জামাল নজরুল ইসলাম | |
---|---|
জন্ম | |
মৃত্যু | মার্চ ১৬, ২০১৩ | (বয়স ৭৪)
সমাধি | চট্টগ্রাম |
জাতীয়তা |
|
শিক্ষা | পিএইচডি |
মাতৃশিক্ষায়তন |
কলকাতা শিশু বিদ্যাপীঠ লরেন্স কলেজ ( পাঞ্জাব , পাকিস্তান) সেন্ট জেভিয়র্স কলেজ(কলকাতা) কলকাতা মডেল স্কুল |
পরিচিতির কারণ |
|
দাম্পত্য সঙ্গী | প্রফেসর ডঃ সুরাইয়া ইসলাম |
সন্তান | ২ |
পুরস্কার |
|
বৈজ্ঞানিক কর্মজীবন | |
কর্মক্ষেত্র | |
প্রতিষ্ঠানসমূহ | |
অভিসন্দর্ভের শিরোনাম | (১৯৬৮) |
জামাল নজরুল ইসলাম (২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯ - ১৬ মার্চ ২০১৩) বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও বিশ্বতত্ত্ববিদ।[১] তিনি মহাবিশ্বের উদ্ভব ও পরিণতি বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস কর্তৃক প্রকাশিত “দি আল্টিমেট ফেইট অফ দি ইউনিভার্স” তার একটি সুবিখ্যাত গবেষণা গ্রন্থ।
অধ্যাপক ইসলাম মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথমেটিকাল অ্যান্ড ফিজিকাল সায়েন্সের গবেষক এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর একজন সিন্ডিকেট সদস্য ছিলেন। এ ছাড়াও তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-র উপদেষ্ঠা-পর্ষদের সদস্য ছিলেন এবং বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রনালয়ের 'উচ্চতর গবেষণা সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন (বাছাই) কমিটি'-র সম্মানিত চেয়ারম্যান ছিলেন। [২] ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।[৩][৪][৫]
জামাল নজরুল ইসলাম ১৯৩৯ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা তখন সে শহরের মুন্সেফ (বর্তমানে সহকারী জজের সমতুল্য) ছিলেন। জামাল নজরুল ইসলামের বয়স যখন মাত্র ১ বছর তখনই তার বাবা কলকাতায় বদলি হন। জামাল নজরুল প্রথমে ভর্তি হন কলকাতার মডেল স্কুলে। এই স্কুল থেকে পরবর্তীতে শিশু বিদ্যাপীঠে। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এই বিদ্যাপীঠেই পড়েন। পরবর্তীকালে আবার মডেল স্কুলে ফিরে যান। কলকাতায় মডেল স্কুলের পর চট্টগ্রামে চলে আসেন। এখানে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য পরীক্ষা দেন। এই ভর্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের জন্য তাঁকে "ডাবল প্রমোশন" দিয়ে সরাসরি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করে নেওয়া হয়। নবম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে পড়াশোনা করেন। এখানে পড়ার সময়ই গণিতের প্রতি তার অন্যরকম ভালোবাসার সৃষ্টি হয়। অনেক অতিরিক্ত জ্যামিতি সমাধান করতে থাকেন। নবম শ্রেণিতে উঠার পর পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান। সেখানে গিয়ে ভর্তি হন লরেন্স কলেজে। এই কলেজ থেকেই তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পাশ করেন। এ সময় নিজে নিজে অনেক অঙ্ক কষতেন। বিভিন্ন বই থেকে সমস্যা নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করতেন যা পরবর্তীকালে তার অনেক কাজে আসে। উল্লেখ্য, হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজে তিনি কেবল একাই গণিত পড়েছিলেন। এটা বেশ উচ্চ পর্যায়ের গণিত হওয়ায় সবাই নিতে চাইতো না। এ সময়ই গণিতের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন। লরেন্স কলেজের পাঠ শেষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে যান।[৬] এখান থেকে বিএসসি অনার্স করেন।
এই কলেজের একজন শিক্ষককে তিনি নিজের প্রিয় শিক্ষক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তার নাম "ফাদার গোরে"। গণিতের জটিল বিষয়গুলো খুব সহজে বুঝিয়ে দিতেন বলেই জে এন ইসলাম তার ভক্ত হয়ে পড়েছিলেন। গোরে তার কাছে গণিতের বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইতেন, ইসলাম আগ্রহভরে তা শেয়ার করতেন। গোরের সঙ্গে ইসলামের এই সম্পর্কের কারণ বলতে গিয়ে ইসলাম বলেন,
গণিতকে এমনিতেই অনেকে ভয় পেত। কিন্তু এটির প্রতিই ছিল আমার অসীম আগ্রহ, ঝোঁক। এ কারণেই বোধহয় তিনি আমাকে পছন্দ করতেন।
বিএসসি শেষে ১৯৫৭ সালে ইসলাম কেমব্রিজে পড়তে যান। কেমব্রিজের প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান থেকে ১৯৫৯ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এখান থেকেই ১৯৬০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।[৭] ১৯৬৪ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৮২ সালে এসসিডি (ডক্টর অফ সায়েন্স) ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৩ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত জামাল নজরুল যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ ম্যারিল্যান্ডে ডক্টরাল-উত্তর ফেলো হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অফ থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনমিতে (বর্তমানে ইনস্টিটিউট অফ অ্যাস্ট্রোনমি) কাজ করেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এখানে তিনি আইনস্টাইনের তত্ত্ব নিয়ে কাজ করতেন এবং এই সূত্রে স্টিভেন হকিংয়ের সঙ্গে পরিচয় গড়ে ওঠে৷
১৯৭১ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজিতে ভিজিটিং সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক ছিলেন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি কলেজ, কার্ডিফ (বর্তমানে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়)-এর সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলে ফেলো ছিলেন। ১৯৭৮ সালে তিনি লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিতে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরে রিডার পদে উন্নীত হন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে অবস্থিত ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্সড স্টাডিতে ১৯৬৮, ১৯৭৩ ও ১৯৮৪ সালে ভিজিটিং সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
১৯৮১ সালেই তিনি চট্টগ্রামে ফিরে এসেছিলেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দুই হাজার আটশো টাকা বেতনে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। এখানেই এক অপ্রত্যাশিত ঘটনার সম্মুখীন হতে হয় তাঁকে। এক বছর অধ্যাপনা করার পরে পুনরায় বিদেশে যেতে চাইলে কিছুতেই বিশ্ববিদ্যালয় সিণ্ডিকেট থেকে ছুটি পাননি তিনি। ফলে সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিদেশযাত্রা করেন জামাল নজরুল ইসলাম এবং পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সব স্থায়ী বাড়ি-ঘর, জমি-জায়গা বিক্রি করে দিয়ে পাকাপাকিভাবে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে চলে আসেন তিনি। তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে পুনরায় কাজে বহাল করে এবং বেতন বাড়িয়ে তিন হাজার টাকা করে। ১৯৮৪ সালে জামাল নজরুল বাংলাদেশে ফিরে এসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। পদার্থবিদ্যা বিভাগে অধ্যাপক কোটা খালি না থাকায় তিনি গণিত বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন এবং গড়ে তোলেন উচ্চতর বিজ্ঞান গবেষণাগার আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠান গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র বা রিসার্স সেন্টার ফর ম্যাথম্যাটিক্যাল অ্যান্ড ফিজিক্যাল সায়েন্স (আরসিএমপিএস)। এখানেই তিনি ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসেবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন।
জামাল নজরুল ইসলাম বই পড়তে ভালবাসতেন । তবে তিনি শখ হিসেবে গান শোনা ও ছবি আঁকার কথা বলেছেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত সবচেয়ে প্রিয়। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট এর প্রতি তার কোনও আগ্রহ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ক্যালকুলেটর ব্যবহারে তার অনীহা ছিল। গাণিতিক হিসাব মাথা খাটিয়ে করতে পছন্দ করতেন। তাই কম্পিউটারের ব্যবহারও তার কাছে ভালো লাগত না। এই অপছন্দের মূল কারণ অবশ্য অপ্রয়োজনীয়তা। তিনি বলতেন, 'ক্যালকুলেটর মস্তিষ্ককে অলস করে দেয়।' তার ধারণা ছিল, বর্তমান তরুণ প্রজন্ম দিন দিন অতিরিক্ত টেলিভিশন ও মোবাইলের দিকে ঝুঁকে পড়ায় তারা লক্ষ্যভ্রষ্ট হচ্ছে।[২]
তার চিন্তার অনেকখানি জুড়ে ছিল দেশ ও সমাজের উন্নতি এবং দারিদ্র্যতা দূরীকরণ। নিজের আয় থেকে কিছু অর্থ জমিয়ে দরিদ্র্য ছাত্রদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া ১৯৭১ সালে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখে বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ বন্ধের উদ্যোগ নিতে বলেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার এই পরোক্ষ অবদান ও পরবর্তীকালে দেশে ফিরে আসা থেকে তার দেশপ্রেমের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া তিনি বিদেশে পড়াশোনা করছে এমন সব শিক্ষার্থীকেই পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরে আসতে উৎসাহিত করেন।[২] বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত লেখক ও শিক্ষক মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশে ফেরার আগে জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। জামাল নজরুল তৎক্ষণাৎ তাঁকে দেশে ফেরার ব্যাপারে উৎসাহ দেন।[তথ্যসূত্র প্রয়োজন]
২০০১ সালে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে বলে একটি গুজব রটেছিল। বাংলাদেশেও এই গুজব ছড়িয়ে পড়ে। সে সময় জামাল নজরুল ইসলাম গণিতের হিসাব কষে দেখান যে, সে রকম সম্ভাবনা নেই। কারণ, প্রাকৃতিক নিয়মে সৌরজগতের সবগুলো গ্রহ এক সরলরেখা বরাবর চলে এলেও তার প্রভাবে পৃথিবীর কোনও ক্ষতি হবে না।[৮]
সংগীতের প্রতি অধ্যাপক জামাল নজরুলের বেশ আগ্রহ ছিল। তিনি বিশেষ করে গজল শুনতে ভালোবাসতেন। রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীতেরও তিনি ছিলেন অনুরাগী।কথাবার্তায় তিনি ছিলেন সদালাপী ও রসিক। গজলের আসর বসাতেন নিজ বাসায়৷ এছাড়া রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীতের প্রতিও তার বিশেষ আগ্রহ ছিল৷।[৯]
অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে আইনস্টাইনের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে সৃষ্টির রহস্য বোঝার চেষ্টা করেছেন। এই গবেষণায় সাফল্যের নিদর্শন তার গ্রন্থাবলী যা তাকে দেশে বিদেশ পরিচিত করে তুলেছিল।
বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী ১৯৮৫ সালে তাকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। ১৯৯৪ সালে তিনি ন্যাশনাল সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি মেডেল পান। ১৯৯৮ সালে ইতালির আবদুস সালাম সেন্টার ফর থিওরিটিকাল ফিজিক্সে থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমি অফ সায়েন্স অনুষ্ঠানে তাকে মেডাল লেকচার পদক দেয়া হয়।[১০] ২০০০ সালে তাকে কাজী মাহবুবুল্লাহ এন্ড জেবুন্নেছা পদক প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে একুশে পদকে ভূষিত করে। পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২০১১ সালে তকে “রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক” প্রদান করে।[১১]
২০০৪ থেকে ২০০৬ মেয়াদের জন্য তাকে ইউজিসি অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়।[১২]
২০১৩ সালের ১৬ই মার্চ শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ৭৪ বছর বয়সে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলামের মৃত্যু হয়। মারা যাওয়ার সময় তিনি স্ত্রী ও দুই মেয়ে রেখে যান। তাকে রোববার চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদে জানাজার পর গরিবুল্লাহ শাহ মাজার কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।