ইসলাম |
---|
বিষয়ক ধারাবাহিক নিবন্ধের অংশ |
জান্নাত (আরবি: جنّة জান্নাহ্; বহুবচন: জান্নাত তুর্কি: Cennet), শাব্দিক. "স্বর্গ বা বাগান", সৎকর্মশীলদের চূড়ান্ত আবাসস্থল[১][২]) হলো পার্থিব জীবনে যে সকল মুসলিম আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলবে এবং পরকালীন হিসাবে যার পাপের চেয়ে পুণ্যের পাল্লা ভারী হবে ও আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে তাদের জন্য আল্লাহ সে সকল আবাসস্থল প্রস্তুত রেখেছেন।[৩] 'জান্নাত' একটি আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ বাগান, উদ্যান, আবৃৃত স্থান। ফার্সি ভাষায় একে বলা হয় বেহেশত। বাংলায় একে বলা হয় স্বর্গ। ইসলামি পরিভাষায়, আখিরাতে ঈমানদার ও নেককার বান্দাদের জন্য যে চির-শান্তির আবাস্থল তৈরি করে রাখা হয়েছে, তাকে জান্নাত বলা হয়। আল কুরআনে আটটি জান্নাতের নাম পাাওয় যায়। জান্নাত এর আটটি স্তর আছে।
কিছু মুসলিম আলেম মূল ইসলামী আরবী শব্দ "জান্নাত" (جنّة)-এর ব্যবহারকে অধিক উৎসাহিত করে থাকেন, যুক্তি হিসেবে তারা বলেন, জান্নাত শব্দটি কুরআনে ব্যবহৃত হয়েছে, তাই শব্দটি বলার সময় প্রতি হরফে দশ নেকি করে ৩ হরফে মোট ৩০ নেকি সাওয়াব পাওয়া যাবে, যা বেহেশত বা অন্যান্য অ-কুরআনীয় প্রতিশব্দ উচ্চারণে পাওয়া যাবে না। কুরআনীয় শব্দ বলায় প্রতি হরফে দশ নেকির ক্ষেত্রে তারা ইসলামী নবী মুহাম্মদ (সা.) এর উক্ত হাদীসটি পেশ করেন,
রাসূল (সা.) বলেছেন,
مَنْ قَرَأَ حَرْفًا مِنْ كِتَابِ اللَّهِ فَلَهُ بِهِ حَسَنَةٌ، وَالحَسَنَةُ بِعَشْرِ أَمْثَالِهَا، لَا أَقُولُ الم حَرْفٌ، وَلَكِنْ أَلِفٌ حَرْفٌ وَلَامٌ حَرْفٌ وَمِيمٌ حَرْفٌ
‘আল্লাহ তাআলার কিতাবের একটি হরফ যে ব্যক্তি পাঠ করবে তার জন্য এর সওয়াব আছে। আর সওয়াব হয় তার দশ গুণ হিসেবে। আমি বলি না যে, আলিফ-লাম-মীম একটি হরফ, বরং আলিফ একটি হরফ, লাম একটি হরফ এবং মীম একটি হরফ।’
— [সুনানে তিরমিযি, হাদিস: ২৯১০]
জান্নাত হলো চির-শান্তির স্থান। সেখানে সবকিছুই সুন্দর ও আকর্ষণীয় বস্তু দ্বারা সু-সজ্জিত। জান্নাতের ঘর-বাড়ি, আসন, আসবাবপত্র সবকিছু স্বর্ণ-রৌপ্য, মণি-মুক্তি, দ্বারা নির্মিত। জান্নাতে থাকবে রেশমের গালিচা, দুধ ও মধুর নহর। মিষ্টিপানির স্রোতধারা। বস্তুত আনন্দ উপভোগের সব-রকম জিনিসই জান্নাতে বিদ্যমান থাকবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
"সেখানে (জান্নাত) তোমাদের মন যা চাইবে তা-ই তোমাদের জন্য রয়েছে আর তোমরা যা দাবি করবে তাও তোমাদের দেওয়া হবে।" (সুরা হামিম আসসাজদা:৩১)
জান্নাতের বিবরণ দিয়ে মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন-
" আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন,
'আমি আমার পুণ্যবান বান্দাদের জন্য জান্নাতে এমন সব বস্তু তৈরি করে রেখেছি, যা কোনো (মানুষের) চোখ কোনোদিন দেখেনি, কোনো (মানুষের) কান কোনোদিন শোনেনি, আর মানুষের অন্তরও যা কোনো দিন কল্পনা করতে পারে নি।' (মিশকাহ্)
"
জান্নাত মোট আটটি। এগুলো হলো- কুরআনে বর্ণিত জান্নাতের নাম/ স্তর সমূহ :
حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ صَالِحٍ، حَدَّثَنَا فُلَيْحٌ، عَنْ هِلاَلِ بْنِ عَلِيٍّ، عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ ـ رضى الله عنه ـ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم " مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَبِرَسُولِهِ وَأَقَامَ الصَّلاَةَ وَصَامَ رَمَضَانَ، كَانَ حَقًّا عَلَى اللَّهِ أَنْ يُدْخِلَهُ الْجَنَّةَ جَاهَدَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، أَوْ جَلَسَ فِي أَرْضِهِ الَّتِي وُلِدَ فِيهَا ". فَقَالُوا يَا رَسُولَ اللَّهِ أَفَلاَ نُبَشِّرُ النَّاسَ. قَالَ " إِنَّ فِي الْجَنَّةِ مِائَةَ دَرَجَةٍ أَعَدَّهَا اللَّهُ لِلْمُجَاهِدِينَ فِي سَبِيلِ اللَّهِ، مَا بَيْنَ الدَّرَجَتَيْنِ كَمَا بَيْنَ السَّمَاءِ وَالأَرْضِ، فَإِذَا سَأَلْتُمُ اللَّهَ فَاسْأَلُوهُ الْفِرْدَوْسَ، فَإِنَّهُ أَوْسَطُ الْجَنَّةِ وَأَعْلَى الْجَنَّةِ، أُرَاهُ فَوْقَهُ عَرْشُ الرَّحْمَنِ، وَمِنْهُ تَفَجَّرُ أَنْهَارُ الْجَنَّةِ ". قَالَ مُحَمَّدُ بْنُ فُلَيْحٍ عَنْ أَبِيهِ " وَفَوْقَهُ عَرْشُ الرَّحْمَنِ ".
আবূ হুরায়রা থেকে বর্ণিতঃ:
তিনি বলেন, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের প্রতি যে ঈমান আনল, সালাত আদায় করল ও রমযানের সিয়াম পালন করল সে আল্লাহ্র পথে জিহাদ করুক কিংবা স্বীয় জন্মভূমিতে বসে থাকুক, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া আল্লাহ্র দায়িত্ব হয়ে যায়। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আমরা কি লোকদের এ সুসংবাদ পৌঁছে দিব না? তিনি বলেন, আল্লাহ্র পথে জিহাদকারীদের জন্য আল্লাহ্ তা’আলা জান্নাতে একশ’টি মর্যাদার স্তর প্রস্তুত রেখেছেন। দু’টি স্তরের ব্যবধান আসমান ও যমীনের দূরত্বের মত। তোমরা আল্লাহ্র কাছে চাইলে ফেরদাউস চাইবে। কেননা এটাই হলো সবচেয়ে উত্তম ও সর্বোচ্চ জান্নাত। আমার মনে হয়, রসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এও বলেছেন, এর উপরে রয়েছে আরশে রহমান। আর সেখান থেকে জান্নাতের নহরসমূহ প্রবাহিত হচ্ছে। মুহাম্মদ ইব্নু ফুলাইহ্ (রহঃ) তাঁর পিতার সূত্রে (নিঃসন্দেহে) বলেন, এর উপরে রয়েছে আরশে রহমান।
— সহিহ বুখারী, হাদিস নং ২৭৯০ হাদিসের মান: সহিহ হাদিস
হাদিস অনুসারে জান্নাতের সর্বমোট ১৮ টি,যেমনঃ
১. বাবুস সালাহ:- নামাজী ব্যক্তিদের দরজা।যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে আন্তরিকভাবে নিয়মিত নামাজ আদায় করবেন, তাদের সম্মানে জান্নাতের এই দরজার নাম রাখা হয়েছে।জান্নাতের ঐ দরজা দিয়ে শুধুমাত্র সালাত কায়েমকারী বা নামাজী ব্যক্তিগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে। এর আরেকটি নাম হলো বাবুল মুসল্লিন বা নামাজিদের দরজা বলা হয়।
২. বাবুর রাইয়ান:-যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে রোজা পালন করবেন, তাদের সম্মানে এই দরজার নামকরণ হয়েছে।জান্নাতের ঐ দরজা দিয়ে শুধুমাত্র রোজাদার ব্যক্তিরাই প্রবেশ করবে।এ আরেকটি নাম হলো বাবুস সায়েমিন বা রোজাদারদের দরজা বলা হয়।
৩. বাবুল মুজাহিদিন:-মুজাহিদদের দরজা।আল্লাহর পথে মুজাহিদকারীদের দরজা। যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে আল্লাহর পথে তার জীবন ও সম্পদ দিয়ে স্বচেষ্টা এবং জিহাদ করবে তার সম্মানে জান্নাতের এই দরজার নামকরণ হয়েছে।
৪. বাবুস সাদাকাহ:- দানবীরদের দরজা। মানুষের প্রয়োজনে যারা তাদের অর্থসম্পদ দিয়ে গরিব, ফকির,এতিম,দুঃস্থ অসহায় মানুষকে সাহায্য-সহযোগিতা করেছে, তাদের সম্মানে এই দরজার নামকরণ হয়েছে।
৫. বাবুল ঈমান:- ঈমানদার ব্যক্তিগণদের দরজা। যারা বিশ্বজাহান ও সমগ্ৰ মাখলুকাতের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপর, মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সৃষ্টিকুলের উপর সুদৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করবে এবং বিনাহিসেবে জান্নাতে স্থান পাবে, তাদের সম্মানে এই দরজার নামকরণ হয়েছে।
৬. বাবুল কাযিমিন আল-গায়িজ ওয়াল আফিনা আনিন্নাস:-রাগনিয়ন্ত্রণকারীদের দরজা।রাগকে নিয়ন্ত্রক-জিম্মাদার ও লোকের ভুলকে ক্ষমাশীল ব্যক্তিগণদের দরজা। যারা মানুষের ভুলকে ক্ষমা করে এবং নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে ও জিম্মায় রাখে, এই দরজার নামকরণ তাদের সম্মানে।
৭. বাবুর রাযিয়িন:-সন্তুষ্টকারীদের দরজা। যারা আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও যাদের ওপর সন্তুষ্ট, তাদের সম্মানের এ দরজার নামকরণ হয়েছে।এই দরজাকে কেউ কেউ বাবুল জিকির, বাবুল হজ, বাবুল ইলম ও বাবু লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ-ও বলে। যারা আল্লাহর ওপর সন্তুষ্ট এবং আল্লাহও যাদের ওপর সন্তুষ্ট, তাদের সম্মানের এ দরজার নামকরণ হয়েছে।
৮. বাবুত তওবা:-(ক্ষমাপ্রার্থী বা তওবাকারীদের দরজা) নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে যে আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, তাদের সম্মানার্থে জান্নাতের এই দরজার নামকরণ করা হয়েছে।এটি তওবাকারীদের জন্য সব সময় খোলা থাকে।
(৯)বাবুস সাদিকিন:- (সত্যবাদী বা সাদিকদের দরজা),যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে নিয়মিত সত্য কথা বলে এবং কখনো মিথ্যা কথা বলে না, তাদের সম্মানে ঐ দরজাটি দিয়ে সত্যবাদী ব্যক্তিগণরা জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(১০)বাবুল মুতাসাদ্দিকিন:- (পারস্পরিক বন্ধুত্বরক্ষক বা মুতাসাদ্দিকদের দরজা),যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে নিয়মিত একজন অপরজনের পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে এবং সেই পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে ও কখনো দুশমনি করে না, তাদের সম্মানে ঐ দরজাটি দিয়ে পারস্পরিক বন্ধুত্বরক্ষক ব্যক্তিগণরা জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(১১)বাবুজ জাকিরিন:- (জিকির-আযকারকারী বা জাকিরদের দরজা),যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে নিয়মিত বিশ্বজাহান ও সমগ্ৰ মাখলুকাতের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের অশেষ মহিমা প্রচার করে এবং মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের জিকির আযকারের মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন বা দিনাতিপাত করে, তাদের সম্মানে ঐ দরজাটি দিয়ে জাকির ব্যক্তিগণরা জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(১২)বাবুস সাবিরিন:- (ধৈর্যধারক বা সাবিরদের দরজা),যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে নিয়মিত ধৈর্য ধারণ করে বিশ্বজাহান ও সমগ্ৰ মাখলুকাতের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের প্রদত্ত বিভিন্ন রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিপদাপদে ও ধৈর্য হারা হয় না কখনো, তাদের সম্মানে ঐ দরজাটি দিয়ে সাবির ব্যক্তিগণরা জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(১৩)বাবুল খাশিয়িন:- (খোদাভীরু,তাকওয়াবান বা খাশিয়িনদের দরজা),যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে নিয়মিত বিশ্বজাহান ও সমগ্ৰ মাখলুকাতের মালিক মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের উপর তাকওয়া অবলম্বন বা খোদাভীতি প্রদর্শন করে, তাদের সম্মানে ঐ দরজাটি দিয়ে খোদাভীরু ব্যক্তিগণরা জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(১৪) বাবুদ দোহা:- (চাশতের নামাজ কায়েমকারীদের দরজা),যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে নিয়মিত চাশতের নামাজ আদায় করবেন, তাদের সম্মানে জান্নাতের এই দরজার নাম রাখা হয়েছে।জান্নাতের ঐ দরজা দিয়ে শুধুমাত্র দোহা সালাত কায়েমকারী বা চাশতের নামাজী ব্যক্তিগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(১৫) বাবুস সিলাহ:- (আত্মীয়তার সুসম্পর্ক স্থাপক বা সিলাহিনদের দরজা),যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে নিয়মিত নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় স্বজনদের সঙ্গে আত্মীয়তার সুসম্পর্ক স্থাপন করে এবং সেই সুসম্পর্ক বজায় রাখার জন্য স্বচেষ্টা করে,জান্নাতের ঐ দরজা দিয়ে শুধুমাত্র আত্নীয়তার সুসম্পর্ক স্থাপক বা সিলাহিন ব্যক্তিগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(১৬)বাবুল মুতাওয়াক্কিলিন:- (তাওয়াক্কুল অবলম্বক বা মুতাওয়াক্কিলদের দরজা),যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে নিয়মিত তাওয়াক্কুল অবলম্বন করবে,জান্নাতের ঐ দরজা দিয়ে শুধুমাত্র তাওয়াক্কুল অবলম্বন বা মুতাওয়াক্কিল ব্যক্তিগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে।
(১৭) বাবুল আয়মান:-শাফাআতপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণ দরজা।কিয়ামতের দিন যারা নবীজির সুপারিশে বিনা হিসাবে জান্নাতে স্থান পাবে, তাদের সম্মানে এই দরজার নামকরণ হয়েছে।
(১৮)বাবুল হাজ্জ্ব:-হাজীদের দরজা।যারা একনিষ্ঠতার সঙ্গে আন্তরিকভাবে মাসজিদুল হারাম বা কাবা শরীফ তাওয়াফ করার মাধ্যমে হজ্জ পালন করেন, তাদের সম্মানে জান্নাতের ঐ দরজা দিয়ে শুধুমাত্র হাজীগণ জান্নাতে প্রবেশ করবে।
ইমাম কুরতুবি জান্নাতের দরজার সংখ্যা ১৮টি উল্লেখ করেছেন।
জান্নাতের প্রশস্ততা সম্পর্কে কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
তোমরা দ্রুত অগ্রসর হও তোমাদের প্রতিপালকের ক্ষমার দিকে ও সেই জান্নাতের দিকে যার বিস্তৃতি হচ্ছে আসমানসমূহ ও যমীনের সমান, যা মুত্তাকীদের জন্য তৈরী করা হয়েছে।
জান্নাত দেখার পরই সঠিকভাবে বোঝা যাবে যে জান্নাত কত বিশাল এবং তার নিয়ামত কত অসংখ্য। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
তুমি যখন দেখবে তখন দেখতে পাবে ভোগ বিলাসের নানান সামগ্রী আর এক বিশাল রাজ্য।
— সূরাহ আদ্-দাহ্রঃ ২০
জান্নাতে শত স্তর আছে আর প্রত্যেক স্তরের মাঝে এত দূরত্ব আছে যতটা দূরত্ব আছে আকাশ ও মাটির মাঝে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন',
জান্নাতে শত স্তর আছে। প্রত্যেক স্তরের মাঝে দূরত্ব হলো আকাশ ও মাটির দূরত্বের সমান। আর ফেরদাউস তার মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরে আছে। আর সেখান থেকেই জান্নাতের চারটি ঝর্ণা প্রবহমান। এর উপরে রয়েছে আরশ। তোমরা আল্লাহ্র নিকট জান্নাতের জন্য দু'আ করলে জান্নাতুল ফেরদাউসের জন্য দু'আ করবে।
— তিরমিজী- কিতাবুল জান্নাহ
জান্নাতে একটি বৃক্ষের ছায়া এত লম্বা হবে যে কোন অশ্বারোহী ঐ ছায়ায় শত বছর পর্যন্ত চলতে পারবে। রাসূলুল্লাহ (সা) ,বলেন,
জান্নাতে এমন একটি বৃক্ষ আছে যার ছায়ায় কোন আরোহী শত বছর পর্যন্ত চলতে পারবে। আর তোমরা ইচ্ছা করলে তিলাওয়াত করতে পার এবং দীর্ঘ ছায়া। আর জান্নাতে তোমাদের কারও একটি ধনুকের পরিমাণ জায়গাও ঐ জায়গা অপেক্ষা উত্তম যেখানে সূর্য উদিত হয় আর সূর্য অস্তমিত হয় (অর্থাৎ পৃথিবীর চেয়ে)।
— সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা – ৩২৫২, ৩২৫৩
সর্বশেষ জান্নাতে প্রবেশকারীকে এ দুনিয়ার চেয়ে দশগুণ বড় জান্নাত দান করা হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
জাহান্নামে থেকে সবশেষে বের হয়ে আসা ব্যক্তিকে আমি চিনি। সে হামাগুড়ি দিয়ে জাহান্নাম থেকে বের হয়ে আসবে। তাকে বলা হবে, "যাও জান্নাতে প্রবেশ কর"। নবী সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, "সে গিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবে। সে দেখবে, লোকেরা স্ব স্ব স্থান অধিকার করে আছে। অতঃপর মহান আল্লাহ তাকে বলবেন, "আচ্ছা সে যুগের (জাহান্নামের শাস্তি) কথা তোমার স্মরণ আছে কি?" সে বলবে, "হ্যাঁ, মনে আছে"। তাকে বলা হবে, "তুমি কি পরিমাণ জায়গা চাও তা ইচ্ছা কর"। সে ইচ্ছা করবে। তখন তাকে বলা হবে, "তুমি যে পরিমাণ ইচ্ছা করেছো তা এবং দুনিয়ার দশগুণ জায়গা তোমাকে দেয়া হলো"। একথা শুনে সে বলবে, "আপনি আমার সাথে ঠাট্টা করছেন? অথচ আপনি হলেন সর্ব শক্তিমান"।
— সহিহ মুসলিম
বর্ণনাকারী ইবনে মাসুদ (রা.) বলেন,
"এ সময় আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে এমনভাবে হাসতে দেখেছি যে, তাঁর মাড়ির দাঁত পর্যন্ত প্রকাশ হয়ে পড়েছে'।
— সহীহ মুসলিম - কিতাবুল ঈমান
জান্নাতে সর্বশেষ ব্যক্তি প্রবেশ করার পরও অনেক জায়গা বাকী থাকবে যা পূর্ণ করার জন্য আল্লাহ্ তায়ালা নতুন জীব সৃষ্টি করবেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
জান্নাতে যতটুকু স্থান আল্লাহ্ চাইবেন ততটুকু স্থান খালি থেকে যাবে। অতঃপর আল্লাহ্ তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী অন্য এক জীব সৃষ্টি করবেন'।
— সহীহ মুসলিম - কিতাবুল জান্নাহ
কুরআন এ আল্লাহ্ তায়ালা বলেন',
"মুমিন পুরুষ আর মুমিন নারীর জন্য আল্লাহ্ অঙ্গীকার করেছেন জান্নাতের যার নিম্নদেশ দিয়ে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত, তাতে তারা চিরদিন থাকবে, আর জান্নাতে চিরস্থায়ী উত্তম বাসগৃহের; আর সবচেয়ে বড় (যা তারা লাভ করবে তা) হল আল্লাহ্র সন্তুষ্টি। এটাই হল বিরাট সাফল্য।"
— সূরাহ আত্-তাওবাহ ৭২
জান্নাতের অট্টালিকাসমূহ সোনা-রূপার ইট দিয়ে নির্মিত হবে। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, "আমি জিজ্ঞেস করলাম, "হে রাসূলুল্লাহ (সা)! সৃষ্টিকে কী দিয়ে সৃষ্টি করা হয়েছে?" রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেন, "পানি দিয়ে"। আমি জিজ্ঞেস করলাম, "জান্নাত কী দিয়ে নির্মিত?" তিনি বললেন,
"একটি ইট রৌপ্যের এবং আরেকটি ইট স্বর্ণের। তার গাঁথুনি হল সুগন্ধিযুক্ত মেশক আম্বর। তার কংকর মোতি ও ইয়াকুতের। তার মাটি জাফরানের। যে ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করবে সে জীবন উপভোগ করবে, তার কোন কষ্ট হবে না। চিরকাল জীবিত থাকবে, মৃত্যু হবে না। জান্নাতীদের কাপড় কখনো পুরানো হবে না। আর তাদের যৌবন কখনো বিনষ্ট হবে না"।
— তিরমিজী- কিতাবুল জান্নাহ
জান্নাতের কোন কোন অট্টালিকায় স্বর্ণের বাগান থাকবে। আবার কোন কোনটিতে রূপার বাগান থাকবে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
দুইটি জান্নাত এমন রয়েছে যে, এর যাবতীয় পাত্রসমূহ ও তার মধ্যে যা কিছু আছে সবই রৌপ্য নির্মিত। আবার দুইটি জান্নাত এমন আছে যে এর সমস্ত আসবাবপত্র এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে সবই স্বর্ণ নির্মিত। জান্নাতে আদনের অধিবাসীদের মধ্যে এবং তাদের প্রতিপালককে দর্শনের মধ্যে কেবল তাঁর বড়ত্ব ও মহানত্বের চাদরখানা ব্যতীত আর কোন আড়াল থাকবে না'।
— সহীহ মুসলিম - কিতাবুল ঈমান
জান্নাতের অট্টালিকাসমূহে সাদা মোতির নির্মিত বড় বড় সুন্দর গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। আনাস বিন মালেক (রা) থেকে মিরাজের হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
অতঃপর আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাওয়া হল, যাতে সাদা মোতির নির্মিত গম্বুজ আছে। আর তার মাটি হল মেশক আম্বরের'।
— সহীহ মুসলিম - কিতাবুল ঈমান
জান্নাতীদের প্রত্যেকের অট্টালিকায় তাঁবু থাকবে যেখানে হুরেরা অবস্থান করবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
তাঁবুতে সুরক্ষিত থাকবে সুলোচনা সুন্দরীরা।
— আর রাহমান - ৭২
জান্নাতের তাঁবু ষাট মাইল প্রশস্ত হবে।
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন ,
জান্নাতের মধ্যে ফাঁপা মোতির একটি তাঁবু থাকবে। এর প্রশস্ততা হবে ষাট মাইল। এর প্রতি কোণে থাকবে হুর-বালা। এদের এক কোণের জন অপর কোণের জনকে দেখতে পাবে না। ঈমানদার লোকেরা তাদের কাছে যাবে। এতে থাকবে দু'টি বাগান, যার সকল পাত্র এবং ভেতরের সকল বস্তু হবে রূপার তৈরি।
জান্নাতের বৃক্ষসমূহ কাঁটা বিহীন হবে ও তাদের ছায়া অনেক লম্বা হবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
আর ডানদিকের দল, কত ভাগ্যবান ডানদিকের দল! তারা থাকবে কাঁটা বিহীন বরই গাছগুলোর মাঝে। কলা গাছের মাঝে যাতে আছে থরে থরে সাজানো কলা, বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছায়া, অবিরাম প্রবাহমান পানির ধারে, আর পর্যাপ্ত ফলমূল পরিবেষ্টিত হয়ে।
— সূরা ওয়াক্বি'আহঃ ২৭-৩২
জান্নাতের বৃক্ষসমূহ সর্বদা শস্য-শ্যামল থাকবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
ঘন সবুজ এ বাগান দু'টি।
— সূরা আর রহমান ৬৪
জান্নাতের বৃক্ষসমূহের শাখাগুলো লম্বা ও ঘন হবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
দুটোই শাখা পল্লবে ভরপুর।
— সূরা আর রহমান ৪৮
রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন,
জান্নাতের প্রতিটি বৃক্ষের মূল হবে স্বর্ণের'। (তিরমিজী- কিতাবুল জান্নাত)
কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
তাতে আছে ফলমূল, আর খেজুর আর ডালিম।
— সূরা আর-রহমান - ৬৮
জান্নাতের প্রত্যেক জান্নাতীর পছন্দমত সর্ব প্রকার ফলমূল মজুদ থাকবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
মুত্তাকীরা থাকবে ছায়া আর ঝর্ণাধারার মাঝে, আর তাদের জন্য থাকবে ফলমূল-যেটি তাদের মন চাইবে। (তাদেরকে বলা হবে) তোমরা তৃপ্তির সাথে খাও আর পান কর, তোমরা যে কাজ করেছিলে তার পুরস্কারস্বরূপ। সৎকর্মশীলদের আমি এভাবেই প্রতিফল দিয়ে থাকি।
— সূরাহ আল-মুরসালাতঃ ৪১-৪৪
জান্নাতের ফল সর্বদা জান্নাতীদের নাগালের মধ্যে থাকবে। আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
জান্নাতের বৃক্ষরাজির ছায়া তাদের উপর থাকবে, আর ফলের গুচ্ছ একেবারে তাদের নাগালের মধ্যে রাখা হবে।
— আদ-দাহর ১৪
জান্নাতের ফলের ছড়া অনেক বড় হবে। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে সূর্য গ্রহণের সলাত সম্পর্কে বর্ণিত হাদীসে এসেছে যে, সাহাবাগণ রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়া সাল্লামকে জিজ্ঞেস করল, "হে রাসূলুল্লাহ্ (সা)! আমরা আপনাকে দেখলাম, আপনি এ স্থানে দাঁড়িয়ে কোন কিছু হাত বাড়িয়ে নিতে যাচ্ছেন। আবার একটু পরে দেখলাম হাত ফিরিয়ে নিলেন"। রাসূলুল্লাহ্ (স) বললেন,
আমি জান্নাত দেখতে পেলাম। অতএব জান্নাতে থেকে ফলের একটা ছড়া নিতে যাচ্ছিলাম। যদি তা নিয়ে নিতাম তবে তোমরা তা পৃথিবী কায়েম থাকা পর্যন্ত খেতে পারতে"।
— সহীহ মুসলিম
জান্নাতের নদীসমূহের পানির রং ও স্বাদ সর্বদা একই রকমের থাকবে। কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
মুত্তাকিদের যে জান্নাতের ওয়াদা দেয়া হয়েছে তার উপমা হলো তাতে আছে নির্মল পানির ঝর্ণা, আর আছে দুধের নদী যার স্বাদ অপরিবর্তনীয়, আছে পানকারীদের জন্য সুস্বাদু মদের নদী আর পরিশোধিত মধুর নদী।
— সূরাহ মুহাম্মদঃ ১৫
আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
"সাইহান, জাইহান, ফোরাত ও নীল জান্নাতের নদী"।
— সহীহ মুসলিম- কিতাবুল জান্নাত
হাকীম বিন মোয়াবিয়া তার পিতা থেকে তিনি নবী (স) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন,
জান্নাতে পানির সাগর, মধুর সাগর, দুধের সাগর ও শরাবের সাগর রয়েছে। এগুলো থেকে পরে আরো নহরের শাখা-প্রশাখা বের হবে।
— তিরমিজী
আবু সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (স) বলেছেন,
আল্লাহ্ স্বীয় দয়ায় যাকে খুশি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন এবং জাহান্নামীদেরকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। (অতঃপর দীর্ঘদিন পর বলবেন) দেখ যে ব্যক্তির অন্তরে বিন্দু পরিমাণ ঈমান আছে তাকে জাহান্নাম থেকে বের কর। তখন তারা এমন অবস্থায় বের হবে যে তাদের শরীর কয়লার ন্যায় জ্বলে গেছে। তখন তাদেরকে হায়াত বা হায়া নামক নদীতে নিক্ষেপ করা হবে। তখন তারা এমনভাবে সজীব হয়ে উঠবে, যেমন বন্যার আবর্জনার মাঝে চারাগাছ সজীব হয়ে উঠে। তোমরা কি কখনো দেখনি যে কেমন হলুদ রং বিশিষ্ট হয়ে ওঠে"।
— সহীহ মুসলিম- কিতাবুল ঈমান
আনাস ইবনুল মালিক (রা) সূত্রে নবী (স) হতে বর্ণিত। তিনি বলেছেন,
আমি জান্নাতে ভ্রমণ করছিলাম, এমন সময় এক নহরের কাছে এলে দেখি যে তার দু'ধারে ফাঁপা মুক্তার গম্বুজ রয়েছে। আমি বললাম, "হে জিব্রীল! এটা কী?" তিনি বললেন, "এটা ঐ কাউসার যা আপনার প্রতিপালক আপনাকে দান করেছেন"। তার ঘ্রাণে অথবা মাটিতে ছিল উত্তম মানের মিশ্ক এর সুগন্ধি।
— সহীহ বুখারী, হাদীস সংখ্যা-৬৫৮১
আবদুল্লাহ বিন ওমর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
কাওছার জান্নাতের একটি নদী। যার উভয় তীর স্বর্ণ নির্মিত। তার পানি ইয়াকুত ও মোতির উপর প্রবহমান। তার মাটি মেশকের চেয়েও বেশি সুগন্ধময়। তার পানি মধুর চেয়ে অধিক মিষ্টি এবং দুধের চেয়ে অধিক সাদা।
— তিরমিজী
আনাস বিন মালেক (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, কাওছার কি? তিনি বললেন,
এটি একটি নদী, যা আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে জান্নাতে দান করবেন। তা দুধ অপেক্ষা সাদা এবং মধু থেকেও সুমিষ্ট। এর মাঝে রয়েছে বহু পাখি। এগুলোর গর্দান হবে উটের গর্দানের মত।
— তিরমিজী
উমর রা বললেন, "এগুলো তো খুব মোটা-তাজা হবে"। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন,
এগুলোর আহারকারী আরো সুখী হবে।
— তিরমিজী- কিতাবুল জান্নাহ
কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
তাদের সামনে ঘুরে ঘুরে রুপার পাত্র পরিবেশন করা হবে আর সাদা পাথরের পানপাত্র। সেই সাদা পাথরও হবে রুপার তৈরি। তারা এগুলোকে যথাযথ পরিমাণে ভর্তি করবে। তাদেরকে পান করানোর জন্য এমন পাত্র পরিবেশন করা হবে যাতে আদার মিশ্রণ থাকবে। সেখানে আছে একটা ঝর্ণা, যার নাম সালসাবীল।
— সূরা আদ্-দাহ্রঃ ১৫-১৮
মহান আল্লাহ্ আরো বলেন,
(অপরদিকে) নেক্কার লোকেরা এমন পানপাত্র থেকে পান করবে যাতে কর্পুরের সংমিশ্রণ থাকবে। আল্লাহ্র বান্দারা একটি ঝর্ণা থেকে পান করবে। তারা এই ঝর্ণাকে (তাদের) ইচ্ছেমত প্রবাহিত করবে।
— সূরাহ আদ্-দাহ্রঃ ৫-৬
সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ বলেন,
পুণ্যবান লোকেরা থাকবে অফুরন্ত নিয়ামতের মাঝে। উচ্চ আসনে বসে তারা (চারদিকের সবকিছু) দেখতে থাকবে। তুমি তাদের মুখে আরাম আয়েশের উজ্জ্বলতা দেখতে পাবে। তাদেরকে পান করানো হবে সীল-আঁটা উৎকৃষ্ট পানীয়। তার সীল হবে মিশ্কের, প্রতিযোগীরা এ বিষয়েই প্রতিযোগিতা করুক। তাতে মেশানো থাকবে 'তাসনীম, ওটা একটা ঝর্ণা, যা থেকে (আল্লাহ্র) নৈকট্যপ্রাপ্তরা পান করবে।
— সূরাহ আল-মুতাফ্ফিফীনঃ ২২-২৮
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
তাদের জন্য আছে নির্ধারিত রিয্ক- ফলমূল; আরা তারা হবে সম্মানিত। (তারা থাকবে) নি'য়ামাতের ভরা জান্নাতে উচ্চাসনে মুখোমুখী হয়ে তাদের কাছে চক্রাকারে পরিবেশন করা হবে স্বচ্ছ প্রবাহিত ঝর্ণার সুরাপূর্ণ পাত্র। নির্মল পানীয়, পানকারীদের জন্য সুপেয়, সুস্বাদু। নেই তাতে দেহের জন্য ক্ষতিকর কোন কিছু, আরা তারা তাতে মাতালও হবে না।
— সূরাহ আস্-সা-ফ্ফাতঃ ৪১-৪৭
আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
দুটো বাগানেই আছে অবিরাম ও প্রচুর পরিমাণে উৎক্ষিপ্তমান দুটো ঝর্ণাধারা। অতএব (হে জ্বিন ও মানুষ!) তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের কোন কোন নি'মাতকে অস্বীকার করবে?
— সূরাহ আর্-রহমানঃ ৬৬-৬৭
এছাড়া জান্নাতের ঝর্ণা সম্পর্কে কুরআন এ বর্ণিত হয়েছে যে,
সেখানে থাকবে প্রবাহমান ঝর্ণা।
— সূরা আল-গাশিয়াহঃ ১২
মহান আল্লাহ্ বলেন,
নিশ্চয়ই মুত্তাকীরা থাকবে নিরাপদ স্থানে, বাগান আর ঝর্ণার মাঝে।
— সূরা আদ্-দুখানঃ ৫১-৫২
মহান আল্লাহ্ বলেন,
মুত্তাকীরা থাকবে ছায়া আর ঝর্ণাধারার মাঝে, আর তাদের জন্য থাকবে ফলমূল-যেটি তাদের মন চাইবে।
— সূরা আল-মুরসালাতঃ ৪১-৪২
আবু হুরাইরাহ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
জান্নাতে প্রবেশকারী প্রত্যেক ব্যক্তি আদম আলাইহিস সলাতু ওয়াস সালামের ন্যায় ষাট হাত লম্বা হবে। (প্রথমে মানুষ ষাট হাত ছিল) পরবর্তীতে তারা খাট হতে লাগল, শেষে বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে।
— সহীহ মুসলিম
মোয়াজ বিন জাবাল (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ নবী (সা) বলেছেন,
জান্নাতিরা জান্নাতে প্রবেশের সময় তাদের চেহারায় কোন দাড়ি-গোঁফ থাকবে না। চক্ষুদ্বয় লাজুক হবে। বয়স হবে ত্রিশ থেকে তেত্রিশ এর মাঝামাঝি।
— তিরমিজী
জাবের বিন আবদুল্লাহ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন,
জান্নাতিরা পানাহার করবে কিন্তু থুথু ফেলবে না এবং পায়খানা-প্রস্রাবও করবে না। নাকে পানি আসবেনা"। সাহাবাগণ আরয করলেন, "তাহলে তাদের খাবার কোথায় যাবে?" তিনি উত্তরে বললেন, "ঢেকুর ও ঘামের মাধ্যমে তা হজম হবে। জান্নাতীরা এমনভাবে আল্লাহ্র প্রশংসা ও তাসবীহ্ পাঠ করবে যেমন তারা শ্বাস গ্রহণ করে"।
— সহীহ মুসলিম
গোলাম সওবান (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) নিকট দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইতোমধ্যে ইহুদীদের পাদ্রীদের মধ্য থেকে একজন পাদ্রী আসল এবং জিজ্ঞেস করল, "যে দিন আকাশ ও পৃথিবীর প্রথম পরিবর্তন করা হবে তখন মানুষ কোথায় থাকবে?" রাসূলুল্লাহ্ (সা), "পুলসেরাতের নিকটবর্তী এক অন্ধকার স্থানে"। অতঃপর ইহুদী পাদ্রী জিজ্ঞেস করল, "সর্ব প্রথম কে পুলসিরাত পার হবে?" তিনি বললেন, "গরীব মুহাজিরগণ (মক্কা থেকে মদীনার হিযরতকারী)"। ঐ ইহুদী পাদ্রী আবার জিজ্ঞেস করল, "জান্নাতিরা জান্নাতে প্রবেশ করার পর সর্ব প্রথম তাদেরকে কী খাবার পরিবেশন করা হবে?" রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু (সা) বললেন, "মাছের কলিজা"। ইহুদী জিজ্ঞেস করল, "এর পর কী পরিবেশন করা হবে?" রাসূলুল্লাহ সল্লল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "এরপর জান্নাতীদের জন্য জান্নাতে পালিত গরুর গোশত পরিবেশন করা হবে"। এরপর ইহুদী জিজ্ঞেস করল, "খাওয়ার পর পানীয় কী কী পরিবেশন করা হবে?" রাসূলুল্লাহ সল্লল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "'সালসাবিল' নামক ঝর্ণার পানি"। ইহুদী পাদ্রী বলল, "তুমি সত্য বলেছ..."। (সহীহ মুসলিম- কিতাবুল হায়েজ)
আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূলুল্লাহ্ (সা) থেকে বর্ণনা করেছেনঃ
কিয়ামতের দিন এ পৃথিবী একটি রুটির ন্যায় হবে। আল্লাহ্ স্বীয় হস্তে তা এমনভাবে উলট পালট করবেন যেমন তোমাদের কেউ সফররত অবস্থায় তার রুটিকে উলট পালট কর। আর ঐ রুটি দিয়ে জান্নাতীদেরকে মেহমানদারী করা হবে"।
— সহীহ মুসলিম
কুরআনে আল্লাহ্ তায়ালা বলেন,
এবং সকাল সন্ধ্যায় তাদের জন্য রিযিকের ব্যবস্থা থাকবে।
— সূরাহ মারইয়ামঃ ৬২
জান্নাতে মদ্যপান করার পর কোন প্রকার মাতলামি ভাব দেখা দিবে না।
— সূরাহ আস্-সা-ফ্ফাতঃ ৪১-৪৭
জান্নাতিদেরকে এমন মদ্যপান করানো হবে যার মধ্যে আদার স্বাদ থাকবে।
— সূরাহ আদ্-দাহ্রঃ ১৫-১৮
জান্নাতিদের পানের জন্য সুস্বাদু পানি, সুমিষ্ট দুধ, সুস্বাদু শরাব, পরিষ্কার স্বচ্ছ মধুর নদীও জান্নাতে বিদ্যমান থাকবে।
— সূরাহ মুহাম্মদঃ ১৫
জান্নাতিদের মেহমানদারির জন্য অন্যান্য ফল ব্যতীত খেজুর, আঙ্গুর, আনার, বরই, আনজীর ইত্যাদি ফলও থাকবে।
— সূরাহ আর-রহমানঃ ৬৮|সূরাহ আল-ওয়াক্বি'আহঃ ২৭-৩২
জান্নাতীদের সেবায় 'শারাবান ত্বাহুরা' (পবিত্র পরিচ্ছন্ন পানীয়) পেশ করা হবে।
— সূরাহ আদ্-দাহ্রঃ ২১
উটের গর্দানের মত পাখির গোশত জান্নাতীদের পরিবেশন করা হবে।
— তিরমিজী- কিতাবুল জান্নাহ
আলী ইবনে আবু তালিব রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমি একদা রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে ছিলাম। হঠাৎ করে আবু বকর ও ওমর রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুও চলে আসলেন। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, "তারা উভয়ে বৃদ্ধ বয়সে মৃত্যুবরণকারী মুসলমানদের সর্দার হবে - তারা পূর্ববর্তী উম্মতের লোক হোক আর পরবর্তী উম্মতের। তবে নবী ও রাসূলগণ ব্যতীত। হে আলী! তুমি এ সংবাদ তাদেরকে দিও না"। (তিরমিজী- আবওয়াবুল মানাকেব)[৫]
আবু সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সল্লল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "হাসান ও হুসাইন রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু জান্নাতী যুবকদের সর্দার হবে"। (তিরমিজী- আবওয়াবুল মানাকেব)[৬]
রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দশজনকে দুনিয়াতেই তাদের জান্নাতী হওয়ার সুসংবাদ দিয়েছেন। তাদেরকে আশারা মুবাশ্শারা বলা হয়। আবদুর রহমান বিন আওফ রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, "আবু বকর জান্নাতী, ওমর জান্নাতী, ওসমান জান্নাতী, আলী জান্নাতী, তালহা জান্নাতী, যুবাইর জান্নাতী, আবদুর রহমান আওফ জান্নাতী, সা'দ বিন আবূ ওক্কাস জান্নাতী, সাঈদ বিন যুবাইর জান্নাতী, আবু ওবাইদা ইবনুল জার রাহ জান্নাতী"। (তিরমিজী- আবওয়াবুল মানাকেব)[৭]
আয়েশা রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, "রাসূলুল্লাহ্ সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম খাদিজা রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহাকে জান্নাতে একটি ঘরের সুসংবাদ দিয়েছেন"। (সহীহ মুসলিম)[৮]
জাবের বিন আবদুল্লাহ রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, "রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ আমাকে জান্নাত দেখানো হল, আমি আবু তালহা রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু এর স্ত্রীকে (উম্মে সুলাইম) সেখানে দেখতে পেলাম। অতঃপর আমি সামনে অগ্রসর হয়ে কোন মানুষের চলার আওয়াজ পেলাম। হঠাৎ দেখলাম বেলাল রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু কে"। (সহীহ মুসলিম)[৯]
যুবায়ের রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, "উহুদের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুই জোড়া কাপড় পরিধান করে ছিলেন। তিনি একটি পাথরের উপর আরোহণ করতে ছিলেন কিন্তু তিনি তাতে চড়তে পারছিলেন না। তখন তিনি তালহা রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহুকে তাঁর নিচে বসালেন এবং তার ওপর আরোহণ করে তিনি তাতে চড়লেন। যুবায়ের বলেন, এসময় আমি নাবী সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি তিনি বলেনঃ তালহার জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে"। (তিরমিজী- আবওয়াবুল মানাকেব)[১০]
সা'দ রাযিয়াল্লাহু তা'আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, "আমি রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কোন জীবিত ব্যক্তির ব্যাপারে একথা বলতে শুনি নাই যে সে জান্নাতী, তবে শুধু আবদুল্লাহ বিন সালামকে একথা বলেছেন"। (সহীহ মুসলিম)[১১]