জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস বা এথনোহিস্টরি (Ethnohistory) হলো আদিবাসী মানুষের রীতিনীতি ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিক রেকর্ডগুলির পাশাপাশি তাদের জীবন ও ইতিহাস সম্পর্কিত তথ্যের উৎসগুলো পর্যালোচনা এবং অধ্যয়ন। এটি এমন সব বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর ইতিহাস অধ্যয়ন করে যা বর্তমান সময়ে বিদ্যমান থাকতে পারে বা নাও থাকতে পারে। এই শব্দটি আমেরিকার ইতিহাস সম্পর্কে লেখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়।
এথনোহিস্টরি তার ভিত্তি হিসাবে ঐতিহাসিক এবং নৃতাত্ত্বিক উভয় উপাত্তই (ডেটা) ব্যবহার করে। এটির ঐতিহাসিক পদ্ধতি এবং উপকরণ নথি ও পান্ডুলিপির প্রচলিত বা মানক ব্যবহারের চেয়ে ব্যতিক্রম। অনুশীলনকারীরা মানচিত্র, সংগীত, চিত্রকলা, ফটোগ্রাফি, লোককাহিনী, মৌখিক ঐতিহ্য, নিদর্শনস্থান অনুসন্ধান, প্রত্নতাত্ত্বিক উপকরণ, জাদুঘর সংগ্রহ, স্থায়ী রীতিনীতি, ভাষা এবং স্থাননাম ইত্যাদি উৎস উপাদান হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।[১]
মেক্সিকোয় আদিবাসীদের ইতিহাস নিয়ে গবেষণারত পণ্ডিতদের উপনিবেশিক যুগ থেকে শুরু হওয়া এক দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য রয়েছে; তারা মেক্সিকো আদিবাসীদের ইতিহাস লেখার জন্য বর্ণানুক্রমিক পাঠ্য এবং অন্যান্য উৎস ব্যবহার করেছিল। প্রত্নতত্ত্ববিদ রবার্ট ওউচোপ সম্পাদিত মধ্য আমেরিকান ইন্ডিয়ানদের হ্যান্ডবুক-এ (The Handbook of Middle American Indians)মেসোআমেরিকান জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাসের উপরেও কয়েকটি খণ্ড (ভলিউম) তৈরি হয়েছিল যা গাইড টু জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাসিক উৎস (Guide to Ethnohistorical Sources) হিসেবে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়।[২] খণ্ডগুলি প্রকাশিত হওয়ার সময়, তাতে ব্যবহৃত 'এথনোহিস্টোরি' (জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস) শব্দটি এবং এর ধারণাটি উভয়ই সাম্প্রতিক সময়ে সাহিত্যে প্রবেশ করে এবং এবিষয়ে এখনো কেউই সম্পূর্ণরূপে একমত হয় নি। " [৩] খণ্ডগুলোর উৎসগুলিকে এক জায়গায় জমা করা হয়েছিল যাতে পরবর্তীতে পেশাদারভাবে গ্রহণযোগ্য নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস তৈরি করতে ব্যবহার করা যায়। [৪]
বিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে শেষদিকে মেক্সিকোয় বেশ কয়েকজন নৃতাত্ত্বিক স্থানীয় নিউ মেক্সিকো ভাষায় বহু উপনিবেশিক বর্ণানুক্রমিক গ্রন্থগুলো নিয়মিতভাবে প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন, যা বর্তমানে জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস শাখায় নিউ ফিলোলোজি নামে পরিচিত। এটি মেক্সিকোর ইতিহাস রচনাকারীদের পূর্ববর্তী ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে নির্মিত যা আদিবাসীদের ইতিহাসকে পুরোপুরি একীভূত করেছিল। [৫][৬][৭]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ইন্ডিয়ান ক্লেইম কমিশন-এর দাবিতে মার্কিন গবেষণা সম্প্রদায় থেকে এই ক্ষেত্রটির উদ্ভব হয়েছিল। অনুশীলনকারীরা ইন্ডিয়ান দাবির পক্ষে ও বিপক্ষে উভয়টিতেই সাক্ষ্য দিয়ে এই তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গির চেয়ে একটি বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করেছিল। উদীয়মান পদ্ধতিটি প্রামাণ্য (ডকুমেন্টারি) ঐতিহাসিক উৎস এবং এথনোগ্রাফিক পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল। এরকম ঘটনাগুলোতে কাজ করা পন্ডিতদের মধ্যে একজন ছিলেন লাতিন আমেরিকান হাওয়ার্ড এফ. ক্লাইন, যিনি ফ্লোরিডা ইন্ডিয়ান্স এবং জিকারিলা অ্যাপাচি নিয়ে কাজ করার জন্য কমিশনে নিযুক্ত হয়েছিলেন।
ক্ষেত্রটি মেলানেশিয়াতেও পৌঁছেছে, যেখানে সাম্প্রতিক কালে ইউরোপীয় কনট্যাক্ট গবেষকদের প্রাচীন যোগাযোগ-উত্তর সময়কাল সরাসরি পর্যবেক্ষণ করতে এবং গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিক প্রশ্নগুলির সমাধান করার অনুমতি দিয়েছে। মাইকেল হারকিন যুক্তি দিয়েছেন যে ২০তম শতাব্দীর শেষের দিকে ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের মধ্যে সাধারণ সম্মিলনের একটি অংশ ছিল জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস।[৮]
বাহ্যিক অ-পাণ্ডিত্য চাপের হেতু কোনও অতিরিক্ত ব্যক্তিত্ব বা সচেতন পরিকল্পনা ছাড়াই জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস স্বভাবগতভাবে বিকশিত হয়েছিল; তা সত্ত্বেও, এটি সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের কেন্দ্রীয় বিষয়গুলিতে জড়িত হয়ে পড়েছিলো। জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাসবিদগণ নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিষয়ে তাদের বিশেষ জ্ঞান, ভাষাগত অন্তর্দৃষ্টি এবং সাংস্কৃতিক ঘটনাগুলো ব্যাখ্যা করে গর্ববোধ করেন। তারা দাবি করেন যে গড়পড়তা ইতিহাসবিদদের চাইতে তারা আরো গভীরভাবে বিশ্লেষণ করতে সক্ষম।[৯] তারা কেনো সংস্কৃতিকে ওই সংস্কৃতির নিজস্ব শর্তাদি এবং নিজস্ব সংস্কৃতি কোড অনুসারে বোঝার চেষ্টা করেন।[১০] বিভিন্ন রকম কাঠামোর মাঝে সেতুবন্ধন তৈরি এবং অতীতের বিষয়াদি ব্যাখ্যার স্বার্থে আরো তথ্যবহুল ধারণা উপলব্ধির কারণে এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাসের সংজ্ঞাটি কালক্রমে আরও পরিশ্রুত ও স্পষ্ট হয়েছে। প্রথমদিকে, জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস শাখাটি ইতিহাস থেকে যথাযথভাবে পৃথক হয়েছিল যেহেতু এটি একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল। উইলিয়াম এন ফেন্টনের বর্ণনা মতে নতুন মাত্রাগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিলো "পর্যালোচনায় এথনোলজিক্যাল ধারণা ও উপাদানের সমালোচনা এবং ঐতিহাসিক উৎস উপাদানগুলির ব্যবহার। [১১] জেমস অ্যাক্সটেলের সংজ্ঞা অনুসারে জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস হলো "জাতিতাত্ত্বিক ধারণা এবং শ্রেণিকরণের দ্বারা বিভিন্ন সংস্কৃতির ধরন ও পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের জন্য ঐতিহাসিক এবং জাতিতাত্ত্বিক পদ্ধতির ব্যবহার।"[১] অন্যরা এই প্রাথমিক ধারণাটিকে পূর্বে উপেক্ষা করা ইতিহাস-কর্মীদের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। উদাহরণস্বরূপ, এড শিফেলিন দৃৃৃঢ়ভাবে বলেছিলেন যে, কীভাবে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ঘটনাগুলি গঠন করা হয় এবং অতীতকে সাংস্কৃতিকভাবে নির্মাণের পদ্ধতিতে মানুষের নিজস্ব বোধকে জাতিগত ইতিহাসের আলোচনায় অবশ্যই মৌলিকভাবে বিবেচনায় নিতে হবে।[১২] পরিশেষে, জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস সম্পর্কে সাইমন্স ধারণা রচনা করেছিলেন যে "এটি এমন এক সাংস্কৃতিক জীবনী যা সূত্র অনুসারে যতদূরসম্ভব দীর্ঘকালীন সময়ের বিভিন্ন ঘটনার সাক্ষ্য দেয়"। তিনি জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাসকে একটি সামগ্রিক ও ডায়াক্রোনিক পদ্ধতির উপর ভিত্তিকৃত একটি প্রচেষ্টা হিসাবে বর্ণনা করেছেন যা তখনই সবচেয়ে ফলপ্রসূ হয় যখন "জীবিত মানুষের স্মৃতি এবং কন্ঠে যোগ দিতে পারে" । [১৩]
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণার ক্ষেত্র হিসাবে নৃতাত্ত্বিক ইতিহাসের উপর আলোকপাতকালে হারকিন এটিকে ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের ক্ষেত্রগুলির একত্রিতকরণ এবং বিচ্যুতি এবং বিশ শতকের মধ্যভাগে মার্কিন ইন্ডিয়ানদের ভূমি দাবির বিশেষ পরিস্থিতি ও উত্তর আমেরিকার আইনি ইতিহাসের বিস্তৃত প্রসঙ্গের সাথে যুক্ত করেছেন।[১৪]
ইউরোপের চিরাচরিত সমাজগুলির (যেমন আয়ারল্যান্ডের) জাতিতাত্ত্বিক ইতিহাস গবেষণার সম্ভাবনার বিষয়ে মন্তব্য করে গাই বাইনার বলেছিলেন যে "নৃতাত্ত্বিক বিকাশের অগ্রণী ব্যক্তিত্বরা... যুক্তি দেখিয়েছেন যে পশ্চিমা সমাজ গবেষণার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতির ফলপ্রসূ প্রয়োগ করা যেতে পারে, তবে ইউরোপীয় সম্প্রদায়ে এই ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় নি এবং এখন অবধি ইউরোপীয় সম্প্রদায়ের নৃতাত্ত্বিক ইতিহাস খুব কমই লেখা হয়েছে"। [১৫]