জোরাওয়ার সিং কাহলুরিয়া | |
---|---|
জন্ম | ১৭৮৬ কাহলুর, |
মৃত্যু | ১৮৪১ তিব্বত |
আনুগত্য | গুলাব সিং |
জোরাওয়ার সিং কাহলুরিয়া (ডোগরি: ज़ोरावर सिंह कहलुरिया) (১৭৮৬-১৮৪১) ছিলেন কাশ্মীরের মহারাজা গুলাব সিংয়ের সেনাপতি। তার লাদাখ, তিব্বত, বালটিস্তান ও ইস্কার্দু আক্রমণের মাধ্যমে হিমালয় অভিযানের জন্য তাকে ঐতিহাসিকেরা ভারতের নেপোলিয়ন বোনাপার্ট আখ্যা দিয়ে থাকেন।[১][২]
জোরাওয়ার সিং ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে কাহলুর রাজ্যের (বর্তমান হিমাচল প্রদেশের অন্তর্গত) এক গ্রামে এক হিন্দু দোগরা রাজপুত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। [৩] পরবর্তীকালে তারা জম্মু অঞ্চলে চলে যান। সেখানে জোরাওয়ার মারমাঠির রাজা যশবন্ত সিংয়ের অধীনে কাজ শুরু করেন। ১৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে মারমাঠি তিনি মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের অধীনে এলে তিনি তার সৈন্যদলে যোগদান করেন।
মহারাজা গুলাব সিংকে এক নিয়মমাফিক বার্তা পৌছানোর সময় জোরাওয়ার তাকে রিয়াসির ভীমগড় দুর্গ পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক আর্থিক আপচয়ের কতা তুলে ধরেন। তার নিষ্ঠায় মুগ্ধ হয়ে গুলাব সিং তাকে রিয়াসির সেনাপতি বানিয়ে দেন। দায়িত্ব নিয়ে জোরাওয়ার ভীমগড় দুর্গের আর্থিক অপচয় রোধ করতে সক্ষম হলে মহারাজা জোরাওয়ারকে জম্মুর উত্তরে সমস্ত দুর্গের সেনাধ্যক্ষ বানিয়ে দেন। এরপর তাকে কিশতোয়াড়ের শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
তার শাসনকালে কিশতোয়াড়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে জোরাওয়ার যুদ্ধের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা শুরু করেন। এই সময় ১৮৩৪ খ্রিষ্টাব্দে লাদাখের রাজা সেপাল নামগ্যালের সামন্ত টিম্বুসের রাজা লাদাখের বিরুদ্ধে জোরাওয়ারের সাহায্য চাইলে তিনি লাদাখের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। প্রথমেই তার ৫০০০ সৈন্য সুরু নদীর তীরে ঐ অঞ্চলের বোটি সৈন্যদের পরাজিত করে। এরপর তিনি কার্গিলের পথে সামন্ত রাজাদের পরাজিত করা শুরু করলে লাদাখের রাজা সেপাল নামগ্যাল তার সেনাপতি বাঙ্কো কাহ্লোনকে জোরাওয়ারের রসদ সংগ্রগের পথটি নষ্ট করতে পাঠান। কিন্তু তীক্ষ্ণবদ্ধির অধিকারী জোরাওয়ার শীতের শুরুতে কার্ৎসে ফিরে আসেন এবং সেখানেই সৈন্যদের নিয়ে শীতকাল কাটান। পরের বছর বসন্তকালে তিনি বাঙ্কো কাহ্লোনের সৈন্যদলকে পরাজিত করে লেহ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। সেপাল নামগ্যাল যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৫০,০০০ টাকা ও বার্ষিক ২০,০০০ টাকা কর দিতে সম্মত হন।
ডোগরাদের এই জয়ে কাশ্মীরের পাঞ্জাবী শাসনকর্তা মেহান সিং লাদাখের সামন্তদের জোরাওয়ারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে উৎসাহিত করলে জোরাওয়ার পুনরায় হিমালয় অতিক্রম করে এই বিদ্রোহ দমন করেন। এই অভিযানে তিনি জাংস্কারের রাজাকে কর প্রদানে বাধ্য করেন। কিন্তু ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে মেহান সিং এরপর লাদাখের রাজা সেপাল নামগ্যালকে জোরাওয়ারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে উৎসাহিত করলে জোরাওয়ার দশদিনে লাদাখ পৌছে বিদ্রোহ দমন করেন। এই বার তিনি লেহতে এক দুর্গ তৈরী করেন এবং দলেল সিংয়ের অধীনে তিনশ সৈন্য রেখে যান। সেপাল নামগ্যালকে সরিয়ে এক লাদাখি সেনাপতি নগোরুব স্তাঞ্জিনকে লাদাখের রাজার সিংহাসনে বসিয়ে দিয়ে যান। কিন্তু নগোরুব তার আনুগত্যে অস্বীকার করলে ১৮৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সেপাল নামগ্যাল পুনরায় লাদাখের রাজা হিসেবে বহাল হন।
স্কার্দুর শাসনকর্তা আহমেদ শাহের পুত্র মহম্মদ শাহ লেহতে পালিয়ে গিয়ে পিতার বিরুদ্ধে সেপাল নামগ্যাল ও জোরাওয়ারের সাহায্য প্রার্থনা করলে লাদাখের সামন্তরা আহমেদ শাহর হাতে তার পুত্রকে তুলে দেন। এর পরিবর্তে ডোগরাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে তাদের সহযোগিতা করতে বলেন। কিন্তু জোরাওয়ার লাদাখে বিদ্রোহ দমন করে ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের শীতকালে বালটিস্তান আক্রমণের আদেশ দেন। নিধম সিংয়ের অধীনে ৫০০০ সৈন্যের অগ্রগামী একটি দল স্কার্দুর দিকে গেলে অধিকাংশই প্রচন্ড শীতের কবলে পড়ে মারা যায়। কিন্তু জোরাওয়ারের নেতৃত্বে মূল বাহিনী স্কার্দুর দুর্গ অবরোধ করে। ডোগরা সৈন্যরা খাড়া পাহাড়ে আরোহণ করে পাহাড়ের কোলে এক ছোট দুর্গ অধিকার করে সেখান থেকে মূল দুর্গে গোলাবর্ষণ করলে আহমেদ শাহ সমর্পণ করেন। এই যুদ্ধের পর সিন্ধু নদের তীরে জোরাওয়ার এক দুর্গ নির্মাণ করেন।
স্কার্দুর সিংহাসনে মহম্মদ শাহকে বসিয়ে তার কাছ থেকে বার্ষিক ৭০০০ টাকা করের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ডোগরা সৈন্যদল পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে আস্তোরের দুর্গ দখল করে সেখানকার রাজাকে বন্দী করে। কিন্তু কাশ্মীরের শিখ শাসনকর্তা মেহান সিং গুলাব সিংয়ের কাছে এই বিষয়ে আপত্তি জানালে তার নির্দেশে আস্তোরের রাজাকে মুক্ত করা হয়।
১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে কিশতোয়াড়, লাদাখ ও বালটিস্তান থেকে ছয় হাজার সৈন্যকে তিনটি দলে বিভক্ত করে জোরাওয়ার তিব্বত অভিযান শুরু করেন। নোনো সুংনাম নামক লাদাখের এক রাজপুত্রের নেতৃত্বে একটি দল সিন্ধু নদের তীর বরাবর অগ্রসর হয়। গুলাম খানের নেতৃত্বে ৩০০ সৈন্যের অপর একটি দল পর্বতের ধার দিয়ে কৈলাস পর্বতশ্রেণীতে পৌঁছয়। ৩০০০ সৈন্যের তৃতীয় দলের নেতৃত্বে জোরাওয়ার সিং প্যাঙ্গং হ্রদের ধার দিয়ে তিব্বত প্রবেশ করেন। এই তিন দল মানসরোবর পার হয়ে গার্তোকে অবস্থিত তিব্বতী সৈন্যদের পরাজিত করেন। শত্রুপক্ষের সেনাপতি টাকলাকোট পালিয়ে গেলে জোরাওয়ার ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই সেপ্টেম্বর টাকলাকোট দুর্গ আক্রমণ করেন। এই দুর্গ দখল করে এর নিকটে চিটাং দুর্গ স্থাপন করে মেহতা বস্তি রামের অধীনে ৫০০ সৈন্য ও ৯টি কামান দেওয়া হয়। জোরাওয়ার ৪৫০ মাইল বরাবর প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ছোট ছোট দুর্গ ও সেনা ছাউনি স্থাপন করে যুদ্ধের জন্য রসদ সরবরাহের ব্যবস্থা করেন। এতদসত্ত্বেও শীতের শুরুতে গিরিবর্ত্মগুলি বরফে ঢাকা পড়ে গেলে শীতের খাদ্য, রসদ, সরঞ্জাম সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ক্ষুধা ও শীতে ডোগরা সৈন্যরা দুর্বল হয়ে মারা যেতে থাকে। এই সময়ে ১৮৪১ খ্রিষ্টাব্দের ১২ই ডিসেম্বর তিব্বতি ও হানরা চিটাংয়ের দুর্গকে পাশ কাটিয়ে জোরাওয়ারের বিরুদ্ধে টো-য়োর যুদ্ধে সম্মুখীন হয়। যুদ্ধের শুরুতে জোরাওয়ার কাঁধে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন এবং কিছুক্ষণ পরে এক তিব্বতি অশ্বারোহীর তরোয়ালের আঘাতে তার মৃত্যু ঘটে।