জানবাজার | |
---|---|
কলকাতার অঞ্চল | |
স্থানাঙ্ক: ২৩°৪৮′ উত্তর ৮৮°১৫′ পূর্ব / ২৩.৮° উত্তর ৮৮.২৫° পূর্ব | |
দেশ | ভারত |
রাজ্য | পশ্চিমবঙ্গ |
শহর | কলকাতা |
ওয়ার্ড |
|
নিকটবর্তী মেট্রো স্টেশন | এসপ্ল্যানেড |
উচ্চতা | ৩৬ ফুট (১১ মিটার) |
সময় অঞ্চল | ভারতীয় সময় (ইউটিসি+৫:৩০) |
পিন | ৭০০ ০১৭ |
এলাকা কোড | +৯১ ৩৩ |
জানবাজার হল মধ্য কলকাতার একটি অঞ্চল। রানি রাসমণির দুশো বছরের পুরনো বাসভবনটি এই অঞ্চলের প্রধান দ্রষ্টব্য। রাসমণির বংশধরেরা এখনও এই বাড়িটিতে বাস করেন।
১৭৮৫ সালে প্রথম যখন কলকাতা শহরকে ৩১টি থানায় বিভক্ত করা হয়, তখন জানবাজার ছিল কলকাতার অন্যতম থানা। তবে পরে এই পরে এই থানাটি তুলে দেওয়া হয়।[১]
পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৫৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। দুর্গ নির্মাণের জন্য গোবিন্দপুর অঞ্চলটিকে মনোনীত করা হলে, সেই অঞ্চলের অধিবাসীদের সুতানুটিতে সরিয়ে দেওয়া হয়। কলকাতার ইউরোপীয় বসতি পুরনো এলাকার গণ্ডী ছাড়িয়ে ময়দান এলাকার আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে।[২] নতুন দুর্গের ভিতর সাধারণ নাগরিকদের বসবাস নিষিদ্ধ হয়ে যায়। তবে লালদিঘির দক্ষিণ ও চৌরঙ্গী রোডের পূর্ব দিকের অংশটিতে ইংরেজ বসতি প্রসারিত হয়। সেই থেকে সুতানুটি "ব্ল্যাক টাউন" (ভারতীয়দের বসতি) ও এসপ্ল্যানেড ও চৌরঙ্গী "হোয়াইট টাউন" (শ্বেতাঙ্গদের বসতি) নামে পরিচিতি লাভ করে।[৩]
প্রথম দিকে সেকালের জানবাজার রোড ও পার্ক স্ট্রিটের মাঝের এলাকায় প্রায় ৪০টি ইউরোপীয়ের বাড়ি ছিল।[৪] যদিও রাইটার্স বিল্ডিং (অধুনা মহাকরণ), বৈঠকখানা (বউবাজার), ধর্মতলা ও জানবাজার অঞ্চলে পরে নিম্নবর্ণীয় হিন্দু, পর্তুগিজ, আর্মেনিয়ান প্রমুখেরা এসে বসবাস শুরু করে। ফলে এই অঞ্চলটি পুরনো কলকাতার ভারতীয় ও শ্বেতাঙ্গ-প্রধান অঞ্চলের মাঝামাঝি এলাকায় পরিণত হয়।[৩]
কলকাতা পৌরসংস্থা এলাকার ৫২ ও ৪৬ নং ওয়ার্ডদুটি জানবাজার এলাকার অন্তর্গত।[৫]
ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত চৌরঙ্গী থেকে সার্কুলার রোড (অধুনা আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু রোড) পর্যন্ত এক মাইল দীর্ঘ রাস্তাটির নাম ছিল জানবাজার রোড। পরে এটির নাম হয় কর্পোরেশন স্ট্রিট।[৬] এখন এই রাস্তাটির নাম সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোড।
সেকালের কলকাতায় রাস্তায় তেলের আলো থাকত। তারপর গ্যাসের আলো ও বৈদ্যুতিক আলো আসে। কিছু সময় ধরে কলকাতার রাস্তায় গ্যাসের আলো থাকবে না বৈদ্যুতিক আলো থাকবে তা নিয়ে মতবিরোধ ছিল। ১৯১৪ সালে কর্পোরেশন স্ট্রিট ও চৌরঙ্গী রোডে ১,০০০ ক্যান্ডেল পাওয়ারের কেইথ ল্যাম্প লাগানো হয়। ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কর্পোরেশন তখন নিজেদের খরচে বৈদ্যুতিক আলোর সুফল সম্পর্কে লোককে অবহিত করত।[৭]
জানবাজার এখন কলকাতা পুলিশের নিউ মার্কেট থানার অন্তর্গত।[৮] থানাটিও জানবাজার এলাকাতেই অবস্থিত।
রানি রাসমণির বাসভবনটি জানবাজার এলাকার প্রধান দর্শনীয় স্থান। রানি রাসমণি ছিলেন দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির প্রতিষ্ঠাতা। ১১ বছর বয়সে জানবাজারের জমিদার রাজচন্দ্র দাসের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। রাসমণি নানা জনহিতকর কাজের জন্য বিখ্যাত ছিলেন।[৯][১০]
রানি রাসমণি রোড ও সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত রানি রাসমণির বাসভবনটির আদি ঠিকানা ছিল ৭০ ও ৭১ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট। রাসমণির শ্বশুর প্রীতিরাম দাস ১৮০৫ সালে এই বাড়িটি নির্মাণকাজ শুরু করেন। বাড়িটি সম্পূর্ণ হতে ৭-৮ বছর সময় লেগেছিল।[৯]
রাসমণি তার বাড়িতে দুর্গাপূজা উদ্যাপন করতেন প্রথা ও রীতিনীতি মেনে। সারা রাত যাত্রা হত। সেযুগে দুর্গাপূজায় সাহেবদের মনোরঞ্জন করার প্রবণতা থাকলেও রাসমণি তা করতেন না। ১৮৬১ সালে তার মৃত্যুর পর থেকে তার জামাইরা পুরনো জায়গাতেই দুর্গাপূজা উদ্যাপন করে আসছেন। রাসমণির বড়ো মেয়ের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ অমলনাথ দাস সিঁথিতে তাঁদের পৈতৃক দুর্গাপূজাটি এই বাড়িয়ে উঠিয়ে আনেন। বাড়ির একটি শাখা বাড়ির অন্য অংশে চলে যান প্রায় একশো বছর আগে। তারা আলাদা পূজা করেন। দাসেরা বলি না দিলেও, তাঁদের সাতটি পাঁঠাবলি হয়। চন্দননগরের শিল্পী প্রতিমা নির্মাণ করেন এবং প্রতিমার পোশাক আনা হয় বর্ধমান থেকে। চৌধুরীদের সুদৃশ্য প্রতিমাটিকে শোলার মুকুট পরানো হয়। [১১]
জয়া চালিহা ও বানি গুপ্তা
রানি রাসমণির পুত্রসন্তান ছিল না। তার চারটি মেয়ে ছিল – পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী ও জগদম্বা। বড় মেয়ে পদ্মমণির বিয়ে হয় রামচন্দ্র দাসের সাথে আর কুমারীর স্বামী হলেন প্যারিমোহন চৌধুরী। সেজো মেয়ে করুণাময়ী বিয়ের দুই বছর পরই মারা যান। তার স্বামী মথুরমোহন বিশ্বাস জগদম্বাকে বিবাহ করেন। তাদের পুত্র ত্রৈলোক্যনাথ বিশ্বাস। ত্রৈলোক্যনাথের চার পুত্র সন্তান - ব্রজগোপাল, নিত্যগোপাল, শ্রীগোপাল আর গোপাল। ব্রজগোপালের দুই কন্যা- লাবন্যলতা এবং বিদ্যুৎলতা। লাবন্যলতার বিবাহ হয় বিজয়কৃষ্ণ হাজরার সঙ্গে। রানী রাসমণির আদি দুর্গাপূজা বাড়ির যে অংশে হতো সেই অংশেই বর্তমানে হাজরা পরিবার বসবাস করেন এবং তারাই সেই দুর্গাপূজা পরিচালনা করেন। অন্যদিকে ত্রৈলোক্যনাথের আর এক পুত্র নিত্যগোপালের দুই সন্তান- সুশীল কুমার বিশ্বাস আর সুনীল কুমার বিশ্বাস। সুনীল কুমার বিশ্বাসের ছেলেরাই বর্তমানে ১৮ রানী রাসমণি রোডে, রানি রাসমণি ভবনের দুর্গাপূজা পরিচালনা করেন যা বিশ্বাস বাড়ির পুজো নামেই পরিচিত। সমগ্র বাড়িটির এখন তিনটি অংশ। জগদম্বার বংশধরেরা বাস করেন ১৩, রানি রাসমণি রোডে, কুমারীর বংশধরেরা থাকেন ১৮/৩ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে ও পদ্মমণির বংশধরেরা বাস করেন ২০ সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে।[৯]
রানি রাসমণি ছিলেন ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলায় নারী-ক্ষমতায়নের প্রতীক। তার বাসভবনের সব কটি ঘর এখনো বাসযোগ্য। বাড়ির সামনের বারান্দায় একটি নাটমন্দির আছে যেখানে পারিবারিক দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। কলকাতা পৌরসংস্থা বাড়িটি ঐতিহ্যবাহী স্থান বলে ঘোষণা করেছে।[১২] বাড়িটির কিছু অংশ এখন ভেঙে পড়েছে।[১৩]
জানবাজারের সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোড একটি ব্যস্ত রাস্তা। সাধারণত এই রাস্তায় প্রচুর যানজট হয়। এটি একটি দুর্ঘটনাপ্রবণ রাস্তা।[১৪] এই অঞ্চলের নিকটবর্তী কলকাতা মেট্রো স্টেশনটি হল এসপ্ল্যানেড।