জেরুসালেম অবরোধ (৬৩৭) | |||||||||
---|---|---|---|---|---|---|---|---|---|
মূল যুদ্ধ: মুসলিমদের সিরিয়া বিজয় (আরব-বাইজেন্টাইন যুদ্ধ) | |||||||||
আল-আকসা মসজিদ, জেরুসালেম, মুসলিমদের অন্যতম প্রধান পবিত্র স্থান। | |||||||||
| |||||||||
বিবাদমান পক্ষ | |||||||||
রাশিদুন খিলাফত | বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য | ||||||||
সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী | |||||||||
আবু উবাইদা ইবনুল জাররাহ খালিদ বিন ওয়ালিদ ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান আমর ইবনুল আস শুরাহবিল ইবনে হাসানা | পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস | ||||||||
শক্তি | |||||||||
~২০,০০০[১] | অজ্ঞাত |
৬৩৭ সালের জেরুসালেম অবরোধ বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ও রাশিদুন খিলাফতের মধ্যকার একটি সংঘর্ষ। ৬৩৭ সালে এই ঘটনা সংঘটিত হয়। রাশিদুন সেনাবাহিনী আবু উবাইদাহর নেতৃত্বে ৬৩৬ সালের নভেম্বরে জেরুসালেম অবরোধ করলে এই ঘটনা সংঘটিত হয়। ছয় মাস পর পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস তৎকালীন খলিফা উমরের ব্যক্তিগত উপস্থিতির শর্তে আত্মসমর্পণ করতে রাজি হন। ৬৩৭ সালের এপ্রিলে খলিফা উমর জেরুসালেমে আসেন এবং এসময় শহর মুসলিমদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
শহরের উপর মুসলিমদের বিজয়ের ফলে ফিলিস্তিনের উপর আরব নিয়ন্ত্রণ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। একাদশ শতকে প্রথম ক্রুসেডের আগ পর্যন্ত এই নিয়ন্ত্রণ বজায় ছিল। খ্রিষ্টান ও ইহুদিদের পাশাপাশি এটি মুসলিমদের কাছেও একটি পবিত্র শহর। এই ঘটনার ফলে বাইজেন্টাইন প্রদেশ প্যালেস্টিনা প্রিমার অবস্থা স্থিতিশীল হয়। ৬১৩ সালে ইহুদিদের হেরাক্লিয়াসের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পর ৬১৪ সালে সাসানীয়রা জেরুসালেম দখল করে নেয় এবং এখানে ইহুদি স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। ৬২৯ সালে বাইজেন্টাইনরা পুনরায় শহর দখল করে নেয় ও গণহত্যা চালায়। ফলে ১৫ বছরের ইহুদি শাসনের অবসান হয়।
জেরুসালেমে মুসলিম কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে বাইজেন্টাইন শাসন প্রতিষ্ঠার ৮ বছর পর ও জুডিয়া থেকে রোমানদের দ্বারা ইহুদিদের বহিষ্কারের প্রায় ৫০০ বছর পর ইহুদিরা এখানে স্বাধীনভাবে বসবাস ও ধর্মপালনের সুযোগ পুনরায় ফিরে পায়।[২]
জেরুসালেম বাইজেন্টাইন প্রদেশ প্যালেস্টিনা প্রিমার একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল। মুসলিম বিজয়ের ২৩ বছর পূর্বে ৬১৪ সালে শেষ বাইজেন্টাইন-সাসানীয় যুদ্ধের সময় সাসানীয় সেনাবাহিনী শাহ্রবারাজের নেতৃত্বে এখানে আক্রমণ করে। পারসিকরা শহরে লুটপাট চালায়। বলা হয় যে তারা শহরের ৯০,০০০ খ্রিষ্টান অধিবাসীকে হত্যা করে।[৩] লুটপাটের অংশ হিসেবে চার্চ অব দ্য হলি সেপালাচার ধ্বংস করা হয়, এর ক্রুশ খুলে নেয়া হয় ও তিসফুনে নিয়ে যাওয়া হয়। ধারণা করা হয় যে ইহুদিরা পারসিকদের সাহায্য করেছিল।[৪]
৬৩২ সালে মুহাম্মদ এর মৃত্যুর পর আবু বকর মুসলিমদের নেতৃত্ব লাভ করেন ও খলিফা হন। এরপর তাকে রিদ্দার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয়। আরবের উপর আবু বকরের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তিনি পূর্ব দিকে ইরাক আক্রমণ করেন। এই অঞ্চলটি তৎকালীন সাসানীয় সাম্রাজ্যের একটি প্রদেশ ছিল। অপরদিকে পশ্চিমে তার বাহিনী বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য আক্রমণ করে।[৫]
৬৩৪ সালে আবু বকর মৃত্যুবরণ করেন ও উমর তার উত্তরসুরি হন। তিনি এই বিজয় অভিযান চালিয়ে যান।[৬] ৬৩৬ সালে সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার হারানো অঞ্চল পুনরুদ্ধারের জন্য একটি বড় অভিযান চালান। কিন্তু ৬৩৬ এর আগস্টে ইয়ারমুকের যুদ্ধে তার বাহিনী পরাজিত হয়। এরপর অক্টোবরের প্রথম দিকে সিরিয়ার মুসলিম বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চীফ আবু উবাইদাহ ভবিষ্যত পরিকল্পনা বিষয়ে একটি সভার আহ্বান করেন। উপকূলীয় শহর কায়সারিয়া ও জেরুসালেমের বিষয়ে বিভিন্ন রকম মত উঠে আসে। আবু উবাইদাহ এই দুটি শহরের গুরুত্ব অনুধাবন করছিলেন। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পেরে তিনি খলিফা উমরের কাছে নির্দেশনা চেয়ে চিঠি লেখেন। উত্তরে খলিফা দ্বিতীয় শহরকে জয় করার নির্দেশ দেন। এরপর আবু উবাইদাহ জাবিয়া থেকে জেরুসালেমের দিকে অগ্রসর হন। তার সাথে খালিদ বিন ওয়ালিদ ও তার অধীনস্থ বাহিনীও ছিল। নভেম্বরের প্রথমদিকে মুসলিমরা জেরুসালেমে পৌছে এবং বাইজেন্টাইন বাহিনী নগর প্রাচীরের ভেতর অবস্থান নেয়।[১]
পারসিকদের কাছ থেকে জেরুসালেম পুনরুদ্ধারের পর হেরাক্লিয়াস এটির প্রতিরক্ষা মজবুত করেন।[৭] ইয়ারমুকে বাইজেন্টাইনদের পরাজয়ের পর জেরুসালেমের পেট্রিয়ার্ক সফ্রোনিয়াস প্রতিরক্ষা পুনরায় সংস্কার করেন।[৮] মুসলিমরা শহর অবরোধ করতে চায়নি। তবে ৬৩৪ সালে মুসলিমরা শহরের সকল প্রবেশ পথের উপর কর্তৃত্ব স্থাপনের পর্যায়ে ছিল। মুসলিমরা পার্শ্ববর্তী দুর্গ পেল্লা ও বসরা দখল করে নেয়ার পর জেরুসালেমে একরকম অবরোধের মুখে পড়ে। ইয়ারমুকের যুদ্ধের পর শহরটি সিরিয়ার বাকি অঞ্চল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং সম্ভবত অবরোধের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখে।[৭] মুসলিম বাহিনী জেরিকো পৌছলে সফ্রোনিয়াস সকল পবিত্র চিহ্ন সংগ্রহ করেন ও কনস্টান্টিনোপলে পাঠানোর জন্য উপকূলে পাঠিয়ে দেন।[৮] মুসলিমরা ৬৩৬ এর নভেম্বরে শহর অবরোধ করে। শহরের উপর ক্রমাগত আক্রমণের বদলেa[›] তারা বাইজেন্টাইনদের রসদ কমে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন যাতে রক্তপাতহীন আত্মসমর্পণ সম্ভব হয়।[৯]
অবরোধের ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য লিখিত নেই।b[›] তবে এটি রক্তপাতহীন ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।[১০] বাইজেন্টাইনরা হেরাক্লিয়াসের কাছ থেকে সাহায্যের ব্যাপারে আশা ছেড়ে দিয়েছিল। চার মাস অবরোধের পর সফ্রোনিয়াস জিজিয়া প্রদান ও আত্মসমর্পণে সম্মত হন। তবে তিনি শর্ত দেন যে খলিফা উমরকে নিজে এসে চুক্তি স্বাক্ষর করতে হবে।[১১] বলা হয় যে, সফ্রোনিয়াসের শর্তগুলো মুসলিমদের কাছে পৌছালে অন্যতম মুসলিম সেনাপতি শুরাহবিল ইবনে হাসানা প্রস্তাব করেন যে মদীনা থেকে খলিফার প্রত্যাবর্তনের অপেক্ষা না করে খালিদ বিন ওয়ালিদকে খলিফা হিসেবে পাঠানো হোক, কারণ তিনি দেখতে অনেকটা উমরের মত ছিলেন।[১২] কিন্তু এই কৌশল কাজ করেনি। সম্ভবত খালিদ সিরিয়ায় খুব পরিচিত ছিলেন অথবা শহরের খ্রিষ্টান আরবদের কেউ কেউ মদীনায় গিয়ে উমর ও খালিদ উভয়কেই দেখেছে ফলে তাদের পার্থক্যগুলো তাদের জানা ছিল। সফ্রোনিয়াস আলোচনায় অসম্মতি জানান। যখন খালিদ মিশনের ব্যর্থতা সম্পর্কে রিপোর্ট করেন, আবু উবাইদাহ খলিফা উমরের কাছে চিঠি লিখে পরিস্থিতি অবহিত করেন ও আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের জন্য তাকে জেরুসালেম আসার আমন্ত্রণ জানান।[১৩]
৬৩৭ সালের এপ্রিলের প্রথমদিকে উমর ফিলিস্তিনে পৌছান। প্রথমে তিনি জাবিয়ায় আসেন।,[১৪] আবু উবাইদাহ, খালিদ ও ইয়াজিদ তাকে সেখানে অভ্যর্থনা জানান। তারা খলিফাকে গ্রহণ করার জন্য এখানে আসেন। আমর অবরোধকারী মুসলিমদের নেতৃত্বের জন্য থেকে যান।[১৫]
উমর জেরুসালেমে আসেন ও উমরের চুক্তি বলে পরিচিত চুক্তিটি সম্পাদন করা হয়। এর ফলে শহর মুসলিমদের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং জিজিয়ার বিনিময়ে অমুসলিমদের নাগরিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। মুসলিমদের পক্ষে খলিফা উমর এতে স্বাক্ষর করেন এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ, আমর ইবনুল আস, আবদুর রহমান বিন আউফ ও মুয়াবিয়া মুসলিম পক্ষে চুক্তির স্বাক্ষী হন। ৬৩৭ সালের এপ্রিলের শেষের দিকে জেরুসালেম কাগজে-কলমে খলিফার কাছে আত্মসমর্পণ করে।[১৬] ৫০০ বছরের নিপীড়নমূলক রোমান শাসনের পর এই প্রথম ইহুদিরা জেরুসালেম বসবাস ও উপাসনা করার জন্য পুনরায় অনুমতি পায়।[২]
বিভিন্ন লিখিত মুসলিম দলিল মোতাবেক যোহরের নামাজের সময় সফ্রোনিয়াস উমরকে চার্চ অব হলি সেপালচারে নামাজ পড়ার আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু এমন করার ফলে ভবিষ্যতে চার্চের খ্রিষ্টান গুরুত্ব কমে যেতে পারে ও মুসলিমরা চুক্তি ভঙ্গ করে এটিকে মসজিদে পরিণত করতে পারে এই আশঙ্কায় উমর তাতে রাজি হননি।[৯] জেরুসালেমে দশদিন অবস্থান করার পর খলিফা উমর মদীনা ফিরে আসেন।[১৭]
খলিফার নির্দেশ অনুযায়ী ইয়াজিদ কায়সারিয়ায় যাত্রা করেন ও পুনরায় বন্দর নগরীর অবরোধে নেতৃত্ব দেন। আমর ও শুরাহবিল ফিলিস্তিন বিজয় সম্পন্ন করার কাজে যাত্রা করেন। সে বছরেই এই কাজ সমাপ্ত হয়। তবে ৬৪০ সাল নাগাদ কায়সারিয়া দখল করা সম্ভব হয়নি। এসময় প্রথম মুয়াবিয়া সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন ও তার কাছে এই শহর আত্মসমর্পণ করে। ১৭,০০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে আবু উবাইদাহ ও খালিদ উত্তর সিরিয়া জয় করতে অগ্রসর হন। ৬৩৭ সালে এন্টিওক জয়ের পর এই অভিযান সমাপ্ত হয়।[১৮] ৬৩৯ সালে মুসলিমরা মিসর আক্রমণ ও জয় করে।
জেরুসালেমে অবস্থানের সময় সফ্রোনিয়াস উমরকে বেশ কিছু পবিত্র স্থান দেখাতে নিয়ে যান। এর মধ্যে টেম্পল মাউন্টও ছিল। এর দুরবস্থা দেখে উমর এখানকার জঞ্জাল ও ধ্বংসস্তুপ সরিয়ে একটি কাঠের তৈরী মসজিদ নির্মাণের আদেশ দেন।[১৯] গলের বিশপ আরকালফ ৬৭৯ থেকে ৬৮২ এর মধ্যে জেরুসালেম ভ্রমণ করেন। তিনি এসময় তার দেখা মসজিদের বিবরণ দেন। তার বর্ণনায় এটির বীমগুলো কাঠের তৈরী ও এটি পুরানো ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মাণ করা হয়েছিল এবং এতে মোট ৩,০০০ লোক একসাথে নামাজ আদায় করতে পারত।[২০]
জেরুসালেম বিজয়ের ৫০ বছরেরও বেশি সময় পর ৬৯১ সালে উমাইয়া খলিফা আবদুল মালিক ডোম অব দ্য রক নির্মাণের কাজে হাত দেন। দশম শতাব্দীর ইতিহাসবিদ আল-মুকাদ্দাসির লেখা অনুযায়ী আবদুল মালিক শহরের খ্রিষ্টান গির্জার চাকচিক্যের সাথে তুলনীয় কিছু গড়ার জন্য এই নির্মাণে হাত দেন। তবে তার উদ্দেশ্য যাই থাক, এর জাকজমক ও আকার তৎকালীন মুসলিমদের সাথে জেরুসালেমের সংযোগ বৃদ্ধিতে যথেষ্ট সহায়ক ছিল।[১৯]
পরবর্তী ৪০০ বছর ধরে ঐ অঞ্চলে মুসলিমদের কর্তৃত্ব বজায় ছিল। প্রথম ক্রুসেডের সময় ইউরোপীয়রা জেরুসালেম দখল করে নেয়ার আগ পর্যন্ত এটি মুসলিমদের অধীনে ছিল।
^ a: The Muslims are said to have lost 4,000 men in the Battle of Yarmouk fought just two months before the siege.
^ b: Muslim historians differ in the year of the siege; while Tabari says it was 636, al-Baladhuri placed its date of surrender in 638 (Futuh II.XI or p. 139; p. 214 in Hitti translation). Agha I. Akram believes 636–637 to be the most likely date.