জিল্যান্ডস-পোস্টেন মুহাম্মদ কার্টুন বিতর্ক বা মুহাম্মদ কার্টুন সংকট (ডেনীয়: Muhammedkrisen)[১] হল মুহাম্মদকে চিত্রিত করা নিয়ে একটি বিতর্ক। ডেনিশ সংবাদপত্র জিল্যান্ডস-পোস্টেন ২০০৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ১২টি সম্পাদকীয় কার্টুন প্রকাশ করে, যার বেশিরভাগই ছিল ইসলাম ধর্মের প্রধান ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদকে চিত্রিত করা কার্টুন। সংবাদপত্রটি ঘোষণা করে যে এটি ইসলামের সমালোচনা ও স্ব-বিবাচন সম্পর্কে বিতর্কে অবদান রাখার একটি প্রচেষ্টা। এটির ফলে ডেনমার্কের মুসলিম গোষ্ঠীগুলি অভিযোগ জানায়, এবং এই সমস্যাটি শেষ পর্যন্ত সহিংস বিক্ষোভে রূপ নেয় ও কিছু মুসলিম দেশে দাঙ্গাসহ বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ হতে দেখা যায়।[২]
ইসলাম ধর্মের একটি শক্তিশালী প্রতিকৃতিহীনতাবাদের ঐতিহ্য রয়েছে এবং বেশিরভাগ ইসলামিক ঐতিহ্যে মুহাম্মাদকে দৃশ্যমানভাবে চিত্রিত করা অত্যন্ত নিন্দাজনক বলে বিবেচিত হয়। কার্টুনগুলি মুহাম্মদ ও ইসলামকে অবমাননা করেছে এমন ধারণার সঙ্গে যুক্ত, ও এটি অনেক মুসলমানকে বিক্ষুব্ধ করেছিল। চিত্র নিয়ে আপত্তিকারী ডেনমার্কের মুসলিম সংগঠনগুলি, ইসলামি দেশসমূহের দূতাবাসকে ও ডেনিশ সরকারকে সংবাদপত্রটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবেদন করে এবং তারা সংবাদপত্রটির বিরুদ্ধে একটি বিচার বিভাগীয় অভিযোগ দায়ের করে, যা ২০০৬ সালের জানুয়ারিতে আদালত খারিজ করে দেয়। ড্যানিশ সরকার মুসলিম দেশগুলির কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করলে এবং এই মামলায় হস্তক্ষেপ না করার ঘোষণা দিলে, আহমেদ আক্কারির নেতৃত্বে বেশ কয়েকজন ডেনিশ ইমাম উক্ত বিষয়ে বিশ্বে সমর্থন আদায়ের জন্য ২০০৫ সালের শেষের দিকে মধ্যপ্রাচ্য সফর করেন। তারা জিল্যান্ডস-পোস্টেন-এর বারোটি কার্টুন ও সেই সঙ্গে কিছু আসল ও কিছু নকলসহ মুহাম্মদের অন্যান্য চিত্রণের একগুচ্ছ দলিল (ডসিয়া) পেশ করে এবং সেখানে তারা দাবি করে যে, ইসলামে নিষিদ্ধ ও অপবিত্র হিসাবে বিবেচিত শূকর হিসাবে মুহাম্মদকে চিত্রিত করা হয়েছে। যখন এটি ও অন্যান্য মিথ্যা উপস্থাপন করা হয়, তখন এই শেষ ছবিটি একটি শুয়োরের চিৎকার প্রতিযোগিতায় একজন প্রতিযোগীর অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের ছবি বলে প্রমাণিত হয়, পরে প্রতিনিধিদলের প্রেস মুখপাত্র স্বীকার করেন যে সফরের লক্ষ্য ছিল শত্রুতা জাগিয়ে তোলা।[৩][৪][৫]:৮০–৪
সমস্যাটি কিছু মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে বিশিষ্ট মিডিয়া মনোযোগ পেয়েছিল, যা ২০০৬ সালের জানুয়ারি মাসের শেষের দিকে ও ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে সারা বিশ্বজুড়ে বিক্ষোভের দিকে পরিচালিত করে। কিছু বিক্ষোভ সহিংসতায় বর্ধিত হয়, যার ফলে ২৫০ জনেরও বেশি মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়, ডেনিশ ও অন্যান্য ইউরোপীয় কূটনৈতিক মিশনে হামলা, গির্জা ও খ্রিস্টানদের উপর আক্রমণ এবং ডেনমার্কের বয়কটের ঘটনা ঘটেছিল। কিছু গোষ্ঠী ডেনিশ নীতিগুলিকে সমর্থন করে, "ড্যানিশ কিনুন" প্রচারাভিযান শুরু করে এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য সমর্থনের অন্যান্য প্রদর্শনের মাধ্যমে তীব্র প্রতিকৃতিহীনতাবাদপন্থী প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়া জানায়। কার্টুনগুলি সারা বিশ্বের সংবাদপত্রগুলিতে সাংবাদিকতার সংহতির ও একটি প্রধান সংবাদ গল্পে পরিণত হওয়ার একটি দৃষ্টান্ত উভয়ই অর্থ হিসাবে পুনঃমুদ্রিত হয়েছিল।
বিতর্কটিকে ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী আন্ডার্স ফগ রাসমুসেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডেনমার্কের সবচেয়ে খারাপ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ঘটনা বলে বর্ণনা করেছিল। ঘটনাটি এমন এক সময়ে ঘটেছিল যখন ১১ই সেপ্টেম্বরের হামলা সহ—পশ্চিমে বেশ কয়েকটি উচ্চ-প্রোফাইল কট্টরন্থী ইসলামি সন্ত্রাসী হামলা—এবং ইরাক ও আফগানিস্তানের মতো মুসলিম দেশগুলিতে পশ্চিমা সামরিক হস্তক্ষেপের পরে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ও পশ্চিমা দেশগুলির মধ্যে রাজনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছিল। একইভাবে ডেনমার্ক ও বৃহত্তর সমাজের মুসলমানদের মধ্যে সম্পর্ক নিম্ন পর্যায়ে ছিল, এবং বিরোধটি ইসলামী সম্প্রদায় ও সমাজের বাকি অংশের মধ্যে অসঙ্গতি ও বৈচিত্র্যের প্রতীক হিসাবে এসেছিল। এর পরের বছরগুলিতে, কার্টুন আঁকার প্রতিশোধ নেওয়ার দাবি করে জিহাদি সন্ত্রাসী চক্রান্ত করা হয়েছিল—এবং জিল্যান্ডস-পোস্টেন ও এর কর্মচারী, ডেনমার্ক বা কার্টুন এবং ইসলামিক নবিদের অন্যান্য ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশকারী সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে— কিছু কার্যকর করা হয়েছিল, সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল ২০১৫ সালের শার্লি এবদো গুলিবর্ষণ।
সমর্থকরা বলেছিল যে কার্টুন প্রকাশ করা বাকস্বাধীনতার একটি বৈধ অনুশীলন ছিল: অভিব্যক্তির বিষয়বস্তু নির্বিশেষে, সন্ত্রাসের ভয় ছাড়াই খোলামেলাভাবে ইসলাম নিয়ে আলোচনা করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এছাড়াও কার্টুনগুলি সমালোচনামূলক বিষয়গুলি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু তৈরি করেছে। বাক স্বাধীনতার জন্য অপেক্ষাকৃত উচ্চ সহনশীলতার ডেনিশ ঐতিহ্য মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। বিতর্কটি সমস্ত সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা, ধর্মীয় সহনশীলতা ও পশ্চিমে তাদের বৃহত্তর সমাজের সঙ্গে মুসলিম সংখ্যালঘুদের সম্পর্ক এবং সাধারণভাবে ইসলামিক বিশ্বের ও পাশ্চাত্যের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে একটি বিতর্কের জন্ম দেয়।