জাপান শব্দটি বিভিন্ন ভাষায় বিভিন্ন রূপে ব্যবহার হয়। জাপানি ভাষায় জাপানকে নিপ্পোন (にっぽん ) এবং নিহোন (にほん ) বলা হয়। এই দুটি শব্দই জাপানিতে 日本 কাঞ্জি দিয়ে লেখা হয়।
নিপ্পোন এবং নিহোন দুটি শব্দেরই আক্ষরিক অর্থ হল "সূর্যের উৎস" অর্থাৎ যেখান থেকে সূর্যের উৎপত্তি হয়,[১] এবং প্রায়শই "উদিত সূর্যের দেশ" হিসাবে অনুবাদ করা হয়ে থাকে। এই নামকরণ চীনা সুই রাজবংশের সাথে চীন সাম্রাজ্যে জাপানি কূটনৈতিক দূতাবাসের চিঠিপত্র বিনিময় থেকে পাওয়া যায় এবং চীনের তুলনায় জাপানের পূর্ব অবস্থানকে বোঝায়। সরকারিভাবে নিহোন শব্দটি ব্যবহারের আগে জাপানকে ওয়া (倭) বা ওয়াকোকু (倭国) বলা হত।[২] জাপানের ইয়ায়োই যুগের সমসাময়িক চীনের তিন সাম্রাজ্যের সময় চীন জাপানে বসবাসরত এক জাতিগত গোষ্ঠীকে ওয়া নামে উল্লেখ করত।
যদিও "ওয়াই" এর ব্যুত্পত্তিগত উৎস অনিশ্চিত, তবে চীনা ঐতিহাসিক গ্রন্থে জাপানের দ্বীপপুঞ্জে (সম্ভবত কিউশু) বসবাসকারী এক প্রাচীন জাতির নাম নথিভুক্ত করা হয়েছে, যাদের নাম ছিল /*ˀWâ/ বা /*ˀWər/ 倭। কার (১৯৯২:৯-১০) ওয়ার প্রচলিত ব্যুৎপত্তিগত প্রস্তাবগুলি নিরীক্ষণ করেছেন, তার মধ্যে সাধ্য প্রস্তাবও রয়েছে (জাপানি প্রথম পুরুষ সর্বনাম ওয়াগা 我が "আমার; আমাদের" এবং ওয়ারে 我 "আমি; নিজে") আবার লজ্জাজনক প্রস্তাবও রয়েছে (জাপানি ওয়াকে "বামন" বোঝানোর জন্য 倭 হিসাবে লেখা হয়েছে)। কার জাপানি /*ˀWâ/-র ব্যাখ্যার দুটি ব্যুৎপত্তিগত বৈচিত্রে ভাগ করেছেন: "আচরণগতভাবে 'পদাবনত' বা শারীরিকভাবে 'খর্বকায়'"। "পদাবনত; অনুগত" অর্থটি ১২১ খ্রিষ্টাব্দে শুয়োওয়েন চিয়েজি অভিধানে প্রথম ব্যবহার করা হয়। সেখানে 倭-কে শুন˨মাও˨ 順皃 "পদাবনত; অনুগত; নিরীহ চেহারার" হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, "মানুষ; লোক"-এর ভিত্তিচিত্র 亻-কে ওয়েই˩˥ 委 "বাঁকা" হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে, এবং প্রাচীন চীনা কবিতা শিচিঙ-কে উদ্ধৃত করেছে। ধারণা করা হয়, যখন চীনারা জাপানের সাথে প্রথমবার সাক্ষাত করে, তখন তারা ওয়া-কে 'ˀWâ' (পিছন দিকে নমিত) হিসাবে লিপ্যন্তর করা হত, যার অর্থ "অনুবর্তী, প্রণত হত্তয়া/আনুগত্যসূচক অভিবাদন"। কার (১৯৯২:৯) উল্লেখ করেছেন যে ধারণা করা হয় যে যখন চীনারা প্রথম জাপানীদের সঙ্গে দেখা করেছিল, তখন ওয়াকে *ˀWâ "পিছনদিকে বাঁকা" হিসাবে লিপ্যন্তর করা হয়েছিল যা "অনুবর্তী/নমিত/সম্মান বা বশ্যতা"। নমন করার প্রথা ঐতিহাসিক সূত্রে পাওয়া যায়। উদাহরণের মধ্যে "উবু হয়ে সম্মান জানানো হয়" (হৌ হান শু, অনু: ৎসুনোদা ১৯৫১:২) এবং "তাঁরা দু হাত জোড় করে মাটিতে হয় উবু হয়ে বা নতজানু হয়ে সম্মান জানায়।" (উয়েই চি, অনু: ৎসুনোদা ১৯৫১:১৩)। কোজি নাকায়ামা উয়েই˧ 逶 "এঁকে বেঁকে যাওয়া"-কে "বহু দূরে" হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন এবং উও˧ 倭 "মহাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন" হিসাবে অনুবাদ করেছেন। উয়ো˧ 倭-র দ্বিতীয় ব্যুৎপত্তি, যার অর্থ "বামন", তার সম্ভাব্য সমগোত্রীয় শব্দগুলি হল আই˩˥ 矮 "নিচু, খর্বকায়", উয়ো˧ 踒 "মচকানো; বাঁকা পা", এবং উয়ো˨ 臥 "শোয়া; গুটিসুটি মারা; বসা (প্রাণী এবং পাখি)"। প্রাচীন চীনা রাজবংশীয় ইতিহাসে চু˧রু˦কুয়ো˦ 侏儒國 "বামন রাষ্ট্রের"-এর উল্লেখ পাওয়া যায়, যার অবস্থান জাপানের দক্ষিণে, এবং সম্ভবত ওকিনাওয়া এবং রিয়ুকিয়ু দ্বীপের সঙ্গে যুক্ত। কার উল্লেখ করেছেন যে উয়াকে "পদাবনত মানুষ" হিসাবে অনুবাদ করার ঐতিহাসিক সূত্র এবং "বামনদের দেশ"-এর কিংবদন্তি এটাই প্রমাণ করে যে "ছোট মানুষ" ব্যুৎপত্তিটি পরে সৃষ্টি হয়েছে।
চীনা, কোরিয়ান এবং জাপানী লেখকগণ ৮ম শতাব্দি অবধি নিয়মিতভাবে ওয়া বা ইয়ামাতো "জাপান"-কে চীনা চিত্রাক্ষর 倭 দিয়ে লিখতেন। কিন্তু এই অর্থের অপমানকর অভিব্যক্তির জন্য জাপানিরা এর মধ্যে খুঁত খুঁজে পান এবং এটাকে বদলে 和 "সমন্বয়, শান্তি, ভারসাম্য" ব্যবহার করা শুরু করেন। পরে এই চিত্রাক্ষরটিই জাপান দেশটিকে চিহ্নিত করার জন্য ব্যবহৃত হয়, প্রায়শই 大 "অত্যন্ত" এর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হত এবং পূর্ববর্তী নাম ইয়ামাতো (大 和) লেখা হত। কিন্তু ইয়ামাতো উচ্চারণটি এই চিত্রাক্ষর দুটি দিয়ে করা যায় না; এটি জাপানের একটি স্থানকে বোঝায় এবং মূলত "পর্বত দ্বার" (山 戸) বলে ধারণা করা হয়।[৩] এই ভাবে শুধুমাত্র কোন জাপানি শব্দের অর্থ প্রকাশ করার জন্য কোন কাঞ্জি ব্যবহার করা, তা সেই কাঞ্জির ওনয়োমি বা কুনয়োমি, ওরফে জুকুজিকুন যাই হোক না কেন, খুব একটা বিরল নয়। চীনা লেখাতে অন্যান্য মৌলিক নামগুলির মধ্যে একটি ছিল ইয়ামাতাই দেশ (邪 馬 台 国), যেখানে একজন রানী হিমিকো বাস করতেন। যখন জাপানি ভাষায় "সূর্যের উৎস" বা হি নো মোতো কাঞ্জিতে লেখা হত তখন 日本 চিত্রাক্ষরগুলি ব্যবহার হত। পরে, এই চিত্রাক্ষরগুলিকে চীনা-জাপানি উচ্চারণ অনুযায়ী ব্যবহার করা শুরু হল, প্রথমে নিপ্পোন এবং পরে নিহোন, যদিও দুটি নাম বর্তমানে বিনিমেয়।
নিপ্পোন শব্দটির ব্যবহার ৭ম শতাব্দি থেকে দেখতে পাওয়া যায়। চতুর্বিংশ ইতিহাসের একটি থাঙের প্রাচীন পুস্তক (舊唐書) অনুযায়ী জাপানি দূতরা উয়োকুয়ো (倭國) নামটি পছন্দ করতেন না, এবং পালটে নিপ্পোন (日本) বা "সূর্যের উৎস" রেখেছিলেন। ৮ম শতাব্দির এক উপাখ্যান, শিচি-র প্রকৃত অর্থ (史記正義) বইটিতে বলা হয় যে চীনা সম্রাজ্ঞী উ জথিয়েন এক জাপানি দূতকে আদেশ দিয়েছিলেন দেশের নামটি নিপ্পোন করতে। জাপানি পূরাণ এবং ধর্মে সূর্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কারণ সম্রাটকে সূর্যের দেবী আমাতেরাসুর বংশধর হিসাবে মান্য করা হয় এবং এই ঐশ্বরিক নিযুক্তির উপর এবং শিন্তো ধর্মের প্রধান দেবতা থেকে বংশদ্ভুত হওয়ার উপর শাসক বংশের বৈধতা নির্ভর করে। দেশের নামটি সূর্যের এই কেন্দ্রীয় গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে।
পর্তুগিজ ধর্মপ্রচারকরা ১৬শ শতাব্দির শেষ দিকে জাপানে আসেন। জাপানি ভাষা শেখাকালিন তারা মধ্য জাপানির বহু ব্যাকরণ বই এবং অভিধান তৈরি করেন। ১৬০৩-১৬০৪ সালে লিখিত ভোকাবুলারিও দা লিঙ্গোয়া দে ইয়াপাম (Vocabvlario da Lingoa de Iapam) অভিধানে জাপানের জন্য দুটি শব্দ পাওয়া যায়: নিফোন (nifon)[৪] এবং জিপ্পোন (iippon)।[৫] অভিধানের শিরোনাম থেকেই বোঝা যায় যে সেই সময় জাপানের পর্তুগিজ শব্দ ছিল ইয়াপাম।
জাপানি বেশ কিছু ধ্বনিতাত্ত্বিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে পার হয়েছে। মূলত এটি *p ছিল, যেটি পরিবর্তিত হয়ে ɸ, এবং শেষে h হয়েছে। এখনও /ɯ/-এর আগে /h/-কে [h] উচ্চারণ করা হয়। এই পরিবর্তনগুলির ফলেই মধ্য জাপানির নিফোন আধুনিক জাপানির নিহোন হয়েছে।
আধুনিক রোমানিকরণের আগে পরতুগিজরা নিজেদের একটি প্রতিবর্ণিকরণ পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। সেই পদ্ধতিতে ii বা ji দিয়ে /zi/ চিহ্নিত করা হত। বর্তমানে হেপবার্ন রোমানিকরণ পদ্ধতিতে iippon-কে jippon হিসাবে লেখা হয়।
ব্যুৎপত্তিগতভাবে জিপ্পোন এবং নিপ্পোন দুটোই 日本-এর উচ্চারণ। প্রথম চিত্রাক্ষরটি (日) /ziti/ বা /zitu/ হিসাবেও উচ্চারণ করা যায়। /hoɴ/ (本)-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে এটাই জিপ্পন হয়ে যায়।
নিহোন/নিপ্পোন জোড়ের মত *জিহোন-এর কোন জুড়িদারের কোন প্রমাণ পাওয়া যায় নি।
জাপানের জাপানি নাম "日本"-কে নিহোন বা নিপ্পোন উচ্চারণ করা যায়। উভয় উচ্চারণই ওনয়োমি থেকে এসেছে।
চিত্রাক্ষর 日 (নিচি)-র অর্থ হল "সূর্য" বা "দিন" এবং 本 (হন)-এর অর্থ হল "ভিত্তি" বা "উৎস"। শব্দটির পূর্ণাঙ্গ অর্থ হল "সূর্ষের উৎস" অথবা "যেখানে সূর্যের উদয় হয়"। এই নামকরণের কারণ হল চীনাদের দৃষ্টিকোণ থেকে, সূর্যের উদয় জাপান থেকে হত। এই নামের জন্যই জাপানকে বলা হয় "উদিত সূর্যের দেশ"।
যৌগকি শব্দে নিচি-র চি অক্ষরটি প্রায়শই লুপ্ত হয়ে যায় এবং উচ্চারণ হওয়ার সময় পরের অক্ষরের আগে একটি অতি স্বল্প দৈর্ঘ্যের বিরতির সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে ধ্বনির দ্বৈততার মত শোনায়, এবং সেই কারণে পরের অক্ষরের প্রথম ব্যঞ্জনবর্ণটি দুবার লেখা হয়। যেমন নিচি 日 (সূর্য) + কো 光 (আলো) = নিক্কো (সূর্যালোক)।
জাপানি 日 এবং 本-এর ঐতিহাসিক উচ্চারণগুলি হল যথাক্রমে নিতি এবং পোন। তবে মধ্য চীনা ভাষায় যৌগিক শব্দে শেষের অঘোষ স্পৃষ্ট ধ্বনিগুলি অনুচ্চারিত থাকত, যার ফলে *নিতিপোন-এর বদলে 日本-এর উচ্চারণ দাঁড়িয়েছে নিপ্পোন (বা পূর্বের ব্যঞ্জনধ্বনির প্রভাবে জিপ্পোন)।
ধ্বনিপরিবর্তনের ফলে আধুনিক জাপানিতে নিতি হয়ে গেছে নিচি এবং পোন হয়ে গেছে হোন। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে নিহোন শব্দটির, যার সম্ভাব্য উৎস হল হোনশু দ্বীপের কান্তো অঞ্চল।
জাপান সরকার এই দুটি নামকেই সঠিক হিসাবে মেনে নিয়েছে।[৬]
দুটি নাম সঠিক হলেও নিপ্পোন নামটি সরকারি ক্ষেত্রে[৭], যেমন মুদ্রার নাম, ডাকটিকিট, আন্তর্জাতিক ক্রীড়ানুষ্ঠান ইত্যাদিতে বেশি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও ব্যবহার হয় জাপানের সরকারি নাম নিপ্পোন-কোকুতে (আক্ষরিক অর্থ: "জাপান রাষ্ট্র" 日本国)।
এর বাইরে নাম ব্যবহারের কোন নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, কোন ক্ষেত্রে নিপ্পোন ব্যবহার হয়, আবার কখনও নিহোন ব্যবহার হয়। উদারণস্বরুপ জাপানিরা তাদের ভাষাকে নিহোঙ্গো বলে, আবার নিপ্পোঙ্গোও সম্ভব[৮], যদিও সেটা বিরল। আবার কোনও ক্ষেত্রে দুটো নামও ব্যবহার হয়ে থাকে। যেমন জাপান ব্যাঙ্কের (日本銀行) নোটে নিপ্পোন গিঙ্কো ব্যবহার হয়, কিন্তু সংবাদমাধ্যমের মত বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিহোন গিঙ্কো হিসাবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে।[৯]
নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে সবসময়েই নিপ্পোন ব্যবহার হয়:[১০]
নিম্নোক্ত ক্ষেত্রে সবসময়েই নিহোন ব্যবহার হয়:[১১]
|শিরোনাম=
অনুপস্থিত বা খালি (সাহায্য)