জেড সম্রাট | |||||||||||
আক্ষরিক অর্থ | জেড সম্রাট | ||||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
| |||||||||||
চীনা | 天公 | ||||||||||
আক্ষরিক অর্থ | স্বর্গীয় পিতা | ||||||||||
| |||||||||||
চীনা | 玉皇大帝 | ||||||||||
আক্ষরিক অর্থ | জেডের শরৎ সম্রাট | ||||||||||
|
জেড সম্রাট (চীনা: 玉皇; ফিনিন: Yù Huáng or 玉帝, Yù Dì) হলেন চীনের সংস্কৃতি, চীনের লোকজ ধর্ম ও চীনা পুরাণে উল্লেখিত প্রথম ঈশ্বর (太帝 tài dì)। তাও ধর্ম মতে, তিনি হলেন ইয়ুনশি তিয়ানজুন, তিনজন পবিত্র আত্মার একজন। চাও ধর্ম মতে তিনি হলেন চাও ডাই (Cao Đài), সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী।[১]
জেড সম্রাট আরও অনেক নামে পরিচিত, যেমন স্বর্গীয় পিতা (天公, Tiān Gōng), সাধারণ মানুষের কাছে যা স্বর্গের সর্বোচ্চ পদ বুঝায়। এছাড়া তিনি ইয়ু হুয়াং শাংডি (玉皇上帝, Yu Huang Shangdi) এবং ইয়ু হুয়াং ডাডি (玉皇大帝, Yu Huang Dadi) নামে পরিচিত।[২]
চীনা পুরাণে জেড সম্রাট সম্পর্কিত অনেক পৌরাণিক গল্প রয়েছে।
কথিত আছে, জেড সম্রাট হলেন সূর্যের দেবতা জিং ডে ও চন্দ্রের দেবী বাও ইয়ুর পুত্র। জন্মের সময় তার শরীর থেকে এক ধরনের অদ্ভুত আলো নির্গত হয় যা দিয়ে পুরো রাজ্য আলোকিত হয়েছিল। শৈশবে তিনি দয়ালু, বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী ছিলেন। শৈশবকালে তিনি দরিদ্র, অসহায়, ক্ষুদার্থ, ও প্রতিবন্ধী মানুষের সাহায্য করতেন। এছাড়া মানুষ ও জীবজন্তু উভয়েরই প্রতি তার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা ছিল। তার পিতার মৃত্যুর পর তিনি সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি তার রাজ্যের সকলের শান্তি ও সন্তুষ্টি নিশ্চিত করেছিলেন। পরে তিনি তার মন্ত্রীকে পাহাড়ের সমুজ্জল উঁচু চূড়ায় তাও নির্মাণের ইচ্ছা প্রকাশ করেন।[৩]
১৭৫০ কল্প-এর (প্রতি কল্পের সময় ছিল ১২৯,০০০ বছর) পরে, তিনি অমরত্ব লাভ করেন। আরও ১০০ মিলিয়ন বছর পর তিনি জেড সম্রাট হন (প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে, তার জেড সম্রাট হওয়ার পূর্ববর্তী সময় ছিল ২২৬,৮০০,০০০ বছর)।
পুরাণের একটি গল্পে বর্ণিত আছে জেড সম্রাট কীভাবে স্বর্গের সকল দেবতাদের সম্রাট হয়েছিলেন। শুধুমাত্র এই কাহিনীতেই তার বীরত্বের কথা ফুটে উঠেছে।
সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী বসবাসের অনুপযুক্ত ছিল। সাধারণ মানুষকে বিভিন্ন রকম ভয়ংকর দানবের সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হত। তাদের বাঁচানোর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ দেবতা ছিল না। অনেক ক্ষমতাধর দানবেরা স্বর্গের অমর দেবতাদের অবজ্ঞা করত। জেড সম্রাট একজন সাধারণ অমর দেবতা ছিলেন যে পৃথিবীতে মানুষকে সাহায্য করত। তিনি এই ভেবে দুঃখবোধ করতেন যে তিনি শুধু মানুষের দুঃখ-দুর্দশা কমাতে পারেন কিন্তু তা একেবারে নিশ্চিহ্ন করতে পারেন না। তিনি তার মন্ত্রীকে নিয়ে এক পর্বতের গুহায় তাও নির্মাণ করেন এবং ধ্যানমগ্ন হন। সেখানে তিনি ৩,২০০ টি শক্তিপরীক্ষা দেন, প্রতিটি পরীক্ষার সময় ছিল ৩ মিলিয়ন বছর।
এই সময়ে পৃথিবীতে একটি শক্তিশালী দুষ্ট আত্মা স্বর্গের অমর দেবতাদের হত্যা করে মহাবিশ্বের কর্তৃত্ব গ্রহণ করার ইচ্ছা পোষণ করে। এই দুষ্ট আত্মাও তার শক্তি বৃদ্ধির জন্য ধ্যানে যায়। সেও ৩,০০০ টি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। শেষ পরীক্ষার পর সে নিজেকে এতই আত্মবিশ্বাসী মনে করে যে তাকে কেউ হারাতে পারবে না। সে পৃথিবীতে এসে স্বর্গে আক্রমণ করার জন্য দুষ্ট আত্মাদের এক বাহিনী তৈরি করে। স্বর্গের দেবতারাও একত্রিত হয় এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু তারা সকলেই সেই দুষ্ট আত্মার কাছে পরাজিত হয়।
এই সময়ে জেড সম্রাটের ধ্যান শেষ হয়। যখন সে বিভিন্ন দানবদের তাড়িয়ে পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করছিল, তখন সে দেখতে পেল স্বর্গ থেকে দুষ্ট আত্মার দীপ্তি নির্গত হচ্ছে এবং বুঝতে পারল সেখানে কোনো বিশৃঙ্খলা হচ্ছে। তিনি স্বর্গে আরোহণ করলেন এবং দেখলেন সেই দুষ্ট আত্মাকে কোনো দেবতাই থামাতে পারছে না। তিনি তার সাথে যুদ্ধ লিপ্ত হলেন। জেড সম্রাটের বেশি সময় ধ্যানমগ্নতা ও শক্তিপরীক্ষা এবং তার শক্তি প্রদর্শনের চেয়ে পরোপকারের ইচ্ছার কারণে তিনি যুদ্ধে জয়ী হলেন। তার এই মহৎ কাজের জন্য সকল দেবতা, অমর ও মানব সম্প্রদায় তাকে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জেড সম্রাট হিসেবে ঘোষণা করেন।
চীনের সৃষ্টি পুরাণ অনুসারে, জেড সম্রাট ছিলেন দেবতামন্ডলীর প্রধান, তিনি সৃষ্টির দায়িত্বে ছিলেন না। অন্য আরেক সৃষ্টি পুরাণ অনুসারে, জেড সম্রাট প্রথম মাটি দিয়ে মানুষের আকার তৈরি করেন এবং রোদে শুকাতে দেন। বৃষ্টির কারণে মানুষের মূর্তির কিছু অংশ বিনষ্ট হয়, যা মানুষের অসুস্থতা ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নির্দেশ করে। সবচেয়ে প্রচলিত পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, মানুষ ফানকুর শরীরের এক ধরনের ডাঁশের মত ছিল। আরেকটি পৌরাণিক কাহিনীতে বর্ণিত আছে, নুইউও হুয়াংহো নদী থেকে মাটি নিয়ে নিজ হাতে মানুষের আকৃতি তৈরি করেন। যেসব মানুষ তার নিজ হাতে তৈরি তারা ধনসম্পদের অধিকারী হয়। পরে তিনি তার চাদর মাটিতে ডুবিয়ে চারদিকে দুলাতে থাকেন। চাদর থেকে তৈরিকৃত মানুষগুলো হয় দরিদ্র।
য়ু চেং'এন রচিত জনপ্রিয় জার্নি টু দ্যা ওয়েস্ট গ্রন্থে জেড সম্রাট সম্পর্কিত অনেক গল্প রয়েছে। এই গ্রন্থে বর্ণিত আছে, জেড সম্রাট স্বর্গে শাসন করতেন। তার কাছে নানা রকমের অভিযোগ আসত। তিনি তা আমলাতান্ত্রিক উপায়ে বিভিন্ন ডিক্রি ও অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে মীমাংসা করতেন। প্রত্যেকের নিজ নিজ নানা রকমের কাজ ছিল এবং তা পালন করতে হত। কেউ তার কাজ সম্পাদনে ব্যর্থ হলে তার জন্য শাস্তির বিধান ছিল।[৪]
এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে প্রচলিত আরেকটি পৌরাণিক গল্পে বর্ণিত আছে, জেড সম্রাটের ঝিনু (সরলীকৃত চীনা: 织女; প্রথাগত চীনা: 織女; ফিনিন: zhī nǚ নামে এক কন্যা ছিল। তাকে মেঘের দেবী বলে আখ্যায়িত করা হয়। আবার কিছু গল্পে তাকে ঢেউয়ের দেবী বলে আখ্যায়িত করা হয়, বলা হয় সে জেড সম্রাট ও স্বর্গীয় সম্রাজ্ঞীর মেয়ে যে আকাশগঙ্গায় ঢেউয়ের সৃষ্টি করে, যা স্বর্গ ও মর্ত্যে আলো প্রদান করে। আরেকটি গল্পে বলা হয়, সে একজন দরজী, যে জেড সম্রাটের জন্য কাজ করে।
প্রতিদিন ঝিনু তার জাদুকরী রাজবেশের সাহায্যে গোসলের জন্য মর্ত্যে অবরোহণ করত। একদিন নিউ ল্যাং (চীনা: 牛郎; ফিনিন: niú láng) নামের এক রাখাল বালক তাকে জলাশয়ে গোসল করতে দেখে ফেলে। নিউ প্রথম দর্শনেই তার প্রেমে পড়ে যায়। সে তীরে রেখে যাওয়া ঝিনুর জাদুকরী রাজবেশ চুরি করে, যাতে সে স্বর্গে ফিরে যেতে না পারে। ঝিনু জলাশয় থেকে ওপরে উঠলে লিউ তাকে ধরে তার বাড়িতে নিয়ে যায়। যখন জেড সম্রাট তা জানতে পারে সে ক্রুদ্ধ হয়। কিন্তু সে তখন আর কিছু করতে পারে না কারণ তার মেয়ে ততক্ষনে লিউয়ের প্রেমে পড়ে যায় এবং তাকে বিয়ে করে। সময় অতিক্রান্ত হতে থাকলে ঝিনুর বাড়ির জন্য মন কাঁদে। একদিন সে তার স্বামী কর্তৃক লুক্কায়িত তার জাদুকরী রাজবেশওয়ালা বাক্স খুঁজে পায়। সে স্বর্গে যাবার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু স্বর্গে যাওয়ার পর জেড সম্রাট আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে একটি নদীর সৃষ্টি করে, যা ঝিনু পার হতে পারে না। অবশেষে দয়াপরবেশ হয়ে সে তাদের দুজনকে বছরে একবার চন্দ্রপঞ্জিকার সপ্তম মাসের সাত তারিখ নদীর তীরে দেখা করার সুযোগ দেন।[৫]
এ থেকে চন্দ্রপঞ্জিকার সপ্তম মাসের সাত তারিখ চীনারা পশ্চিমা দেশের ভালোবাসা দিবস-এর মত কিসি উৎসব পালন করে। জাপানে এ দিনটি তানাবাতা নামে পরিচিত। কোরিয়ায় দিনটি চিলসেওক নামে পরিচিত। ভিয়েতনামে দিনটি দ্যাত তিচ নামে পরিচিত। এই দিন যদি বৃষ্টি তাহলে বলা হয় ঝিনু তার স্বামীর সাথে দেখা হওয়ার আনন্দে কাঁদছে।
চীনা রাশিচক্রে ১২টি প্রাণী নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছু গল্প প্রচলিত আছে। একটি গল্পে বলা হয়, জেড সম্রাট বহু বছর স্বর্গ ও মর্ত্য সুশৃঙ্খলভাবে চালাতে থাকলেও তিনি নিজে মর্ত্যে আসতে পারতেন না। তখন তার আগ্রহ জাগে মর্ত্যের প্রাণীগুলো সম্পর্কে। তাই তিনি প্রাণীকুলকে স্বর্গে ডেকে পাঠান। বিড়াল ছিল প্রাণীকুলের মধ্যে সুন্দরতম। সে তার বন্ধু ইঁদুরকে তাকে পরদিন সকালে ডেকে দেওয়ার অনুরোধ করে। ইঁদুর বিড়ালের চেয়ে কুৎসিত, এই ভয়ে পরদিন বিড়ালকে না ডেকে চলে যায়। যার ফলে বিড়াল সভায় যেতে পারে না এবং বিড়ালের পরিবর্তে শূকর স্থান করে নেয়। জেড সম্রাট প্রাণীকুলকে দেখে খুশি হয় এবং বছরকে তাদের মধ্যে ভাগ করে দেয়। বিড়াল যখন এই সম্পর্কে জানতে পারে সে তখন ইঁদুরের উপর ক্ষিপ্ত হয়। এই গল্প অনুসারে, এ ঘটনাই বিড়াল ও ইঁদুরের মধ্যে শত্রুতার কারণ। [৬]
জেড সম্রাট ইয়ুনশি তিয়ানজুন-এর সহকারী ছিলেন। ইয়ুনশি তিয়ানজুনকে সব কিছুর প্রথম হিসেবে ধারণা করা হয়। তিনি স্বর্গ ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন এবং তার সহকারী ও উত্তরাধিকারী হিসেবে ইয়ু হুয়াং বা জেড সম্রাটকে নির্বাচন করেছেন। জেড সম্রাট তার উত্তরাধিকারী হিসেবে কিন ক্যু ইয়ু-চেন তিয়ান-সুনকে (金闕玉晨天尊) দায়িত্ব দেন। স্বর্গে তিনি তার স্ত্রী সমুদ্রদেবী মাজুসহ বিশাল পরিবার নিয়ে বসবাস করতেন। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইয়াং শেন, মহৎ গুণাবলীর দেবতা; এরলাং শেন, কপালে তৃতীয় চক্ষুবিশিষ্ট সত্যদর্শী দেবতা, যার স্বর্গীয় কুকুর তিয়ানগু দুষ্ট আত্মাদের তাড়ায়। তার অপর স্ত্রী ঘোড়ার মাথাবিশিষ্ট দেবী, যিনি চীনে প্রথম রেশম উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ। তার এক কন্যা শি কুনিং, যুবতী মেয়েরা তাদের ভবিষ্যৎ স্বামী সম্পর্কে জানতে তার উপাসনা করে।[২]
জেড সম্রাটের জন্মদিন প্রথম চন্দ্র মাসের নবম দিন। এই দিনে তাও ধর্মালম্বীরা মন্দিরে উপাসনা করে। যাজক ও সাধারণ মানুষ সবাই সাক্ষাঙ্গে প্রণত হয়, ধূপ পোড়ায় ও খাবার পরিবেশন করে।[৭] এই দিন সকালে চীনা ও তাইওয়ানের গৃহস্থালীতে তিন স্তর বিশিষ্ট পূজাবেদী বসানো হয়। বেদীর প্রথম স্তরে রাখা হয় ছয় ধরনের শাকসবজি, নুডুলস, ফলমূল, কেক, তাঙ্গুয়ান, অপক্ক পানপাতা। নিচের দুই স্তরে থেকে উৎসর্গীকৃত পাঁচটি উপাদান ও মদ। পরে তারা তার সম্মানার্থে তিনবার নতজানু হয় এবং নয়বার কওতও করে তার দীর্ঘায়ু কামনা করে।[৮]
ইয়ুক অং কুং তিন (玉皇宮殿) অথবা ইয়ুক অং পো তিন (玉皇寶殿) জেড সম্রাটের প্রতি উৎসর্গীকৃত হংকং-এর অ্যা কুং গাম-এ অবস্থিত একটি মন্দির। ১৯শ শতাব্দীর মধ্যভাগে হুইঝাও ও চাওঝাও লোকজন পর্বত থেকে পাথর কেটে নগর গড়ে তুলে। তার উপাসনার জন্য ছোট ছোট উপাসনার স্থান ইয়ুক অং নির্মাণ করে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ছোট উপাসনার স্থানকে ছোট মন্দিরে রূপান্তর করা হয়। পরে অনেকবার এই মন্দিরকে নবরুপ দান করা হয়। সর্বশেষ ১৯৯২ সালে এটিকে নতুন রূপ দেওয়া হয়।[৯]
ভয়েজার ২ কর্তৃক আবিস্কৃত শনি গ্রহের একটি উপগ্রহ রীয়ার একটি আগ্নেয়গিরির নাম তার নামানুসারে রাখা হয়েছে।
উইকিমিডিয়া কমন্সে জেড সম্রাট সম্পর্কিত মিডিয়া দেখুন।