কৃষি |
---|
ইতিহাস |
কৃষি |
অন্যান্য ধরন |
সম্পর্কিত |
তালিকা |
বিষয়শ্রেণী |
জৈব খামার ব্যবস্থা (ইংরেজি: Organic farming) বা জৈব কৃষি (ইংরেজি: Organic agriculture বা Biological agriculture) (জৈব কৃষিব্যবস্থা বা জৈব চাষ নামেও পরিচিত) বলতে এক ধরনের সর্বাঙ্গীণ কল্যাণমূলক কৃষিজাত ও খামারজাত দ্রব্য উৎপাদন প্রণালীকে বোঝায়, যার উদ্দেশ্য হল বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টিকারক কৃত্রিম অজৈব উপাদান ও বংশাণুগতভাবে পরিবর্তিত জীবের ব্যবহার পরিহার বা সীমিত করে এবং প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন উপাদান ও চর্চাকে অগ্রাধিকার প্রদান করে মৃত্তিকা, কৃষি বাস্তুতন্ত্র ও মানুষের ক্ষতি ন্যূনতম করা এবং এদের দীর্ঘস্থায়ী বা টেকসই সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা। জৈব খামার ব্যবস্থা বিভিন্ন বাস্তুতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, জীববৈচিত্র্য ও স্থানীয় পরিস্থতির সাথে সাযুজ্যপূর্ণ চক্রের উপর নির্ভরশীল। এতে স্থানীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, নবীকরণ ও বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটিয়ে সবার ভাগাভাগি করে নেওয়া পরিবেশের উপকার সাধন করা হয় ও সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মধ্যে সম্পর্ক যেন ন্যায্য হয় ও তাদের জীবনযাত্রার মান যেন উন্নত হয়, সে ব্যাপারগুলিতে উৎসাহ প্রদান করা হয়।[১][২][৩][২][৪][৫][৬][৭]
ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে জৈব খামার ব্যবস্থাতে পরিবেশবান্ধব রোগবালাই ও কীটনাশক, প্রাণী ও উদ্ভিদ বর্জ্যজাত জৈব সার এবং নাইট্রোজেন-আবদ্ধকারক আচ্ছাদন ফসল ব্যবহার করা হয়। প্রথাগত কৃষির রাসায়নিক কীটনাশক ও কৃত্রিম সারের ব্যবহারের কারণে যে পরিবেশগত ক্ষতির সৃষ্টি হয়, তার প্রত্যুত্তরে আধুনিক জৈব খামার ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে। প্রথাগত কৃষির তুলনায় জৈব কৃষিতে মাটির ক্ষয় কম হয়, ভূগর্ভস্থ ও ভূপৃষ্ঠস্থ পানিতে নাইট্রেট চোঁয়ানো কম হয়, কীটনাশক কম ব্যবহৃত হয়, প্রাণীজাত বর্জ্য পুনঃচক্রায়িত হয়। কিন্তু এর বিপরীতে জৈব খামারের ফলন প্রায় ২০% কম ও খামারজাত দ্রব্যের মূল্য বেশি।
জৈব খামার ব্যবস্থাগুলি আন্তর্জাতিকভবে নিয়ন্ত্রিত এবং বিশ্বের অনেক দেশে ও বহুজাতিক অঞ্চলে এই নিয়মগুলিকে আইনগতভাবে প্রয়োগ করা হয়। মূলত ১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠিত জৈব কৃষি আন্দোলনসমূহের আন্তর্জাতিক সংঘ (International Federation of Organic Agriculture Movements বা IFOAM) যে আদর্শমানগুলি বেঁধে দিয়েছে, সেগুলিই ঐসব আইনের ভিত্তি।[৮] ঐসব নিয়ম ও আইন মেনে চললে ও আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদানকারী সংস্থাসমূহের স্বীকৃতি পেলে তবেই সাধারণত কোনও খামার ব্যবস্থাকে "জৈব" হিসেবে অভিহিত করা হয়। যেমন মার্কিন কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংজ্ঞানুযায়ী জৈব খামারকে অবশ্যই ন্যূনতম ৯৫% জৈব উপাদানবিশিষ্ট হিসেবে স্বীকৃতির সনদপ্রাপ্ত দ্রব্য ব্যবহার করতে হবে।[৩]
জৈব খামার ব্যবস্থাকে কদাচিৎ পরিবেশবান্ধব খামার ব্যবস্থা (ইংরেজি: Ecological farming) নামেও ডাকা হতে পারে।
আন্তর্জাতিক জৈব কৃষি সংঘ জৈব খামার ব্যবস্থা বা জৈব কৃষির চারটি মূলনীতিকে প্রাধান্য দিয়েছে। এগুলি হল স্বাস্থ্য, পরিবেশবান্ধবতা, নায্যতা ও পরিচর্যা। স্থাস্থ্য নীতি অনুযায়ী জৈব কৃষির উদ্দেশ্য হল মাটি, উদ্ভিদ, প্রাণী, মানুষ ও পৃথিবীর স্বাস্থ্যকে এক ও অভিন্ন কল্পনা করে সেটিকে টেকসই করা ও সেটির উন্নতিসাধন করা। পরিবেশবান্ধব বা বাস্তবৈজ্ঞানিক মূলনীতি হল এই যে জৈব কৃষিকে অবশ্যই বাস্তুসংস্থানসমূহ ও বাস্তু চক্রসমূহের উপর ভিত্তি করে সম্পাদন করতে হবে, সেগুলির সাথে কাজ করতে হবে, সেগুলিকে অনুকরণ করতে হবে ও সেগুলিকে টিকিয়ে রাখতে হবে। ন্যায্যতার মূলনীতি বলে যে জৈব কৃষিকে আর্থিক সুযোগ ও বাসযোগ্য অভিন্ন পরিবেশের প্রতি ন্যায্য থাকে, এমন সব সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে পালন করতে হবে। পরিচর্যার মূলনীতি বলে যে জৈব কৃষিকে সাবধানতা ও দায়িত্বের সাথে পরিচালনা করতে হবে যাতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পরিবেশের স্বাস্থ্য ও সুস্থতা সুরক্ষিত থাকে।[৯]
ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে জৈব খামার ব্যবস্থাতে জৈব উৎসের সার যেমন মিশ্র জৈব সার (কম্পোস্ট), গবাদি পশুর গোবর, সবুজ সার, অস্থিচূর্ণ সার (বোন মিল), ইত্যাদি ব্যবহার করা হয় এবং শস্য আবর্তন, সাথী ফসলের আবাদ, মিশ্র ফসলের আবাদ, কীটপতঙ্গভূক প্রাণীদের লালনপালন, ইত্যাদি কৌশলকে অধিকতর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বিরল ব্যতিক্রম বাদে কৃত্রিম রাসায়নিক কীটনাশক, কৃত্রিম রাসায়নিক সার, অন্যান্য শিল্পজাত রাসায়নিক পদার্থ, বংশাণু প্রকৌশল ব্যবহার করে সৃষ্ট বংশাণুগতভাবে পরিবর্তিত উদ্ভিদ ও উদ্ভিদ বৃদ্ধিকারক উদ্বোধক পদার্থ (গ্রোথ হরমোন) নিষিদ্ধ করা হয়।[১০] পশুপালনের ক্ষেত্রে ব্যাকটেরিয়ানিরোধক (অ্যান্টিবায়োটিক) ও অন্যান্য ঔষধের (যেমন মোটাতাজাকরণ উদ্বোধক-রস তথা হরমোন) ব্যবহার পরিহার বা সীমিত করা হয় ও পশুদেরকে তাদের জন্য স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে রাখা হয়। পশুদেরকে ভবনে বন্দী না রেখে খোলা জায়গায় চারণ করে শরীরচর্চা করার সুযোগ দেওয়া হয়, তাদের জন্য পুষ্টিগত ভারসাম্যের অধিকারী জৈব পশুখাদ্য (অর্গানিক ফিড), নির্মল বায়ু ও পানীয় জল, সৌরালোক ও ছায়ার সুবন্দোবস্ত করা হয় এবং চাপহীন পরিবেশ ও সঠিক পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার মাধ্যমে পশুর সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করা হয়। এভাবে জৈব খামার ব্যবস্থাতে উৎপাদন লক্ষ্যে পৌছানোর পাশাপাশি প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন জলাভূমি ও বনভূমি টেকসইকরণ, পানি ও মৃত্তিকার গুণমান বজায় বা বৃদ্ধিকরণ, মৃত্তিকার উর্বরতা ও সুস্বাস্থ্য রক্ষা, খামারের পশুকল্যাণ, বন্যপ্রাণীর বৈচিত্র্য সংরক্ষণ, জৈব উপায়ে রোগ ও বালাই নিয়ন্ত্রণ, কৃষিজাত পণ্যের পুষ্টিমান বৃদ্ধি, ইত্যাদি ব্যাপারগুলি নিশ্চিত করা হয়।
২০শ শতাব্দীর শুরুর দিকে দ্রুত পরিবর্তনশীল কৃষিচর্চাসমূহের প্রতিক্রিয়া হিসেবে জৈব খামার ব্যবস্থার উদ্ভব হয়। বর্তমানে বহুসংখ্যক সংস্থা জৈব খামার ব্যবস্থার বিকাশে কাজ করছে। জৈবকৃষির মানগুলিকে এমনভাবে নকশা করা হয়, যাতে সেগুলিতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন পদার্থগুলির ব্যবহার অনুমোদিত থাকে (যেমন প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন কীটনাশক পাইরিথিন) ও কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থসমূহের ব্যবহার হয় সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ বা অত্যন্ত সীমিত থাকে। যেসব কৃত্রিম মানবনির্মিত রাসায়নিক পদার্থকে অনুমোদন দেওয়া হয়, তাদের মধ্যে আছে কপার সালফেট, মৌলিক গন্ধক বা সালফার ও আইভারমেক্টিন। বংশাণুগতভাবে পরিবর্তিত জীব, (অত্যন্ত ক্ষুদ্র) ন্যানো-উপাদানসমূহ, মানব পয়োবর্জ্যের কর্দম, উদ্ভিদ বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রক পদার্থ, উদ্বোধক বা হরমোন এবং গবাদি পশুপালন শিল্পে ব্যাকটেরিয়ারোধক ঔষধের ব্যবহার (অ্যান্টিবায়োটিক), ইত্যাদি নিষিদ্ধ।[১১][১২]
জৈব খামার ব্যবস্থার উপকারিতা অনেক। এর সপক্ষ প্রবক্তারা দাবি করেন যে পরিবেশ টিকিয়ে রাখা, স্বয়ংসম্পূর্ণতা, অকপটতা, স্বনির্ভরতা ও স্বাধীনতা, সুস্বাস্থ্য, খাদ্য সরবরাহে নিরাপত্তা, নিরাপদ খাদ্য, ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই কৃষির বিভিন্ন সুবিধা প্রদান করে। জৈব খামার ব্যবস্থার কারণে ভূমি ও পানিতে রাসায়নিক দূষণ হ্রাস পায়, পানি সম্পদের সংরক্ষণ সম্ভব হয় এবং এভাবে একটি অধিকতর সুস্বাস্থ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। জৈব খামার ব্যবস্থাজাত দ্রব্যতে কোনও রাসায়নিক কীটনাশক অবশিষ্ট থাকে না, এবং এগুলির পুষ্টিমান উচ্চ হয়ে থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অধিকন্তু জৈব খামার ব্যবস্থা আর্থসামাজিক কল্যাণ, স্থানীয় জনসম্প্রদায়গুলিকে সমর্থন প্রদান ও গ্রামীণ জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
১৯৯০ সাল থেকে জৈব খামার ব্যবস্থাজাত খাদ্য ও অন্যান্য পণ্যের বাজারের আকার দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১২ সালে বাজারের আয়তন ছিল প্রায় ৬ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার।[১৩] এই চাহিদার বৃদ্ধির সাথে সাথে জৈব উপায়ে পরিচালিত খামারভূমির পরিমাণও চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০১ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর প্রায় ৮.৯% হারে এইসব জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়।.[১৪] ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭ কোটি ৫০ লক্ষ হেক্টর (১৯ কোটি একর) জমিতে জৈব উপায়ে কৃষিকাজ সম্পাদন করা হয়, যা কিনা বিশ্বের মোট আবাদী জমির মাত্র ১.৬%।[১৫] এর মধ্যে অর্ধেক পরিমাণ জমিই অস্ট্রেলিয়াতে অবস্থিত।[১৬]
উল্লিখিত উপকারিতাগুলি সত্ত্বেও জৈব খামার ব্যবস্থার কিছু সমস্যা আছে, যার মধ্যে আছে অপেক্ষাকৃত উচ্চ উৎপাদন ব্যয়, বাজারে সীমিত প্রবেশাধিকার এবং বৃহৎ মাপনীতে উন্নীতকরণের সমস্যা। বড় মাপের জৈব খামার ব্যবস্থা জনগণের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবে কি না, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ আছে। গবেষণায় দেখা গেছে যে জৈব খামার ব্যবস্থাতে ফলন প্রথাগত কৃষির তুলনায় ২০% কম হয়।[১৭] যেহেতু জৈব খামার ব্যবস্থাতে উৎপাদনের পরিমাণ প্রথাগত কৃষির তুলনায় কম, তাই বিশ্বের অন্যত্র প্রথাগত রীতিতে খামারের কাজের জন্য অতিরিক্ত আবাদী জমির প্রয়োজন পড়ে, অর্থাৎ প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রাকৃতিক ভূখণ্ডকে আবাদী জমিতে রূপান্তরিত করতে হয়। ফলে বিশ্বের অন্যত্র জীববৈচিত্র্য হ্রাস ও নেতিবাচক জলবায়ুগত প্রভাবের সৃষ্টি হতে পারে যা স্থানীয় পরিবেশে অর্জিত উপকারগুলিকে শেষ বিচারে নাকচ করে দিতে পারে[১৮] তবে বর্ধমান ভোক্তা চাহিদা ও সরকার ও প্রত্যয়নকারী সংস্থাগুলি দ্বারা এটি যে স্বীকৃতি লাভ করেছে, তা আশাব্যঞ্জক। নীতিগত সহায়তা, অব্যাহত গবেষণা ও উদ্ভাবন-নবীকরণ জৈব কৃষির বিকাশ ও বিস্তারের জন্য অত্যাবশ্যক।