোগীকে শেখ জসিম মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। তবে এটি ভুল বলে প্রমাণিত হয়। শেখ জসিমের ছোট ভাই শেখ আহমাদ বিন মোহাম্মদ বিন থানির হত্যার পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ আলীকে পিতার অনেক দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য নিযুক্ত করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কিন্তু শেখ জসিম তাকে খুব ছোট বলে মনে করেন।
শেখ আহমদ নিহত হওয়ার পর ১৯০৫ সাল থেকে কার্যত শেখ জসিম পুনরায় রাজত্ব গ্রহণ করেন এবং ১৯১৩ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে পদে বহাল থাকেন।
শেখ জসিম ১৯১৩ সালের ১৭ জুলাই বিকালে মারা যান এবং দোহার উত্তরে লুসাইলে তাকে সমাহিত করা হয়।[১]