জৈনধর্ম |
---|
ধর্ম প্রবেশদ্বার |
ঈশ্বরের ধারণা |
---|
জৈনধর্মে ঈশ্বর ধারণাটি অন্যান্য ধর্মের ঈশ্বর ধারণার তুলনায় অনেকটাই স্বতন্ত্র। জৈনধর্মে ঈশ্বরত্বকে প্রত্যেক আত্মার অন্তর্নিহিত গুণ মনে করা হয়। জৈন বিশ্বাস অনুসারে, আত্মার এই গুণটি কর্ম-সংক্রান্ত বিষয়ের সংযোগের কারণে প্রচ্ছন্ন থাকে। যে সকল আত্মা অনন্ত আনন্দ, অনন্ত শুদ্ধ জ্ঞান (‘কেবল জ্ঞান’), অনন্ত শক্তি ও অনন্ত অন্তর্দৃষ্টি অর্জন করতে সমর্থ হন, তাদেরই জৈনধর্মে ‘ঈশ্বর’ বলা হয়। ব্রহ্মাণ্ডের অভিপ্রকাশ, সৃষ্টি ও পালনের জন্য দায়ী সৃষ্টিকর্তা দেবতার ধারণাটি জৈনধর্মে প্রত্যাখ্যান করা হয়। জৈন মতবাদ অনুসারে, ব্রহ্মাণ্ড ও তার উপাদানগুলি (আত্মা, বস্তু, মহাকাশ, কাল ও গতির নিয়মাবলি) সর্বদাই বিদ্যমান। সকল উপাদান ও কর্ম পরিচালিত হয় বিশ্বজনীন প্রাকৃতিক বিধান অনুসারে। জগত-বহির্ভূত আত্মা ব্রহ্মাণ্ডের ন্যায় জাগতিক বস্তুকে প্রভাবিত করতে পারেন না।[১]
সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে, প্রত্যেক জীবিত সত্ত্বার আত্মা সকল দিক থেকেই যথাযথ এবং সকল প্রকার কর্মের বন্ধন থেকে মুক্ত। এই ধরনের আত্মাকেই ‘ঈশ্বর’ বা ‘ঈশ্বরীয় গুণসম্পন্ন আত্মা’ মনে করা হয়। এই ‘ঈশ্বর’ ধারণাটি কেবলমাত্র সেই সব আত্মার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, যে আত্মার মধ্যে ঈশ্বরীয় গুণগুলি নিজস্ব অন্তর্নিহিত প্রকৃতি অনুসারে প্রকাশিত হয়েছে।
রত্নকরন্দ শ্রাবকাচার (একটি প্রধান জৈন ধর্মগ্রন্থ) অনুসারে:[২]
জৈন বিশ্বাস অনুসারে, ঈশ্বরত্ব প্রত্যেক আত্মার (বা প্রত্যেক জীবিত সত্ত্বার) একটি অন্তর্নিহিত গুণ। এই গুণের বৈশিষ্ট্য হল অনন্ত আনন্দ, অনন্ত শক্তি, অনন্ত শুদ্ধ জ্ঞান (‘কেবল জ্ঞান’)[৩] অনন্ত অন্তর্দৃষ্টি এবং গণনাযোগ্য অন্যান্য অনন্ত গুণাবলির যথাযথ অভিপ্রকাশ। এই বিষয়টি দুটি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। প্রথমত, আত্মাকে দেখা যায় আত্মারই দৃষ্টিকোণ থেকে। সময়সার, নিয়মসার ও প্রবচনসূত্র নামক গূঢ় ও গুপ্ত গ্রন্থগুলিতে এই দৃষ্টিকোণ থেকে আত্মার গুণাবলি, যথাযথ গঠনভঙ্গিমা, উপাদান ও প্রকৃতি এবং আত্মা ও আত্মার সূত্র গুণাবলি থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন অবস্থার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আত্মাকে আত্মার থেকে ভিন্ন বস্তু এবং সেগুলির সঙ্গে আত্মার সম্পর্কের দৃষ্টিকোন থেকে দেখা। এই মত অনুসারে, আত্মার গুণাবলি কর্মের কারণে প্রচ্ছন্ন থাকে। জৈনধর্মে কর্ম হল প্রকৃতির মৌলিক উপাদান। যিনি সঠিক বিশ্বাস, সঠিক জ্ঞান ও সঠিক আচরণের মাধ্যমে কর্মের বন্ধন ছিন্ন করতে পারেন, তাকেই একজন ‘ঈশ্বর’ বলা চলে। আত্মার এই যথার্থতাকে বলা হয় ‘কেবলী’। একজন ঈশ্বর কেবলী ভাব অর্জন করে মুক্ত আত্মায় পরিণত হন। দুঃখ, জন্ম ও মৃত্যুর ধারাবাহিক চক্র, জগত, কর্ম এবং দেহের থেকে মুক্তি লাভ করেন। এটিকে বলা হয় ‘নির্বাণ’ বা মোক্ষ।
জৈনধর্ম জ্ঞান লাভের জন্য কোনও সর্বোচ্চ সত্ত্বার উপর নির্ভরশীলতার শিক্ষা দেয় না। তীর্থঙ্করেরা হলেন পথপ্রদর্শক ও শিক্ষক। তারা জ্ঞানলাভের মার্গদর্শন করান। তবে জ্ঞানলাভের জন্য ব্যক্তিকে নিজেকে সংগ্রাম করতে হয়। নৈতিক পুরস্কার ও যন্ত্রণাগুলি কোনও দিব্য সত্ত্বার কাজ নয়। এগুলি বিশ্বের একটি অন্তর্নিহিত নৈতিক শৃঙ্খলার ফল। এটি একটি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রস্বরূপ। তাই ব্যক্তি কর্মের মাধ্যমে নিজ কর্মের ফল ভোগ করেন।
জৈনরা বিশ্বাস করেন, জ্ঞান ও সকল কর্মের বন্ধন থেকে সর্বোচ্চ মুক্তি লাভ করার জন্য ব্যক্তিকে অবশ্যই নৈতিক আদর্শগুলি পালন করতে হবে। শুধুমাত্র চিন্তার ক্ষেত্রে নয়, বাক্য ও কার্যের ক্ষেত্রেও এই আদর্শগুলি পালন করা আবশ্যিক। জীবনব্যাপী কাজের মাধ্যমে এই অনুশীলনকে বলা হয় ‘মহাব্রত’ পালন।
ঈশ্বরদের দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা: সাকার ঈশ্বর, যাঁরা ‘অরিহন্ত’ নামে পরিচিত এবং নিরাকার ঈশ্বর, যাঁরা ‘সিদ্ধ’ নামে পরিচিত। জৈনধর্মে ‘দেবী’ ও ‘দেব’দের স্বর্গবাসী আত্মা মনে করা হয়। তাঁর পূর্ব পূর্ব জন্মে সৎ কর্মের আচরণের ফলে স্বর্গবাসী হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এই আত্মাদের স্বর্গবাসের কাল নির্দিষ্ট। এই সময়কাল উত্তীর্ণ হলে তাঁদেরও মোক্ষ লাভ করার জন্য আবার মানুষ রূপে পুনর্জন্ম গ্রহণ করতে হয়।
এই জন্য জৈনধর্মে ঈশ্বরের সংখ্যা অনন্ত। সকলেই গুণাবলির অভিপ্রকাশের ক্ষেত্রে সমান, মুক্ত ও অনন্ত। আত্মা ও কর্ম জৈনধর্মে পৃথক। আত্মা সজীব এবং কর্ম নির্জীব। যাঁরা জ্ঞান লাভের অবস্থায় থাকেন এবং পরে জ্ঞান লাভ করেন, জৈনধর্মে তাঁদেরই ‘ঈশ্বর’ বলা হয়। তাই যে সত্ত্বারা (‘অরিহন্ত’) সর্বোচ্চ জ্ঞান (‘কেবল জ্ঞান’) অর্জন করেছেন, তাদের ‘ঈশ্বর’ বলে পূজা করা হয়। ঈশ্বরত্বের গুণ সকলের ক্ষেত্রে এক ও সমান। জৈনধর্মকে কখনও কখনও একটি ঈশ্বর-নিরপেক্ষ ধর্ম মনে করা হয়।[৪] যদিও ঈশ্বর ধারণার সংজ্ঞা অনুসারে এটিকে নাস্তিক্যবাদী বা বহু-ঈশ্বরবাদী ধর্মও বলা যায়।
জৈনধর্মে ‘পঞ্চ-পরমেষ্টী’রা (সংস্কৃত ভাষায় যার অর্থ ‘পাঁচ সর্বোচ্চ সত্ত্বা’) হলেন ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দিষ্ট পদমর্যাদাক্রমে ন্যস্ত পাঁচ প্রকারের সর্বোচ্চ পূজনীয় সত্ত্বা। এই পাঁচ ধরনের সর্বোচ্চ সত্ত্বারা হলেন:
যে মানব সকল অন্তর্নিহিত কামনাবাসনা জয় এবং অনন্ত সত্য জ্ঞান (‘কেবল জ্ঞান’) অর্জন করতে পারেন, তাকেই জৈনধর্মে ‘অরিহন্ত’ নামে পূজা করা হয়।[৫] তাদের বলা জয় ‘জিন’ (বিজয়ী) বা ‘কেবলী’ (সর্বজ্ঞ সত্ত্বা)। অরিহন্ত হলেন এমন এক আত্মা যিনি সকল কামনা ধ্বংস করেছেন, যাঁর কোনও বন্ধন নেই এবং কোনও বাসনাও নেই। এই কারণেই তিনি চারটি ‘ঘাটিয়া কর্ম’ ধ্বংস করতে সমর্থ হয়েছেন এবং ‘কেবল জ্ঞান’ অর্জন করে সর্বজ্ঞ হয়েছেন। এই ধরনের আত্মার তবু একটি শরীর ও চারটি ‘অঘাটিয়া কর্ম’ থাকে। নিজেদের মানবজীবনের শেষে অরিহন্তেরা সকল অবশিষ্ট অঘাটিয়া কর্ম ধ্বংস করে সিদ্ধত্ব প্রাপ্ত হন। দুই ধরনের ‘কেবলী’ বা ‘অরিহন্ত’ আছেন:[৬]
‘তীর্থঙ্কর’ শব্দটির অর্থ ‘তীর্থের প্রতিষ্ঠাতা’। জৈনধর্মে ‘তীর্থ’ শব্দটির অর্থ ‘সমুদ্রের মধ্যে দিয়ে যাওয়া একটি গমনযোগ্য পথ’। তীর্থঙ্করেরা জন্ম ও মৃত্যুর অনন্ত সমুদ্রের মধ্য দিয়ে ‘গমযোগ্য পথে’র সন্ধান দেন।[৮] জৈন বিশ্বজনীন সময়চক্র অনুসারে, অবসর্পিণী যুগে ঋষভনাথ ছিলেন প্রথম তীর্থঙ্কর এবং মহাবীর ছিলেন শেষ তীর্থঙ্কর।[৯]
তীর্থঙ্কররা শ্রমণ, শ্রমণী, শ্রাবক ও শ্রাবিকা নিয়ে গঠিত চতুর্মুখী সংঘের পুনরুজ্জীবন ঘটান। জৈন সাহিত্য অনুসারে, প্রত্যেক বিশ্বজনীন সময়চক্রের অর্ধেক কালে ঠিক ২৪ জন তীর্থঙ্কর কৃপা করেন।[৯] তীর্থঙ্করদের বলা যায় শিক্ষক ঈশ্বর। তাঁরা জৈন দর্শন শিক্ষা দেন। জৈন ও হিন্দুধর্মে দেবপূজার নিয়মে কিছু সাদৃশ্য থাকলেও, দেবতা হিদেবে তীর্থঙ্করেরা হিন্দু দেবমণ্ডলীর দেবদেবীগণের অনুরূপ নন।[১০] তীর্থঙ্করেরা মুক্ত। তাঁরা ব্রহ্মাণ্ডের অপর কিছুর সঙ্গে কোনও প্রকার আদানপ্রদানের ঊর্ধ্বে। তাঁরা কোনও রকম সৃজনশীল কাজে লিপ্ত থাকেন না। প্রার্থনার উত্তরে মধ্যস্থতা করার যোগ্যতা বা ক্ষমতাও তাঁদের নেই।
‘তীর্থঙ্কর-নাম-কর্ম’ হল এক বিশেষ ধরনের কর্ম। এই কর্মের বন্ধনে এক আত্মা তীর্থঙ্করের সর্বোচ্চ সত্ত্বায় উত্তীর্ণ হন।[১১]
নির্বাণ লাভের সময় সকল অরিহন্তই ‘সিদ্ধ’ বা মুক্ত আত্মায় পরিণত হন। সিদ্ধ হলেন এমন এক আত্মা, যিনি জন্ম ও মৃত্যুর ক্রমিক চক্রের থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেছেন। এমন আত্মা নিজের সত্য সত্ত্বাটিকে জানতে পেরে সকল কর্ম ও দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যান। তিনি নিরাকার। অনন্ত আনন্দ, অনন্ত অন্তর্দৃষ্টি, অনন্ত জ্ঞান ও অনন্ত শক্তির অধিকারী হয়ে তিনি ব্রহ্মাণ্ডের শীর্ষদেশে ‘সিদ্ধশিলা’ (মুক্ত আত্মাদের রাজ্য) নামক স্থানে বাস করেন।
আচারাঙ্গ সূত্র (১.১৯৭) গ্রন্থে সিদ্ধদের সম্পর্কে বলা হয়েছে:
মুক্ত আত্মা দীর্ঘ নয়, ক্ষুদ্র নয়, গোল নয়, ত্রিকোণ নয়, চতুর্ভূজ নয়, বৃত্ত নয়। সে কালো নয়, নীল নয়, লাল নয়, সবুজ নয়, সাদাও নয়। সে সুগন্ধী বা দুর্গন্ধপূর্ণও নয়। সে তিক্ত নয়, কটুস্বাদের নয়, সঙ্কুচিত নয়, মিষ্টিও নয়। সে রুক্ষ বা কোমল নয়। সে ভারী বা হালকা নয়। সে শীতল বা উত্তপ্ত নয়। সে কঠোর বা মসৃণ নয়। সে নিরাকার। তার পুনর্জন্ম নেই। (বস্তুর) সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নেই। সে নারী, পুরুষ বা লিঙ্গ-নিরপেক্ষও নয়। সিদ্ধ সকল ধারণা ও জ্ঞানের অধিকারী, তবু সে তুলনার অতীত। এর সার নিরাকার; নিঃশর্তের কোনও শর্ত নেই। সে শব্দ নয়, বর্ণ নয়, গন্ধ নয়, স্বাদ অয়, স্পর্শ নয় বা সেই ধরনের কোনও কিছুই নয়।[১২]
সিদ্ধত্ব হল সকল আত্মার সর্বোচ্চ লক্ষ্য। অসংখ্য আত্মা সিদ্ধ হয়েছেন এবং আরও অসংখ্য আত্মা সিদ্ধ হবেন।[d] জৈনধর্ম অনুসারে, ঈশ্বরত্ব কয়েকজন সর্বজ্ঞ ও শক্তিমান সত্ত্বার একচেটিয়া অধিকার নয়। সঠিক ধারণা, জ্ঞান ও আচরণের মাধ্যমে সকল আত্মা আত্মস্বরূপ উপলব্ধি করে সিদ্ধত্ব অর্জন করতে পারেন। এই অনন্ত আনন্দের অবস্থা লাভ করে এবং সকল কামনা ধ্বংস করে আত্মা আর জাগতিক বিষয় নিয়ে চিন্তা করেন না এবং ব্রহ্মাণ্ডের কাজকর্মেও হস্তক্ষেপ করেন না। কারণ, কোনও ধরনের ক্রিয়াকর্ম বা কামনা পুনরায় কর্মের বন্ধনে আত্মাকে আবদ্ধ করে এবং সেক্ষেত্রে মুক্তি লুপ্ত হয়।
জৈনরা এই কামনাবাসনাহীন দেবতাদের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা জানান। তাদের থেকে বিশেষ কিছু লাভ করার উদ্দেশ্যে তারা প্রার্থনা করেন না। যে গুণাবলি কর্মের বন্ধন ধ্বংস করে ঈশ্বরত্ব লাভে সহায়ক হয়েছে, সেই গুণাবলির প্রতিই তারা প্রার্থনা জানান। ‘বন্দেতদ্গুনলব্ধায়’ (‘সেই দেবতাদের গুণাবলির প্রতি আমরা প্রার্থনা জানাই সেই সব গুণাবলি অর্জনের জন্য’) শব্দটির মাধ্যমে এই ধারণাটি আরও স্পষ্ট হয়।[১৩]
অ্যানি ভ্যালেলির মতে:
জৈনধর্ম নিচে নেমে আসার ধর্ম নয়। জৈনধর্মে আমরাই আছি যাদের উপর দিকে উঠতেই হয়। আমাদের শুধু নিজেদের সাহায্য করতে হবে। জৈনধর্মে আমাদের ঈশ্বর হতে হবে। সেটাই একমাত্র কথা।[১৪]
জৈন বিশ্বতত্ত্বে ‘দেব’ বা দৈব সত্ত্বাগুলির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায়। তবে এই সত্ত্বারা সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর – কোনও অর্থেই গৃহীত হয়নি। অন্যান্য জীবিত সত্ত্বার মতো তারাও দুঃখ ও পরিবর্তনের মুখাপেক্ষী। এঁদের মৃত্যুও অবশ্যম্ভাবী।
জৈনধর্মে তীর্থঙ্করদের সহচর রূপে ‘শাসনদেবতা’ ও ‘শাসনদেবী’দের অস্তিত্বের বিবরণ পাওয়া যায়। এঁরা তীর্থঙ্করদের দিব্য প্রচার সভা ‘সমবসরণ’ সৃজন করেন। এই ধরনের দৈব সত্ত্বারা নিম্নোক্ত শ্রেণিতে বিভক্ত:
যে সব আত্মারা সৎ কর্মের অনুষ্ঠান করেন, তারা স্বর্গে দেবতা রূপে জন্মগ্রহণ করেন। তার জীবনকাল বেশ দীর্ঘ। তবে সৎ কর্মের প্রভাব ফুরালে তারা কর্মের ফল অনুসারে আবার মানবলোক, পশুলোক বা নরকে জন্মগ্রহণ করেন। এই সকল দেবগণ মুক্ত নন। তাদের আসক্তি ও কামনাবাসনা রয়েছে। তাই তারা পূজনীয়ও নন।
আচার্য হেমচন্দ্র এই ধরনের দেবপূজার সমালোচনা করে লিখেছেন:
এই ধরনের স্বর্গীয় সত্ত্বারা (দেবগণ) আসক্তি ও কামনাবাসনায় জর্জরিত; তাঁরা তাঁদের পাশে নারী ও অস্ত্র রাখেন, কাউকে পছন্দ করেন, কাউকে অপছন্দ করেন; এই ধরনের স্বর্গীয় সত্ত্বাদের পূজা করা মুক্তিকামীর উচিত নয়।[১৫]
এই ধরনের দেবতাদের পূজাকে ‘মিথ্যাত্ব’ বা ভ্রান্ত বিশ্বাস বলা হয়। মনে করা হয়, এই ধরনের পূজা মানুষকে কর্মের বন্ধনে আবদ্ধ করে।
জৈন ধর্মগ্রন্থে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা রূপে ঈশ্বরের ধারণাটি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে যে, কোনও জীবিত সত্ত্বার কর্মের জন্য দায়ী বা কর্মের কারণস্বরূপ কোনও ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই। খ্রিস্টীয় ১২শ শতাব্দীতে আচার্য হেমচন্দ্র যোগশাস্ত্র গ্রন্থে ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে জৈন দৃষ্টিভঙ্গি বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন:[১৬]
এই ব্রহ্মাণ্ড কেউ সৃষ্টি করেননি, কেউ এটি রক্ষা করেন না; এটি স্বরক্ষিত, এর কোনও ভিত্তি বা সহায়ক নেই।
শাস্ত্রীয় নির্দেশবাক্য ছাড়াও সৃষ্টিতত্ত্ব-সংক্রান্ত ধারণাগুলির প্রত্যাখ্যান করার জন্য জৈনরা ন্যায় ও অবরোহী যুক্তিবাদের প্রয়োগ ঘটিয়ে থাকেন। জৈন আচার্যগণ বৈদিক, সাংখ্য, মীমাংসা, বৌদ্ধ ও অন্যান্য দর্শনে দৈবত্ব ও ব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে ধারণাগুলি পর্যালোচনা করেন। তারপর বিতর্কের মাধ্যমে তারা সেগুলি প্রত্যাখ্যান করেন। আচার্য জিনসেন তার মহাপুরাণ গ্রন্থে সবচেয়ে সুস্পষ্টভাবে এই প্রত্যাখ্যানের ব্যাখ্যা দিয়েছেন।[১৭][১৮][১৯] কার্ল স্যাগান তার কসমস গ্রন্থে জিনসেনের উক্ত গ্রন্থটি থেকে নিম্নোক্ত অংশটি উদ্ধৃত করেন:[২০]
কোনও কোনও মূর্খ ঘোষণা করেছেন যে, সৃষ্টিকর্তা জগত সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টিতত্ত্ব বিভ্রান্তিকর। এই তত্ত্ব প্রত্যাখ্যান করাই উচিত।
যদি ঈশ্বর জগত সৃষ্টি করে থাকেন, তবে সৃষ্টির পূর্বে তিনি কোথায় ছিলেন? যদি বল, তিনি তুরীয় এবং তাঁর কোনও অবলম্বনের প্রয়োজন নেই, তবে এখন তিনি কোথায়?
কোনও প্রকার কাঁচামাল ছাড়া ঈশ্বর কীভাবে জগত সৃষ্টি করলেন? যদি বল, তিনি প্রথমে কাঁচামাল সৃষ্টি করে, তারপর জগত সৃষ্টি করেছেন, তবে অন্তহীন ক্ষয়ের সম্মুখীন হবে।
যদি বল, এই কাঁচামাল প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্ট হয়েছিল, তবে আরেকটি ভ্রান্তির সম্মুখীন হবে। কারণ, সেক্ষেত্রে সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড নিজেই নিজের স্রষ্টা এবং তার সৃষ্টিও হয়েছে প্রাকৃতিক উপায়ে।
ঈশ্বর যদি নিজের ইচ্ছায় কোনও প্রকার কাঁচামাল ছাড়াই এই জগত সৃষ্টি করেন, তবে এটি তাঁর ইচ্ছা ছাড়া আর কিছুই না – এবং কে এই ছেলেমানুষি কথায় বিশ্বাস করবে?
তিনি যদি নিখুঁত ও পূর্ণ হন, তবে সৃষ্টির ইচ্ছা তাঁর মধ্যে জাগবে কেন? অন্যদিকে যদি তিনি নিখুঁত না হন, তবে মৃৎশিল্পী যেমন ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করতে পারে না, তেমনি তিনিও তা সৃষ্টি করতে পারবেন না।
যদি তিনি নিরাকার, কর্মহীন ও সর্বপ্রিয় হন, তবে তিনি কীভাবে জগত সৃষ্টি করলেন? এই ধরনের এক আত্মা, যাঁর মধ্যে কোনও সত্ত্বাই নেই, তাঁর মধ্যে কোনও কিছু সৃষ্টি করার ইচ্ছাও থাকার কথা নয়।
যদি তিনি নিখুঁত হন, তবে তিনি মানবের তিন লক্ষ্য স্থির করার চেষ্টা করবেন না। তবে তিনি ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করবেন কোন সুবিধা পাওয়ার জন্য?
যদি বল, তিনি কোনও উদ্দেশ্যেই সৃষ্টি করেননি, শুধু তাঁর প্রকৃতি সৃষ্টি করার। তবে ঈশ্বর ধারণা অর্থহীন। যদি তিনি কোনও ধরনের লীলাচ্ছলে সৃষ্টি করে থাকেন, তবে সেই লীলা মূর্খ বালকের খেলা মাত্র। তার পরিণতিতে বিপদ আছে।
যদি তিনি সাকার সত্ত্বার (পূর্বতন সৃষ্টিতে প্রাপ্ত) কর্মের কারণে সৃষ্টি করেন, তবে তিনি সর্বশক্তিমান প্রভু নন, অন্য কিছুর অধীনস্থ মাত্র।
যদি তিনি জীবিত সত্ত্বার প্রতি প্রেম ও তাদের প্রয়োজনের কারণে জগত সৃষ্টি করে থাকেন, তবে তিনি কেন সকল দুর্ভাগ্য থেকে মুক্ত সম্পূর্ণ আনন্দময় জগত সৃষ্টি করলেন না?
যদি তিনি তুরীয় হন, তবে তিনি সৃষ্টি করতেন না। কারণ, সেক্ষেত্রে তিনি মুক্ত হতেন: আদানপ্রদানে লিপ্ত থাকলেও হতেন না, কারণ, সেক্ষেত্রে তিনি সর্বশক্তিমান হতেন না। এইভাবেই ঈশ্বর কর্তৃক জগত সৃষ্টির ধারণাটির কোনও ভিত্তি নেই।
নিজের সৃষ্ট সন্তানদের হত্যা করে ঈশ্বর মহাপাপ করতেন। যদি বল, তিনি শুধু অশুভ সত্ত্বাকে ধ্বংস করতে হত্যা করেন, তবে কেন তিনি সেই ধরনের অশুভ সত্ত্বা সৃষ্টি করলেন?
সৎ ব্যক্তির উচিত দিব্য সৃষ্টিতত্ত্বের অশুভ মতবাদে বিশ্বাসকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা। জানবে, জগত সৃষ্ট হয়নি, যেমন সময় সৃষ্টি হয়নি, তেমন। এর শুরু বা শেষ নেই। এর ভিত্তি আদর্শ, জীবন ও অন্যান্য। অসৃষ্ট ও অবিনশ্বর জগত নিজ প্রকৃতির অধীনেই বেঁচে থাকে।
এই উৎস থেকে এই নিবন্ধে লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা পাবলিক ডোমেইনে রয়েছে।